Friday, March 25, 2011

নবুওতী বিপ্লব : লক্ষ্য ও প্রতিকূলতা

বিশ্বের নির্যাতিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির দিশারী হিসেবে মহানবী হজরত মোহাম্মদের (সা.) আবির্ভাব ঘটেছিল। তাঁর আগমনী বার্তা সব শ্রেণীর সব ধরনের জালিম-অত্যাচারীর বুক কাঁপিয়ে দিয়েছিল। কারণ তারা পূর্ববর্তী খোদায়ি গ্রন্থে জেনেছিল তাঁর জীবনের মিশন কী হবে। কি ধর্মীয়, কি অর্থনৈতিক, কি রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক—সব ক্ষেত্র থেকে আত্মপূজারী স্বার্থদুষ্ট ব্যক্তিদের উত্খাত এবং সর্বত্র আল্লাহর শাশ্বত চিরন্তন ন্যায় বিধানের প্রতিষ্ঠাই হবে শেষ নবীর ‘নবুওতী বিপ্লবের’ মুখ্য উদ্দেশ্য—একথা তারা আগে থেকেই আঁচ করেছিল। আর মুখ্যত মহান আল্লাহ এজন্যই তাঁকে দুনিয়াতে পাঠিয়েছিলেন এবং দ্ব্যর্থহীনভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন : ‘পথ-নির্দেশক যাবতীয় বিধি ব্যবস্থা এবং সত্য জীবন বিধান দিয়ে রাসুলকে এজন্যই পাঠানো হলো যেন মানব রচিত (পক্ষপাতদুষ্ট) সব বিধি-ব্যবস্থার ওপর আল্লাহর ন্যায় বিধানেরই তিনি প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করেন।’ মহান আল্লাহ সেই সঙ্গে এও ঘোষণা করলেন যে, ‘খোদায়ি জীবনবিধান প্রতিষ্ঠার এ সংগ্রামকে যদিও মুশরিক তথা আল্লাহর অবাধ্য মানুষেরা খারাপ জানবে (তবুও এ সংগ্রামকে তার লক্ষ্যপথে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।)’ (সূরা সাফ)
এ কারণেই মহানবীর (সা.) নবুওতী জীবনের শুরু থেকে ইতিহাসে আমরা বার বার সত্যের সঙ্গে অসত্যের সংঘাত লক্ষ্য করেছি।
মানবতার দুশমনরা পদে পদে রাহমাতুল্লিল আলামিন সর্বহারা মজলুম মানুষের দরদী নবীর প্রতি নানাভাবে জুলুম-নির্যাতন চালিয়েছে। চেষ্টা করেছে ইসলামের ন্যায়-নীতি প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম শুরুতেই স্তব্ধ করে দিতে। কিন্তু ইসলামী বিপ্লবের নায়ক আর্ত শোষিত মানুষের দরদী নেতা কোনো অন্যায়-অসত্যের সামনেই মাথানত করেননি। আপস করেননি বাতিলের সঙ্গে। অতীতের কোনো নবী-রাসুলকেও খোদায়ি জীবন বিধান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বাতিলের সঙ্গে আপস করতে দেখা যায়নি।
উপরোক্ত আয়াতের আলোকে এটা সুস্পষ্ট যে, ইসলামের কথা, ইসলামী ন্যায়নীতি ও সাম্যের কথা যখনই উচ্চারিত হবে, তখনই ব্যক্তি ও কোটারি স্বার্থের পূজারীদের গায়ে আগুন ধরে যাবে। দেড় হাজার বছর আগে তথা সব নবী-রাসুলের যুগে যেমন এটা ছিল এক বাস্তব সত্য, আজও তেমনি। বস্তুত এ কারণেই আমরা দেখতে পাই, যে মোহাম্মদ (সা.) আরব সমাজে দীর্ঘ ৪০টি বছর ধরে সুনামের সঙ্গে অতিবাহিত করেছেন এবং সর্বত্র আদর্শ সমাজকর্মী, ‘আমিন-সাদেক’ তথা বিশ্বস্ত ও সত্যবাদী হিসেবে খ্যাতিমান ছিলেন, সম্মানজনক পদবি ছাড়া কেউ তাঁর মূল নাম ধরে সম্বোধন করতে চাইত না, তাঁর উপস্থিতিতে আরব নেতারা কোনো বিরোধ ফয়সালা না করে তাঁর ওপর ছেড়ে দিত; সেই জনপ্রিয় সমাজ দরদী আদর্শ ব্যক্তি নবুওত পাওয়ার পর তাঁর বিরুদ্ধে তারা প্রচণ্ড দুশমনিতে লেগে গেল। তিনি যখন ঘোষণা করলেন, সব ক্ষেত্রে একমাত্র আল্লাহরই বিধি-ব্যবস্থা চালু হবে; তখন আরব নেতা আবু লাহাবের মুখ দিয়ে উচ্চারিত হয়েছিল—‘মোহাম্মদ মুর্দাবাদ’ (নাউজুবিরল্গাহ), যার জবাবে অভিশাপ দিয়ে আল্লাহ বললেন : ‘আবু লাহাব মুর্দাবাদ, মুর্দাবাদ।’
এ কারণেই মহানবী (সা.) যখন লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্র বিপ্লবী বাণী উচ্চারণ করেন, তখন সমাজের যেখানে যার নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব ছিল সবাই ক্ষেপে উঠেছিল। হজরত যখন বললেন, শোষণের বড় হাতিয়ার সুদ বন্ধ কর অন্যথায় আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের সঙ্গে কিয়ামতের দিন লড়াই করার জন্য প্রস্তুত থাক, তখন সমাজের পুঁজিপতিরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। তারা সমাজের গুণ্ডা ও বখাটে ছেলে-ছোকরাদের নানাভাবে উসকে দিয়ে, অর্থ দিয়ে হজরতের প্রতি ঢিল ও প্রস্তর নিক্ষেপের জন্য লেলিয়ে দিল।
সামাজিক পবিত্রতা বজায় রাখার জন্য তিনি যখন অশ্লীল আচরণ ও ব্যভিচারের বিরুদ্ধে কথা বললেন, সব অশ্লীলতা ও নগ্নতাপ্রিয় মানুষ—ইসলামবিরোধীদের কাতারে গিয়ে দল ভারি করল। এভাবে পদে পদে মহানবী (সা.) ও ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের অন্যায়কারীদের বিরোধিতা ও জুলুমের শিকার হতে হয়েছিল।
একইভাবে এ যুগেও পৃথিবীর যে কোনো ভূখণ্ডেই হোক, কেউ মহানবীর (সা.) সাম্য, ন্যায়নীতি ও জীবন আদর্শের অনুসারী বলে দাবি করলে এবং সমাজে ইনসাফ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলে এটা অবধারিত যে, তারা যত ভালো মানুষই হোন না কেন প্রতিষ্ঠিত সমাজের স্বার্থপর মহল থেকে তাদের বিরোধিতার সম্মুখীন হতেই হবে। সে বিরোধিতার মোকাবিলা করে ঈমানি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া এবং সমাজের বঞ্চিত মানুষদের ভাগ্যোন্নয়ন ও তাদের ইহ-পরকালীন মুক্তির জন্য বজ্রকঠোর শপথ গ্রহণ করার মধ্যেই মুসলমানিত্বের দাবি ও নবী-জীবন ভিত্তিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সার্থকতা নিহিত।
আজ সব মাসুলিম রাষ্ট্রের জনগণ চায় এক পথে চলতে আর ওই শিক্ষা-সংস্কৃতির কোলে লালিত একশ্রেণীর নেতৃত্ব চায় তাদের ভিন্ন পথে নিয়ে যেতে। পরাধীনতার নাগপাশমুক্ত হওয়ার পর থেকে মুসলিম দেশগুলোর সর্বত্রই জীবনবোধ এবং দৃষ্টিভঙ্গিগত এ সংঘাতই চলে আসছে। সর্বাত্মক বিপ্লবের নায়ক মহানবীর জীবনাদর্শকে সমাজে প্রতিষ্ঠায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সবাইকে আজ নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে প্রয়োজনীয় যোগ্য লোকের সংখ্যা বৃদ্ধিতে অধিক তত্পর হতে হবে। এই সংখ্যা বৃদ্ধির দ্বারাই পাশ্চাত্যের জড়বাদী ধ্যান-ধারণাবিশিষ্ট নেতৃত্ব এবং সাধারণ মুসলিম জনতার মধ্যকার চিন্তাগত দ্বন্দ্বের অবসান ঘটা সম্ভব। ষ


লেখক :জু ল ফি কা র আ হ ম দ কি স ম তী
সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক, ইসলামী চিন্তাবিদ

No comments:

Post a Comment