Friday, March 25, 2011

আল কোরআনে মাতৃভাষার গুরুত্ব

ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
মহান আল্লাহর প্রিয় ও সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হচ্ছে মানব জাতি। এই শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি বা আশরাফুল মাখলুকাত তাদের মনের ভাব, হৃদয়ের আকুতি, অন্তরের ব্যাকুলতা ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করে থাকে। এই ভাষা আল্লাহর দান। মানুষের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত এই ভাষা এক অমূল্য ও অতি বড় নেয়ামত। আল্লাহ মানুষকে স্বাধীন বাকশক্তি বা কথা বলার ক্ষমতা দান করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘দয়াময় আল্লাহ শিক্ষা দিয়েছেন কোরআন, সৃজন করেছেন মানুষ, তাকে শিখিয়েছেন বর্ণনা’ (সূরা আর-রহমান, আয়াত ১-৪)। অর্থাত্ আল্লাহ মানুষকে তার মনের ভাব প্রকাশ করতে শিখিয়েছেন।
একজন মানব শিশু যে জনপদে জন্মগ্রহণ করে, যে পরিবেশে সে বেড়ে ওঠে, যে মায়ের কোলে সে প্রতিপালিত হয়, সে জনপদের মানুষের ভাষা, সেই পরিবেশের ভাষা, সে মায়ের ভাষা তার নিজের ভাষায় পরিণত হয়। প্রায় সাড়ে ছয়শ’ কোটি আদম সন্তান অধ্যুষিত পৃথিবী নামক এই এ ভূখণ্ডে প্রায় পাঁচ হাজার সাতশ’টি ভাষা রয়েছে। ভাষার এই ভিন্নতা, বিচিত্রতা মহান আল্লাহর সীমাহীন ক্ষমতা ও অসীম কুদরতের এক অপূর্ব ও অকল্পনীয় নিদর্শনের বহিঃপ্রকাশ। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, ‘আল্লাহর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য’ (সূরা আর-রুম, আয়াত ২২)।
মাতৃভাষার মাধ্যমে অন্য ভাষার মানুষকে, অন্য ভাষার মানুষের চিন্তা-চেতনা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও কৃষ্টি সহজে জানা যায়, আয়ত্ত করা যায়, নিজ অনুভবে নিয়ে এসে তাকে আত্মস্থ করা যায় হৃদয়ের গভীরতম প্রদেশে। মাতৃভাষা অতি সহজেই একজন মানুষের ব্যক্তি সত্তার অন্তর্গত হয়ে যায়। তাই নবী-রাসূলগণকে আল্লাহ যে অঞ্চলে প্রেরণ করেছেন, তাঁদেরকে সে অঞ্চলের মানুষের ভাষাভাষী করেছেন। এ মর্মে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি প্রত্যেক রাসূলকেই তার নিজ কওমের ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছি, তাদের নিকট সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য’ (সূরা ইব্রাহীম, আয়াত ৪)। এ আয়াতে সু্স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, মাতৃভাষার মাধ্যমে যত সহজে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে মানুষকে বোঝানো সম্ভব হয়, অন্য কোনো ভাষায় বোঝানো ও প্রকাশ করা তত সহজ হয় না। এজন্যই আল্লাহ নবী-রাসূলগণকে তাঁদের নিজ নিজ সম্প্রদায়ের ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছিলেন। হিব্রু ভাষাভাষী অঞ্চলে আল্লাহ হিব্রুভাষী নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন এবং তাঁর নিকট আল্লাহ হিব্রু ভাষায়ই কিতাব নাযিল করেছেন। যেমন তাওরাত ও ইঞ্জিল।
মহানবী মুহাম্মদ (সাঃ)-এর ভাষা ছিল আরবি। তার নিকট অবতীর্ণ মানবতার মুক্তির দিশারি কোরআনের ভাষাও ছিল আরবি। রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর প্রতি আরবি ভাষায় কোরআন নাজিল হওয়া সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘আমি আপনার ভাষায় কোরআনকে সহজ করে দিয়েছি, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে’ (সূরা আদ-দুখান, আয়াত ৫৮)।
অন্যত্র তিনি বলেন, ‘আমি আপনার প্রতি কোরআন নাযিল করেছি আরবি ভাষায় যাতে আপনি সতর্ক করতে পারেন মক্কা ও তার চতুর্দিকের জনগণকে এবং সতর্ক করতে পারেন রোজ হাশর সম্পর্কে’ (সূরা আশ-শূরা, আয়াত ৭)। তিনি আরও বলেন, ‘আমি এটা নাযিল করেছি আরবি ভাষায় কোরআন রূপে, যাতে তোমরা অনুধাবন করতে পার’ (সূরা আয-যুখরুফ, আয়াত-৩)।
কোরআনুল কারিমের বর্ণিত আয়াতগুলো থেকে জানা যায় যে, ইসলাম মাতৃভাষার উপর অশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। এ কারণে দেখা যায় যে, পরবর্তীকালে ইসলাম প্রচারকরা পৃথিবীর যে অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে গমন করেছেন, সে এলাকার মানুষের ভাষা তারা আয়ত্ত করে ওই ভাষাতেই ইসলামের বাণী, হকের দাওয়াত মানুষের সামনে পেশ করেছেন। মানবতার মুক্তির নির্ভুল দিশারি ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী, হেদায়াতের আলোকবর্তিকা মহাগ্রন্থ আল কোরআন মাতৃভাষাকে অশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। কেননা ইবাদত-উপাসনায়, দ্বীনের জ্ঞানার্জন ও মহান আল্লাহর আরাধনায় মাতৃভাষা মানুষকে যথার্থভাবে অনুপ্রাণিত করে। তাই মাতৃভাষার গুরুত্ব অনুধাবন করে আমাদেরকেও মাতৃভাষার সেবায়, মাতৃভাষার উন্নয়নে, মাতৃভাষার শ্রীবৃদ্ধিতে আত্মনিয়োগ করতে হবে।
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক

No comments:

Post a Comment