Friday, March 25, 2011

কোরআনের বিধান নারীর সমানাধিকারের গ্যারান্টি

ভূমিসহ সম্পদ, সম্পত্তি এবং উত্তরাধিকারে নারীর সমান অধিকারের স্বীকৃতি দিয়ে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি-২০১১ এর খসড়া অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের এক দিন আগে গত ৭ মার্চ মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে এ অনুমোদন দেয়া হয়। এ বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নতুন নারী উন্নয়ন নীতিতে পারিবারিক, সামাজিক পর্যায় ও কর্মক্ষেত্রে সমানাধিকার নিশ্চিত করার ঘোষণা রয়েছে। ১৯৯৭-এর নারীনীতির আদলে এবারও যৌন হয়রানি, পর্নোগ্রাফির মতো সামপ্রতিক বিষয়কেও যুক্ত করা হয়েছে। এতে উপার্জন, উত্তরাধিকার, ঋণ, ভূমি ও বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের ক্ষেত্রে নারীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকার বিধান রাখা হয়েছে। এ ছাড়া নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ সিডওর বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার পাশাপাশি বিদ্যমান সব বৈষম্যমূলক আইন বিলোপ করার বিধান রয়েছে। এর আগে ১৯৯৭ সালে তত্কালীন আওয়ামী লীগ সরকার নারী উন্নয়ন নীতি করেছিল। পরে ২০০৪ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার নারীর সমানাধিকারের অংশ বাদ দিয়ে নারী উন্নয়ন নীতি সংশোধন করে। এরপর ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নারী উন্নয়ন নীতি অনুমোদন করলেও ইসলামপন্থীদের চাপের মুখে পিছিয়ে আসে।
জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে তত্কালীন ভারপ্রাপ্ত খতিব মরহুম মুফতি মুহাম্মদ নূরুদ্দীনকে প্রধান করে প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রণয়ন করতে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটি ২০০৮ সালের নীতিমালার ১৫টি ধারা কোরআন সুন্নাহর পরিপন্থী বলে মন্তব্য করে। এর মধ্যে সিডও ধারাটি বাতিলের সুপারিশ করেছিল কমিটি। সিডও এর অনেক ধারা মুসলিম উম্মাহর বিশ্বাস, চেতনা ও সংস্কৃতিবিরোধী বলে উল্লেখ করে কমিটি। ১৯৯৭, ২০০৪, ২০০৮-এর নীতিমালা এবং ২০১০ এর খসড়া নীতিমালায় সিডও সনদ বাস্তবায়ন করার বিধান রাখা হয়েছে। আবার অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন ও সম-অধিকার সংক্রান্ত ধারাটি ধর্মীয় অনুশাসনের ভিত্তিতে করার সুপারিশ করেছিল কমিটি। এ ছাড়া মোট ১৫টি ধারা ধর্মীয় অনুশাসনের আলোকে সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছিল ওই কমিটি।
‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি’ মন্ত্রিসভা নীতিগতভাবে অনুমোদন করায় দেশজুড়ে বিতর্ক ও বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। উলামা মাশায়েখসহ ইসলামপ্রিয় জনতা এ নীতি বাতিলের জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানান। তাদের বক্তব্য— উত্তরাধিকারসহ সব ক্ষেত্রে নারীর সমতা বিষয়ক এ নীতিমালা পবিত্র কোরআনের সূরা নিসার ৭, ১১, ১২, ১৩, ১৪, ৩৩ ও ১৭৬ নম্বর আয়াতের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী মুসলমান কোরআনের আইন পরিবর্তন কোনো অবস্থাতে মেনে নেবে না। জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্র বলতে উত্তরাধিকারও অন্তর্ভূক্ত। এ আইন কার্যকর হলে সামাজিক অস্থিরতা ও নৈরাজ্য দেখা দিতে পারে এবং পারিবারিক শৃঙ্খলা ভেঙে যেতে পারে, যা কখনও আমাদের কাম্য নয়। অনেকেই মনে করেন, জাতিসংঘের চাপে সরকার নারীর সমতা আইন কার্যকর করতে যাচ্ছে। জাতিসংঘ ১৯৯৪ সালে অনুষ্ঠিত কায়রো সম্মেলনে সমকামিতা বৈধ করার উদ্যোগ নেয়। ১১৩ পৃষ্ঠার খসড়া প্রস্তাবের মূলভিত্তি ছিল জবঢ়ত্ড়ফঁপঃরাব ঐবধষঃয, যা সরাসরি ইঙ্গিত করে এমন এক ব্যবস্থার প্রতি যেখানে ধর্মীয়, সামাজিক ও আইনগত বাধা পরিহার করে যৌন স্পৃহা চরিতার্থ করা যায়। ওই প্রস্তাবে আরও বলা হয় ্তুঞত্ধফরঃরড়হধষ হড়ঃরড়হং মবহফবত্ নধংবফ ফরারংরড়হ ড়ভ ঢ়ধত্বহঃধষ ধহফ ফড়সবংঃরপ ভঁহপঃরড়হং ধত্ব হড় ষড়হমবত্ াধষরফ্থ অর্থাত্ ‘ঐতিহ্যগত প্রথা, মাতাপিতা ও পারিবারিক কর্মকাণ্ডের লিঙ্গভিত্তিক পার্থক্য এখন আর বৈধ নয়।’ ‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি’ ওই কায়রো সম্মেলনের ধারাবাহিকতার অংশ।
ব্রিটিশ ২০০ বছর ভারতবর্ষে রাজত্ব করে দোর্দণ্ড প্রতাপে কিন্তু শরীয়া আইনে হাত দেয়ার সাহস করেনি। এখনও পুরো ভারতবর্ষে পার্সোনাল ল বোর্ডের মাধ্যমে বিবাহ, তালাক, দেনমোহর, খোরপোষ ও দাম্পত্য জীবন পুনরুদ্ধার সম্পর্কিত সমস্যাবলী বিজ্ঞ মুফতি ও অভিজ্ঞ আলিম সমন্বয়ে গঠিত বোর্ডের রায়ের ভিত্তিতে সমাধা করা হয়। শরীয়াহ আইন মূলত পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আইন। পবিত্র কোরআনের বিধান পরিবর্তনের এখতিয়ার ও ক্ষমতা কারো নেই। শরীয়াহ আইনের ক্ষেত্রে ফকিহ, মুফতি ও আলিমদের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। ইসলাম নারীদের মা, বোন, স্ত্রী ও কন্যা হিসেবে মর্যাদার আসনে সমাসীন করেছে।
মহান আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত ধর্ম ইসলামে নারীকে যথোচিত মর্যাদা ও অধিকার দেয়া হয়েছে। ইসলামী শরীয়ত বোন, কন্যা, জায়া, জননীকে পরিবার ও সমাজের সদস্যরূপে মর্যাদার উচ্চ আসনে সমাসীন করেছেন। নারী ও পুরুষ একই অবিভাজ্য সত্তা এবং অভিন্ন উত্স হতে প্রবাহিত দুটি স্রোতধারা, যা এক মোহনায় মিলিত হয়েছে। নারীর আইনগত অধিকার সংরক্ষণে ইসলাম উদারতার পরিচয় দিয়েছে। দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইনে নারী-পুরুষের অধিকার সমান। জান, মাল ও মর্যাদার নিরাপত্তায় ইসলামী আদালতে রয়েছে ইনসাফপূর্ণ বিচারব্যবস্থা। চুরি, জেনা ও হত্যার বিচারে নারী-পুরুষের জন্য একই বিধান প্রযোজ্য। ইসলামের সোনালি যুগে নারীরা পুরুষের মতো সব-অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করতেন, তবে এ ক্ষেত্রে তারা শরীয়তের বিধিবিধান পুরোপুরি মেনে চলতেন। সেখানে উচ্ছৃখলতা ও বেহায়াপনার মোটেই স্থান ছিল না।
ইসলামী শরীয়ত নারীর অর্থনৈতিক অধিকার পূর্ণাঙ্গরূপে সংরক্ষণ করে। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদ এবং মোহরানার প্রাপ্ত অর্থের মালিকানা একমাত্র নারীর। এতে কারও হস্তক্ষেপ অবৈধ ও অবাঞ্চিত। স্ত্রীর ভরণ-পোষণের দায়িত্ব স্বামীর ওপর। নারী তার নিজের অর্থ সম্পদ জমা, বিনিয়োগ, ব্যবসা ও দান করার পুরোপুরি অধিকার সংরক্ষণ করেন। উপরোক্ত পর্যালোচনা থেকে এটা স্পষ্ট হলো যে, ইসলাম নারীদের ধর্মীয় শিক্ষা, আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রদান করেছে। ইসলামের পারিবারিক ও উত্তরাধিকার আইন খুবই ভারসাম্যপূর্ণ। ইসলামের দৃষ্টিতে নারীর অর্জিত বা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তিতে পুরুষের কোনো অধিকার নেই; কিন্তু পরিবারের পুরুষ সদস্যদের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি থেকে নারী সদস্যদের ভরণ-পোষণ ও উত্তরাধিকার প্রাপ্তির পূর্ণতম অধিকার রয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, পবিত্র কোরআনের বিধিবিধান অলঙ্ঘনীয় ও অপরিবর্তনীয়। ষ


লেখক :ড. আ ফ ম খা লি দ হো সে ন
অধ্যাপক, গবেষক

No comments:

Post a Comment