Friday, March 25, 2011

ইসলাম এবং সহিষ্ণুতার সৌন্দর্য

 খা লি দ বে গ


খলিফা হজরত উমর বিন খাত্তাব (রা.) যখন মৃত্যুশয্যায়, তিনি তার পরবর্তী খলিফার উদ্দেশে নানা নির্দেশ ও উপদেশ সংবলিত একটি দীর্ঘ অসিয়তনামা (উইল) প্রণয়ন করে গেলেন। সেই ঐতিহাসিক দলিলের সর্বশেষ বাক্যটি হলো, ‘জনগণের পক্ষ থেকে আমি তোমাকে এই নির্দেশ দান করছি যে, আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের (সা.) নামে যাদের নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে তাদের ব্যাপারে কর্তব্যবিমুখ হয়ো না; অর্থাত্ (ইসলামী রাষ্ট্রে যারা অমুসলিম সংখ্যালঘু বা জিম্মি) তাদের সঙ্গে আমাদের যে চুক্তি তা কখনও লঙ্ঘন করো না, তাদের নিরাপত্তা রক্ষায় আমরা অবশ্যই সর্বাত্মকভাবে সচেষ্ট থাকব এবং তাদের ওপর এমন ভার চাপানো যাবে না, যা বহন করতে তারা অক্ষম।’
এই নির্দেশনামা যখন লেখা হচ্ছিল, সায়্যিদানা উমর (রা.) তখন যন্ত্রণাগ্রস্ত অবস্থায় শয্যাশায়ী। ফজরের সালাতে ইমামতি করার সময় এক অমুসলিম তাকে বিষমাখানো ছোরা দ্বারা আঘাত করে। এই মারাত্মক ছুরিকাঘাতে আহত অবস্থায় তিনি আলোচ্য অসিয়াতনামাটি লিপিবদ্ধ করান। মনে রাখা আবশ্যক, উমর ফারুক (রা.) তখন এমন এক বিশাল সাম্রাজ্যের শাসক, যে সাম্রাজ্য মিসর থেকে পারস্য পর্যন্ত বিস্তৃত। নিশ্চয়ই এই প্রশ্ন স্বাভাবিক যে, দুশমন কর্তৃক আক্রান্ত অবস্থায় তার সময়ের এবং আমাদের এই সময়েরও একজন সাধারণ শাসকের প্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে? অবশ্যই দ্রুত প্রতিশোধ গ্রহণ। (আজকালের ‘প্রাজ্ঞ ও জ্ঞানদীপ্ত’ শাসকরা তো হত্যা চক্রান্তে সত্যিই যুক্ত কি যুক্ত নয়, সে কথা সঠিকভাবে না জেনেই, শুধু সন্দেহবশতই বোমাবর্ষণ করে থাকে) একজন ক্ষমাশীল ও সদ্বিবেচক শাসকের কাছ থেকেও, খুব বেশি হলে আমরা শুধু এটুকু আশা করতে পারি যে, তিনি বিষয়টি ভুলে যাবেন ও ক্ষমা করবেন এবং সেটাই উচ্চতম আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হবে। কিন্তু সংখ্যালঘুদের সার্বিক নিরাপত্তা বিধান এবং তাদের ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের এই নির্দেশকে কি শুধুই অনন্য বলে অভিহিত করা যায়? না। কারণ অপর একটি বিষয় খুবই উল্লেখযোগ্য যে, মুসলিম ঐতিহাসিকদের অভিমত হলো, খলিফা উমরের এই নির্দেশনামা ছিল খুবই স্বাভাবিক। বিশেষ করে দেশের পর দেশ যখন মুসলিম শাসনাধীনে চলে আসছে এবং খলিফা নিজেই যখন তার শাসনামলে বিধির পর বিধি জারি করে সব নাগরিকের, জীবন সম্পদ ও ধর্মের সার্বিক নিরাপত্তা বিধানের একটি সুনিশ্চিত ও সুরক্ষিত আদর্শ স্থাপন করেছেন, তখন এই মৃত্যুকালীন অসিয়ত আদৌ অস্বাভাবিক কিছু নয়। বলা আবশ্যক, প্রতিষ্ঠিত এই আদর্শ মুসলিম বিশ্বে শতাব্দীর পর শতাব্দী একইভাবে অব্যাহত আছে।
অবশ্য সায়্যিদানা উমর (রা.) যা করেছেন, তা সবই রাসুলের (সা.) শিক্ষা ও জীবনাদর্শের বিশ্বস্ত প্রতিরূপ। আসলে সংখ্যালঘুদের জীবন, সম্পদ ও ধর্মপালনের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বিধান যে কোনো ইসলামী রাষ্ট্রের একটি ধর্মীয় কর্তব্য। কারণ সংখ্যালঘুদের ওপর যে কোনো ধরনের অবিচার-অত্যাচারের জন্য রাসুল (সা.) নিজে আখিরাতে অত্যাচারী মুসলমানের বিরুদ্ধে বিচার দাবি করবেন। আর ইসলামে যেহেতু ধর্মের ক্ষেত্রে কোনো জোরজবরদস্তি ও বাধ্যবাধকতার অবকাশ নেই, মুসলমানকে শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সবার প্রতি একই রকম ইনসাফ রক্ষা করা অবশ্যকর্তব্য।
এই শিক্ষার ফলেই মুসলিম শাসনাধীনে ধর্মীয় স্বাধীনতার এমন একটি মূল্যবান আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হলো, যে বিষয়ে কারও কোনো ধারণাই ছিল না। শুধু যে মুসলমানদের ইতিহাসই উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন বয়ে আনল তা নয়, ইসলামের সংস্পর্শে পুরো পৃথিবীর দৃষ্টিভঙ্গিই বদলে গেল। বিরুদ্ধ ধর্মমতের দমন, নিগ্রহ-নির্যাতন, হত্যাকাণ্ড (ঐড়ষড়পধঁংঃ) ইত্যাদি, যা অন্য সব সভ্যতার একটি কলঙ্কজনক সাধারণ বৈশিষ্ট্য, সেই বৈশিষ্ট্যে দেখা দিল এমন পরিবর্তন, যার ফলে নিপীড়ন-নির্যাতন থেকে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা অনেকখানি নিশ্চিত হলো এবং এরই ফলে ইহুদিরা খ্রিস্টানদের হাত থেকে এবং পূর্বাঞ্চলীয় খ্রিস্টানরা রোমান ক্যাথলিকদের নিপীড়ন থেকে অনেকটই রক্ষা পেল। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, উমাইয়াদের শাসনাধীন স্পেনে এবং আব্বাসীয় খেলাফতের অধীন বাগদাদে খ্রিস্টান ও ইহুদিরা সম্পূর্ণরূপে ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করত; আর এই যে পারস্পরিক ধর্মীয় সহাবস্থান, আগে তাদের মধ্যে কোনো সময়েই বিদ্যমান ছিল না।
উল্লেখযোগ্য যে, এই দৃষ্টান্তমূলক সহিষ্ণুতা ইসলামী শিক্ষার ফলেই গড়ে উঠেছে। ইসলামের মূল পয়গামই হলো, পার্থিব জীবন একটি পরীক্ষা। আমরা এখানে জাহান্নাম কি জান্নাতের যে পথ, তার যে কোনো একটিকেই গ্রহণ করতে পারি। নবী-রাসুলদের মানব সম্প্রদায়ের কাছে এই পয়গাম দিয়ে পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করার জন্যই প্রেরণ করা হয়েছে। তাঁদের এজন্য পাঠানো হয়নি যে, তাঁরা শক্তিপ্রয়োগে মানুষকে সঠিক পথে নিয়ে আসবেন। মুসলিমদের দায়িত্বও ঠিক একই রকম। তারা মানুষের কাছে ইসলামের যে প্রকৃত পয়গাম, সেটাই যথাসাধ্য পৌঁছে দেবে। তাদের কাজ ইসলামকে রদবদল করে মানুষের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলাও নয়, মানুষের নিজস্ব পছন্দকে দমন করে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করাও নয়। এই সঙ্গে এটা মনে রাখা আবশ্যক, আখিরাতের যে ফলাফল সেটা বিশ্বাসের (ঈমান) ওপর নির্ভরশীল। অতএব সব সত্ ও মহত্কর্মই পুরোপুরি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে, যদি সঠিক বিশ্বাস না থাকে। আর বিশ্বাস যেহেতু অন্তরের সম্পদ, এক্ষেত্রে কোনোরূপ শক্তিপ্রয়োগ চলে না।
এই ধারণা ভুল যে, অন্য যে কোনো ধর্মাবলম্বীরাও নিজ ধর্মকে অক্ষত রেখে ইসলামের অংশীদার হতে পারে। এরকম হলে, সহিষ্ণুতা অবলম্বনের ক্ষেত্রে মুসলমানদের যে আদর্শ, সেটা অবশিষ্ট পৃথিবীর বক্তব্যের সঙ্গে রীতিমত সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে। মার্মাডিউক পিকথল উল্লেখ করেন, ‘পশ্চিমা জাতিগুলো যে কিছুটা হলেও সহিষ্ণুতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে, সেটা তাদের ধর্মীয় বিধান পরিহার বা অস্বীকার করার সুফল, অথচ অন্যদিকে, মুসলমানদের ক্ষেত্রে ধর্মীয় আদর্শ শিথিল ও খর্ব হওয়ার কারণেই অসহিষ্ণুতার সৃষ্টি।’
পশ্চিমা বিশ্ব সামাজিক সাম্য ও মিলনের যে পথ তৈরি করেছে সেটা জনজীবন থেকে ধর্মের প্রভাবকে যথাসম্ভব নিশ্চিহ্ন করার ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং এই অর্জন, তাদের ধারণা, আলোচ্য বিষয়ে যথাযথ প্রচার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ফলেই সম্ভব হয়েছে। সুতরাং এটা স্মরণ রাখা উত্তম যে গত শতাব্দীতে সহিষ্ণুতার ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের যে বিশাল অগ্রগতি (যা অভিনন্দন লাভের যোগ্য), তাকে ইসলাম কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত নীতি-আদর্শের কাছে পৌঁছতে অনেক পথ ও সময় অতিক্রম করতে হয়েছে। প্রথমত, মুসলমানদের যে ব্যক্তিগত-পারিবারিক বিধান, সেটা পাশ্চাত্যে অস্বীকৃত; অথচ অমুসলিম সংখ্যালঘুদের ব্যক্তিগত বিধান ও অধিকার মুসলিম বিশ্বের কোথাও কোনোদিন এতটুকু ক্ষুণ্ন হয়নি। দ্বিতীয়ত, ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বত্রই মাইক্রোফোনে আজান প্রচারের কোনো অনুমতি নেই; অথচ মুসলিম বিশ্বে গির্জায় ঘণ্টাধ্বনি নির্বিঘ্নে ও যথানিয়মে প্রচারিত হচ্ছে। তৃতীয়ত, পাশ্চাত্য প্রচার মাধ্যমের যে বিশ্ববিস্তৃত ইসলামবৈরী পক্ষপাতদুষ্ট ও কুসংস্কারাশ্রিত ভূমিকা, সেই ভূমিকাও মৌলিক-অসহিষ্ণুতার বিশেষ কারণও পরিণতি। চতুর্থত, সাম্প্রদায়িক হিংসাশ্রিত অপরাধকর্ম পশ্চিমা জীবনধারার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, অবশ্য এই বিষয়টি সততই বেশ কৌশলে আড়ালে রাখা হয়। পঞ্চমত, ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ব্যাপারটি কখনোই খুব একটা গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয় না, যথেষ্ট প্রাধান্যও দেয়া হয় না। এ বিষয়ে একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যায় : ১৯৯৯ সালে মুসলমানদের অনুকূলে দুটি প্রস্তাব মার্কিন সিনেটে উত্থাপিত হলো। প্রস্তাবটির শীর্ষ নাম ছিল, ‘মুসলমানদের প্রতি ধর্মীয় সহিষ্ণুতা রক্ষাকল্পে সমর্থন’ (অ জবংড়ষঁঃরড়হ ঝঁঢ়ঢ়ড়ত্ঃরহম ত্বষরমরড়ঁং ঃড়ষবত্ধহবপ ঃড়ধিত্ফ গঁংষরসং)। কিন্তু সিনেটে যদিও প্রস্তাবটি পাস হলো, কিছু কিছু ইহুদি ও খ্রিস্টানের একগুঁয়ে চাপের কারণে উচ্চকক্ষে তা আর গৃহীত হলো না। ঘটনাটি ছিল ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর দুর্ঘটনার দুই বছর আগের। তারপর তো সবই আমূল বদলে গেল। আসলে সেপ্টেম্বরের ‘দৈব দুর্ঘটনাটি’ অভিনব বটে, তবে এর মধ্য দিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব তার বহু দিনের লালিত অসহিষ্ণুতা ও প্রতিহিংসা ক্রমবর্ধমান হারে অব্যাহত রাখার একটা ‘যৌক্তিক’ ভিত্তি দাঁড় করাতে সক্ষম হলো।
শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয়, অবশিষ্ট ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের’ কাছেও পরিস্থিতি প্রায় একই রূপ পরিগ্রহ করল। জার্মানি এবং ফ্রান্সের কথা উল্লেখ করতে পারি; সেখানে এখন সরকারি শক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় মুসলিম মহিলাদের মস্তক থেকে হিজাব ছিনিয়ে নেয়া হচ্ছে। এরপরও এই গোঁড়া-ধর্মান্ধরাই নারী অধিকার এবং সহিষ্ণুতার প্রবক্তা এবং তারা এখন সরব দাবি তুলেছে, ‘অসহিষ্ণুতা’ নিরসনকল্পে মুসলিম বিশ্বের শিক্ষাক্রমে যথোচিত পরিবর্তন আনতে হবে। যাই হোক, মুসলমানদের মধ্যে বিরাজমান যে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, সেটা কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নাটকীয়তা নয়; এটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি অপরিহার্য ধর্মীয় কর্তব্য। সব অসহিষ্ণুতার মোকাবিলায় তাদের প্রবল হয়ে উঠতে হবে, এমনকি সেই অবস্থার বিরুদ্ধেও যখন তা সহিষ্ণুতার ভান ও কপট ছদ্মবেশ মাত্র।
অনুবাদ : অধ্যাপক আবু জাফর

No comments:

Post a Comment