Friday, March 25, 2011

মদিনা সনদ : শান্তির উদারনীতি

মো হা ম্ম দ কা ম রু ল ই স লা ম

রাসূল (সা.) আগমনের আগে এক সংকটময় মুহূর্ত অতিক্রম করেছিল আরবসহ সারাবিশ্ব। ইতিহাসে তাকে আইয়ামে জাহেলিয়ার যুগ বলা হয়। এ সময় সর্বত্র বিরাজ করছিল অশান্তির দাবানল। এ ক্রান্তিকালীন কাণ্ডারি হয়ে এসেছিলেন আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। প্রথমদিকে দ্বিধাবিভক্ত ও কলহপ্রিয় জাতিকে একটি আদর্শের ছায়াতলে নিয়ে আসতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। মক্কাবাসী তাকে সাদরে গ্রহণ না করায় তিনি হিজরত করে মদিনা চলে গিয়েছিলেন। মদিনার অধিবাসীদের মধ্যে এক আত্মার বন্ধন সৃষ্টি করেছিলেন। যে মূলমন্ত্রের মাধ্যমে তিনি এ বন্ধনটি তৈরি করেছিলেন সেটি মানবতার মুক্তির সনদ হিসেবে খ্যাত ‘মদিনা সনদ’। ঐতিহাসিক M.Watt এ সনদকে ঈড়হংঃরঃঁঃরড়হ ড়ভ গধফরহধ' বলে অভিহিত করেছেন। যা ছিল যে কোনো সময়ের জন্য মানবতার মুক্তির এক মহাসনদ।
রাসূল (সা.) আল্লাহর নির্দেশে ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মদিনায় হিজরত করেন। এ সময় তিনি দেখলেন, মদিনায় বিভিন্ন গোত্র, উপগোত্র ও বিভিন্ন মতাদর্শের অনুসারীরা বসবাস করছে। এরা ছিল মোটামুটি পাঁচ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। ১. মদিনায় আদি পৌত্তলিক সম্প্রদায়, ২. ইহুদি সম্প্রদায়, ৩. খ্রিস্টান সম্প্রদায়, ৪. নবী দীক্ষিত মুসলিম সম্প্রদায় (আনসার), ৫. মক্কা থেকে আগত মুসলিম সম্প্রদায় (মুহাজির)। তখন মদিনা বসবাসরত সম্প্রদায়ের মধ্যে সদ্ভাব ছিল না। তাদের মধ্যে আদর্শের মিল তো ছিলই না, তদুপরি বিরাজ করছিল জাতিগত হিংসা-বিদ্বেষ। যার ফলে মদিনার ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। আইনের শাসন ছিল না।
মহানবী (সা.) মদিনায় বিরাজমান এ পরিস্থিতিতে বিবদমান গোত্রগুলোর মধ্যে আন্তঃবিরোধ মিটিয়ে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে একটি জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করতে প্রচেষ্টা চালান। আর এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন ছিল কলহে লিপ্ত সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে ঐক্য ও সদ্ভাব সৃষ্টি করা। এ ছাড়াও প্রয়োজন ছিল জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সব নাগরিকের সমান অধিকার ও কর্তব্য নির্ধারণ এবং মুহাজিরদের মদিনায় বাসস্থান ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। কারণ যে দেশে বিভিন্ন ধর্মমত ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোক বাস করে সে দেশে পরমত সহিষ্ণুতার প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি ও ঐক্য না থাকলে দেশের কল্যাণ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। ফলে মহানবী (সা.) মদিনার সব সম্প্রদায়ের সঙ্গে বৈঠক করে আন্তঃসাম্প্রদায়িক ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ করার লক্ষ্যে ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে মদিনায় বসবাসকারী সব সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি সন্ধি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এ চুক্তিটি ঐতিহাসিক ‘মদিনা সনদ’ নামি পরিচিত। বিশ্বের ইতিহাসে ‘মদিনা সদন’ অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি সনদ। এর মাধ্যমে রাসূল (সা.) এর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞার প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ড. গঁরত্ এর মতে, ‘মদিনা সদন’ শুধু সে যুগে কেন, বরং সর্বযুগে ও সর্বকালে হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর অসামান্য মাহাত্ম্য ও অপূর্ব মননশীলতা ঘোষণা করবে।’
মদিনা সনদ পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম লিখিত সংবিধান এবং একে মহাসনদও বলা যেতে পারে। আরবি ভাষায় লিখিত এ সনদের মোট ৪৭টি ধারা ছিল। কয়েকটি প্রধান ধারা নিম্নে উল্লেখ করা হলো।
* মদিনা সনদে স্বাক্ষরকারী ইহুদি, খ্রিস্টান, পৌত্তলিক ও মুসলমান সম্প্রদায়গুলো সমান নাগরিক অধিকার ভোগ করবে এবং তারা একটি সমন্বিত জাতি (কমনওয়েলথ) গঠন করবে।
* পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা বজায় থাকবে, মুসলমান ও অমুসলমান সম্প্রদায়ের লোকেরা বিনা দ্বিধায় নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারবে। কেউ কারো ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
* রক্তপাত, হত্যা, বলাত্কার এবং অপরাপর গর্হিত কার্যকলাপ একেবারেই নিষিদ্ধ করা হলো।
* দুর্বল ও অসহায়কে সর্বতোভাবে সাহায্য ও রক্ষা করতে হবে।
* ইহুদিদের মিত্ররাও সমান নিরাপত্তা ভোগ করবে।
মদিনা সনদের উপহারে বলা হয়, আল্লাহ এ সনদের সত্যিকার বাস্তবায়নকারী। অন্যায়কারীকে বা বিশ্বাসঘাতককে এ সনদ প্রশ্রয় দেয় না।
মদিনা সদন বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র। রাসূল (সা.) আবির্ভাবের আগ পর্যন্ত বিশ্বের কোনো শাসকই জনগণকে কোনো লিখিত শাসনতন্ত্র উপহার দিতে পারেনি। এ শাসনতন্ত্রের মাধ্যমে মহানবী (সা.) বিভিন্ন সম্প্রদায়কে একটি শক্তিশালী জাতি হিসেবে গড়ে তোলেন এবং তারা একত্রে মিলেমিশে বসবাস করার সুযোগ পান। ফলে তাদের মধ্যে গোত্রীয় ধারণার পরিবর্তে একটি রাজনৈতিক ঐক্যের সৃষ্টি হয় এবং মদিনা সনদের মাধ্যমেই প্রথম দেশভিত্তিক জাতীয়তাবোধের সৃষ্টি হয়। মদিনার সামাজিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে উচ্ছৃঙ্খলা রহিত হয় এবং সুশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়। যা নব্য প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্র মদিনার প্রশাসনিক ভিত্তিকে অনেক শক্ত করে তোলে এবং ইসলাম আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিস্তার লাভ করার সুযোগ পায়।
মদিনা সনদ থেকে যে শিক্ষা পাওয়া যায় তা হলো—মদিনা রাষ্ট্র ও জনগণের ওপর মহানবীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ, সব নাগরিকের নিজ নিজ ধর্ম, নিজস্ব সংস্কৃতি ইত্যাদি পালনের অধিকার। শত্রুর আক্রমণ থেকে নিজেদের নিরাপদ রাখার জন্য একের প্রতি অপরের সহযোগিতা এবং অন্যের মত ও বিশ্বাসের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার মানসিকতা ও যোগ্য নেতৃত্বের আনুগত্য মেনে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলা। কারণ তখনকার দিনে সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের অধিকারী ছিলেন স্বয়ং রাসূল (সা.) এবং তিনি হয়েছিলেন নবগঠিত মদিনা প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রনায়ক।
মদিনা সনদ ছিল বিশ্বের ইতিহাসের প্রথম আন্তর্জাতিক চুক্তির ধারণা। এ চুক্তির নীতিমালাগুলো বিশ্লেষণ করলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শান্তি প্রতিষ্ঠার অনেক মূল্যবান উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়। এ সনদে ব্যক্তিগত বা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, ন্যায্য স্বার্থ সংরক্ষণ, ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে স্বাধীনতা এবং পরস্পরের প্রতি সুসম্পর্কের ভিত্তি নিশ্চিত করা হয়েছিল। যার ফলে অশান্ত মদিনায় শান্তির সুবাতাস বইতে শুরু করেছিল। শান্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মহানবী (সা.) মদিনা নামক যে ইসলামী রাষ্ট্রটির গোড়াপত্তন করেছিলেন তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব তদানীন্তন বিশ্বের সর্বত্র প্রতিফলিত হয়েছিল।
মদিনা সদনের এ সাফল্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বৃহত্তর সনদ স্বাক্ষরের পথকে সুগম করে। এমনিভাবে এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিকতাবাদের সূচনা হয়। বর্তমান বিশ্বের শান্তি-সংহতি ও নিরাপত্তা বিধানের জন্য জাতিসংঘ গঠন করা হয়েছে। সে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার ধারণা মদিনা সনদের মধ্যেই পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে আরনল্ড টয়েনবীর তার ডরংফড়স ড়ভ গঁযধসসধফ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ‘ইসলামই প্রকৃত জাতিপুঞ্জ গঠনের ধারণা দিয়েছিল। এ ধারণাই সঠিক ও প্রয়োগযোগ্য।’

No comments:

Post a Comment