Friday, March 25, 2011

ফতোয়া বিচার ও আইনের পার্থক্য

ফতোয়ার আভিধানিক সংজ্ঞা : ‘ফতোয়া’ শব্দটি ‘ইফতা’ ক্রিয়া ধাতু থেকে উত্সারিত একটি বিশেষ্য। যার অর্থ হলো ‘জিজ্ঞাসার জবাব’। যে কোনো ধরনের জিজ্ঞাসার জবাবকেই ফতোয়া বলা হয়। [উসুলুল ইফতা : পৃষ্ঠা-৯]
পরবর্তীকালে শব্দটি শুধু দ্বীনি জিজ্ঞাসার জবাবের অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। ‘মু’জামুল ওয়াসিত’ নামক অভিধান গ্রন্থে ফতোয়া শব্দের অর্থ বলা হয়েছে—‘ফতোয়া হলো আইন কিংবা শরয়ী বিধি-বিধানের অবোধগম্য বা অজ্ঞাত বিষয় সংক্রান্ত জিজ্ঞাসার জবাব।’ [আল-মু’জাম : পৃষ্ঠা-৬৭৩]
পারিভাষিক সংজ্ঞা : পরিভাষায় ফতোয়া বলা হয়, ‘উপস্থিত কোনো দ্বীনি বিষয় সম্পর্কে কোনো ব্যক্তির জিজ্ঞাসার ভিত্তিতে শরয়ী দলিল প্রমাণের আলোকে আল্লাহর বিধান কি? তা সামগ্রিক ও ব্যাপক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে অবহিত করা ও জানিয়ে দেয়া, যা পালনের ব্যাপারে (মুফতির পক্ষ থেকে) কোনোরূপ বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হবে না।’ (বরং বাধ্য করার দায়িত্ব সরকার ও ইসলামী আদালতের) [আল মিসবাহ : পৃষ্ঠা-১৬]
আল্লামা তাকী উসমানী ফতোয়ার সংজ্ঞা নিম্নোক্ত শব্দে উল্লেখ করেছেন :
‘আধুনিক পরিভাষায় ফতোয়ার অর্থ হলো, ‘দ্বীনি জিজ্ঞাসার জবাব।’ [উসুলুল ইফতা : পৃষ্ঠা-১০]
আল কোরআনে এই পারিভাষিক অর্থেও শব্দটির ব্যবহার পাওয়া যায়। যেমন ইরশাদ হয়েছে—
‘তারা রমনীদের সম্পর্কে আপনাকে জিজ্ঞাসা করে। আপনি বলে দিন যে, তোমাদের এ বিষয়ে আল্লাহই ফতোয়া দিচ্ছেন।’ [সূরা নিসা : ৪ : ১২৭]
অর্থাত্ রমনীদের বিয়ে-শাদী করার ব্যাপারে তারা আপনার কাছে অনুমতি প্রার্থনা করে। আপনি বলে দিন যে, বিয়ে বৈধ হওয়ার বিষয়ে আল্লাহ ফতোয়া দিচ্ছেন।
আরও ইরশাদ হয়েছে—
‘তারা আপনাকে (উত্তরাধিকার আইন সম্পর্কে) জিজ্ঞাসা করে। আপনি বলে দিন যে, আল্লাহ তোমাদের ‘কালালাহ’ বা নিঃসন্তানদের উত্তরাধিকারের ফতোয়া বর্ণনা করেছেন।’ [সূরা নিসা : ৪ : ১৭৬]
আভিধানিক ও পারিভাষিক সংজ্ঞার আলোকে একথা সুস্পষ্ট হয়ে যায়, ফতোয়ার সঙ্গে তা পালনের আইনগত কোনো বাধ্যবাধকতা সংশ্লিষ্ট থাকে না; বরং এটি কেবলই জিজ্ঞাসার জবাব। কোনো ব্যক্তি যখন নিজ থেকে ধর্ম মেনে চলার প্রত্যয় গ্রহণ করে, তখন জীবন চলার পথে যেসব বিষয়ে ধর্মের বিধান সম্পর্কে তার জানা থাকে না, সেসব বিষয়ে বিবেকের তাড়নায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে কোনো বিশেষজ্ঞ মুফতিকে যখন তিনি প্রশ্ন করেন, তখন মুফতি আপন কর্তব্যবোধের দ্বারা তাড়িত হয়ে কোরআন, সুন্নাহ, ইজমা, কিয়াস, ফিকাহ ও ফতোয়ার গ্রন্থগুলো ঘেটে জিজ্ঞাসিত বিষয়ে ঐশী বিধান কি, দলিল প্রমাণসহ তা বর্ণনা করে থাকেন। মানুষের দৈনন্দিন জীবনের নিত্যনতুন ঘটনা ও সমস্যার ইসলামী সমাধান কি, কারও জিজ্ঞাসার প্রেক্ষিতে কোরআন, সুন্নাহ ও ইসলামী শরইয়্যার আলোকে তা বাতলিয়ে দেয়ার আরেক নাম ফতোয়া।
ফতোয়া ও আইনের পার্থক্য : ফতোয়া কখনই আইন ও বিচারের মতো বাধ্যবাধকতা আরোপ করে না। ফতোয়ার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার জন্য মুফতি কখনই আইনগতভাবে কাউকে বাধ্য করেন না বা বলও প্রয়োগ করেন না। ইসলামী রাষ্ট্রেও ফতোয়ার অবস্থান একই। ফতোয়া ইসলামী আইনের মর্যাদা রাখে বটে, তবে বিচার বিভাগ কর্তৃক তা আইন হিসেবে গৃহীত হয়ে বাস্তবায়িত না হলে তা আইন হিসেবে গণ্য হয় না। বিচার বিভাগ ফতোয়ার সিদ্ধান্তকে আইন হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন এবং সে আলোকে বিচার করতে পারেন। কেননা সব ইসলামী বিধানই ইসলামী আইনের মর্যাদা রাখে। ইসলামী রাষ্ট্রের বিচারকরা আইনি সঙ্কটের মোকাবিলা করতে মুফতিদের থেকে মতামত গ্রহণ করতেন। সারকথা এই যে, মুফতির দেয়া ফতোয়া মানার ক্ষেত্রে আইনগত কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু বিচারকের রায় মানার ক্ষেত্রে আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এজন্য বিচারকের রায়ের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে—
‘শরয়ী কোনো বিধান বাধ্যতামূলকভাবে পালনের জন্য অবগত করার নাম বিচার বা রায়।’ [তাবসিরাতুল হুক্কাম ইবনে ফারহুন মালিকীকৃত : খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-১২] আইনের অর্থ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ফিকাহবিদরা উল্লেখ করেছেন যে, ‘বিচারকের রায় বা আইন বলা হয়, যা বাধ্যতামূলকভাবে কার্যকর করা হয়।’ [কাওয়াইদুল ফিকহ : পৃষ্ঠা-২৬৭]
ফতোয়া ও ইসলামী বিচারের মাঝে পার্থক্য এখানেই যে, মুফতি বিধান সম্পর্কে অবগত করেন মাত্র, কিন্তু তা মানার জন্য বাধ্য করেন না। কিন্তু কাজী বা বিচারক বিধান সম্পর্কে অবগত করেন, তত্সঙ্গে তা মানতে ও বাস্তবায়ন করতেও বাধ্য করেন।
আমাদের দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গ্রাম্য সালিশের মাধ্যমে শাস্তি প্রদানের যে খবরাখবর পত্রপত্রিকায় প্রকাশ হতে দেখা যায়, সেগুলো আদৌ ইসলামী শরিয়তসম্মত নয়। এক্ষেত্রে ‘ফতোয়া’ শব্দটির অব্যবহার করা হয়ে থাকে। কেননা কোনো মুফতি এ ধরনের শাস্তির বিধান কার্যকর করার নির্দেশ দিতে পারেন না। যদি কেউ দেয়, তাহলে মনে করতে হবে সে মুফতি নয়; বরং মুনশী, মাতব্বর জাতীয় কেউ হয়ে থাকবে। কারণ ফতোয়ার যে সংজ্ঞা আমরা উল্লেখ করলাম, তাতে ফতোয়ার সিদ্ধান্ত কার্যকর করার জন্য মুফতি বাধ্য করার অধিকার রাখেন না এবং সে জন্য কোনো রূপ বল প্রয়োগ করাও তার এখতিয়ার বহির্ভূত। ইসলামী বিচার ব্যবস্থায় সালিশি বৈধ থাকলেও এর জন্য অনেক শর্ত-শারায়েত রয়েছে। সালিশির মাধ্যমে দুই বিবদমান পক্ষের মাঝে সমঝোতা সৃষ্টিই মূল উদ্দেশ্য। তাই শাস্তি ও জরিমানা সংক্রান্ত ক্ষেত্রে সালিশি বৈধ নয় এবং এ ব্যাপারে বিচার করার ও রায় প্রদান করার কিংবা তা বাস্তবায়ন করার কোনো অধিকার সালিশি বোর্ডের নেই। ড. আবদুল করিম যায়দান তার ‘নিযামুল কাযা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন— ‘হানাফি ফিকাহবিদদের অভিমত এই, হদ্দ, কিসাস ও দিয়াতের ক্ষেত্রে সালিশি চলবে না।’ [নিযামুল কাযা ফিশ শরিয়াতিল ইসলামিয়্যাহ : পৃষ্ঠা-২৯৩]
উল্লেখ্য, ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় ‘হদ্দ’ বলা হয় যে সব অপরাধের শাস্তি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত। যথা—১. কেউ ব্যভিচার করলে অবিবাহিতের ক্ষেত্রে ১০০ বেত্রাঘাত, বিবাহিতের ক্ষেত্রে প্রস্তারাঘাতে মৃত্যু দণ্ড। ২. মিথ্যা অপবাদ দিলে ৮০ বেত্রাঘাত, ৩, চুরি করলে হাত কর্তন, ৪. ছিনতাই ডাকাতি করলে পর্যায়ভেদে হাত-পা কর্তন, মৃত্যুদণ্ড, শূলে বিদ্ধ করে মৃত্যু দণ্ড, জেলে আবদ্ধকরণ কিংবা দেশান্তর, ৫. নেশা করলে ৮০ বেত্রাঘাত। ‘কিসাস’ হত্যা করলে মৃত্যুদণ্ড, জখম করলে সমপরিমাণ জখম। ‘দিয়্যাত’ হত্যার বিনিময়ে ক্ষতিপূরণ আদায় ১০০ উট।
সুতরাং গ্রাম্য মাতব্বররা সালিশের নামে জরিমানা ও দুররা মারার যে মহড়া পালন করে থাকেন, তা ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে আদৌ বৈধ নয়। সুতরাং একজন মুফতি কি করে এরূপ ফতোয়া দিতে পারেন? এগুলোর পেছনে গ্রাম্য মাতব্বরদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অনেক বিষয় জড়িত থাকে। ফতোয়া শব্দের আশ্রয়ে তারা এগুলো করে তাদের তৃপ্তি মিটিয়ে থাকেন। ফতোয়ার সঙ্গে এর দুরবর্তী কোনো সম্পর্কও নেই। বরং ফতোয়ার ভাষায় এহেন কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ও হারাম। যারা এহেন কর্ম করবে তাদের এর জন্য শাস্তি ভোগ করতে হবে। ষ


লেখক : সিনিয়র মুহাদ্দিস, মালিবাগ মাদ্রাসা
গবেষক, ইসলামী চিন্তাবিদ

No comments:

Post a Comment