Friday, March 25, 2011

রাসুলুল্লাহর (সা.) সাহিত্যানুরাগ

রাসুলুল্লাহ (সা.) ছিলেন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল। তার জীবনের মিশন ছিল সত্যের পয়গাম ও শাশ্বত দ্বীনের প্রচার-প্রসার। কিন্তু তিনি যেমন একজন রাসুল ছিলেন, তেমনি ছিলেন একজন মানুষও। সাধারণ মানুষের মতো তারও অনুভব, অনুভূতি ও লেনদেনের প্রয়োজন হতো। মানুষ হিসেবে সেই মুহূর্তগুলো তাকে পীড়িত করেছে। আপনজনের প্রতি ভালোবাসা, বিপদে ব্যথিত হওয়া এবং সুখের সময় আনন্দ প্রকাশ করার ক্ষেত্রে তিনি অন্যান্য মানুষের ব্যতিক্রম ছিলেন না। সেসব মুহূর্তে তিনি অলঙ্কার ও সাহিত্যপূর্ণ সাবলীল ভাষায় মনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন। একাডেমিক শিক্ষা তাঁর ছিল না। তার জ্ঞানের উত্স ছিল আসমানি ওহী। তাই তার সাহিত্যও ছিল ঐশী শক্তিতে বলীয়ান। শুদ্ধ বাচনভঙ্গি, অতিপ্রভাবক বিষয়বস্তু নিরূপণ, সাবলীল উপস্থাপনা ও হৃদয়স্পর্শী ব্যাখ্যায় তিনি ছিলেন অতুলনীয়।
যেহেতু তিনি উম্মী ছিলেন, তাই লেখ্য-সাহিত্যে তার কোনো ছাপ পাওয়া যায় না। কিন্তু কথ্য-সাহিত্যের পুরোপুরি বৈশিষ্ট্য তার মধ্যে ছিল। তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন স্প্পষ্টভাষী বংশ কুরাইশে। বেড়ে উঠেছেন বিশুদ্ধভাষী গোত্র বনু সাদে। অলঙ্কারপূর্ণ কালাম কোরআনুল কারিম দ্বারা তার পরবর্তী পাথেয় সঞ্চিত হয়েছে। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তার বিচরণ লক্ষণীয়। যেমন—কথাবার্তা, সংম্বোধন, ঘটনা বর্ণনা, উপদেশ দান, দোয়া ও অনুভূতি প্রকাশে তিনি তার সাহিত্যচেতা মনের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। এজন্য তার ভাষায় ছিল সম্মোহনী শক্তি। এর টানে অনেকেই ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছেন।
কোরআন ও হাদিসের সাহিত্যভাণ্ডার আরবি গদ্য সাহিত্যে সমৃদ্ধি আনে। তবে কবিতাপ্রীতিও নবীজীর মধ্যে কোনো অংশে কম ছিল না। কবিতার ছন্দে, ভাব ও অনুভূতিতে যে অভিব্যক্তি প্রকাশ পায় রাসুল (সা.) তা যথাযথ অনুভব করতেন। সাহাবায়ে কেরামের কবিতা আবৃত্তিকে পছন্দের দৃষ্টিতে দেখতেন। বরং যেসব কবি মুসলমান হয়েছিলেন, তিনি তাদের কবিতাকে দ্বীনের সাহায্যার্থে প্রয়োগ করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন। কবি হাসসান ইবনে সাবিত (রা.) ছিলেন রাসুলের কবি। রাসুলের ওপর আরোপিত বিভিন্ন অপবাদের জবাবদানে তিনি তার কাব্যপ্রতিভাকে কাজে লাগিয়েছেন। রাসুল (সা.) তাকে উত্সাহিত করে বলেন ‘ইসলামের খেদমত ঢাল-তলোয়ারে যেমন করা যায়, তেমনি কবিতা ও সাহিত্যের মাধ্যমেও করা যায়।’
কবিতা আবৃত্তির দ্বারা আবেগে আপ্লুত হওয়ার ঘটনাও হাদিসে পাওয়া যায়। মক্কা বিজয়ের সময় কিছু লোককে ইসলামের প্রতি চরম বিদ্বেষ পোষণের কারণে সাধারণ ক্ষমার আওতাভুক্ত করা হয়নি। তাদের সবাইকে হত্যার নির্দেশ দেয়া হয়। এদের মধ্যে কুরাইশদের এক ব্যক্তি ছিল। তাকে হত্যা করার পর তার বোন রাসুলের (সা.) দরবারে এসে আবেগঝরা ও হৃদয়গ্রাহী ভাষায় কবিতা আবৃত্তি করতে থাকে। এ কবিতা রাসুলের মধ্যে বিরাট প্রভাব ফেলে। কবিতা শুনে তিনি আফসোস করে বললেন, ‘এই কবিতা যদি আগে শুনতাম তবে তাকে মাফ করে দিতাম।’ স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে কখনও তার নিজের মুখ থেকে কবিতার ছন্দ বেরিয়ে যেত। কিন্তু কাফেররা যেহেতু তার ওপর অবতীর্ণ আল্লাহর বাণীকে স্বরচিত কবিতা বলে অপপ্রচার চালাতো, সে জন্য তিনি অনেকটা ইচ্ছাকৃতভাবেই তা থেকে বিরত থাকতেন। কোরআনে এরশাদ হচ্ছে, ‘আমি তাঁকে (রাসুলকে) কবিতা রচনা শিক্ষা দিইনি এবং এরকম কাজ তার পক্ষে শোভনও নয়।’
রাসুলের (সা.) অসংখ্য হাদিসের মধ্যে গদ্য সাহিত্যের কথ্যরূপ স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে আছে। প্রিয় ছেলে ইবরাহিমের ইন্তেকালের পর দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ের অভিব্যক্তি প্রকাশ পায়। একদিকে দাসত্বের প্রতি পূর্ণ দৃষ্টি, যেন সীমা লঙ্ঘন না হয়ে যায়; অন্যদিকে মানব-প্রকৃতির চিরায়ত রীতির বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন জড়তাহীন ও মর্মস্পর্শী ভাষায়। তিনি তখন বলেছিলেন ‘অন্তর ব্যথিত, চক্ষুদ্বয় অশ্রুসিক্ত, কিন্তু আমি বলব সে কথাই, যাতে আমার প্রভু সন্তুষ্ট; হে ইবরাহিম! তোমার বিরহে আমি ভারাক্রান্ত।’ নারীদের কোমল স্বভাবের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘তারা স্বচ্ছ কোমল স্ফটিকের পাত্রের মতো।’ পরস্পর মতবিরোধ ও বিভেদের কোনো অবকাশ নেই—একথা বোঝাতে বলেন ‘এ ব্যাপারে দুটি ছাগল পরস্পরে শিং নাড়াতে পারবে না।।’
রাসুল (সা.) তার বিবিদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ পরিবেশে কথা বলার সময়ও সাহিত্যপূর্ণতার দিকে দৃষ্টি রাখতেন। একদিন তিনি বিবিদের কাছে অভিজ্ঞতার কথা ব্যক্ত করেন অত্যন্ত সাহিত্যপূর্ণ ও চিত্তাকর্ষক ভাষায়। সেখানে তিনি একটি ঘটনা আকারে কয়েকজন মহিলার নিজ নিজ স্বামী সম্পর্কে মন্তব্য পেশ করেছেন। ‘হাদিসে উম্মে জারা’ নামে সেই বিবরণ বর্ণিত হয়েছে হাদিসের কিতাবগুলোয়। বিশেষভাবে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করার সময় সাহিত্যের ঝলক প্রস্ফুটিত হতো। তার মোনাজাত ও দোয়া এই পরিমাণ প্রভাবক ছিল যে, তা শুধু আরবি সাহিত্যে নতুন ধারার সূচনা করেনি বরং সাহিত্যের উচ্চ শ্রেণীভুক্ত হয়ে যায়। উপস্থাপনের দিক থেকে এগুলো যেমন গাম্ভীর্যপূর্ণ, তেমনি তাত্পর্যের দিক থেকেও অনেক উচ্চাঙ্গের। এর সর্বোত্কৃষ্ট দৃষ্টান্ত রাসুলের (সা.) দোয়া, যা তিনি তায়েফের ময়দানে করেছিলেন। এছাড়াও আরাফাতের ময়দানে ও বদর যুদ্ধের রাতের দোয়া, বিদায় হজের ভাষণ ইত্যাদিতে রাসুলের (সা.) সাহিত্যানুরাগের বিশেষ প্রমাণ পাওয়া যায়।
রাসুল (সা.) মানব সভ্যতার উত্কর্ষে যে বিশাল অবদান রেখে গেছেন, তা থেকে সাহিত্যাঙ্গন খালি নয়। এক্ষেত্রেও তার সুস্পষ্ট প্রভাব ও অবদান উদ্ভাসিত।


জ হি র উ দ্দি ন বা ব র
zahirbabor@yahoo.com

No comments:

Post a Comment