Friday, March 25, 2011

হালাল জীবিকা : সুস্থ জীবনের পথ

হজরত আবদুল্লাহ বিন মাসুদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘হালাল জীবিকার সন্ধান করা ফরজ ইবাদতের পরই ফরজ (অপরিহার্য কর্তব্য)।’ অন্য কথায়, হালাল জীবিকা অর্জনের জন্য যে কর্মপ্রচেষ্টা, গুরুত্বের প্রশ্নে নামাজ রোজা হজ ইত্যাদি অপরিহার্য (ফরজ) ধর্মীয় ইবাদতগুলোর পরেই তার স্থান।
এই সংক্ষিপ্ত হাদিসে তিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিদ্যমান। প্রথমত, আপাতদৃষ্টিতে বাস্তবতা এবং আধ্যাত্মিকতার মধ্যে যে বিভাজন, ইসলামী জীবনবিধান সেই দ্বিভাজিত দর্শনকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করে। আমরা প্রায়ই দেখি, এই দ্বিভাজিত (ফরপযড়ঃড়সু) ধারণার কারণেই বাস্তবতা ও আধ্যাত্মিকতা কার্যত বিপরীতমুখী হয়ে ওঠে। বস্তুবাদী জগতের প্রতি অতিরিক্ত আকর্ষণের ফলে মানুষ যেমন তার আত্মিক দাবি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, অন্যদিকে আধ্যাত্মিকতাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে মানুষ এমন একটা প্রবণতার শিকার হয়, যখন সে জীবনের বাস্তব সুখ-দুঃখ থেকে নিজেকে গুটিয়ে ফেলে। আপাতভাবে দুটির মধ্যে পরস্পরবিরোধিতা আছে; কিন্তু একটি অপরটিকে পুরোপুরি অস্বীকার করবে, সেই অস্বীকৃতিও কি আছে? এটা কি সম্ভব যে, পরস্পরকে যথোচিত স্বীকৃতি জানিয়ে এ পরস্পরবিরোধিতার অবসান ঘটানো যেতে পারে? এমন কোনো পথ কি আছে? নাকি তারা একেবারেই আলাদা, যে কারণে তাদের মিলন ও সহাবস্থান সম্ভবই নয়? সব ধর্মের ক্ষেত্রেই এটা একটা মৌলিক প্রশ্ন। অতীতে অনেক ধর্ম দ্বিতীয় ধারণা অর্থাত্ পরস্পরবিরোধীকেই সত্য বলে গ্রহণ করেছে, যে কারণে সন্ন্যাসব্রতই তাদের কাছে মানবতার প্রকৃষ্ট আদর্শ। দুর্ভাগ্যবশত, এই বিশ্বাস ও দিকনির্দেশনা নিয়ে কেউ যখন বহুদূর অগ্রসর হয়, তখন দেখা যায় মানবতা আর মানবতা নেই; এক উত্কট ভারসাম্যহীনতার মধ্যে মানবতা বরং পরিত্যক্ত হয়েছে। খ্রিস্টান এবং হিন্দু-সন্ন্যাসীদের বীভত্স জীবনকথা কেউ পাঠ করে দেখতে পারেন যে, যারা আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধতা অর্জনের জন্য বাস্তবতাবর্জিত কী আত্মঘাতী সন্ন্যাসব্রতকে বেছে নিয়েছিলেন!
এরই প্রতিক্রিয়াস্বরূপ অন্য অনেকে এমন এক পথ গ্রহণ করল, যেখানে বাস্তব আনন্দ ও সুখই হয়ে উঠল জীবনের একমাত্র কাম্য ও লক্ষ্য। বলাই বাহুল্য, পশ্চিমা সভ্যতা আজ এ ধারণাকে কেন্দ্র করেই সোল্লাসে আবর্তিত এবং এটা খুবই সর্বজনবিদিত ব্যাপার যে, সেখানে মানবাত্মা ও নৈতিকতাকে আজ কী পরিমাণ মাশুলই না গুনতে হচ্ছে! আর এ থেকে এটা ক্রমাগতভাবেই প্রতীয়মান হচ্ছে যে, নিশ্চয়ই এখানে কোথাও কোনো বড় রকমের ভুল আছে।
এই দুই চরম জীবনবোধের মধ্যে ইসলাম একটি ভারসাম্যপূর্ণ সরল পথ প্রদর্শন করে। আসলে মানুষ একই সঙ্গে বস্তুমুখী ও আধ্যাত্মিক চেতনাসম্পন্ন। জীবনের বাস্তব দাবি ও প্রবৃত্তির স্বাভাবিক চাহিদাকে অস্বীকার করার মধ্যে সমাধান নেই, সমাধান আছে এই দাবিগুলোকে প্রধান ও একমাত্র বিবেচনা না করার মধ্যে। এগুলো জীবনের অংশ বটে কিন্তু জীবনের উদ্দেশ্য অথবা লক্ষ্য নয়। তারা যতক্ষণ যথাস্থানে আছে তারা আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অর্থসম্পদ কোনো সমস্যা নয়, সমস্যা হলো অর্থপ্রীতি ও অর্থলিপ্সা। সম্পদ এমনিতে খারাপ নয়, বরং আল্লাহপ্রদত্ত নিয়ামত; যে কারণে কোরআন আমাদের বলছে, আল্লাহপাক তোমাদের যে সম্পদ দান করেছেন, সেটা তোমাদের প্রতিষ্ঠালাভের সহায়ক উপকরণ (সূরা আন্ নিসা, আ: ৫) এবং একটি হাদিসেও সম্পদের প্রশংসা করে বলা হয়েছে, ‘ধর্মনিষ্ঠ ব্যক্তির হালাল উপার্জন’। আসলে হালাল জীবিকা অর্জন আধ্যাত্মিকতার প্রতিকূল তো নয়-ই, বরং এটা অপরিহার্য ধর্মীয় কর্তব্য।
কিন্তু এই উপার্জন হতে হবে অবশ্যই হালাল পথে এবং এটাই হলো প্রথমোক্ত হাদিসের দ্বিতীয় বার্তা। আমাদের দায়িত্ব শুধু অর্থ উপার্জন নয়, দায়িত্ব হলো হালাল বা বৈধপথে উপার্জন। এটা এমন এক বিশদ আলোচনার বস্তু, যা একটি সমাজের অর্থনৈতিক জীবনব্যবস্থাকে পুনর্গঠিত করে। প্রতিটি ব্যবসায়িক পরিকল্পনা অথবা সম্ভবপর সব ব্যবসায়িক উদ্যোগই সমাজের জন্য কল্যাণকর নয় এবং এক্ষেত্রে ভালো-মন্দ কোনো সিদ্ধান্ত কেবল বাজার ও বিপণন-শক্তির উপর ছেড়ে দেয়া যায় না। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ভালো এবং মন্দ অবশ্যই একটি উচ্চতর আদর্শের দিকনির্দেশনা দ্বারা নির্ধারিত হওয়া আবশ্যক। বলা প্রয়োজন, শরিয়াহ (পবিত্র ইসলামী বিধান) আমাদের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক সব ব্যবসায়িক উদ্যোগ ও ক্রিয়াকর্ম হালাল-হারামকে সামনে রেখে পরিচালনা করে এবং ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক, উভয় স্তরে এই নির্দেশনা অবশ্যই অনুসরণ করা জরুরি। হতে পারে, কখনও এই নির্দেশনা প্রচলিত ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে উঠলো। দৃষ্টান্তস্বরূপ, যতই লাভজনক ও আর্থিকভাবে প্রলুব্ধকর হোক, রিবা (সুদ), জুয়া, পর্নোগ্রাফি (নগ্নতা, অশ্লীলতা) সুরা, মদ এসব সম্পূর্ণরূপে হারাম; এসব থেকে একজন মুসলমানকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। এটা একজন ঈমানদার ব্যক্তির অর্থনৈতিক জিহাদ বা সংগ্রাম; এবং এটাও খুবই সহজবোধ্য, কেন এই বিরত থাকা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ফরজ। ব্যক্তিগত পর্যায়ে এই ফরজ রক্ষা করতে হবে হালাল পেশা ও হালাল ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত থেকে; আর সামষ্টিক স্তরে এই ফরজ হলো এমন একটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা, যেখানে ব্যক্তির পক্ষে হালাল উপার্জনের পথকে বেছে নেয়া সহজ হয় এবং হারাম উপার্জন নিরুত্সাহিত করে। অনেক সময় আমরা আমাদের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক পর্যায়ের যে দায়িত্ব, এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে ব্যর্থ হই। এটা পরিষ্কার যে, আমাদের ব্যক্তিগত পর্যায়ের দায়িত্বই প্রধান ও চরম; কারণ আখিরাতে আমাদের ব্যক্তিগত কার্যকলাপের জন্যই জবাবদিহি করতে হবে। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও সত্য যে, অদ্যকার বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো, সিএনএন, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক এবং ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন ইত্যাদি দ্বারা ভয়ানকভাবে প্রভাবিত এই যুগে সহজবোধ্য কারণেই ব্যক্তিগত কোনো প্রচেষ্টাই সমাজের অর্থনৈতিক জীবনকে হালাল উপার্জনের দিকে এগিয়ে দিতে পারে না। সুদকে পরিহার করা কেন আজ এত দুরূহ? সেটা এ জন্য নয় যে, এর মধ্যে একটা স্বাভাবিক ও সহজ মুনাফার প্রশ্ন জড়িত; বরং এই জন্য যে, পুরো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডই আজ সুদভিত্তিক ব্যবস্থাপনা দ্বারা শৃঙ্খলিত। সিএনএন যখন চব্বিশ ঘণ্টা ধরে অত্যন্ত প্রলুব্ধকর ইসলামবিরোধী বিজ্ঞাপন আমাদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে, এর বিপরীতে আমাদের পক্ষে ইসলামী জীবনব্যবস্থা গড়ে তোলা কি সম্ভব? জনগণের কাছ থেকে কর (ঞধী) আদায়ের প্রশ্নটি আমরা কি আদৌ হালাল-হারাম সংক্রান্ত কোনো বিবেচনায় আনতে পারি? পারি না, কারণ মুসলিম দেশগুলোতেও কর আদায়ের সিদ্ধান্ত এবং জাতীয় বাজেট প্রণীত হয় আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের নির্দেশক্রমে। অতএব স্পষ্টতই ব্যক্তিগত পর্যায়ে ‘হারাম’ পরিত্যাগ করার বিষয়টি প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রীতিমতো সাংঘর্ষিক। কারণ এই ব্যবস্থা শুধু ‘হারাম’-এর উপর প্রতিষ্ঠিত নয়, ‘হারাম’-কে রীতিমতো বাধ্যতামূলক পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। অতএব এমতাবস্থায় এক্ষেত্রে কোনোরূপ পরিবর্তন সাধনের চিন্তা করার অর্থ প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটি সামষ্টিক সংগ্রাম।
তৃতীয়ত, হালাল উপার্জনের জন্য আমাদের যা কিছু চেষ্টা-প্রচেষ্টা, তা কিন্তু কোনো অবস্থাতেই আমাদের প্রাথমিক ধর্মীয় কর্তব্যকর্মকে আছন্ন বা শিথিল করে দিতে পারে না। এমনকি শতভাগ বিশুদ্ধ হালাল উপার্জনের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে আমরা কিন্তু কোনোভাবেই নামাজ, কি রোজা, কি হজব্রত পালনে শৈথিল্য বা ঔদাসীন্য দেখাতে পারি না।
বস্তুতপক্ষে, প্রথমে যা মনে হয়, বিষয়টি কিন্তু সে তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক কিছু ইসলামী আন্দোলন একটা ভুল বক্তব্য তুলে ধরছে যে, সালাতের মতো যেসব প্রাথমিক ইবাদত, সেগুলি শুধু ইবাদতের জন্য ইবাদত নয়; সেগুলো ছিল ইসলামী রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রস্তুতি গ্রহণ। এই বক্তব্য আসলে সংশ্লিষ্ট আন্দোলনের সঙ্গে শ্রোতাকে শামিল করার একটা প্রচেষ্টা বলা যায়। কিন্তু এই বক্তব্য আদৌ গৃহীত হচ্ছে না, গুরুত্বও পাচ্ছে না; বরং বক্তাদেরই দূরে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে। কারণ এতে আনুষ্ঠানিক ইবাদত ও রাজনীতি সমন্বিত না হয়ে উভয়ের মধ্যে একটা বৈপরীত্য সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে যারা রাজনীতি ও অর্থনৈতিক অঙ্গনে সামষ্টিক সংগ্রামের কথা তুলে ধরছেন, তারা অনেক সময়ই ধর্মের প্রাথমিক দায়িত্বগুলোকে ‘বৃহত্তর’ সংগ্রামের স্বার্থে উপেক্ষা করছেন। এখানে প্রথমোক্ত হাদিসটি অগ্রাধিকার নির্ধারণের ক্ষেত্রে আমাদের সাহায্য করতে পারে; আর্থিক কার্যকলাপ একটি কর্তব্য, কিন্তু এই কর্তব্যের স্থান প্রাথমিক কর্তব্যের পরে এবং আমাদের স্মরণ রাখা আবশ্যক : অর্থনীতি এবং ধর্ম উভয়েই সঠিক অগ্রাধিকার নিরূপণই সঠিক কর্ম। ষ

লেখক : খা লি দ বে গ
অনুবাদ : অধ্যাপক আবু জাফর

No comments:

Post a Comment