Friday, March 25, 2011

চাই নামাজ উপযোগী কোরআন শিক্ষা

দি দা র উ ল আ ল ম
ঈমানদার মুসলমান হলেও আমাদের অনেকে ১. যথাযথ সহিহভাবে কোরআন পড়তে জানেন না। শৈশবে শিখলেও পরবর্তীকালে নানাবিধ ব্যস্ততার কারণে না পড়ায় এখন মাঝে মধ্যে পড়লেও আগের মতো আর সহিহ-শুদ্ধ হয় না। ২. কোরআন আগে শিখলেও না পড়ার কারণে ভুলে গেছেন। ৩. ভুলে গেছেন মনে করে এখন আর কোরআন পড়েন না এবং সহিহ-শুদ্ধতা যাচাইয়ের ব্যাপারে কারও শরণাপন্নও হন না বা কোনো পদক্ষেপও গ্রহণ করেন না এবং ৪. এমনও অনেকে আছেন যারা কোরআন পড়া মোটেই শিখেননি, কোরআন পড়তেই জানেন না।
এ দেশের বেশিরভাগ মুসলমান শুনে শুনে নামাজ আদায়ের উপযোগী কিছু সূরা-কেরাত শিখে তা দিয়ে নামাজ আদায় করে তৃপ্তি লাভ করে থাকলেও সূরা-কেরাতগুলোর শুদ্ধাশুদ্ধি যাচাইয়ের জন্য কাউকে শোনানোর প্রয়োজন মনে করেন না। অথচ নামাজ যথারীতি আদায় করলেও নামাজের মধ্যে কেরাত অশুদ্ধ পড়লে, সূরা অশুদ্ধ পড়লে যে নামাজ ভঙ্গ হয়ে যায়, নামাজ হয় না, এটুকু তিনি জানার প্রয়োজনও মনে করেননি, কেউ হয়তো যথাযথ গুরুত্ব সহকারে তা তাকে জানায়নি। যারা সমাজসেবক হিসেবে সমাজসেবায় আর শিক্ষানুরাগী হিসেবে শিক্ষাক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে কিছুটা হলেও অবদান রাখছেন, সমাজসেবার আর শিক্ষার অংশ হিসেবে কোরআনবিমুখ আর কোরআন শিক্ষা বঞ্চিত অসহায় ও হতভাগ্যদের ব্যাপারে সমাজসেবী আর শিক্ষানুরাগীদের, জনপ্রতিনিধিদের, বিভিন্ন পর্যায়ের প্রধানদের বিশেষ করে সরকারের ন্যূনতম কিছুই কি করণীয় নেই?
যারা অর্থ সম্পদের মালিক এবং ক্ষমতা কর্তৃত্বের অধিকারী তাদের সমাজসেবায় আর শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের পাশাপাশি ধর্মের ব্যাপারেও কাজ করতে হবে। কারণ স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টির প্রয়োজনে দুনিয়ার কথা যেমনি বলেছেন, তেমনি বলেছেন আখেরাতের কথাও। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘আর মানুষের মধ্যে এমন লোকও আছে যে বলে—হে আমাদের প্রভু! এ দুনিয়াতেই আমাদের দাও। বস্তুত আখেরাতে তার জন্য কোনো অংশ নেই। তাদের মধ্যে এমন লোকও রয়েছে যে বলে, হে আমাদের প্রভু! এ দুনিয়াতে আমাদের কল্যাণ দাও এবং আখেরাতের কল্যাণও দাও আর আমাদের দোজখের আগুন থেকে রক্ষা কর। এদের জন্য অংশ রয়েছে এরা যা অর্জন করেছে তাতে’ (সূরা বাকারা : ২০০ থেকে ২০২ আয়াত)। কাজেই ধর্মের জন্য, কোরআনের শিক্ষার জন্য, ধর্মীয় শিক্ষার প্রচার ও প্রসারে, বিশেষ করে নামাজ সহিহভাবে আদায় উপযোগী শিক্ষায় সাধারণ মানুষকে শিক্ষিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে, কর্মসূচি চালু করতে হবে। বিত্তশালী এবং কর্তৃত্বের অধিকারীরা ধর্মের ব্যাপারে ন্যূনতম কিছু কাজ না করলে শেষ পরিণতি হবে আফসোসের। আল্লাহর আগাম ঘোষণা হচ্ছে, ‘হায়! মৃত্যুই যদি আমাকে শেষ করে দিত! আমার ধন-সম্পদ আমার কোনো কাজেই এলো না। আর আমার ক্ষমতা-প্রতিপত্তিও আমার থেকে বরবাদ হয়ে গেল’ (সূরা হাক্কাহ : ২৭ থেকে ২৯ আয়াত)।
কোরআন শিক্ষাসহ ধর্মীয় শিক্ষার প্রচার ও প্রসারে এবং নামাজ শেখার ব্যাপারে সরকার, সমাজসেবক, শিক্ষানুরাগীসহ সংশ্লিষ্ট সবার নজর দেয়া অতীব প্রয়োজন। কোনোরকম অবকাঠামো নির্মাণ ছাড়াই ওই কাজটি অনায়াসে আনজাম দেয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে যা জরুরি তা হচ্ছে শুধু একটু সচেতনতা, একটু উদ্যোগ, একটু চিন্তা-ফিকির। পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও সময়-সুযোগের আলোকে কাজটি শুরু করার ক্ষেত্রে নিজের পদ্ধতিই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি। কর্মসূচির আওতায় যা থাকবে তা হচ্ছে স্রেফ নামাজ সহিহভাবে আদায় উপযোগী ব্যবস্থা তথা আরবি ২৯টি হরফের পরিচয়, সূরা ফাতিহাসহ ৪ থেকে ১০টি সুরা (দুর্বল ব্যক্তিবিশেষের জন্য প্রয়োজনে সূরা ফাতিহা ও মাত্র ৪টি সূরা), তাকবিরে তাহরিমা (নামাজ শুরুর আল্লাহু আকবার) থেকে নামাজ শেষের আচ্ছালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ্ পর্যন্ত ভেতরের প্রয়োজনীয় দোয়া-দরুদগুলো শেখানোর ব্যবস্থা; সঙ্গে থাকবে সহজ সরল বাংলা, গণিত (সাধারণ হিসাব-নিকাশ) এবং ইংরেজি (ব্যক্তিবিশেষের জন্য) শিক্ষা। কর্মসূচি বাস্তবায়নে দৈনিক বাঁধাধরা সময় নির্ধারণ না করে স্থান-কাল-পাত্র ভেদে দৈনিকের পরিবর্তে অর্ধ-সাপ্তাহিক বা সাপ্তাহিক সময় নির্ধারণ করা যেতে পারে সর্বোচ্চ ১ ঘণ্টা সময়ের জন্য।
ওই কর্মসূচি বাস্তবায়নে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রাইমারি, হাই স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় বয়স্ক শিক্ষার আদলে এ কার্যক্রম শুরু করে শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিবর্গকে ইমাম, মোয়াজ্জিন এবং শিক্ষকদের কাজে লাগাতে পারে, জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করা এবং উপজেলা কর্মকর্তাদের তদারকির দায়িত্বও দেয়া যেতে পারে। রাজনৈতিক অফিসে, বিভিন্ন ক্লাবে, সামাজিক সংগঠনের অফিসে, বাজারে ও মসজিদে এ কর্মসূচি চালু করা যায়। এনজিওদের সব কাজ ঠিক রেখে সঙ্গে সরকার নিয়ম করে দিয়ে ওই কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য নির্দেশ দিতে বা অনুরোধ করতে পারেন। যিনি সহিহভাবে কোরআন পড়তে পারেন, ব্যক্তিগত উদ্যোগে তিনি বাড়িতে, পরিবারে, অফিসেও এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে পারেন। এ প্রসঙ্গে দুটি বর্ণনা অতীব জরুরি—১. আবু মুসা (রা.) থেকে বর্ণিত যে, একদিন রাসুল (সা.) তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে নামাজ পড়ে বসলেন। এ সময় এক ব্যক্তি এসে তাড়াতাড়ি রুকু-সিজদা করে নামাজ পড়ল। রাসুল (সা.) বললেন, তোমরা ওই ব্যক্তিকে দেখতে পাচ্ছ? সে যদি এ অবস্থায় মারা যায় তবে মোহাম্মদের (সা.) উম্মতের বহির্ভূত অবস্থায় মারা যাবে (সহিহে আবু বকর বিন খুজাইমা)। ২. হজরত হুযায়ফা (রা.) এক ব্যক্তিকে দেখলেন ভালোভাবে রুকু-সিজদা না করে নামাজ পড়ছে। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, এভাবে কতদিন যাবত্ নামাজ পড়ছ? সে বলল, ৪০ বছর। তিনি বললেন, ‘তুমি ৪০ বছর যাবত্ কোনো নামাজই পড়নি। এ অবস্থায় মারা গেলে তুমি অমুসলিম অবস্থায় মারা যাবে।’ কোরআন ও হাদিসের আলোকে এটুকু সুস্পষ্ট যে কোরআন শেখা সহজ। এছাড়া আরবি ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা তিন কারণে আরবিকে ভালোবাস—১. আমি আরাবি, ২. কোরআনের ভাষা আরবি ও ৩. জান্নাতিদের ভাষা আরবি’ (হাদিস)। আমরা জানি চ এর স্থলে ঋ দিলে নাম্বার পাওয়া যায় না, ব-এর স্থলে ভ দিলে অর্থ পাল্টে যায়, আরবি হরফ একটির স্থলে আরেকটি পড়লে কি সওয়াব পাওয়া যাবে? কাজেই মুসলমান হিসেবে মাত্র ২৯টি আরবি হরফ সম্পর্কে আমাদের জানতে হবে, জানাতে হবে, নামাজ আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়ার জন্য হলেও আমাদের কোরআন শিখতে হবে। নামাজ পড়া এবং পরিবার-পরিজনকে, অধিনস্থদের নামাজের আদেশ দেয়া আল্লাহর সুস্পষ্ট নির্দেশ। আল্লাহ বলেন, ‘পরিবার-পরিজনকেও নামাজের নির্দেশ দাও এবং নিজেও এতে অবিচল থাক’ (সূরা ত্বহা ১৩২ আয়াত)। আল্লাহ আমাদের ওই ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করার, কাজ করার, নামাজ উপযোগী কোরআন শিক্ষা কর্মসূচি চালু করার এবং সহিহ তরিকায় নামাজ শেখার ও শিক্ষা দেয়ার তৌফিক দিন। আমিন। ষ
লেখক : শিক্ষাবিদ ও সাংবাদিক

ইসলামে দাওয়াতের গুরুত্ব

ড. মু. বি লা ল হু সা ই ন


ইসলামে দাওয়াতের গুরুত্ব্ব অপরিসীম। যে কারণে অসংখ্য নবী-রাসুল এ পৃথিবীতে আগমন করেছেন। ‘দাওয়াহ’ আরবি শব্দ। যার শাব্দিক অর্থ—আহ্বান করা, ডাকা। পরিভাষায় সব মানব সমাজকে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সুখ-শান্তি, কল্যাণ ও মুক্তি লাভের উদ্দেশ্যে পরিচালিত কার্যক্রমকে ইসলামে দাওয়াত হিসেবে গণ্য করা হয়। এ দাওয়াত মানুষকে অশান্তি থেকে শান্তির দিকে, অকল্যাণ থেকে কল্যাণের দিকে, সঙ্কীর্ণতা থেকে উদারতার দিকে, জাহান্নাম থেকে জান্নাতের দিকে এবং পশ্চাত্পদতা থেকে প্রগতির দিকে ধাবিত করে। আল্লাহর সঙ্গে মানব জাতির সম্পর্ক দৃঢ় করতে দাওয়াত সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
ইসলামী দাওয়াতের কর্মসূচি আল্লাহর পক্ষ থেকে মানবজাতির জন্য এক বিরাট নিয়ামত। তিনি মানবজাতির মধ্য থেকে কিছু লোককে বাছাই করে দাওয়াতের জন্য মনোনীত করেছেন। তাদের আল্লাহ তায়ালা বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন। পৃথিবীর প্রথম মানব ও নবী হজরত আদম (আ.) এ দাওয়াতের কার্যক্রমের সূচনা করেন। পরবর্তী সময়ে হজরত নূহ, হুদ, সালিহ, ইয়াকুব ও ইউসুফ (আ.) থেকে হজরত ঈসা (আ.) পর্যন্ত অসংখ্য নবী-রাসুলের মাধ্যমে এ ধারা অব্যাহত রাখেন। তারা আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আসা বাণীগুলো সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতেন।
মহানবীর (সা.) দাওয়াত ছিল সার্বজনীন। পূর্ববতী নবী ও রাসুলরা বিশেষ কোনো গোত্র, গোষ্ঠী বা অঞ্চলের অধিবাসীকে দাওয়াত দিয়েছেন। ফলে তাদের দাওয়াত সার্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্য হয়নি। মহানবী (সা.) সব জাতি-গোষ্ঠীর কাছে আল্লাহ প্রদত্ত দাওয়াত দিয়েছেন। মহান আল্লাহ তায়ালা এ জন্যই তাকে ঘোষণা দেয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘আপনি বলুন, হে মানবমণ্ডলী! আমি তোমাদের সবার প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত রাসুল’ (সূরা আল-আ’রাফ : ১৫৮)। তাঁর অবর্তমানে দাওয়াতের এ গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয় মুসলিম উম্মাহর প্রতি। যারা কিয়ামত পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখবে।
সমাজের সব ধরনের অন্যায়, অবিচার, পাপাচার, মারামারি, দুর্নীতি, ব্যক্তি চরিত্র নষ্টসহ সব অপরাধ নির্মূলে ইসলামী দাওয়াত বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে। কেননা, এ দাওয়াতের মূল বিষয়বস্তু হলো সত্ কাজের আদেশ এবং অসত্ কাজের নিষেধ। সেহেতু ব্যক্তি সব ধরনের অন্যায় কাজ থেকে বিরত থেকে সমাজে সুবিচার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করবে। পাপাচারযুক্ত এ সমাজে ইসলামী দাওয়াতই মানব সমাজের কাছে আশার আলো প্রজ্বলিত করতে পারে।
পৃথিবীকে সবার কাছে সুন্দর করতে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে খিলাফতের দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। এ দায়িত্ব সুন্দরভাবে পালনের জন্য মুসলিম উম্মাহর উপর দাওয়াতি ও তাবলিগের কাজ ফরজ করে দিয়েছেন। এ দায়িত্ব পালনে পবিত্র কোরআনে দায়ীদের উত্সাহিত করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তাঁর কথার চেয়ে কার কথা উত্তম হতে পারে, যে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়, সত্কর্ম করে এবং বলে আমি মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত’ (হা-মীম আস সাজদাহ : ৩)। আল্লাহ তায়ালা অন্যত্র বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে অবশ্যই এমন একটি দল থাকতে হবে, যারা মানব জাতিকে কল্যাণের দাওয়াত দেবে, সত্কাজের আদেশ করবে এবং অসত্কাজে নিষেধ করবে, তারাই সফলকাম’ (আলে ইমরান : ১০৪)।
দাওয়াতি কার্যক্রম একটি চলমান প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়া থেকে বিরত থাকার কোনো সুযোগ মুসলিম উম্মাহর নেই। সব ধরনের অন্যায়-অবিচারে পৃথিবী যখন জর্জরিত তখনই অবিরাম দাওয়াতি কার্যক্রমই পারে বিপন্ন মানবতাকে মুক্তির সন্ধান দিতে। মানুষকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে দাওয়াতে বিকল্প কিছুই নেই। এ দাওয়াতের মাধ্যমে সমাজ-দেশ-জাতি-রাষ্ট্রের মধ্যে বসবাসকারী মানবতা মুক্তি ও কল্যাণ লাভ করতে পারে। এতে ছেদ পড়লে মানব সমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে। মহানবীও (সা.) এ বিষয়ে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেন, আমি সেই সত্তার শপথ করে বলছি, যার হাতে রয়েছে আমার প্রাণ, অবশ্যই তোমরা সত্কাজের নির্দেশ দেবে এবং অসত্ কাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখবে। নতুবা তোমাদের ওপর শীঘ্রই আল্লাহ শাস্তি অবতীর্ণ করবেন। তখন তোমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানাতে থাকবে কিন্তু তোমাদের প্রার্থনা কবুল করা হবে না। (তিরমিজি)
অতএব সামাজিক অশান্তি দূর করা ও মানবতার মুক্তির জন্য সবাইকে একযোগে দাওয়াতি কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে হবে। নিজেদের পরিশুদ্ধ হতে হবে এবং অন্যদের মাঝে চিন্তার পরিশুদ্ধি ঘটাতে হবে। তবে আমরা নতুন প্রজন্মের মাঝে একটি কল্যাণময় সমাজ উপহার দিতে সক্ষম হবো এবং পরকালে লাভ করতে পারব চূড়ান্ত সফলতা। ষ
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

ইসলাম এবং সহিষ্ণুতার সৌন্দর্য

 খা লি দ বে গ


খলিফা হজরত উমর বিন খাত্তাব (রা.) যখন মৃত্যুশয্যায়, তিনি তার পরবর্তী খলিফার উদ্দেশে নানা নির্দেশ ও উপদেশ সংবলিত একটি দীর্ঘ অসিয়তনামা (উইল) প্রণয়ন করে গেলেন। সেই ঐতিহাসিক দলিলের সর্বশেষ বাক্যটি হলো, ‘জনগণের পক্ষ থেকে আমি তোমাকে এই নির্দেশ দান করছি যে, আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের (সা.) নামে যাদের নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে তাদের ব্যাপারে কর্তব্যবিমুখ হয়ো না; অর্থাত্ (ইসলামী রাষ্ট্রে যারা অমুসলিম সংখ্যালঘু বা জিম্মি) তাদের সঙ্গে আমাদের যে চুক্তি তা কখনও লঙ্ঘন করো না, তাদের নিরাপত্তা রক্ষায় আমরা অবশ্যই সর্বাত্মকভাবে সচেষ্ট থাকব এবং তাদের ওপর এমন ভার চাপানো যাবে না, যা বহন করতে তারা অক্ষম।’
এই নির্দেশনামা যখন লেখা হচ্ছিল, সায়্যিদানা উমর (রা.) তখন যন্ত্রণাগ্রস্ত অবস্থায় শয্যাশায়ী। ফজরের সালাতে ইমামতি করার সময় এক অমুসলিম তাকে বিষমাখানো ছোরা দ্বারা আঘাত করে। এই মারাত্মক ছুরিকাঘাতে আহত অবস্থায় তিনি আলোচ্য অসিয়াতনামাটি লিপিবদ্ধ করান। মনে রাখা আবশ্যক, উমর ফারুক (রা.) তখন এমন এক বিশাল সাম্রাজ্যের শাসক, যে সাম্রাজ্য মিসর থেকে পারস্য পর্যন্ত বিস্তৃত। নিশ্চয়ই এই প্রশ্ন স্বাভাবিক যে, দুশমন কর্তৃক আক্রান্ত অবস্থায় তার সময়ের এবং আমাদের এই সময়েরও একজন সাধারণ শাসকের প্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে? অবশ্যই দ্রুত প্রতিশোধ গ্রহণ। (আজকালের ‘প্রাজ্ঞ ও জ্ঞানদীপ্ত’ শাসকরা তো হত্যা চক্রান্তে সত্যিই যুক্ত কি যুক্ত নয়, সে কথা সঠিকভাবে না জেনেই, শুধু সন্দেহবশতই বোমাবর্ষণ করে থাকে) একজন ক্ষমাশীল ও সদ্বিবেচক শাসকের কাছ থেকেও, খুব বেশি হলে আমরা শুধু এটুকু আশা করতে পারি যে, তিনি বিষয়টি ভুলে যাবেন ও ক্ষমা করবেন এবং সেটাই উচ্চতম আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হবে। কিন্তু সংখ্যালঘুদের সার্বিক নিরাপত্তা বিধান এবং তাদের ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের এই নির্দেশকে কি শুধুই অনন্য বলে অভিহিত করা যায়? না। কারণ অপর একটি বিষয় খুবই উল্লেখযোগ্য যে, মুসলিম ঐতিহাসিকদের অভিমত হলো, খলিফা উমরের এই নির্দেশনামা ছিল খুবই স্বাভাবিক। বিশেষ করে দেশের পর দেশ যখন মুসলিম শাসনাধীনে চলে আসছে এবং খলিফা নিজেই যখন তার শাসনামলে বিধির পর বিধি জারি করে সব নাগরিকের, জীবন সম্পদ ও ধর্মের সার্বিক নিরাপত্তা বিধানের একটি সুনিশ্চিত ও সুরক্ষিত আদর্শ স্থাপন করেছেন, তখন এই মৃত্যুকালীন অসিয়ত আদৌ অস্বাভাবিক কিছু নয়। বলা আবশ্যক, প্রতিষ্ঠিত এই আদর্শ মুসলিম বিশ্বে শতাব্দীর পর শতাব্দী একইভাবে অব্যাহত আছে।
অবশ্য সায়্যিদানা উমর (রা.) যা করেছেন, তা সবই রাসুলের (সা.) শিক্ষা ও জীবনাদর্শের বিশ্বস্ত প্রতিরূপ। আসলে সংখ্যালঘুদের জীবন, সম্পদ ও ধর্মপালনের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বিধান যে কোনো ইসলামী রাষ্ট্রের একটি ধর্মীয় কর্তব্য। কারণ সংখ্যালঘুদের ওপর যে কোনো ধরনের অবিচার-অত্যাচারের জন্য রাসুল (সা.) নিজে আখিরাতে অত্যাচারী মুসলমানের বিরুদ্ধে বিচার দাবি করবেন। আর ইসলামে যেহেতু ধর্মের ক্ষেত্রে কোনো জোরজবরদস্তি ও বাধ্যবাধকতার অবকাশ নেই, মুসলমানকে শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সবার প্রতি একই রকম ইনসাফ রক্ষা করা অবশ্যকর্তব্য।
এই শিক্ষার ফলেই মুসলিম শাসনাধীনে ধর্মীয় স্বাধীনতার এমন একটি মূল্যবান আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হলো, যে বিষয়ে কারও কোনো ধারণাই ছিল না। শুধু যে মুসলমানদের ইতিহাসই উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন বয়ে আনল তা নয়, ইসলামের সংস্পর্শে পুরো পৃথিবীর দৃষ্টিভঙ্গিই বদলে গেল। বিরুদ্ধ ধর্মমতের দমন, নিগ্রহ-নির্যাতন, হত্যাকাণ্ড (ঐড়ষড়পধঁংঃ) ইত্যাদি, যা অন্য সব সভ্যতার একটি কলঙ্কজনক সাধারণ বৈশিষ্ট্য, সেই বৈশিষ্ট্যে দেখা দিল এমন পরিবর্তন, যার ফলে নিপীড়ন-নির্যাতন থেকে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা অনেকখানি নিশ্চিত হলো এবং এরই ফলে ইহুদিরা খ্রিস্টানদের হাত থেকে এবং পূর্বাঞ্চলীয় খ্রিস্টানরা রোমান ক্যাথলিকদের নিপীড়ন থেকে অনেকটই রক্ষা পেল। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, উমাইয়াদের শাসনাধীন স্পেনে এবং আব্বাসীয় খেলাফতের অধীন বাগদাদে খ্রিস্টান ও ইহুদিরা সম্পূর্ণরূপে ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করত; আর এই যে পারস্পরিক ধর্মীয় সহাবস্থান, আগে তাদের মধ্যে কোনো সময়েই বিদ্যমান ছিল না।
উল্লেখযোগ্য যে, এই দৃষ্টান্তমূলক সহিষ্ণুতা ইসলামী শিক্ষার ফলেই গড়ে উঠেছে। ইসলামের মূল পয়গামই হলো, পার্থিব জীবন একটি পরীক্ষা। আমরা এখানে জাহান্নাম কি জান্নাতের যে পথ, তার যে কোনো একটিকেই গ্রহণ করতে পারি। নবী-রাসুলদের মানব সম্প্রদায়ের কাছে এই পয়গাম দিয়ে পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করার জন্যই প্রেরণ করা হয়েছে। তাঁদের এজন্য পাঠানো হয়নি যে, তাঁরা শক্তিপ্রয়োগে মানুষকে সঠিক পথে নিয়ে আসবেন। মুসলিমদের দায়িত্বও ঠিক একই রকম। তারা মানুষের কাছে ইসলামের যে প্রকৃত পয়গাম, সেটাই যথাসাধ্য পৌঁছে দেবে। তাদের কাজ ইসলামকে রদবদল করে মানুষের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলাও নয়, মানুষের নিজস্ব পছন্দকে দমন করে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করাও নয়। এই সঙ্গে এটা মনে রাখা আবশ্যক, আখিরাতের যে ফলাফল সেটা বিশ্বাসের (ঈমান) ওপর নির্ভরশীল। অতএব সব সত্ ও মহত্কর্মই পুরোপুরি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে, যদি সঠিক বিশ্বাস না থাকে। আর বিশ্বাস যেহেতু অন্তরের সম্পদ, এক্ষেত্রে কোনোরূপ শক্তিপ্রয়োগ চলে না।
এই ধারণা ভুল যে, অন্য যে কোনো ধর্মাবলম্বীরাও নিজ ধর্মকে অক্ষত রেখে ইসলামের অংশীদার হতে পারে। এরকম হলে, সহিষ্ণুতা অবলম্বনের ক্ষেত্রে মুসলমানদের যে আদর্শ, সেটা অবশিষ্ট পৃথিবীর বক্তব্যের সঙ্গে রীতিমত সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে। মার্মাডিউক পিকথল উল্লেখ করেন, ‘পশ্চিমা জাতিগুলো যে কিছুটা হলেও সহিষ্ণুতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে, সেটা তাদের ধর্মীয় বিধান পরিহার বা অস্বীকার করার সুফল, অথচ অন্যদিকে, মুসলমানদের ক্ষেত্রে ধর্মীয় আদর্শ শিথিল ও খর্ব হওয়ার কারণেই অসহিষ্ণুতার সৃষ্টি।’
পশ্চিমা বিশ্ব সামাজিক সাম্য ও মিলনের যে পথ তৈরি করেছে সেটা জনজীবন থেকে ধর্মের প্রভাবকে যথাসম্ভব নিশ্চিহ্ন করার ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং এই অর্জন, তাদের ধারণা, আলোচ্য বিষয়ে যথাযথ প্রচার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ফলেই সম্ভব হয়েছে। সুতরাং এটা স্মরণ রাখা উত্তম যে গত শতাব্দীতে সহিষ্ণুতার ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের যে বিশাল অগ্রগতি (যা অভিনন্দন লাভের যোগ্য), তাকে ইসলাম কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত নীতি-আদর্শের কাছে পৌঁছতে অনেক পথ ও সময় অতিক্রম করতে হয়েছে। প্রথমত, মুসলমানদের যে ব্যক্তিগত-পারিবারিক বিধান, সেটা পাশ্চাত্যে অস্বীকৃত; অথচ অমুসলিম সংখ্যালঘুদের ব্যক্তিগত বিধান ও অধিকার মুসলিম বিশ্বের কোথাও কোনোদিন এতটুকু ক্ষুণ্ন হয়নি। দ্বিতীয়ত, ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বত্রই মাইক্রোফোনে আজান প্রচারের কোনো অনুমতি নেই; অথচ মুসলিম বিশ্বে গির্জায় ঘণ্টাধ্বনি নির্বিঘ্নে ও যথানিয়মে প্রচারিত হচ্ছে। তৃতীয়ত, পাশ্চাত্য প্রচার মাধ্যমের যে বিশ্ববিস্তৃত ইসলামবৈরী পক্ষপাতদুষ্ট ও কুসংস্কারাশ্রিত ভূমিকা, সেই ভূমিকাও মৌলিক-অসহিষ্ণুতার বিশেষ কারণও পরিণতি। চতুর্থত, সাম্প্রদায়িক হিংসাশ্রিত অপরাধকর্ম পশ্চিমা জীবনধারার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, অবশ্য এই বিষয়টি সততই বেশ কৌশলে আড়ালে রাখা হয়। পঞ্চমত, ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ব্যাপারটি কখনোই খুব একটা গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয় না, যথেষ্ট প্রাধান্যও দেয়া হয় না। এ বিষয়ে একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যায় : ১৯৯৯ সালে মুসলমানদের অনুকূলে দুটি প্রস্তাব মার্কিন সিনেটে উত্থাপিত হলো। প্রস্তাবটির শীর্ষ নাম ছিল, ‘মুসলমানদের প্রতি ধর্মীয় সহিষ্ণুতা রক্ষাকল্পে সমর্থন’ (অ জবংড়ষঁঃরড়হ ঝঁঢ়ঢ়ড়ত্ঃরহম ত্বষরমরড়ঁং ঃড়ষবত্ধহবপ ঃড়ধিত্ফ গঁংষরসং)। কিন্তু সিনেটে যদিও প্রস্তাবটি পাস হলো, কিছু কিছু ইহুদি ও খ্রিস্টানের একগুঁয়ে চাপের কারণে উচ্চকক্ষে তা আর গৃহীত হলো না। ঘটনাটি ছিল ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর দুর্ঘটনার দুই বছর আগের। তারপর তো সবই আমূল বদলে গেল। আসলে সেপ্টেম্বরের ‘দৈব দুর্ঘটনাটি’ অভিনব বটে, তবে এর মধ্য দিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব তার বহু দিনের লালিত অসহিষ্ণুতা ও প্রতিহিংসা ক্রমবর্ধমান হারে অব্যাহত রাখার একটা ‘যৌক্তিক’ ভিত্তি দাঁড় করাতে সক্ষম হলো।
শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয়, অবশিষ্ট ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের’ কাছেও পরিস্থিতি প্রায় একই রূপ পরিগ্রহ করল। জার্মানি এবং ফ্রান্সের কথা উল্লেখ করতে পারি; সেখানে এখন সরকারি শক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় মুসলিম মহিলাদের মস্তক থেকে হিজাব ছিনিয়ে নেয়া হচ্ছে। এরপরও এই গোঁড়া-ধর্মান্ধরাই নারী অধিকার এবং সহিষ্ণুতার প্রবক্তা এবং তারা এখন সরব দাবি তুলেছে, ‘অসহিষ্ণুতা’ নিরসনকল্পে মুসলিম বিশ্বের শিক্ষাক্রমে যথোচিত পরিবর্তন আনতে হবে। যাই হোক, মুসলমানদের মধ্যে বিরাজমান যে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, সেটা কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নাটকীয়তা নয়; এটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি অপরিহার্য ধর্মীয় কর্তব্য। সব অসহিষ্ণুতার মোকাবিলায় তাদের প্রবল হয়ে উঠতে হবে, এমনকি সেই অবস্থার বিরুদ্ধেও যখন তা সহিষ্ণুতার ভান ও কপট ছদ্মবেশ মাত্র।
অনুবাদ : অধ্যাপক আবু জাফর

তাবলিগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা : মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস রহ. জীবনদর্শন

মাওলানা মোঃ আবুল হোসাইন পাটওয়ারী


ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে ভারতবর্ষের দিল্লি এলাকার সর্ব বিখ্যাত অলি নিজাম উদ্দিন রহ. মাজার এলাকায় বাস করতেন যুগশ্রেষ্ঠ আবেদ হজরত মাওলানা ইসমাইল রহ.। তিনি ছিলেন আবেদ ও মানবসেবক। তিনি যত বেশি মানবসেবা করতে পারতেন তত বেশি আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়া আদায় করতেন। তার পর্ণকুটিরে জন্মলাভ করেন বর্তমান বিশ্বখ্যাত বিশ্ব ইজতেমার অগ্রদূত হজরত মাওলানা ইলিয়াস শাহ আখতার রহ.। তিনি ১৩০৩ হিজরি সালে জন্মগ্রহণ করেন।
তার পূর্ব পুরুষরা ছিলেন ধর্মীয় ও সামাজিক নেতৃত্বের অগ্রদূত। তার জীবন অতিবাহিত হয় অনুকূল সামাজিক পরিবেশে। যার ফলে তিনি তার পূর্ব পুরুষদের চেয়ে অনেক বেশি খ্যাতি অর্জন করেন।
হজরত মাওলানা ইলিয়াস শাহ রহ. বাল্যশিক্ষা গ্রহণ করেন পিতা হজরত মাওলানা ইসমাইল রহ.-এর কাছ থেকে। ১৩১৪ হিজরিতে তিনি বড় ভাইয়ের সঙ্গে লেখাপড়ার জন্য নিজ গ্রাম ছেড়ে চলে যান। এ সময় তিনি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৩২৬ হিজরি সালে তিনি দাওরা হাদিস বিভাগ থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভ করেন। হাদিস শাস্ত্রে তিনি গভীর জ্ঞান অর্জন করেন।
১৩২৮ হিজরি সাল থেকে ভারতবর্ষের সাহারানপুর মাজাহিরুল উলুম মাদ্রাসায় শিক্ষকতার পদে যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। এখানে প্রায় ৮ বছর ধরে ইলমে দ্বীনের তালিম দেন। এরপর তার পিতা ও বড় ভাইয়ের ইন্তেকালের পরে এলাকাবাসীর অনুরোধে তিনি নিজ গ্রাম মেওয়াতে ইলমে দ্বীনের খেদমতে আত্মনিয়োগ করেন। তত্কালে মেওয়াত এলাকার অধিবাসীরা শিক্ষা-দীক্ষা, ঈমান-আমলে ছিল খুবই নগণ্য। তারা নাম মাত্র মুসলমান ছিলেন।
তাবলিগ জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা হজরত মাওলানা ইলিয়াস শাহ আখতার রহ. তার পিতা হজরত মাওলানা ইসমাইল রহ. প্রতিষ্ঠিত মক্তব পরিচালনার মাধ্যমে এলাকাবাসীর মধ্যে হেদায়াতমূলক কার্য পরিচালনা শুরু করেন। আর এরই সূত্র ধরে শুরু হয় মানুষকে ঈমান ও আমলের প্রতি আহ্বান। আর সেই আহ্বানকে আজকের বিশ্বের দরবারে তাবলিগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমা হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে, যা ১৯৪৪ সাল থেকে অদ্যাবধি আমাদের বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
হজরত মাওলানা ইলিয়াস শাহ আখতার রহ.-এর মানব কল্যাণ সাধনে তার নিজ এলাকা মেওয়াত অঞ্চলে ঈমান ও আমলের যে বিপ্লব সৃষ্টি করেছিলেন তার বাস্তব নমুনা আমাদের বাংলাদেশে ঢাকা শহরের উত্তরাঞ্চলে তুরাগ নদীর তীরে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ইজতেমার অনুষ্ঠানটি। মাওলানা ইলিয়াস শাহ রহ. তার দাওয়াতের মাধ্যমে মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন পরকালের চিন্তা-চেতনা আর আল্লাহ তায়ালার উপর দৃঢ়বিশ্বাস। আমরা দুনিয়াতে এসেছি আবার চলে যাব। কি নিয়ে যাব সেই সম্পদ তৈরির লক্ষ্যেই আজকের তাবলিগ জামাতের বিশ্বজোড়া আন্দোলন ও ইজতেমার অনুষ্ঠান। এখানে বিশেষ করে ঈমান, আমল ও দুনিয়ার কল্যাণ, আখিরাতের মুক্তির কথাগুলোই বয়ান করা হয়।
ইলিয়াস শাহ রহ.-এর মূল কথা ছিল হে মুসলমানেরা! তোমরা মুসলমান হও। মানব কল্যাণই ছিল তার জীবনের একমাত্র ব্রত। তাবলিগ জামাতের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সর্বোচ্চ ত্যাগ সাধনার মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত সফলতা অর্জন। অকৃত্রিম ভালোবাসা, অক্লান্ত সাধনা, সর্বোপরি ইখলাছ ও লিল্লাহিয়াতের পরাকাষ্ঠার কারণেই তাবলিগ জামাত আজ মানুষের হৃদয়রাজ্য জয় করতে পেরেছে। সর্বোচ্চ ত্যাগ ও সাধনার মাধ্যমে জীবনের কাঙ্ক্ষিত সফলতার পথে এগিয়ে চলাই তাবলিগ জামাতের মূল টার্গেট। তাই তো বাংলাদেশের বিশ্ব ইজতেমা তিন দিনের পরিবর্তে একই সময়ে দুই বারে ৬ দিনে উন্নীত করা হয়েছে।
তাই আমি বলছি যে, তাবলিগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মহান ব্যক্তি মাওলানা ইলিয়াস শাহ রহ. আজও আমাদের মাঝে চির বিদ্যমান হয়ে আছেন এবং ভবিষ্যতেও থাকবেন ইনশাআল্লাহ।
লেখক : শিক্ষক, খতিব।

বিশ্বাসের আলো ও সেক্যুলারিজম

এমএ করিম ইবনে মছব্বির
সেক্যুলারিজমের (ঝবপঁষধত্রংস) শাব্দিক অর্থ ধর্মনিরপেক্ষতা। আর আভিধানিক অর্থ শিক্ষা, রাজনীতি, নৈতিক মূল্যবোধ প্রভৃতিকে ধর্মের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখার মতবাদ। আমাদের দেশের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা সেক্যুলারিজমের সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে—কোনো ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব না করা, কোনো ধর্মের প্রতি বিদ্বেষভাব পোষণ না করা এবং যার যার ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনে অবাধ অধিকার। অভিধানের সংজ্ঞার সঙ্গে এই ব্যাখ্যার মিল কোথায়?
বস্তুত সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করতেই ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’ শব্দের এভাবে অপব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে যেন তারা কোনোভাবেই অনুভব করতে না পারেন যে, ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদের আবরণে তাদের ধর্মহীন মতবাদে দীক্ষিত করে তোলা হচ্ছে। নৈতিক মূল্যবোধে ন্যায়, অন্যায়, বৈধ, অবৈধ, পাক, নাপাক প্রভৃতি শিক্ষার উত্স হচ্ছে ধর্মীয় বিধিবিধান তথা শরিয়ত। অপরদিকে ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদ হচ্ছে নৈতিক মূল্যবোধবর্জিত একটি মতবাদ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, পাশ্চাত্যে লিভ টুগেদার বৈধ অধিকার বলে স্বীকৃতি পেয়েছে, আবার অরুচি ধরে গেলে যার যেদিকে ইচ্ছা চলে যাওয়ার অধিকারও সংরক্ষিত হয়েছে। এর চেয়ে আরও আশ্চর্যের বিষয়, সমকামিতার মতো ঘৃণ্য কাজকেও সেসব দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে বৈধতার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
এসবই হয়েছে ধর্মীয় প্রভাববিবর্জিত নীতিহীনতা তথা ধর্ম নিরপেক্ষতা থেকে। এর ফলে মানুষ আজ মনুষ্যত্ব তথা নৈতিক মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়েছে। মানুষ অনেক নিচে নেমে গেছে। একদিক থেকে আজকের মানুষের চেয়ে পশুরা অনেক পরিচ্ছন্ন, অনেক ভদ্র ও পবিত্র। কারণ প্রকৃতির অনুশাসন দ্বারা পশু শাসিত ও চালিত হয়। তারা প্রকৃতির বিধান কখনও লঙ্ঘন করে না। আসলে বিশ্বাসের বিধানমুক্ত হয়ে লোভ-লালসার পেছনে ছুটে গিয়ে মানুষ অনেক নিচে নেমে যেতে পারে। যে জাহিলিয়াত থেকে একদিন আল্লাহ মানুষকে মুক্ত করেছিলেন আজ মানুষ সেদিকেই ঝাঁপিয়ে পড়ছে।
আরবে ইসলামের পূর্ববর্তী সময়কে জাহিলিয়াত বলা হয়। মানুষ যখন তার চিন্তা-চেতনা, নীতি-আদর্শ, মানদণ্ড, মূল্যবোধ, বিধি-বিধান, প্রথা, রীতি-নীতি আরেক মানুষের কাছ থেকে গ্রহণ করে থাকে, তখন সেটাই হচ্ছে যাবতীয় উপাদানসহ পূর্ণ জাহিলিয়াত। পক্ষান্তরে আল্লাহপাক মানবজাতিকে হেদায়েতের জন্য যুগে যুগে প্রেরিত রাসুলদের প্রতি শরীয়তের যে বিধি-বিধান নাজিল করেছেন, তার অনুসরণ করাই হচ্ছে জাহিলিয়াত থেকে মুক্তির উপায়। ইসলামের অনুসারীদের তাই বিশ্বাসের আলোয় জীবনের পথে চলা ছাড়া উপায় নেই। আমরা অনেকেই নিজেকে মুসলমান বলে দাবি করি এবং সেইসঙ্গে নিজেকে ধর্ম নিরপেক্ষ মতবাদের অনুসারী বলেও গর্ব করি।
পক্ষান্তরে আল্লাহপাক বলেন, হে ইমানদাররা, তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবিষ্ট হও। (। আল্লাহ পাক আরও বলেন, হে ইমানদাররা, তোমরা আল্লাহকে যথাযথভাবে ভয় কর এবং তোমরা মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না। (আল-কোরআন)
উপরের উদ্ধৃত আয়াতগুলোর মর্ম হচ্ছে, ইসলাম গ্রহণ করলে সম্পূর্ণভাবেই করতে হবে। কাটছাঁট করার, অর্থাত্ সুবিধাজনক অংশটি গ্রহণ আর অপছন্দনীয় অংশটুকু বর্জন করার সুযোগ নেই। যারা আংশিকভাবে ইসলামকে মেনে চলতে চান, পার্থিব জীবনে তাদের জন্য লাঞ্ছনা আর কিয়ামত দিবসে কঠোর শাস্তি ছাড়া আর কী পরিণতি হতে পারে! প্রকৃতপক্ষে ইসলাম মানবজাতিকে পার্থিব জীবনের প্রতিটি বাঁকে চলার পদ্ধতি বলে দিয়েছে। এমন কোনো অঙ্গন নেই যেখানে ইসলামী বিধিবিধান ও আদেশ-নিষেধ প্রযোজ্য নয়। মানবজীবনে এর যে কোনো একটি অঙ্গনে ইসলামী বিধিবিধান অস্বীকার করলে তার ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে আল্লাহপাক বলেন, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, যেসব লোক তদানুযায়ী ফয়সালা করে না, তারা কাফির (আল কোরআন)।’ অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ পাক যা অবতীর্ণ করেছেন, তদানুযায়ী যারা ফয়সালা করে না, তারা ফাসিক-পাপাচারী (আল-কোরআন ২:৮৫)।’
বিশ্বাস ও আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিহীন চেতনার ধারক-বাহক ও আহ্বায়কদের পরিণাম সম্পর্কে মহানবী (সা.)-এর একটি বিখ্যাত হাদিস নিচে দেয়া হলো। প্রিয় নবী (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি জাহিলিয়াতের দিকে আহ্বান জানাবে, সে হবে জাহান্নামি। জনৈক সাহাবি (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.), নামাজ-রোজা আদায় করা সত্ত্বেও কি সে জাহান্নামি হবে? মহানবী (সা.) বললেন, হ্যাঁ নামাজ-রোজা আদায় করলেও এবং নিজেকে মুসলমান বলে দাবি করলেও তাকে জাহান্নামেই যেতে হবে (মুসনাদে আহমাদ, হাকিম)।
সাহাবায়ে কেরামরা (রা.) ছিলেন খাঁটি ইমানদার। তাদের সাধারণ ইবাদতও ছিল অত্যন্ত উচ্চমানের ও নিখুঁত। হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী জাহিলিয়াতের দিকে আহ্বান জানানোর মতো একটি অপরাধের কারণে তাদের জাহান্নামে যেতে হবে।
এ অবস্থায় ধর্ম নিরপেক্ষতার মতো মারাত্মক পথে থাকলে তার অবিলম্বে আল্লাহর কাছে তওবা করে সঠিক পথে ফিরে আসা অপরিহার্য।

অসহায় বিপন্ন মানুষের প্রতি তাকান

মা ও লা না শা হ আ ব দু স সা ত্তা র


ধনী-গরিব আল্লাহপাকের সৃষ্টি। বাহ্যিক দৃষ্টিতে আমরা প্রভূত অর্থ-সম্পদ অধিকারীকে ধনী বললেও আদতে সে ধনী নয়। আর স্বীয় অভাব মোচনের সামান্য পরিমাণ যার অর্থ, টাকা-পয়সা উপার্জনের ক্ষমতা নেই—এমন লোককে আমরা সাধারণত গরিব বলে থাকি। পবিত্র কোরআনে এ সম্পর্কে আল্লাহপাক বলেছেন। ওয়াল্লাহুল গানিয়্যুঅ আনতুমুল ফুকারাও। অর্থাত্ মহান আল্লাহপাকই একমাত্র ধনী আর তোমরা সবাই দরিদ্র বা গরিব। তাসাউফ শাস্ত্রের এ গরিবের ব্যাখ্যায় পবিত্র কোরআনের বিধিবিধানসম্মত হলেও ইসলাম গরিব-দুঃখী, অসহায়দের স্বার্থ সংরক্ষণ অধিকার বা হকগুলো ফরজ রূপে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। জাকাত, ফেতরা, সদকা ছাড়াও স্বাভাবিক নিয়মে দেশপ্রথা ও প্রচলিত রীতিনীতি অনুযায়ী গরিব, দুঃখী, অসহায়রা ধনাঢ্য, সামর্থ্যবানদের থেকে সাহায্য-সহযোগিতা পেতে পারে।
ইসলাম মানবসমাজকে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছে। একশ্রেণীর লোক ধন-সম্পদ ও অর্থের পাহাড় গড়বে। আর অন্য শ্রেণীর লোক দরিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত হবে—এ নিয়ম-নীতি ইসলাম কখনোই পছন্দ করে না। ইসলাম ধর্ম ধন-সম্পদ ও অর্থকড়ির ব্যাপারে উদারতা ও ইনসাফের মাধ্যমে গরিবের অধিকার ব্যাপকভাবে সংরক্ষিত করেছে। অন্যদিকে গরিব, দুঃখী মানুষের স্বাভাবিক জীবনধারণের জন্য ধনীদের প্রতি তাদের হককে নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। ইসলামী অর্থনীতিতে জাকাত, সদকা, ফেতরা ও দান-খয়রাত শুধু গরিব, অসহায় ও বিপন্ন মানুষের বেলায় প্রাপ্য এবং তা তাদের মৌলিক প্রাপ্য। গরিবদের মৌলিক অধিকার যেমন ইসলাম স্বীকার করেছে, পাশাপাশি তাদের মর্যাদাও দিয়েছে গুরুত্বসহকারে। এ সম্পর্কে হজরত রাসুলে পাক (সা.) হজরত বেলাল (রা.)-কে বলেছিলেন, ‘বেলাল, তুমি চেষ্টা করো যে, ইহলোক থেকে গরিব অবস্থায় যেতে পারো, ধনী-বিত্তবান ও অর্থশালী অবস্থায় যেতে চেষ্টা করো না।’ আল্লাহর নবী (সা.) আরও বলেছেন, ‘আমির অর্থাত্ ধনাঢ্য, বিত্তশালী লোকের ৪০ বছর আগে গরিব-দুঃখীরা বেহেশতে প্রবেশ করবে।’
‘রোজ কিয়ামতে আল্লাহ সুবহানাহুতায়ালা ফেরেশতাদের জিজ্ঞেস করবেন। দেখ তো আমার প্রিয় বান্দারা কোথায়। ফেরেশতারা আরজ করবেন, ইয়া আল্লাহ। কারা আপনার প্রিয় বান্দা। মহান আল্লাহপাকের পক্ষ থেকে উত্তর আসবে, তারা মুসলমান দরিদ্র লোক। যারা আমার দানে অর্থাত্ আমি যা দিতাম তাতে তারা পরিতৃপ্ত এবং সন্তুষ্ট ছিল, এসব লোককে বেহেশতে নিয়ে যাও।’
আমরা প্রতি মুহূর্তে মহান আল্লাহপাকের অগণিত নেয়ামত ভোগ করে আসছি। এর শুকরিয়া আদায় করে শেষ করা যায় না। দুনিয়ার জীবনে গরিব, অসহায়-দুস্থ মানুষের অধিকার ও সম্মান আল্লাহপাক প্রদান করেছেন, তেমন ধনাঢ্য-বিত্তবানদের তাদের প্রতি যথাযথ কর্তব্য পালনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তাই স্বাভাবিক নিয়ম ছাড়া বিশেষ করে জাকাত, সদকা, ফেতরা প্রদানের মাধ্যমে আমরা দুঃখভরা দরিদ্র, অসহায়, মিসকিন, দুস্থদের সাহায্য-সহযোগিতা করতে পারি। এ সম্পর্কে আমাদের প্রিয়নবী করীম (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা গরিব, অসহায়দের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন কর এবং তাদের প্রতি সাধ্য অনুযায়ী সাহায্যের হাত বাড়াও। পরোকালে তারাই তোমার ধন-সম্বল হবে। জেনে রাখ, দান-খয়রাতে অর্থ-সম্পদ বৃদ্ধি পায়।’ একবার সাহাবিরা হজরত রাসুলে পাক (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর নবী, যার সামর্থ্য নেই, সেই ব্যক্তি কীভাবে তার কর্তব্য পালন করবে। এর উত্তরে আল্লাহর নবী (সা.) বললেন, নিজের শক্তি দিয়ে, পরিশ্রম করে।’ সাহাবিরা আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘যদি সেরূপ কোনো সুযোগ না পায়, তাহলে কী করবে?’ আল্লাহর নবী (সা.) বললেন, ‘যেসব গরিব-দুঃখী, কষ্টে-বিপদে জর্জরিত, তাদের দান-খয়রাতের মাধ্যমে সেবা করবে।’
অতএব আসুন, যথাসাধ্য আমরা প্রতিনিয়ত গরিব, দুঃখী, অসহায়, বিপন্ন, ফকির, মিসকিন, এতিমদের সেবা ও সাহায্য-সহযোগিতায় হাত বাড়াই।ষ
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ, সিরাত মিশন।

জনপ্রতিনিধির জনসেবা

আ ব দু ল্লা হ মু কা র র ম


সেবা একটি মহত্ কাজ। ইসলাম এতে উত্সাহ যোগায় এবং সেবকের জন্য পুরস্কারের ঘোষণাও করে অনেক জায়গায়। সেবার পরিসর ছোট বা বড় যাই হোক না কেন তা পুণ্যের কাজ। সেবক নিয়ত ও ইখলাছ অনুপাতে ছওয়াবের ভাগী হয়। বাহ্যত দুনিয়াবি কাজও অনেক সময় সত্ নিয়তের কারণে ছওয়াবের কাজে পরিণত হয়। আবার অনেক ধর্মীয় কাজও নিয়তজনিত ত্রুটির কারণে ভেস্তে যায়।
জীবনের নানা সময়ে, নানা আনুকূল্য ও সেবার প্রয়োজনেই মানুষের সমাজবদ্ধ বসবাস। মানুষের লক্ষ্যে-অলক্ষ্যে পারস্পরিক সহমর্মিতা, সহযোগিতা ও সেবাই সমাজব্যবস্থা সচল থাকে। সেবার সে মানসিকতা লোপ পেলে সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে যায়। সমাজে বিশৃংখলা, নৈরাজ্য ও শোষণের মহামারী পরিলক্ষিত হয়। ইতিহাস সাক্ষী? ইসলামপূর্ব জাহেলি যুগে অঞ্চল ও গোত্রসর্বস্ব সমাজ বিদ্যমান থাকলেও তা ছিল আধিপত্য বিস্তার, হিংসা-বিদ্বেষ এবং পরশ্রীকাতরতার ভয়াল থাবায় জরাজীর্ণ। সে সমাজে ‘আমি, আমার ও আমাদের’ ছাড়া আর কারও কথা ভাবার সুযোগই ছিল না। সে পৈশাচিক সমাজকে ইসলাম যখন মানবতার দীক্ষা দিল। ‘আমি ও আমরা’-এর সঙ্গে অন্যকে নিয়েও ভাবতে শেখাল? তখন সে সমাজের হিংস্র মানুষগুলো ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হলো। সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে এল। সমাজ হলো কল্যাণমুখী।
আমাদের ঘুণেধরা এ জীর্ণশীর্ণ সমাজকে ফলপ্রসূ, সুশৃঙ্খল ও কল্যাণমুখী করতে সেবকের প্রয়োজন, যারা নিজেদের পাশাপাশি অন্যদের নিয়েও ভাববে, বরং অন্যদের বিষয়কেই প্রাধান্য দেবে। নবী করীম সা. ইরশাদ করেন, ‘জাতির নেতা তাদের সেবক’। আমাদের সমাজ ও সরকার ব্যবস্থাকে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনার জন্য প্রচলিত ধারায় গণতান্ত্রিক নিয়মে কয়েকটি স্তরে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয়। তাদের প্রধান পরিচয় ‘জনপ্রতিনিধি’। বিধিমতে জনসেবা করাই তাদের কাজ। জনগণের সমস্যা সমাধান করা, তাদের সার্বিক কল্যাণের পথকে সুগম করার লক্ষ্যে সরকারের উচ্চমহলের দৃষ্টি আকর্ষণের মাধ্যমে তাদেরই সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা। নির্বাচনপূর্ব প্রচারণায় সবারই প্রতিশ্রুতি তাই প্রমাণ করে। সম্প্রতি পৌরসভা নির্বাচন হতে চলেছে। আশা করা যাচ্ছে, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হবে শিগগিরই। তাই সেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যারা সেবক হিসেবে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন, তারা তাদের সেবাকে সুন্দর ও সার্থক করতে অতীতের সে সব মহামনীষীগণের সেবাকর্ম দেখে নিতে পারেন, অদ্যাবধি পৃথিবীবাসী যাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। যাদের নিয়ে আমরা নিজেরাও গর্ব করি।
১. হজরত আবু বকর রা. ইসলামের প্রথম খলিফা। তিনি মক্কার বিশিষ্ট ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন। ইসলাম গ্রহণের পর তার সমুদয় সম্পদ দ্বীনি কাজে ব্যয় করেছেন। খলিফা হওয়ার পরও ইসলামী খেলাফতের এ বাদশা জীবিকার সন্ধানে কাপড়ের গাট্টি মাথায় নিয়ে বাজারে ছুটছেন। পথে হজরত ওমরের সঙ্গে সাক্ষাত্। জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাচ্ছেন? আপনি এখন রাষ্ট্রপ্রধান। ব্যবসার উদ্দেশ্যে বাজারে যাওয়ার সুযোগ আর নেই। রাষ্ট্রের প্রতিটি মানুষের সব দায়িত্ব এখন আপনার। আপনি রাষ্ট্রের কাজে ব্যস্ত থাকবেন, আর রাষ্ট্র আপনার প্রয়োজন মেটাবে। এর পর তার যত্সামান্য ভাতা নির্ধারণ করা হয়। এর উপরই সন্তুষ্ট থেকে অবশিষ্ট জীবন পার করে দেন। অতঃপর মৃত্যুশয্যায় ওয়ারিশদের অসিয়ত করে গেলেন, ‘বায়তুলমাল থেকে গৃহীত সমুদয় ভাতা আমার সম্পত্তি থেকে ফিরিয়ে দেবে’। বাস্তবে হয়েছিলও তাই।
২.ক. হজরত ওমর রা.। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা, অর্ধজাহানের সফল শাসক। তাঁর সাধারণ নিয়ম ছিল, রাতের আঁধারে ছদ্মবেশে ঘুরে ঘুরে প্রজাদের প্রকৃত অবস্থা জানা। একদিন রাতে হাঁটছেন। দূরে খোলা ময়দানে কাতর কণ্ঠ শুনে এগিয়ে গেলেন। দেখেন, মুসাফির দম্পতি, স্ত্রী প্রসব ব্যথায় কাতরাচ্ছে। তাদের সহযোগিতার কেউ নেই এবং অতীব প্রয়োজনীয় আসবাবপত্রও নেই। স্বামী এ অবস্থায় স্ত্রীকে একা রেখে কোথাও যেতে পারছে না এবং কোন কিছুর ব্যবস্থাও করতে পারছে না। তাই কোনো ত্রাণকর্তার প্রতীক্ষায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পথ চেয়ে আছে। হজরত ওমর রা. দৌড়ে বাড়ি এসে স্ত্রীকে বললেন, চল চল, আজ তোমার মহাপুণ্যের সুযোগ হয়েছে। অতঃপর খলিফার স্ত্রী ধাত্রীর কাজ সমাধা করলেন আর খলিফা নিজে বাইরে অন্যান্য কাজের আন্জাম দিলেন।
খ. অন্য আরেক দিনের ঘটনা। প্রজাদের অবস্থা জানতে রাতে তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এক ঘর থেকে বাচ্চাদের করুণ আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। শিশুদের অবিরাম আর্তনাদে মহিলাকে ওমর ভর্ত্সনা করলেন, তুমি কেমন মহিলা যে, মা হয়েও শিশুদের থামাতে পারছ না! ভেতর থেকে মহিলা গর্জে ওঠল, তুমি কে? তোমার পথে তুমি যাও। উপদেশ খয়রাত করতে হবে না। আমার ঘরে কয়েকজন এতিম শিশু আছে অথচ তাদের খাবারের কোনো ব্যবস্থা নেই। আগুন জ্বালিয়ে খাবারের মিথ্যা দোহাই দিয়ে শিশুদের আর কতক্ষণ থামিয়ে রাখা যায়?
খলিফা ওমর দৌড়ে বায়তুল মালে গিয়ে প্রয়োজনীয় খাবার বস্তাভর্তি করে গোলামকে বললেন, এটা আমার কাঁধে তুলে দাও। গোলামের অবাক প্রশ্ন। হুজুর আমি থাকতে আপনি কাঁধে নেবেন কেন? তিনি বললেন, কিয়ামত দিবসে আমার বোঝা তুমি কাঁধে নেবে না। তাই দুনিয়াতেও আমার বোঝা আমাকেই বহন করতে দাও। খলিফা নিজে বস্তা কাঁধে নিয়ে মহিলার বাড়ি গিয়ে হাজির। অতঃপর বললেন, মা! তুমি রুটি সেঁকো আর আমি বানিয়ে দিচ্ছি। এভাবে শিশুদের খাইয়ে আনন্দরত অবস্থায় রেখে আসার সময় মহিলা বলছিল, খলিফা ওমর কোথায়? আজ যদি আমার ক্ষমতা থাকতো তবে খেলাফতের মসনদ থেকে তাকে নামিয়ে তোমাকেই সেখানে বসিয়ে দিতাম। মহিলা আদৌ জানতো না যে, বস্তাবাহী সে ব্যক্তিটিই খলিফা ওমর।
আমাদের সমাজের এ বেহাল দশায় সমাজ বিনির্মাণে এমন জনপ্রতিনিধির প্রয়োজন, যারা হবেন প্রকৃত নিষ্ঠাবান সমাজসেবক। সমাজের প্রতিটি স্তরের প্রতিটি সদস্যের কামনা এমনই। পূর্বসূরিদের নিয়ে যারা গর্ব করেন, যাদের উত্তরসূরি হতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করেন, তাদের কাছে অন্যদের ব্যতিক্রম কিছু প্রত্যাশা ও চাওয়া তো থাকতেই পারে।
আমাদের জনপ্রতিনিধিদের মনে রাখতে হবে—মহানবী সা. ইরশাদ করেন, তোমরা সবাই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকে আপন দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেসিত হবে?

দাওয়াতের কাজ আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার মাধ্যম

— মাওলানা মুহাম্মাদ সা’দ
বিশ্ব ইজতিমা শুরু হয়েছে গত ২২ জানুয়ারি। ২৩ জানুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে শেষ হয়েছে ইজতিমার প্রথম পর্ব। আজ থেকে শুরু হচ্ছে ইজতিমার দ্বিতীয় পর্ব। ৩০ জানুয়ারি দ্বিতীয় পর্বের সমাপ্তির মাধ্যমে শেষ হবে এবারকার বিশ্ব ইজতিমা। এবারই বিশ্ব ইজতিমা বাংলাদেশে দুই পর্বে অনুষ্ঠিত হলো। প্রথম পর্বে ২২ জানুয়ারি মাগরিবের নামাজের পর বিশ্ব তাবলিগ জামাতের শীর্ষ মুরুব্বি দিল্লি নিজামুদ্দিনের হজরত মাওলানা মুহাম্মাদ সা’দ যে গুরুত্বপূর্ণ বয়ান করেন সেটির অনুবাদ করেছেন লাবীব আবদুল্লাহ। বিশ্ব ইজতিমা বিষয়ক সংবাদ বুলেটিন ‘ইজতেমা প্রতিদিন’-এর সৌজন্যে সেটির নির্বাচিত অংশ তুলে ধরা হলো


দাওয়াত হলো আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার মাধ্যম। আকিদা-মুআমালা, মু’আশারা ও আখলাক ঠিক হবে দাওয়াতের মাধ্যমে। দ্বীন শুধু কল্পনার নাম নয়। প্রিয় নবীজী যা নিয়ে দুনিয়ায় প্রেরিত হয়েছেন তার সামগ্রিক এক চিত্রের নাম দ্বীন। তিনি সাহাবায়ে কেরামকে পূর্ণ দ্বীনের ওপর উঠিয়েছেন। সাহাবায়ে কেরাম হলেন দ্বীনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি। উম্মত যখন এই কাজ ছেড়ে দেবে তখন তারা অন্য জাতি ও ধর্মের দ্বারা মাদয়ু-আহূত হবে। তারা ভিন জাতির তাহজিব-তামাদ্দুনের আগ্রাসনের শিকার হবে। অন্যদের কৃষ্টি-কালচারের প্রতি তাদের ডাকা হবে। এই হালত থেকে নিত্যনতুন আধুনিক অনেক তরিকা বের করা হবে এবং হচ্ছে। কিন্তু উম্মাহ প্রথম যুগে যেভাবে যে কাজে ইসলাহ-সংশোধন হয়েছে, বর্তমান যুগেও সেভাবেই ইসলাহ হবে। অন্য কোনো তরিকায় হবে না অবস্থার পরিবর্তন। এই ফিকির ও ভাবনা ঠিক নয় যে দাওয়াতের কাজ শুধু নবীজী ও সাহাবায়ে কেরামের যুগের জন্য সীমিত ছিল। মূলত নবীওয়ালা এই কাজ সর্বকালের সবার জন্য। কিয়ামত পর্যন্ত সময়ের জন্য। উম্মত যদি সম্মিলিতভাবে এই কাজ ছেড়ে দেয় তাহলে তাদের ধ্বংস অনিবার্য। সম্মিলিতভাবে নয়, যদি ইনফেরাদি-ব্যক্তিগতভাবেও এ দাওয়াত ছেড়ে দেয়া হয় তাহলেও উম্মতের ক্ষতি হবে অপূরণীয়। এর প্রমাণ পাওয়া যায় প্রসিদ্ধ সাহাবি হজরত কা’ব ইবনে মালেকের (রা.) জীবনে। তিনি যদিও বদরি সাহাবি ছিলেন না, কিন্তু গাযওয়াতে তাবুকে তিনি যেতে পারেননি। এ ঘটনা প্রসিদ্ধ। এই না যাওয়ার কারণে পঞ্চাশ রাত তার জীবনে নেমে আসে দুঃখের ছায়া। তার ও তার দুই সাথীসহ দুঃখের মাঝে দিন কাটান। জমিন প্রস্তুত হওয়ার পরও তাদের জন্য হয়েছিল সংকীর্ণ। পুরো মদিনাবাসী তাদের বয়কট করেছিল। সালামের উত্তর দিত না। এ সময় গাস্সানের বাদশা তার নামে রেশমের কাপড়ে পত্র পাঠিয়ে তাকে দাওয়াত দেয় যে, তোমার সাথী তোমার ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করেছে। আমাদের পথে এসো। তিনি এই পত্র আগুনে জ্বালিয়ে দেন এবং বলেন, এক মুসিবত শেষ হওয়ার আগেই আরেক মুসিবত এসে হাজির।
সাহাবি হওয়া সত্ত্বেও তাকে গাস্সানের বাদশা দাওয়াত দিল। এ ঘটনা কিয়ামত পর্যন্ত সময়ের জন্য আমাদের জন্য শিক্ষা। দাওয়াত ছেড়ে শুধু আমল করলে দ্বীনের হেফাজত হবে না। দ্বীনের ওপর ইস্তেকামাত ও দ্বীনের হেফাজত নির্ভর করে অন্যকে দাওয়াত দেয়ার ওপর, দ্বীনের হেফাজত দাওয়াতের ওপর মাওকুফ-নির্ভরশীল। দাওয়াত না দিলে, বাতিল শক্তি এই উম্মতকে অন্য দিকে দাওয়াত দেবে।
ঈমান শিখতে হয়, ঈমানের মজলিস কায়েম করতে হয়। দাওয়াতের কাজে বুনিয়াদি সিফাত হলো ঈমানের সিফাত। কোরআন-হাদিসে মুমিনকে দাওয়াত দেয়ার কথা বলা হয়েছে। সাহাবায়ে কেরাম ঈমানের মজলিস কায়েম করতেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রা.) অন্য সাহাবিকে দাওয়াত দিয়ে বলতেন, এসো আমরা ঈমান আনি। অর্থাত্ ঈমানের আলোচনা করি। ঈমানের প্রতি দাওয়াত দেয়া প্রত্যেক মুমিনের দায়িত্ব, মুমিনের কাজ। প্রত্যেকেই অন্য কিছুর আলোচনা ছেড়ে আল্লাহ তায়ালার জাত ও সিফাত, তাওহিদ ও আল্লাহর বড়াইয়ের দিকে দাওয়াত দেবে। মজার বিষয় হলো, একজন আমাকে প্রশ্ন করলেন, ঈমানেরও কি আবার মজলিস হয়? এই মজলিস দ্বারা কি ঈমান শক্তিশালী হয়?
ইমাম বুখারি (রহ.) ঈমান শক্তিশালীকরণ বিষয়ে অধ্যায় সংযোজন করেছেন। হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) অন্য সাহাবিকে দাওয়াত দিতেন। তার মা’মুল ছিল তিনি বলতেন, এসো ঈমান আনি। এসো ঈমানের তাজদিদ-নবায়ন করি। কোরআন কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ঈমান আন। অর্থাত্ ঈমান বৃদ্ধি কর। মূলত ঈমান অনুযায়ী ইতাআত-আনুগত্য হবে। দিল হলো ঈমানের জায়গা। কালেমার মেহনতের জায়গা। আমরা অনেকেই মনে করি, কালেমার দাওয়াত শুধু অমুসলিমদের জন্য। এ ধারণা ঠিক নয়। মুমিনদেরও কালেমার দাওয়াত দিতে হবে।
আজ সর্বত্র আল্লাহর বড়ত্ব ও কুদরত ছাড়া বস্তুবাদী মাদ্দিয়াতের আলোচনা। আমাদের বস্তুবাদী আলোচনা ছেড়ে আল্লাহর কুদরতের আলোচনা করতে হবে। এক সাহাবিকে রাসুল (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, সকাল কীভাবে কাটিয়েছ? তিনি বললেন, ঈমানে হকের সঙ্গে, সঠিক ঈমানের সঙ্গে। তিনি বললেন, এর আলামত কী? তিনি বললেন, আরশ কুরসি আমার সামনে, কিয়ামতের বিষয়াদি আমাদের সামনে। আমার রূহকে দুনিয়া থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আখেরাতমুখী করেছি। নবীজী বললেন, তুমি ঈমানের পরিচয় পেয়েছ। এর ওপর অটল থাক। মূলত ঈমান এভাবে ছুটে যায় যেমন ছুটে যায় লাগামহীন উট। আমরা যেমন জামা খুলে ফেলি, ঈমানও তেমনিভাবে খুলে যায়। আমাদের ঈমানের আলোচনা বাড়াতে হবে, গালেব রাখতে হবে। সাহাবায়ে কেরাম ইলমের হালকা কায়েম করতেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) ইলমের হালকা কায়েম করে অন্যকে দাওয়াত দিতেন এবং বলতেন, মসজিদে নবীজীর মিরাস বণ্টন হচ্ছে, আর তোমরা বাজারে? উম্মতকে সাহাবায়ে কেরাম জুহদ ও মেহনতের কথা বলে ঈমানের দাওয়াত দিতে হবে। আমাদের দাওয়াতের উদ্দেশ্য হলো দুনিয়ার নানা পরিবেশ থেকে ঈমানের পরিবেশে আনা। যেখানে আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো কিছুর আলোচনা থাকবে না। বস্তুবাদী নকশা ছেড়ে ঈমান বিল গায়েবের বিষয়ে দাওয়াত দেয়া।
ঈমান কী? এ বিষয়ে রাসুল (সা.) জিজ্ঞাসিত হয়ে বললেন, তোমার নেক কাজ যদি তোমাকে খুশি করে, অসত্ কাজ যদি তোমাকে পেরেশানে ফেলে, তাহলে তুমি মুমিন। আমরা মনে করি, আমরা ঈমানদার। অথচ আমাদের আমল, আমাদের আখলাক, আমাদের ইবাদত, আমাদের মুআমালা, আমাদের মুআশারা ঈমানের খেলাফ। এক সাহাবির পক্ষ থেকে নবীজীর দরবারে গিবত হয়ে গেল। নবীজী বললেন, তুমি কোরআনের খেলাপ করলে। যে ব্যক্তি কোরআনের হারামকে হালাল ভাববে সে কোরআনের খেলাপ করল। আমাদের কালিমার ইখলাস হাসিল করতে হবে। ঈমান ও ইখলাস একই। কালেমার ইখলাস হলো হারাম থেকে বিরত থাকা। ঈমান হলো উটকে লাগাম লাগানোর মতো। এর দ্বারা উটকে যেভাবে ইচ্ছা পরিচালনা করা যায়। অনুরূপ মুমিন ঈমান দ্বারা পরিচালিত হবে।
দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে ঘোরাফেরা করা সাহাবায়ে কেরামের কাজ। সব উম্মতকে তাদের অঙ্গনে দাওয়াতের কাজ করতে হবে। দুনিয়ার কোনো প্রান্তে যদি আল্লাহর হুকুম লঙ্ঘন হয়, তাহলে তার মোকাবিলায় সবাইকে কাজ করতে হবে। অনেকেই মনে করে, দাওয়াতের কাজ অন্যান্য কল্যাণকর কাজের মতো একটি। এ ধারণাও ঠিক নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, আল্লাহর পথে দাওয়াতের কাজের মতো অন্য কোনো কাজ নেই। আমাদের এহসাস ও অনুভূতি খতম হয়ে যাচ্ছে। দাওয়াতের কাজ ছেড়ে দেয়া যে গোনাহ, এই অনুভূতিও নেই আমাদের মাঝে। আমাদের ইস্তেগফার করতে হবে এবং খোলাফায়ে রাশেদার মতো দাওয়াতের কাজ নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় বের হতে হবে।

মুমিনের আচরণে সৌজন্য সদাচার

মোহাম্মদ সদরুল আমীন রাশেদ


ব্যবহার মানব জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য উপাদান। মানুষের সঙ্গে উত্তম ব্যবহার ও ইসলামী শরীয়াহ পরিপালন পরস্পর সহধর্মী। একটিকে ছাড়া অন্যটির কথা চিন্তাও করা যায় না। তাই সবাইকে অবশ্যই ইসলামী শরিয়ার আলোকে চরিত্র গঠন করতে হবে। আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে জগতের সব মানুষ আমাদের কাছে সর্বোত্তম ব্যবহার পাওয়ার অধিকার রাখেন। ইসলামে সুন্দর ব্যবহারকে ইবাদত হিসেবে গণ্য করা হয়। জনগণের প্রতি ভালো ব্যবহার আমাদের জীবনের অন্যতম ব্রত হওয়া উচিত। হাসিমুখে ও আন্তরিকতার সঙ্গে সবাইকে গ্রহণ করা আমাদের দায়িত্ব। মানব সেবার গুণ দ্রুত ও ইতিবাচক সেবাদানের মানসিকতা থাকতে হয়। তাই অবৈধ ও অনৈতিক কাজ থেকে দূরে থাকতে হবে। ইসলামী জীবনাচার, আদব-কায়দা ও শিষ্টাচার নিজের জীবনে পরিপালন করতে হবে।
ইসলাম কী? একজন জিজ্ঞেস করলেন। মুহাম্মদ (সা.) বললেন, পবিত্র বচন ও পরের জন্য জীবন। যে হৃদয়ে মানুষের জন্য প্রেম, ভালোবাসা ও সহানুভূতি নেই, সমব্যথা নেই, সে দিলের জন্য জান্নাত নেই। পরিপাটি হয়ে থাকা, সালাম ও পরিচয় দেয়া, সহযোগিতামূলক আচরণ করা, সৌজন্য বজায় রাখা, পরিমিত আহার করা এবং অনুমতি নিয়ে কথা বলা ইসলামের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
ইসলামে শিষ্টাচার বা আদবকে ঈমানের অংশ বলা হয়েছে। ইসলাম পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সাংস্কৃতিক পার্থক্যকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং জীবনযাপনের বিভিন্ন পর্যায়ে সর্বজনীন শিষ্টাচার বা আদব-কায়দার সাধারণ মূলনীতি অনুসরণের নির্দেশনা দিয়েছে। তাই সর্বপ্রথমে ইসলামের মিশন এবং ভিশন সম্পর্কে আমাদের সচেতন হতে হবে।
ইসলাম একটি সেবার ধর্ম, অনুষ্ঠানসর্বস্বতাই যার মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। আমরা পৃথিবীর সব মানুষের সম্পদকে আমানত হিসেবে মনে করব। সর্বোত্তম মানবসেবা চালিয়ে যাওয়া আমাদের একটি দায়িত্ব। সে জন্য সেবাদানের ব্যাপারে আজকের মুমিনদের মধ্যে স্পিরিট সৃষ্টি করতে হবে। ইসলাম হলো একটি সেবা প্রদানকারী ইন্ডাস্ট্রির নাম। এ জন্য আমাদের প্রতিযোগিতামূলকভাবে, যোগ্যতার মাধ্যমে, দ্রুততা ও দক্ষতার সঙ্গে জীব-জগতের সেবা প্রদান করা উচিত। সর্বোত্তম ব্যবহার, বিনয়ী চরিত্র, ব্যক্তিত্ব, আনুগত্য, সহযোগিতা ও পারস্পরিক সুসম্পর্কের মাধ্যমে সেবাদান নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের ব্যাপারে সদা সচেতন থাকা উচিত। সে-ই সবচেয়ে ভালো মুসলমান, যার স্বভাব আপন পরিবারের কাছে সবচেয়ে ভালো বলে বিবেচিত। সে-ই পূর্ণ মুসলমান যার আচরণ সর্বোত্তম। যে ব্যক্তি নিজের লেনদেন ও কাজ-কারবারে সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত এবং ওয়াদা পালন করে, দায়িত্ব পালন করে, মানুষকে ধোঁকা না দেয়, আমানতের খেয়ানত করে না, মানুষের হক নষ্ট করে না, ওজনে কম দেয় না, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না এবং সুদ-ঘুষসহ যাবতীয় অবৈধ রোজগার থেকে নিজেকে রক্ষা করে চলে, সে-ই হলো প্রকৃত মুসলমান।
সালামের ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। খুশি মনে সালামের জবাব দেয়া সবার কর্তব্য। পরিচিত অপরিচিত সবাইকে সালাম দিতে হবে। সুযোগ পেলে মুসাফাহা করতে হবে। অবস্থার কথা জিজ্ঞেস করে পরিবারের লোকদেরও খোঁজখবর নেয়া যেতে পারে। মানুষকে আমাদের সর্বোত্তম বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। তাদের সঙ্গে সব সময় হাসিমুখে কথা বলতে হবে। রাসুল (সা.) সব সময় মানুষের সঙ্গে হাসি মুখে কথা বলতেন। সুতরাং বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি দ্বারা আগতকে অভ্যর্থনা জানাতে হবে। একজন হাস্যোজ্জ্বল মানুষের সঙ্গে যে কেউ কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। হজরত আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেন, ‘এক ব্যক্তি নবী করিম (সা.)-এর কাছে আরজ করলেন, আপনি আমাকে অসিয়ত করুন। তিনি বললেন, তুমি রাগ করো না। লোকটি কয়েকবার তা আরজ করলে নবী করিম (সা.) প্রত্যেকবারই বললেন, রাগ করো না।’ আমাদের সমাজে একটি কথার প্রচলন করা যেতে পারে—রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন।
পৃথিবীতে যত আদর্শ প্রচারিত হয়েছে তা হয়েছে সুন্দর কথা দিয়েই, অসুন্দর কথা ও কুবচন দিয়ে কোনো আদর্শ পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সুন্দর কথা দিয়ে সহজেই মানুষের মন জয় করা যায়। শ্রেষ্ঠ মনীষীরা সুভাষী ছিলেন। সুন্দর কথার হাত, পা ও জীবন আছে। সুন্দর কথায় রোগ জীবাণু ধ্বংসের ওষুধ আছে, এন্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা আছে। সুন্দর কথায় শর্করার শক্তি আছে, ভিটামিনের সঞ্জীবনী আছে, আমিষের পুষ্টিগুণ আছে। একটি সুন্দর কথা ভালো গাছের মতো, মাটিতে যার বদ্ধমূল শিকড়, আকাশে যার বিস্তৃত শাখা, যে গাছ অফুরন্ত ফল বিলিয়ে দেয়। শুদ্ধভাবে, গুছিয়ে ও সুস্পষ্ট ভাষায় কথা বলতে হবে। বিপদে আপদে আশপাশের সবার খোঁজখবর নিতে হবে। বাড়িতে এলে সম্মানের সঙ্গে তাদের বসতে দিতে হবে এবং সুযোগমত উপযুক্ত আতিথেয়তাও করতে হবে। আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি যে দয়ার্দ্র, আল্লাহ তার প্রতি দয়ার হাত বাড়ান। মানুষের সেবা করলেই আল্লাহর সেবা করা হয়। পথের কাঁটা সরিয়ে দেয়াও ঈমানের অংশ।
কেউ যদি তার ভাইয়ের অভাব মোচনের চেষ্টা করে সফল না হয় তবুও আল্লাহ তার গুনাহ মাফ কর দেবেন। মানুষের সঙ্গে বাক্যালাপ করতে হবে তাদের বোধশক্তি অনুসারে। প্রত্যেক ব্যক্তি তার উন্নতিতে সাহায্য পাবে তার চরিত্র অনুসারে। তোমাদের মধ্যে তারাই আল্লাহর রাসুলের সবচেয়ে প্রিয় ও পরকালে ঘনিষ্ঠতম, যারা শিষ্টাচারপরায়ণ আর তারা সবচেয়ে বড় শত্রু ও সবচেয়ে পর যারা বদমেজাজি। নম্রতা ও সৌজন্য সওয়াবের কাজ। প্রকৃত বিনয় সব সত্ গুণের অংশ। সদগুণ ও সত্যনিষ্ঠায় অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা সদা জাগ্রত রাখতে হবে। কথা হবে মাধুর্যপূর্ণ, সংক্ষিপ্ত, যথাযথ ও আপেক্ষিক। সৌজন্যের খাতিরে যেসব শব্দ ব্যবহার করা যেতে পারে—অনুগ্রহপূর্বক, আপনাকে ধন্যবাদ, দুঃখিত, আমাকে ক্ষমা করবেন, যদি কিছু মনে না করেন, আপনার কাছে কৃতজ্ঞ ইত্যাদি।
জনসাধারণের সঙ্গে এমন আচরণ করা যাবে না যার ফলে ইসলামী আদর্শের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এবং বিবাদে জড়ানোর সম্ভাবনা থাকে। অবাধ্যতা পরিহার করতে হবে, গুজব ছড়ানো যাবে না ও অমার্জিত ভাষায় কথা বলা যাবে না। কথা না বলার মানসিকতা, হিংসা, ঘৃণা পোষণ, অশুভ কামনা, নিন্দা করা, কপটতা ও স্থিরতার অভাব, উেকাচ ও উপহার ইত্যাদি পরিহার করতে হবে।
হজরত মাসরুক (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন—তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক উত্তম ওই ব্যক্তি, যিনি স্বভাবে সর্বোত্তম। রাসুলুল্লাহ (সা.) স্বভাবে অশালীন ছিলেন না এবং অনিচ্ছাকৃতও অশালীন উক্তি করতেন না। কোনো মানুষ ভুলবশত কোনো কাজ করে ফেললেও তাকে সামনাসামনি তিরস্কার করা যাবে না। সময়ের কাজ যথাসময়ে করতে হবে।

আল কোরআনে মাতৃভাষার গুরুত্ব

ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
মহান আল্লাহর প্রিয় ও সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হচ্ছে মানব জাতি। এই শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি বা আশরাফুল মাখলুকাত তাদের মনের ভাব, হৃদয়ের আকুতি, অন্তরের ব্যাকুলতা ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করে থাকে। এই ভাষা আল্লাহর দান। মানুষের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত এই ভাষা এক অমূল্য ও অতি বড় নেয়ামত। আল্লাহ মানুষকে স্বাধীন বাকশক্তি বা কথা বলার ক্ষমতা দান করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘দয়াময় আল্লাহ শিক্ষা দিয়েছেন কোরআন, সৃজন করেছেন মানুষ, তাকে শিখিয়েছেন বর্ণনা’ (সূরা আর-রহমান, আয়াত ১-৪)। অর্থাত্ আল্লাহ মানুষকে তার মনের ভাব প্রকাশ করতে শিখিয়েছেন।
একজন মানব শিশু যে জনপদে জন্মগ্রহণ করে, যে পরিবেশে সে বেড়ে ওঠে, যে মায়ের কোলে সে প্রতিপালিত হয়, সে জনপদের মানুষের ভাষা, সেই পরিবেশের ভাষা, সে মায়ের ভাষা তার নিজের ভাষায় পরিণত হয়। প্রায় সাড়ে ছয়শ’ কোটি আদম সন্তান অধ্যুষিত পৃথিবী নামক এই এ ভূখণ্ডে প্রায় পাঁচ হাজার সাতশ’টি ভাষা রয়েছে। ভাষার এই ভিন্নতা, বিচিত্রতা মহান আল্লাহর সীমাহীন ক্ষমতা ও অসীম কুদরতের এক অপূর্ব ও অকল্পনীয় নিদর্শনের বহিঃপ্রকাশ। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, ‘আল্লাহর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য’ (সূরা আর-রুম, আয়াত ২২)।
মাতৃভাষার মাধ্যমে অন্য ভাষার মানুষকে, অন্য ভাষার মানুষের চিন্তা-চেতনা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও কৃষ্টি সহজে জানা যায়, আয়ত্ত করা যায়, নিজ অনুভবে নিয়ে এসে তাকে আত্মস্থ করা যায় হৃদয়ের গভীরতম প্রদেশে। মাতৃভাষা অতি সহজেই একজন মানুষের ব্যক্তি সত্তার অন্তর্গত হয়ে যায়। তাই নবী-রাসূলগণকে আল্লাহ যে অঞ্চলে প্রেরণ করেছেন, তাঁদেরকে সে অঞ্চলের মানুষের ভাষাভাষী করেছেন। এ মর্মে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি প্রত্যেক রাসূলকেই তার নিজ কওমের ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছি, তাদের নিকট সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য’ (সূরা ইব্রাহীম, আয়াত ৪)। এ আয়াতে সু্স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, মাতৃভাষার মাধ্যমে যত সহজে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে মানুষকে বোঝানো সম্ভব হয়, অন্য কোনো ভাষায় বোঝানো ও প্রকাশ করা তত সহজ হয় না। এজন্যই আল্লাহ নবী-রাসূলগণকে তাঁদের নিজ নিজ সম্প্রদায়ের ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছিলেন। হিব্রু ভাষাভাষী অঞ্চলে আল্লাহ হিব্রুভাষী নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন এবং তাঁর নিকট আল্লাহ হিব্রু ভাষায়ই কিতাব নাযিল করেছেন। যেমন তাওরাত ও ইঞ্জিল।
মহানবী মুহাম্মদ (সাঃ)-এর ভাষা ছিল আরবি। তার নিকট অবতীর্ণ মানবতার মুক্তির দিশারি কোরআনের ভাষাও ছিল আরবি। রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর প্রতি আরবি ভাষায় কোরআন নাজিল হওয়া সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘আমি আপনার ভাষায় কোরআনকে সহজ করে দিয়েছি, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে’ (সূরা আদ-দুখান, আয়াত ৫৮)।
অন্যত্র তিনি বলেন, ‘আমি আপনার প্রতি কোরআন নাযিল করেছি আরবি ভাষায় যাতে আপনি সতর্ক করতে পারেন মক্কা ও তার চতুর্দিকের জনগণকে এবং সতর্ক করতে পারেন রোজ হাশর সম্পর্কে’ (সূরা আশ-শূরা, আয়াত ৭)। তিনি আরও বলেন, ‘আমি এটা নাযিল করেছি আরবি ভাষায় কোরআন রূপে, যাতে তোমরা অনুধাবন করতে পার’ (সূরা আয-যুখরুফ, আয়াত-৩)।
কোরআনুল কারিমের বর্ণিত আয়াতগুলো থেকে জানা যায় যে, ইসলাম মাতৃভাষার উপর অশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। এ কারণে দেখা যায় যে, পরবর্তীকালে ইসলাম প্রচারকরা পৃথিবীর যে অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে গমন করেছেন, সে এলাকার মানুষের ভাষা তারা আয়ত্ত করে ওই ভাষাতেই ইসলামের বাণী, হকের দাওয়াত মানুষের সামনে পেশ করেছেন। মানবতার মুক্তির নির্ভুল দিশারি ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী, হেদায়াতের আলোকবর্তিকা মহাগ্রন্থ আল কোরআন মাতৃভাষাকে অশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। কেননা ইবাদত-উপাসনায়, দ্বীনের জ্ঞানার্জন ও মহান আল্লাহর আরাধনায় মাতৃভাষা মানুষকে যথার্থভাবে অনুপ্রাণিত করে। তাই মাতৃভাষার গুরুত্ব অনুধাবন করে আমাদেরকেও মাতৃভাষার সেবায়, মাতৃভাষার উন্নয়নে, মাতৃভাষার শ্রীবৃদ্ধিতে আত্মনিয়োগ করতে হবে।
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক

ন্যায়বিচারে ব্যর্থ হলে আল্লাহর লানত

রাষ্ট্রীয় শাসনকার্য ও বিচারকার্য পরিচালনা করা একটি পুণ্যমূলক ইবাদত। এর সম্পর্ক মানুষের সঙ্গে। তবে যেসব ইবাদত মানুষের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সেগুলোর বিপদাশঙ্কাও বেশি। তবে কোনোটিতে কম কোনোটিতে বেশি মাত্রায় বিপদ। সর্বাধিক বিপদের কাজ হলো শাসনকার্য ও বিচারকার্য পরিচালনা করা। শাসনকার্য ও বিচার যদি ইনসাফ, ইখলাছ এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হয় তবে উত্তম আমল। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা কর তখন ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে বিচার করবে।’ (নিসা : ৫৮)। অন্যত্র এসেছে, ‘বল আমার পালনকর্তা নির্দেশ দিয়েছেন ন্যায়বিচারের।’ (আরাফ : ২৯)। পবিত্র কোরআনে আরও এসেছে, ‘আর যদি বিচার নিষ্পত্তি কর, তবে ন্যায়বিচার কর, আল্লাহ ন্যায়বিচারকদের ভালোবাসেন।’ (মায়িদাহ : ৪২)।
মহানবীর (সা.) হাদিসে এসেছে, ‘ন্যায়পরায়ণ শাসকের একদিন, অন্যব্যক্তির একাকী ষাট বছরের ইবাদতের সমান।’ (তাবরানী)। অন্য হাদিসে এসেছে, সর্বপ্রথম তিন ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে, তাদের একজন ন্যায়বিচারক শাসক। (মুসলিম)। আরেক হাদিসে এসেছে, তিন ব্যক্তির দোয়া প্রত্যাখ্যান করা হয় না, তাদের একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক।’ মহানবী (সা.) আরও বলেন, কিয়ামতের দিনে আমার অধিক কাছে বসবে ন্যায়পরায়ণ শাসক।’
এতে প্রমাণিত হয় যে, ন্যায়বিচার একটি মহান ইবাদত এবং অনেক বড় নেকির কাজ।
পক্ষান্তরে ন্যায়বিচার পরিহার করলে বিপদাশঙ্কাও বেশি। উপরে বর্ণিত হাদিসের মাধ্যমে অনুভূত হয়েছে যে, জালিম শাসকের একদিন একজন ফাসিকের ষাট বছরের পাপের সমান। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তদনুসারে যারা বিধান দেয় না তারা কাফির।’ (মায়িদাহ : ৪৪)। ‘আল্লাহ তায়ালা যে বিধান অবতীর্ণ করেছেন, যে ব্যক্তি সে অনুযায়ী বিচার মীমাংসা করে না সে ফাসিক।’ (মায়িদাহ: ৪৭)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি দশ ব্যক্তিরও শাসক হয় সে ব্যক্তি কিয়ামতের দিনে এমতাবস্থায় হাজির হবে যে, তার হাত ঘাড়ের সঙ্গে বাঁধা থাকবে। তার ন্যায়পরায়ণতা তাকে মুক্ত করবে অথবা তার জুলুম তাকে ধ্বংস করবে’ (আহমদ)। হজরত আবুবকর সিদ্দিক (রা) বলেন, ‘যে ব্যক্তি শাসক নিযুক্ত হওয়ার পর ইনসাফ করে না, তার উপর আল্লাহর লানত আপতিত হয়।’


জ সী ম উ দ্দী ন খা ন পা ঠা ন

মদিনা সনদ : শান্তির উদারনীতি

মো হা ম্ম দ কা ম রু ল ই স লা ম

রাসূল (সা.) আগমনের আগে এক সংকটময় মুহূর্ত অতিক্রম করেছিল আরবসহ সারাবিশ্ব। ইতিহাসে তাকে আইয়ামে জাহেলিয়ার যুগ বলা হয়। এ সময় সর্বত্র বিরাজ করছিল অশান্তির দাবানল। এ ক্রান্তিকালীন কাণ্ডারি হয়ে এসেছিলেন আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। প্রথমদিকে দ্বিধাবিভক্ত ও কলহপ্রিয় জাতিকে একটি আদর্শের ছায়াতলে নিয়ে আসতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। মক্কাবাসী তাকে সাদরে গ্রহণ না করায় তিনি হিজরত করে মদিনা চলে গিয়েছিলেন। মদিনার অধিবাসীদের মধ্যে এক আত্মার বন্ধন সৃষ্টি করেছিলেন। যে মূলমন্ত্রের মাধ্যমে তিনি এ বন্ধনটি তৈরি করেছিলেন সেটি মানবতার মুক্তির সনদ হিসেবে খ্যাত ‘মদিনা সনদ’। ঐতিহাসিক M.Watt এ সনদকে ঈড়হংঃরঃঁঃরড়হ ড়ভ গধফরহধ' বলে অভিহিত করেছেন। যা ছিল যে কোনো সময়ের জন্য মানবতার মুক্তির এক মহাসনদ।
রাসূল (সা.) আল্লাহর নির্দেশে ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মদিনায় হিজরত করেন। এ সময় তিনি দেখলেন, মদিনায় বিভিন্ন গোত্র, উপগোত্র ও বিভিন্ন মতাদর্শের অনুসারীরা বসবাস করছে। এরা ছিল মোটামুটি পাঁচ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। ১. মদিনায় আদি পৌত্তলিক সম্প্রদায়, ২. ইহুদি সম্প্রদায়, ৩. খ্রিস্টান সম্প্রদায়, ৪. নবী দীক্ষিত মুসলিম সম্প্রদায় (আনসার), ৫. মক্কা থেকে আগত মুসলিম সম্প্রদায় (মুহাজির)। তখন মদিনা বসবাসরত সম্প্রদায়ের মধ্যে সদ্ভাব ছিল না। তাদের মধ্যে আদর্শের মিল তো ছিলই না, তদুপরি বিরাজ করছিল জাতিগত হিংসা-বিদ্বেষ। যার ফলে মদিনার ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। আইনের শাসন ছিল না।
মহানবী (সা.) মদিনায় বিরাজমান এ পরিস্থিতিতে বিবদমান গোত্রগুলোর মধ্যে আন্তঃবিরোধ মিটিয়ে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে একটি জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করতে প্রচেষ্টা চালান। আর এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন ছিল কলহে লিপ্ত সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে ঐক্য ও সদ্ভাব সৃষ্টি করা। এ ছাড়াও প্রয়োজন ছিল জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সব নাগরিকের সমান অধিকার ও কর্তব্য নির্ধারণ এবং মুহাজিরদের মদিনায় বাসস্থান ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। কারণ যে দেশে বিভিন্ন ধর্মমত ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোক বাস করে সে দেশে পরমত সহিষ্ণুতার প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি ও ঐক্য না থাকলে দেশের কল্যাণ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। ফলে মহানবী (সা.) মদিনার সব সম্প্রদায়ের সঙ্গে বৈঠক করে আন্তঃসাম্প্রদায়িক ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ করার লক্ষ্যে ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে মদিনায় বসবাসকারী সব সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি সন্ধি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এ চুক্তিটি ঐতিহাসিক ‘মদিনা সনদ’ নামি পরিচিত। বিশ্বের ইতিহাসে ‘মদিনা সদন’ অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি সনদ। এর মাধ্যমে রাসূল (সা.) এর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞার প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ড. গঁরত্ এর মতে, ‘মদিনা সদন’ শুধু সে যুগে কেন, বরং সর্বযুগে ও সর্বকালে হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর অসামান্য মাহাত্ম্য ও অপূর্ব মননশীলতা ঘোষণা করবে।’
মদিনা সনদ পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম লিখিত সংবিধান এবং একে মহাসনদও বলা যেতে পারে। আরবি ভাষায় লিখিত এ সনদের মোট ৪৭টি ধারা ছিল। কয়েকটি প্রধান ধারা নিম্নে উল্লেখ করা হলো।
* মদিনা সনদে স্বাক্ষরকারী ইহুদি, খ্রিস্টান, পৌত্তলিক ও মুসলমান সম্প্রদায়গুলো সমান নাগরিক অধিকার ভোগ করবে এবং তারা একটি সমন্বিত জাতি (কমনওয়েলথ) গঠন করবে।
* পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা বজায় থাকবে, মুসলমান ও অমুসলমান সম্প্রদায়ের লোকেরা বিনা দ্বিধায় নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারবে। কেউ কারো ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
* রক্তপাত, হত্যা, বলাত্কার এবং অপরাপর গর্হিত কার্যকলাপ একেবারেই নিষিদ্ধ করা হলো।
* দুর্বল ও অসহায়কে সর্বতোভাবে সাহায্য ও রক্ষা করতে হবে।
* ইহুদিদের মিত্ররাও সমান নিরাপত্তা ভোগ করবে।
মদিনা সনদের উপহারে বলা হয়, আল্লাহ এ সনদের সত্যিকার বাস্তবায়নকারী। অন্যায়কারীকে বা বিশ্বাসঘাতককে এ সনদ প্রশ্রয় দেয় না।
মদিনা সদন বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র। রাসূল (সা.) আবির্ভাবের আগ পর্যন্ত বিশ্বের কোনো শাসকই জনগণকে কোনো লিখিত শাসনতন্ত্র উপহার দিতে পারেনি। এ শাসনতন্ত্রের মাধ্যমে মহানবী (সা.) বিভিন্ন সম্প্রদায়কে একটি শক্তিশালী জাতি হিসেবে গড়ে তোলেন এবং তারা একত্রে মিলেমিশে বসবাস করার সুযোগ পান। ফলে তাদের মধ্যে গোত্রীয় ধারণার পরিবর্তে একটি রাজনৈতিক ঐক্যের সৃষ্টি হয় এবং মদিনা সনদের মাধ্যমেই প্রথম দেশভিত্তিক জাতীয়তাবোধের সৃষ্টি হয়। মদিনার সামাজিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে উচ্ছৃঙ্খলা রহিত হয় এবং সুশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়। যা নব্য প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্র মদিনার প্রশাসনিক ভিত্তিকে অনেক শক্ত করে তোলে এবং ইসলাম আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিস্তার লাভ করার সুযোগ পায়।
মদিনা সনদ থেকে যে শিক্ষা পাওয়া যায় তা হলো—মদিনা রাষ্ট্র ও জনগণের ওপর মহানবীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ, সব নাগরিকের নিজ নিজ ধর্ম, নিজস্ব সংস্কৃতি ইত্যাদি পালনের অধিকার। শত্রুর আক্রমণ থেকে নিজেদের নিরাপদ রাখার জন্য একের প্রতি অপরের সহযোগিতা এবং অন্যের মত ও বিশ্বাসের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার মানসিকতা ও যোগ্য নেতৃত্বের আনুগত্য মেনে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলা। কারণ তখনকার দিনে সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের অধিকারী ছিলেন স্বয়ং রাসূল (সা.) এবং তিনি হয়েছিলেন নবগঠিত মদিনা প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রনায়ক।
মদিনা সনদ ছিল বিশ্বের ইতিহাসের প্রথম আন্তর্জাতিক চুক্তির ধারণা। এ চুক্তির নীতিমালাগুলো বিশ্লেষণ করলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শান্তি প্রতিষ্ঠার অনেক মূল্যবান উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়। এ সনদে ব্যক্তিগত বা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, ন্যায্য স্বার্থ সংরক্ষণ, ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে স্বাধীনতা এবং পরস্পরের প্রতি সুসম্পর্কের ভিত্তি নিশ্চিত করা হয়েছিল। যার ফলে অশান্ত মদিনায় শান্তির সুবাতাস বইতে শুরু করেছিল। শান্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মহানবী (সা.) মদিনা নামক যে ইসলামী রাষ্ট্রটির গোড়াপত্তন করেছিলেন তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব তদানীন্তন বিশ্বের সর্বত্র প্রতিফলিত হয়েছিল।
মদিনা সদনের এ সাফল্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বৃহত্তর সনদ স্বাক্ষরের পথকে সুগম করে। এমনিভাবে এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিকতাবাদের সূচনা হয়। বর্তমান বিশ্বের শান্তি-সংহতি ও নিরাপত্তা বিধানের জন্য জাতিসংঘ গঠন করা হয়েছে। সে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার ধারণা মদিনা সনদের মধ্যেই পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে আরনল্ড টয়েনবীর তার ডরংফড়স ড়ভ গঁযধসসধফ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ‘ইসলামই প্রকৃত জাতিপুঞ্জ গঠনের ধারণা দিয়েছিল। এ ধারণাই সঠিক ও প্রয়োগযোগ্য।’

রাসুলুল্লাহর (সা.) সাহিত্যানুরাগ

রাসুলুল্লাহ (সা.) ছিলেন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল। তার জীবনের মিশন ছিল সত্যের পয়গাম ও শাশ্বত দ্বীনের প্রচার-প্রসার। কিন্তু তিনি যেমন একজন রাসুল ছিলেন, তেমনি ছিলেন একজন মানুষও। সাধারণ মানুষের মতো তারও অনুভব, অনুভূতি ও লেনদেনের প্রয়োজন হতো। মানুষ হিসেবে সেই মুহূর্তগুলো তাকে পীড়িত করেছে। আপনজনের প্রতি ভালোবাসা, বিপদে ব্যথিত হওয়া এবং সুখের সময় আনন্দ প্রকাশ করার ক্ষেত্রে তিনি অন্যান্য মানুষের ব্যতিক্রম ছিলেন না। সেসব মুহূর্তে তিনি অলঙ্কার ও সাহিত্যপূর্ণ সাবলীল ভাষায় মনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন। একাডেমিক শিক্ষা তাঁর ছিল না। তার জ্ঞানের উত্স ছিল আসমানি ওহী। তাই তার সাহিত্যও ছিল ঐশী শক্তিতে বলীয়ান। শুদ্ধ বাচনভঙ্গি, অতিপ্রভাবক বিষয়বস্তু নিরূপণ, সাবলীল উপস্থাপনা ও হৃদয়স্পর্শী ব্যাখ্যায় তিনি ছিলেন অতুলনীয়।
যেহেতু তিনি উম্মী ছিলেন, তাই লেখ্য-সাহিত্যে তার কোনো ছাপ পাওয়া যায় না। কিন্তু কথ্য-সাহিত্যের পুরোপুরি বৈশিষ্ট্য তার মধ্যে ছিল। তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন স্প্পষ্টভাষী বংশ কুরাইশে। বেড়ে উঠেছেন বিশুদ্ধভাষী গোত্র বনু সাদে। অলঙ্কারপূর্ণ কালাম কোরআনুল কারিম দ্বারা তার পরবর্তী পাথেয় সঞ্চিত হয়েছে। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তার বিচরণ লক্ষণীয়। যেমন—কথাবার্তা, সংম্বোধন, ঘটনা বর্ণনা, উপদেশ দান, দোয়া ও অনুভূতি প্রকাশে তিনি তার সাহিত্যচেতা মনের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। এজন্য তার ভাষায় ছিল সম্মোহনী শক্তি। এর টানে অনেকেই ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছেন।
কোরআন ও হাদিসের সাহিত্যভাণ্ডার আরবি গদ্য সাহিত্যে সমৃদ্ধি আনে। তবে কবিতাপ্রীতিও নবীজীর মধ্যে কোনো অংশে কম ছিল না। কবিতার ছন্দে, ভাব ও অনুভূতিতে যে অভিব্যক্তি প্রকাশ পায় রাসুল (সা.) তা যথাযথ অনুভব করতেন। সাহাবায়ে কেরামের কবিতা আবৃত্তিকে পছন্দের দৃষ্টিতে দেখতেন। বরং যেসব কবি মুসলমান হয়েছিলেন, তিনি তাদের কবিতাকে দ্বীনের সাহায্যার্থে প্রয়োগ করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন। কবি হাসসান ইবনে সাবিত (রা.) ছিলেন রাসুলের কবি। রাসুলের ওপর আরোপিত বিভিন্ন অপবাদের জবাবদানে তিনি তার কাব্যপ্রতিভাকে কাজে লাগিয়েছেন। রাসুল (সা.) তাকে উত্সাহিত করে বলেন ‘ইসলামের খেদমত ঢাল-তলোয়ারে যেমন করা যায়, তেমনি কবিতা ও সাহিত্যের মাধ্যমেও করা যায়।’
কবিতা আবৃত্তির দ্বারা আবেগে আপ্লুত হওয়ার ঘটনাও হাদিসে পাওয়া যায়। মক্কা বিজয়ের সময় কিছু লোককে ইসলামের প্রতি চরম বিদ্বেষ পোষণের কারণে সাধারণ ক্ষমার আওতাভুক্ত করা হয়নি। তাদের সবাইকে হত্যার নির্দেশ দেয়া হয়। এদের মধ্যে কুরাইশদের এক ব্যক্তি ছিল। তাকে হত্যা করার পর তার বোন রাসুলের (সা.) দরবারে এসে আবেগঝরা ও হৃদয়গ্রাহী ভাষায় কবিতা আবৃত্তি করতে থাকে। এ কবিতা রাসুলের মধ্যে বিরাট প্রভাব ফেলে। কবিতা শুনে তিনি আফসোস করে বললেন, ‘এই কবিতা যদি আগে শুনতাম তবে তাকে মাফ করে দিতাম।’ স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে কখনও তার নিজের মুখ থেকে কবিতার ছন্দ বেরিয়ে যেত। কিন্তু কাফেররা যেহেতু তার ওপর অবতীর্ণ আল্লাহর বাণীকে স্বরচিত কবিতা বলে অপপ্রচার চালাতো, সে জন্য তিনি অনেকটা ইচ্ছাকৃতভাবেই তা থেকে বিরত থাকতেন। কোরআনে এরশাদ হচ্ছে, ‘আমি তাঁকে (রাসুলকে) কবিতা রচনা শিক্ষা দিইনি এবং এরকম কাজ তার পক্ষে শোভনও নয়।’
রাসুলের (সা.) অসংখ্য হাদিসের মধ্যে গদ্য সাহিত্যের কথ্যরূপ স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে আছে। প্রিয় ছেলে ইবরাহিমের ইন্তেকালের পর দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ের অভিব্যক্তি প্রকাশ পায়। একদিকে দাসত্বের প্রতি পূর্ণ দৃষ্টি, যেন সীমা লঙ্ঘন না হয়ে যায়; অন্যদিকে মানব-প্রকৃতির চিরায়ত রীতির বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন জড়তাহীন ও মর্মস্পর্শী ভাষায়। তিনি তখন বলেছিলেন ‘অন্তর ব্যথিত, চক্ষুদ্বয় অশ্রুসিক্ত, কিন্তু আমি বলব সে কথাই, যাতে আমার প্রভু সন্তুষ্ট; হে ইবরাহিম! তোমার বিরহে আমি ভারাক্রান্ত।’ নারীদের কোমল স্বভাবের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘তারা স্বচ্ছ কোমল স্ফটিকের পাত্রের মতো।’ পরস্পর মতবিরোধ ও বিভেদের কোনো অবকাশ নেই—একথা বোঝাতে বলেন ‘এ ব্যাপারে দুটি ছাগল পরস্পরে শিং নাড়াতে পারবে না।।’
রাসুল (সা.) তার বিবিদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ পরিবেশে কথা বলার সময়ও সাহিত্যপূর্ণতার দিকে দৃষ্টি রাখতেন। একদিন তিনি বিবিদের কাছে অভিজ্ঞতার কথা ব্যক্ত করেন অত্যন্ত সাহিত্যপূর্ণ ও চিত্তাকর্ষক ভাষায়। সেখানে তিনি একটি ঘটনা আকারে কয়েকজন মহিলার নিজ নিজ স্বামী সম্পর্কে মন্তব্য পেশ করেছেন। ‘হাদিসে উম্মে জারা’ নামে সেই বিবরণ বর্ণিত হয়েছে হাদিসের কিতাবগুলোয়। বিশেষভাবে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করার সময় সাহিত্যের ঝলক প্রস্ফুটিত হতো। তার মোনাজাত ও দোয়া এই পরিমাণ প্রভাবক ছিল যে, তা শুধু আরবি সাহিত্যে নতুন ধারার সূচনা করেনি বরং সাহিত্যের উচ্চ শ্রেণীভুক্ত হয়ে যায়। উপস্থাপনের দিক থেকে এগুলো যেমন গাম্ভীর্যপূর্ণ, তেমনি তাত্পর্যের দিক থেকেও অনেক উচ্চাঙ্গের। এর সর্বোত্কৃষ্ট দৃষ্টান্ত রাসুলের (সা.) দোয়া, যা তিনি তায়েফের ময়দানে করেছিলেন। এছাড়াও আরাফাতের ময়দানে ও বদর যুদ্ধের রাতের দোয়া, বিদায় হজের ভাষণ ইত্যাদিতে রাসুলের (সা.) সাহিত্যানুরাগের বিশেষ প্রমাণ পাওয়া যায়।
রাসুল (সা.) মানব সভ্যতার উত্কর্ষে যে বিশাল অবদান রেখে গেছেন, তা থেকে সাহিত্যাঙ্গন খালি নয়। এক্ষেত্রেও তার সুস্পষ্ট প্রভাব ও অবদান উদ্ভাসিত।


জ হি র উ দ্দি ন বা ব র
zahirbabor@yahoo.com

নবী জীবনের ঘটনা : পবিত্র যন্ত্রণা

অবশেষে কামরায় ঢুকে পড়লেন উমর (রা.)। আর অপেক্ষা করতে পারলেন না। অপেক্ষার প্রয়োজনও ছিল না। একবার, দু’বার এবং তিনবার অনুমতি চাওয়ার পর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে কামরার ভেতরে এসে হাজির হওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ্র মুখোমুখি দাঁড়ানোর জন্য বিপুল বেচাইনির ঝড়ে তিনি আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। অন্য রকম একটি ভার ভার যন্ত্রণা ও কষ্ট তাঁকে কুঁকরে তুলছিল। উমর (রা.) তাঁর বিনীত দুটি চোখ, সমব্যথি ও কাতর দুটি চোখ মেলে দেখলেন রাসূলুল্লাহ (সা.) দড়ির খাটিয়ার উপর শুয়ে আছেন। নির্জনে, নিঃশব্দে একটি ঘরে তাঁর এই শুয়ে থাকা দেখে উমরের হৃদয়ে অসম্ভব কষ্টের তুষারপাত শুরু হলো। দুঃখের এক পশলা হাহাকার তার অন্তর আর্দ্র করে তুলল। কী বলবেন, কী করবেন, কোনো কিছুই ঠিক করতে পারছেন না। প্রশ্ন কৌতূহল আর কষ্টের ধারালো অনুভবগুলোই তাঁর এখানে এসে আরও তীক্ষষ্ট হয়ে উঠেছে।
গত রাতে রাসূলুল্লাহ্র একটি ব্যক্তিগত কষ্টের কথা, দুঃখের কথা, মনোযাতনা ও যন্ত্রণার কথা শুনে উমরের ব্যাকুলতা রাতের ঘুমে নিরন্তর আঘাত করেছে। ফজরের জামাতে এসে তিনি দৌড়ে শামিল হয়েছেন মদীনায়। জামাতের পর রাসূলুল্লাহ্ (সা.) সময়ক্ষেপণ না করে আবারও নির্জন অন্দরে চলে আসায় উমর (রা.) বিহ্বল হয়ে মসজিদে বসেছিলেন কিছুক্ষণ। মাঝে দু’বার এসে অনুমতি চেয়েছিলেন; অনুমতি মিলেনি। অবশেষে এক বুকফাটা-আব্দার তিনি রাসূলুল্লাহ্র (সা.) দরবারে পাঠালেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাঁকে অনুমতি দিলেন এবং এরপর তিনি কামরায় ঢুকলেন।
উমর (রা.) রাসূলুল্লাহ্র (সা.) মুখোমুখি হয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাঁকে দেখছিলেন। তাঁর পারিবারিক একটি সঙ্কটে, দাম্পত্যের একটি সমস্যায় তিনি কতটা কষ্টের মধ্যে আছেন, সবার অগোচরে, কতটা নিঃশব্দ দুঃখের মধ্যে প্রহর কাটছে তাঁর, উমর (রা.) সম্ভবত তা-ই লক্ষ্য করছেন। উমর (রা.) তাঁর দু’চোখ মেলে রাসূলুল্লাহেক (সা.) দেখলেন। দেখলেন সাধারণ একটি দড়ির খাটে শুয়ে আছেন তিনি। তাঁর গায়ে দড়ির দাগ পড়ে গেছে। কোমল ত্বকে দারিদ্র্যের নিষ্ঠুর আঁচড়ের মতোই সেই দাগ জ্বল জ্বল করছে। উমর (রা.) দেখলেন আসবাবপত্রহীন, আয়োজনহীন, বিত্তহীন এই কামরার এক পাশে রাখা আছে সামান্য যব, আরবের মোটা খাবার। আরেক পাশে একটি খুঁটিতে ঝুলছে সামান্য একটি শুর চামড়া। উল্লেখ করার মতো তেমন আর কোনো আসবাবপত্র ঘরে নেই।
দেখতে দেখতেই উমরের বোধগুলো ঝাপসা হয়ে এলো। মুষলধারে নেমে আসা বৃষ্টিতে হঠাত্ আক্রান্ত পথিকের মতো উমরের হৃদয় কাকভেজা হয়ে গেল। নিয়ন্ত্রণের শক্ত পিঞ্জর ভেঙে গেল তাঁর। উমর (রা.) ডুকরে কেঁদে উঠলেন। কাঁদতেই লাগলেন। দু’চোখ বেয়ে বিন্দু বিন্দু কষ্টের ভাঁপ কপাল বেয়ে নেমে আসতে লাগল। উমর (রা.) এক সীমানাহীন ভালোবাসার ভুবন, হাহাকারের ভুবন, পবিত্র যন্ত্রণার ভুবনে বন্দি হয়ে গেলেন।
অঝোরে বৃষ্টি ঝরার মতো উমরের দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে দেখে অসম্ভব কোমল কণ্ঠে বিপুল সান্ত্বনার আবেশ ছড়াতে রাসূলে আকরাম (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন ‘উমর! তুমি কাঁদছ কেন?’
দিশেহারা কান্নার মাঝেও অশ্রুপাতের অবিরল ধারার মধ্যেও উমর আরজ করলেন ‘এছাড়া আমার কান্নার আর কী কারণ থাকতে পারে যে, রোম সম্রাট আর পারস্য সম্রাট পৃথিবীর প্রাচুর্য ভোগ করছে। অথচ নবী হয়ে আপনার এই দারিদ্র্য!’
সম্পূর্ণ পাত্র উপুড় করে দেয়ার মতোই উমর তাঁর ভালোবাসা ও কষ্টের, দুঃখ ও যন্ত্রণার আদ্যোপান্ত উপুড় করে দিলেন। তাঁর নিঃশব্দ হাহাকার প্রচণ্ডভাবে বিস্ফোরিত হলো। মানবতার, সহানুভূতির সর্বোচ্চ শৃঙ্গে যার আয়েশী অবস্থান, সেই রাসূলে আকরাম (সা.) সব শুনলেন, দেখলেন। তাঁর এক প্রেমিক সহচরের হৃদয় উজাড় করা কান্নায় তিনি অভির্ভূত হলেন। তিনি এক অনন্য অভিব্যক্তি শূন্যে ছেড়ে দিলেন। দৃশ্যমান বাস্তবতার ঊর্ধ্বে, সংকীর্ণ ইহকালীনতার বাইরে এক দিগন্তহীন দিগন্ত থেকে তিনি উচ্চারণ করলেন ‘উমর! তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, রোম সম্রাট ও পারস্য সম্রাট পৃথিবীর প্রাচুর্য ভোগ করুক আর আমি পরকালের ক্ষয়-লয়হীন অনাবিল শান্তি লাভ করি?’
অশ্রুসিক্ত উমরের দু’চোখ স্থির হয়ে আছে রাসূলুল্লাহ্র (সা.) অদ্ভুত প্রশান্ত মুখের উপর। এ প্রশ্নের জবাবে তাঁর নিজের মুখে কোনো শব্দ নেই। তিনি শুধু শান্তির অনাবিল প্রতীক এই মুবারক মুখের আদলে শান্তির মানচিত্র খুঁজে নিচ্ছেন। তাঁর বুকের মধ্যে জমে যাওয়া কষ্টের পালকগুলো উড়ে উড়ে চলে যাচ্ছে দূরে, অন্যখানে।


শ রী ফ মু হা ম্ম দ

প্রসঙ্গ: ফতোয়া ও গ্রাম্য সালিশ প্রয়োজন উলামা-মাশায়েখদের সমন্বিত পদক্ষেপ

আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে অসামাজিক ও নৈতিকতাবিরোধী কর্মকাণ্ডকে কেন্দ্র করে গ্রাম্য মাতব্বর এবং সালিশকারীদের সিদ্ধান্তকে ‘ফতোয়া’ ও শাস্তিকে ‘দোররা’ হিসেবে অভিহিত করে। প্রতিনিয়ত এসব কর্মকাণ্ডকে ‘ফতোয়াবাজি’ বলে প্রপাগান্ডা চালাচ্ছেন। গ্রামের যেসব লোক সালিশ করে বেত্রাঘাতের মাধ্যমে শাস্তি কার্যকর করছে, তারা কেউ ইসলামী আইনে পারদর্শী ‘মুফতি’ নন। তাদের প্রদত্ত রায় কোনোক্রমে ‘ফতোয়া’ নয়। ফিকহে ইসলামীর মৌলিক নীতিমালা সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই নেই। তারা যা করছে তা প্রচলিত সামাজিক রীতি-প্রথার (Convention of the society) আওতায় পড়তে পারে, ধর্মের আওতায় নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গ্রাম্য সালিশে মানসিক ও দৈহিক শাস্তি মেয়েদের প্রদান করা হয়, তাকে একঘরে করা হয় আর ছেলেকে করা হয় আর্থিক জরিমানা। এটাও ইসলামী ইনসাফের পরিপন্থী। ধর্মের অপব্যাখ্যা করে প্রদত্ত সালিশি বিচারের নামে এসব রায়, সিদ্ধান্ত ও দনণ্ড প্রয়োগ শরিয়াহ আইনের পরিপন্থী এবং বিচারবহির্ভূত এসব কার্যক্রম কোনোভাবেই বরদাশত করা উচিত নয়। কোনো সভ্য সমাজে এটা চলতে পারে না।
ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত থাকলে ‘মুফতি’ কুরআন, হাদিস, ইজমা, কিয়াস, ইশতেহসানের ভিত্তিতে যে কোনো সমস্যার শরয়ী ব্যাখ্যা দেবেন। প্রদত্ত ব্যাখ্যাকে ভিত্তি ধরে রাষ্ট্র কর্তৃক নির্ধারিত উপযুক্ত আদালতের (Competent Court) বিচারক (কাজী) বাদী-বিবাদী-সাক্ষীর বক্তব্য, আসামির স্বীকারোক্তি, জেরা-জবানবন্দি, তদন্ত প্রতিবেদন ও Circumstantial evidence গ্রহণ করে নিরপেক্ষ রায় প্রদান করবেন এবং প্রশাসন আদালতের রায় কার্যকর করবে। সাজা ও ভীতি প্রদর্শনমূলক শাস্তি (হুদুদ ও তাজিরাত) কার্যকর দায়িত্ব সরকারের নির্দিষ্ট বিভাগের। ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে অর্থাত্ বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কোনো ব্যক্তির পক্ষে শরয়ী শাস্তির বিধান কার্যকর করার সুযোগও নেই, আইনও নেই। এটা তার এখতিয়ার বহির্ভূত।
ফতোয়া প্রদান করা মুফতিদের ধর্মীয় অধিকার। জোর করে এ অধিকার হরণ করা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। বাংলাদেশের প্রায় কওমী ও আলিয়া মাদরাসায় স্বতন্ত্র ফতোয়া বিভাগ আছে। পারদর্শী মুফতিরা হাতে-কলমে শিক্ষার্থীদের ‘শরিয়াহ আইন’ সম্পর্কে বিস্তারিত পাঠদান করে থাকেন। যুগ চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে মুসলমানদের ব্যক্তি, পারিবারিক ও সামষ্টিক জীবনে নানা সমস্যা দেখা দেয়—এগুলোর শরয়ী ব্যাখ্যা ও সমাধান মানুষ জানতে আগ্রহী। যুগ যুগ ধরে বিজ্ঞ মুফতিরা এ দায়িত্ব পালন করে আসছেন। পরিচ্ছন্নতা, নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, চাঁদ দেখা, বিয়ে, তালাক, খোরপোশ, ইদ্দত, সম্পত্তির উত্তরাধিকার, দেনমোহর প্রভৃতি বিষয়ে উদ্ভূত সমস্যা বা মাসয়ালার শরয়ী ব্যাখ্যা ও সমাধান দেয়ার উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ (Competent Authority) হচ্ছেন মুফতিরা। এসব আদালতের কাজ নয়। আদালতের পক্ষে ইসলামী শরিয়তের জটিল মাসায়েলগুলোর ব্যাখ্যা দেয়া সঙ্গত কারণে সম্ভব নয়। আদালতের মূল কাজ হচ্ছে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। এসব মাসয়ালা-মাসায়েলের জবাব দিতে গেলে বিচার কার্যক্রম ব্যাহত হবে। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে অনেক সময় হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্ট আইনের ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন, মুসলিম পারিবারিক বিষয়াবলীতে শরিয়াহের বিধিবদ্ধ বিধান (Islamic Legal Codes) অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক। বিধিবদ্ধ বিধানে স্পষ্ট নয় অথবা দ্বৈততা আছে অথবা ভিন্ন ভিন্ন মত আছে এমন সব ব্যাপারে বিজ্ঞ বিচারক বিজ্ঞ মুফতিদের আদালতে তলব করে শরয়ী ব্যাখ্যা জানতে চান। প্রদত্ত ব্যাখার আলোকে বিজ্ঞ বিচারক রায় ঘোষণা করেন। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে এরকম বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। তখন বিচারকের কাছাকাছি ইসলামী আইনে পারদর্শী জুরি বোর্ডের সদস্যরাও আদালতে বসতেন। বাংলাদেশেও এরকম ঘটনার নজির আছে। তালাকপ্রাপ্ত নারী সাবেক স্বামীর কাছ থেকে কত দিন খোরপোশ পাওয়ার দাবিদার এ সম্পর্কিত একটি মামলায় জেলা জজ আদালত ও হাইকোর্টের বিজ্ঞ বিচারকরা পরস্পরবিরোধী রায় দিলে সুপ্রিমকোর্ট বায়তুল মোকাররমের সাবেক খতিব মাওলানা উবায়দুল হক (রহ.) ও মাসিক মদীনার সম্পাদক মাওলানা মুহীউদ্দীন খানকে আদালতে তলব করে এ ব্যাপারে শরিয়তের ব্যাখ্যা জানতে চান। তাদের প্রদত্ত ব্যাখ্যার আলোকে বিজ্ঞ বিচারক রায় ঘোষণা করেন যে, তালাকপ্রাপ্ত মহিলা ইদ্দত চলাকালীন সাবেক স্বামীর পক্ষ থেকে কাবিননামায় বর্ণিত হারে যথাযথ খোরপোশ পাবেন।
ভারতের প্রায় প্রতিটি অঙ্গরাজ্যে সরকারের অনুমোদনক্রমে শরিয়াহ আইনে বিশেষজ্ঞ মুফতিদের সমন্বয়ে ‘মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ড’ রয়েছে। বোর্ডের রায় আদালতের কাছে স্বীকৃত ও গ্রহণযোগ্য। কেন্দ্রীয় ‘মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ড’-এর এক সময় চেয়ারম্যান ছিলেন বিশ্বখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ আল্লামা সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.)।
এরই মধ্যে বাংলাদেশ হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ফতোয়ার নামে সংঘটিত সব ধরনের বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ডকে অবৈধ ও ফৌজদারি অপরাধ বলে ঘোষণা করেছেন। আদালত একই সঙ্গে রায়ে বলেন, যদি কোনো ব্যক্তি ফতোয়া জারি করে এবং তার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তিকে শাস্তি দেয় তাহলে তা অবশ্যই শাস্তিযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ বলে গণ্য হবে। এছাড়া যারা ফতোয়া জারি করে ও শাস্তি দেয়ার মতো বিচারবহির্ভূত কাজে সহযোগিতা করবেন তারাও একই দোষে দোষী হিসেবে সমপরিমাণ শাস্তি পাবেন। হাইকোর্টের রায়ে স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে, ফতোয়া একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। উচ্চ আদালতের প্রতি সন্মান রেখে নিবেদন করতে চাই, বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ডকে অবৈধ ও ফৌজদারি অপরাধ বলে আদালতের রুলিংয়ের ক্ষেত্রে কারও দ্বিমত নেই। সালিশি বিচারের নামে যারা শারীরিক শাস্তি দেয় তাদের আইনের আওতায় আনার সিদ্ধান্ত প্রশংসনীয়। কিন্তু ফতোয়া যদি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হয়ে থাকে তা হলে শরিয়াহ আইন (ফিকহে ইসলামী) শিক্ষা, অনুশীলন ও চর্চার কাঠামো ভেঙে পড়বে। বাংলাদেশে যেসব মাদরাসা ও গবেষণা কেন্দ্রে হাতে-কলমে ইফতা পড়ানো হয় তা বেআইনি হয়ে যাবে এবং যুগে যুগে প্রাজ্ঞ ইমামদের লিখিত ফতোয়ার বিপুল আয়তনের গ্রন্থাবলি নিষিদ্ধ হয়ে যাবে।
অনেক সময় মাসয়ালা ও জটিল সমস্যার বর্ণনা, পারিপার্শিক অবস্থা, সাক্ষীর বক্তব্যের অসঙ্গতির কারণে মুফতিরা একই মাসয়ালার ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন। অনেক সময় প্রাজ্ঞ ইমামদের ইখতিলাফের কারণেও ব্যাখ্যা ভিন্ন হতে পারে। এ অসঙ্গতি দূর করার জন্য আমাদের প্রস্তাব হচ্ছে রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনায় ইসলামী আইনে বিশেষজ্ঞ আলিমদের নিয়ে একটি শক্তিশালী ‘কেন্দ্রীয় ফতোয়া বোর্ড’ গঠন করা হোক। এ বোর্ডের প্রধান দেশের ‘গ্র্যান্ড মুফতি’ অভিধায় ভূষিত হবেন। বোর্ডের আওতায় জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে স্থানীয় বিজ্ঞ আলিমদের নিয়ে ‘ফতোয়া বোর্ড’ থাকবে। বোর্ড প্রদত্ত ফতোয়া রাষ্ট্রীয়ভাবে গ্রহণযোগ্য হবে। বড় বড় মাদরাসায় বা ইসলামী গবেষণাকেন্দ্রিক ইফতা বিভাগ আছে এবং শিক্ষার্থীরা নিয়মিত শরিয়াহ আইনের ওপর গবেষণা করেন তাদের প্রদত্ত ফতোয়াও সহিহ বলে বিবেচিত হবে। ফতোয়ার ক্ষেত্রে ভিন্নতা দেখা দিলে ‘কেন্দ্রীয় ফতোয়া বোর্ড’-এর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে। এর বাইরে ইসলামী আইনের ব্যাখ্যা দেয়ার মতো কোনো অথরিটি না থাকা বাঞ্ছনীয়। তা হলে গ্রামগঞ্জে যেসব মোড়ল-মাতব্বর সালিশি রায় দিয়ে তা কার্যকর করছে, সে প্র্যাকটিস বন্ধ হয়ে যাবে। সৌদি আরব সরকার সম্প্রতি এমন একটি নির্দেশনা জারি করে।
যেসব ফতোয়ার সঙ্গে সাজা, দণ্ড, প্রশাসনিক ও বিচারিক কর্মকাণ্ড বিজড়িত সে ক্ষেত্রে বিজ্ঞ মুফতিরা অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন করবেন। আমাদের মনে রাখতে হবে, মুফতিরা বিচার করার ও দণ্ড কার্যকর করার বৈধ কর্তৃপক্ষ নন। এ দায়িত্ব আদালতের ও প্রশাসনের।
একশ্রেণীর সংবাদপত্র ও এনজিও চক্র যে হারে গ্রাম্য সালিশ এবং শাস্তিকে ‘ফতোয়া’ ‘ফতোয়াবাজি’ ও ‘দোররা’ বলে অভিহিত করে সাধারণ মানুষের অন্তরে ইসলামী অনুুশাসন এবং বিধিবিধানের প্রতি ভীতি ও অশ্রদ্ধার জন্ম দিচ্ছে, তাতে আমরা শঙ্কিত না হয়ে পারি না। এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। অনৈতিক যৌন সম্পর্কে যারা জড়িয়ে পড়ছে বা পরকীয়া প্রেমে যারা আসক্ত তাদের ব্যাপারে বিদ্যমান আইনের ধারাকে আরও কঠোর করা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। অন্যথায় সামাজিক স্থিতি ও শৃঙ্খলা ভেঙে পড়তে পারে। স্মর্তব্য যে, পারিবারিক ও সামাজিক শৃঙ্খলার স্বার্থে শরিয়াহ আইন অপরাধীর প্রতি কঠোর। অপরাধের মাত্রানুযায়ী দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা শরিয়াহ আইনের বৈশিষ্ট্য, যাতে অপরাধের উত্সমূল বন্ধ হয়ে যায়। কারণ অপরাধ অপরাধের জন্ম দেয়।
আমরা আবারও বলছি, শরিয়াহ আইন কার্যকর করার দায়িত্ব সরকারের। শরিয়াহ আইন বিশেল্গষণ করবেন বিজ্ঞ মুফতিরা। শরিয়াহ আইনের অনুপস্থিতিতে প্রচলিত দেশীয় আইন মেনে চলতে জনগণ বাধ্য। সুতরাং আলিম, উলামা, মাশায়েখ ও মুফতিদের সমন্বিত কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, সংলাপ, আলোচনা সভার মাধ্যমে ‘ফতোয়া’ ও ‘দোররা’র সঠিক তথ্য এবং অবস্থান জনগণের কাছে তুলে ধরা দরকার। প্রয়োজনে উচ্চ আদালতের বিচারক, সিনিয়র আইনজীবী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বিজ্ঞ আলিম ও মুফতিদের মতবিনিময় হতে পারে।
লেখক : ড. আ ফ ম খা লি দ হো সে ন

অধ্যাপক, গবেষক ও ইসলামি চিন্তাবিদ

সবার আগে মানবাধিকারের ঘোষণা দিয়েছেন মহানবী (সা.)

‘হজরত মোহাম্মদের (সা.) ভাষণসমূহ : একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক সমীক্ষা’ শিরোনামে থিসিস করেছেন ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন। তার থিসিসের বিষয়-বৈশিষ্ট্য নিয়ে সাক্ষাত্কারে তিনি জানান, বিভিন্ন ভাষণে মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) শাশ্বত ও সর্বোচ্চ মানবাধিকারের ঘোষণা পৃথিবীতে সবার আগে দিয়ে গেছেন। মহানবীর (সা.) ভাষণগুলো মানুষ ও মানবতার প্রতি তাঁর স্বর্ণালী অবদানের উজ্জ্বল স্বাক্ষর। সাক্ষাত্কার নিয়েছেন শরীফ মুহাম্মদ


মানবতার নবী হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনের পুরোটাই ছিল মানুষ ও মানবতার স্বর্ণালী আদর্শ ও শিক্ষায় ভরপুর। বাস্তব আচরণ ও ঘটনার বাইরে তাঁর ভাষণ-বক্তব্য থেকেও এর অগণিত নমুনা পাওয়া যায়। ব্যাপকভাবে এ প্রসঙ্গে আমরা শুধু বিদায় হজের ভাষণের কথাই জানি ও আলোচনায় আনি। কিন্তু তাঁর জীবনের প্রায় সব ভাষণ-বক্তব্যেই মানুষ ও মানবতার প্রতি তাঁর অবদানের তথ্যটি ফুটে ওঠে। ‘হজরত মোহাম্মদের (সা.) ভাষণসমূহ : একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক সমীক্ষা’ শিরোনামে থিসিস সম্পন্ন করে পিএইচডি অর্জন করা অধ্যাপক ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন এ কথা জানান।
চট্টগ্রাম ওমর গণি এমইএস কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির অধ্যাপক ড. খালিদকে ২০০৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এ বিষয়ে ডিগ্রিটি দেয়া হয়। ৩৭০ পৃষ্ঠায় রচিত তার থিসিসটিতে রয়েছে আটটি অধ্যায়। থিসিসটির তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহ মুহাম্মদ শফিকুল্লাহ। পরীক্ষক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবির অধ্যাপক ড. আবু বকর সিদ্দিক ও ভারতের লক্ষেষ্টৗ বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ও ইসলামী সভ্যতা বিভাগের চেয়ারম্যান ড. শিব্বির আহমদ। ড. খালিদ জানান, তিনি তার থিসিসে মহানবীর (সা.) ৮১টি ভাষণ সংগ্রহ, ভাষান্তর ও বিশ্লেষণ করেন। ভাষণগুলোর মাঝে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বিদায় হজের ভাষণ, মক্কা বিজয়, তাবুক প্রান্তর, গাদির খুম, বদর, ওহুদ প্রান্তর, মদিনার প্রথম ভাষণ, দাজ্জালের ব্যাপারে সতর্কতা, মুহাজির-আনসারের সমাবেশ, মক্কায় নেতৃস্থানীয়দের জন্য আয়োজিত ভোজসভা, আকাবা উপত্যকা, মসজিদে নববী ও মুতার যোদ্ধাদের বিদায় দানকালে দেয়া ভাষণগুলো।
এক প্রশ্নের জবাবে ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন জানান, মহানবীর (সা.) ভাষণে সামাজিক নিরাপত্তা, অসাম্প্রদায়িক সহাবস্থানের প্রেরণা ও রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা রক্ষার চেতনা প্রস্ফুটিত। এছাড়াও মহানবীর (সা.) ভাষণে রয়েছে ধর্মের সঙ্গে সমাজ-সংস্কৃতির সম্পর্ক, মানবাধিকার, নারীর মর্যাদা ও শিশুর অধিকার, অধীনস্থদের সঙ্গে মানবিক আচরণ, সহিষ্ণুতা, সহমর্মিতা, ভ্রাতৃত্ববোধ, আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতা, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, যুদ্ধক্ষেত্রে নৈতিকতা, মানবসেবা, ক্ষমা ও ঔদার্য, বাড়াবাড়ি বিষয়ে সতর্কতা, খতমে নবুওয়ত, জিহাদ, সুদমুক্ত অর্থনীতি, আত্মীয়তার সম্পর্ক সুদৃঢ়করণ, ব্যক্তি ও ব্যাষ্টিক দায়িত্ববোধ, সামাজিক ন্যায়বিচার, দাসমুক্তি, বর্ণ ও গোত্রীয় বৈষম্যের অবসান এবং শ্রমের মর্যাদা সম্পর্কিত বহুবিধ নির্দেশনা ও আলোকপাত।
মানবাধিকার রক্ষায় মহানবীর (সা.) ভাষণ ও নির্দেশনার ভূমিকা সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বিভিন্ন ভাষণের ধারাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মহানবী (সা.) শাশ্বত ও সর্বোচ্চ মানবাধিকারের ঘোষণা সবার আগে দিয়ে গেছেন। ১২১৫ সালের ম্যাগনাকার্টা, ১৬২৮ সালের পিটিশন অব রাইটস, ১৬৭৯ সালের হেবিয়াস কর্পাস অ্যাক্ট, ১৬৮৯ সালের বিল অব রাইটস এবং ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা মানুষের সামনে আসার বহু শত বছর আগেই মানবতার ঝাণ্ডাবাহী মহানবীর (সা.) ভাষণে মানুষের আর্থ-সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অধিকার ঘোষিত হয়েছে।
থিসিস সম্পন্ন করতে ড. খালিদ তিনটি দেশের বিভিন্ন ইসলামী প্রতিষ্ঠান ও লাইব্রেরি মন্থন এবং পৃথিবী বিখ্যাত ইসলামী স্কলারদের সাক্ষাত্কার গ্রহণ করেন। একই সঙ্গে নির্দিষ্টভাবে ৮৬টি আরবি, ৮৫টি ইংরেজি, ৩০টি উর্দু, ৬টি ফার্সি, ৫টি বাংলা গ্রন্থ ও ১৫টি সাময়িকী অধ্যয়ন করেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সিরাত বিশ্বকোষের চতুর্দশ খণ্ডে তার থিসিস থেকে নেয়া মহানবীর (সা.) ভাষণগুলো মূল আরবিসহ বাংলা তরজমা ‘রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর খুতবাসমূহ’ নামে ছাপা হয়েছে।
—অধ্যাপক ড. আফম খালিদ হোসেন

বিশ্বভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা.)

ইসলামে একে অপরকে স্নেহ-ভালোবাসা, প্রীতি-সম্প্রীতির বাঁধনে আবদ্ধ রাখতে চায়। আবদ্ধ রাখতে চায় বিশ্বভ্রাতৃত্ব বন্ধুত্বের ডোরে সেতুবন্ধে। একমাত্র ইসলামই বিশ্বভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ইসলামই সর্বপ্রথম ঘোষণা দিয়েছে—দুনিয়ার সব মানুষ এক আদমের সন্তান। অতএব সৃষ্টিগতভাবে কারও ওপর কারও প্রাধান্য নেই। নিশ্চয়ই আল্লাহপাকের মহান দরবারে সর্বাধিক সম্মানিত সে ব্যক্তিই যে তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক পরহেজগার। নিশ্চয়ই আল্লাহপাক মহাজ্ঞানী, সর্ববিষয়ে ওয়াকিবহাল। সূরা আল ইমরানে ইরশাদ হয়েছে—‘তোমরা আল্লাহপাকের রজ্জুকে একে অপরে আঁকড়ে ধরো। আর দলে দলে বিভক্ত হয়ো না।’
বস্তুত সারা বিশ্বের মুসলমান এক ও অভিন্ন। একদেহ-একপ্রাণের মতোই। এক্ষেত্রে আরব আজম নেই। দেশ হিসেবেও নেই কোনো বিভেদ-বিভাজন। সবাই এক, একই কালিমার পরিচয়ধারী বিশ্বাসী। সবাই একই নবীর উম্মত-অনুসারী। মুসলামনদের পরস্পর সৌহার্দ্য ভ্রাতৃত্বের শিকড় প্রোথিত গভীরে পাতালে। যা উপড়ে যাওয়ার নয়। নয় ছিন্নবিচ্ছিন্ন হওয়ার। তাই মুসলমানদের সম্পর্ক ভ্রাতৃত্ববোধ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে হুজুর (সা.) ইরশাদ করেন—মুসলমান মুসলমানদের ভাই। কোনো ভাই অন্যের প্রতি জুলুম করো না। একে অন্যকে তিরস্কার করো না। যে তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করবে, আল্লাহপাক তার প্রয়োজন পূরণ করবেন। যে কোনো মুসলমানের দুঃখ-কষ্ট লাঘব করবে, আল্লাহপাক কিয়ামতের দিন তার দুঃখ দূর করবেন। যে কোনো মুসলমানের দোষ গোপন করবে, আল্লাহপাক কিয়ামতের দিন তার দাষ গোপন করবেন। হুজুর (সা.) আরও বলেন, তোমরা মুমিনদের পরস্পরের মধ্যে দয়া-মায়া এবং সহমর্মিতার একটি দেহের মতো পাবে। দেহের একটি অংশে ব্যথা হলে সর্বাংশে তা অনুভূত হয়। বোখারি ও মুসলিম।
উপরের আলোচনা থেকে একথাই প্রতীয়মান হলো যে মুসলমান মুসলমানের ভাই। সত্যিই বিশ্বভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় হুজুর (সা.) এমন একটি রূপ পরিগ্রহ ও সমাজ স্থাপন করেছিলেন যার নজির ইতিহাসে মেলা ভার। কোনো সভ্য দেশের সভ্যসমাজ আজও তা দেখাতে পারেনি।
সত্য বলতে কী! সে সমাজে সবাই ছিল কমল কোমল, সবাই ছিল ভ্রাতৃত্ব সৌহার্দ্যের ডোরে গাঁথা। কেউ কাউকে কষ্ট দিত না। না আচরণে, উচ্চারণে। না কাজে-কর্মে। সবাই ছিল ভাই ভাই হয়ে। বর্তমানে আমরা কি পারি না সবাই ভাই ভাই হয়ে থাকতে। একটি সুন্দর সুশীল সমাজ গঠন করতে, গড়ে তুলতে। 



ম দা দু ল হ ক ই র ফা ন

সমাজ কল্যাণের প্রেরণা ধ্বনিত হোক মিম্বার থেকে

ইসলামের শুভসূচনা মূলত মসজিদকে কেন্দ্র করেই হয়েছিল। মক্কায় অবস্থানকালীন বায়তুল্লাহ মসজিদে প্রকাশ্য ও স্বাধীনভাবে কোনো কার্যক্রম চালানোর সুযোগ না থাকলেও গোপনে একে কেন্দ্র করেই পরিচালিত হয় ইসলামের কার্যক্রম। মদিনায় হিজরত করার পর মসজিদে নববী হয়ে ওঠে মুসলমানদের মূল কেন্দ্রবিন্দু। যাবতীয় কর্মপন্থা নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন হয় এখান থেকেই। রাসুল (সা.) অনন্য ত্যাগের মাধ্যমে যখন মদিনাতে একটি কল্যাণরাষ্ট্র গড়ে তুললেন তখন এর পরিচালনার জন্য আলাদাভাবে কোনো সচিবালয় কিংবা সংসদ গড়ে ওঠেনি। মসজিদে নববীই ছিল সবকিছুর প্রাণ। খেজুর পাতার ছাউনিতে বসেই ১২ লাখ বর্গমাইলের বিশাল সাম্রাজ্য শাসন করেছেন রাসুলুল্লাহ (সা.)। দিকে দিকে ইসলামের বিজয় মশালের শুভযাত্রা শুরু হয় এই মসজিদ থেকেই।
খোলাফায়ে রাশেদার যুগেও মসজিদই ছিল প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। পরবর্তী ইসলামী খেলাফতের যুগ চলাকালীন শাসনকার্যের জন্য আলাদা স্থান নির্বাচন করা হয়ে গেলেও মসজিদের ভূমিকা অনেকাংশে ছিল অক্ষুণ্ন। কিন্তু ইসলামী খেলাফত ব্যবস্থা বিলুপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মসজিদ নিছক ইবাদতখানা হিসেবেই গণ্য হতে থাকে। মসজিদের ভূমিকাও অন্যান্য ধর্মের উপাসনালয়ের মতো হয়ে যায়। মুসলমানদের সামগ্রিক জীবনপদ্ধতিতে মসজিদের যে বিশেষ ভূমিকা হতে পারে সে কথা অনেকেরই অজানা। মসজিদ বলতেই মনে হয়, এখানে শুধু নামাজ হবে আর ফজিলতসংক্রান্ত কিছু ওয়াজ-নসিহত হবে। বিশেষ করে মসজিদের প্রধান ব্যক্তি মুসলমানদের ধর্মীয় নেতা ইমামরাও নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। বেতনধারী কর্মচারী হিসেবে শুধু কর্তব্যের দায়ে ফজিলতসংক্রান্ত কিছু ওয়াজ-নসিহত এবং ফরজ নামাজ পড়ানোকেই নিজেদের প্রধান দায়িত্ব মনে করতে থাকে। ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করা কিংবা আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রতি নজর রাখার পরিবর্তে বর্তমানে তাদের অনেকের লক্ষ্য হচ্ছে কীভাবে মসজিদ কমিটিকে তুষ্ট করা যাবে। তারা যেন কোনোক্রমেই অসন্তুষ্ট না হয়ে যান। অনেক ক্ষেত্রে ইমামরা হীনমন্যতার কারণে সত্য কথা বলা কিংবা বাতিলের প্রতিবাদ করতেও কুণ্ঠিত হন।
মুসলিম জাতির অধঃপতন, সমাজের অবক্ষয় ও ব্যক্তিত্বের চরম অবনতির এই মুহূর্তে ইমামরা তাদের নিজেদের কোনো দায়িত্ব পালনের উপযোগীই ভাবছেন কি না তাতে সন্দেহ আছে। অথচ মুসলিম উম্মাহর এই ক্রান্তিলগ্নে ইমামরা রাখতে পারেন বিশেষ ভূমিকা। মসজিদের মিম্বর হতে পারে বিশেষ দিকদর্শক। কেননা বাংলাদেশের এমন কোনো গ্রাম বা শহর পাওয়া যাবে না, যেখানে কোনো মসজিদ নেই। প্রতিটি মসজিদেই রয়েছে কমপক্ষে একজন করে ইমাম। ইসলামের প্রচার-প্রসার, সামাজিক গণসচেতনতা ও জাগরণ সৃষ্টিতে তারা রাখতে পারে গঠনমূলক ভূমিকা। অন্তত শুক্রবারে অধিকাংশ মুসলমান মসজিদে এসে হাজির হয়। ইমাম সাহেবও তাদের উদ্দেশ্য করে কিছু কথা বলেন। এ কথাগুলোই যদি হয় গঠনমূলক ও পরিকল্পিত, তবে তাতেই আদায় হবে বিশাল দায়িত্ব।
মসজিদের মিম্বর থেকে ইমামদের মাধ্যমে যে বিষয়গুলো উপস্থাপিত হতে পারে, তার কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা হলো—
* ইমাম সাহেব সাপ্তাহিক জুমাবারের খুতবাতে উপস্থিত শ্রোতা-মুসল্লি এবং তার আওতাধীন সমাজে মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় এবং সামাজিক সমস্যা কী তা চিহ্নিত করে এর সমাধানের জন্য সচেতনতা ও প্রেরণা জোগাতে পারেন। পাশাপাশি ইসলামের সোনালি যুগের ইতিহাস থেকে প্রাসঙ্গিক হৃদয়গলানো ঘটনাবলী উল্লেখপূর্বক শ্রোতা-মুসল্লির চিন্তাধারাকে শাণিত করার প্রয়াস চালাতে পারেন।
* সমসাময়িক মুসলিম বিশ্বের সমস্যা ও এর থেকে উত্তরণের পন্থা নির্দেশ করতে পারেন। মুসলমানরা তাদের নিজেদের ইমানি দায়িত্ব আঞ্জাম না দিলে তাদের পরিণতির কথা কোরআন-হাদিসের ভাষ্য উল্লেখপূর্বক তুলে ধরতে পারেন।
* সমাজে সংঘটিত সব ধরনের অপকর্ম, অনৈতিক আচরণের বিরুদ্ধে মুসল্লিদের সচেতন করে তুলতে পারেন। এর ভয়াবহ পরিণতির কথা তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে পারেন।
* যুব সমাজের মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতি জাগ্রতকরণ এবং দেশ ও জাতির স্বার্থে অবদান রাখার জন্য তাদের উদ্বুদ্ধ করতে পারেন।
* সমাজে প্রচলিত ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার, ধর্মের আবরণে ভণ্ডামী এবং সব ধরনের শিরক-বিদআতের প্রতি সবাইকে সজাগ এবং প্রতিরোধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানাতে পারেন।
* যে কোনো ধরনের অন্যায় ও অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হওয়া। কারও অসন্তুষ্ট হয়ে যাওয়ায় তোয়াজ না করে সত্যের প্রতি লোকদের উদ্বুদ্ধ করতে প্রয়াস চালাতে পারেন।
* ছোট ছোট কোমলমতি শিশু-কিশোরদের মধ্যে দ্বীনি শিক্ষার পাশাপাশি সততা, আমানতদারী, পিতা-মাতার খেদমত, সমাজসেবা, মিল্লাতের উন্নতি প্রভৃতি বিষয়ে শিক্ষাদানের জন্য মসজিদভিত্তিক মক্তব গড়ে তুলতে পারেন।
* ইসলাম ও আধুনিকতার মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ সহাবস্থান তৈরি করে ইসলামের সর্বজনীনতা ও কালজয়ী আদর্শ প্রমাণ করতে পারেন। নব-উদ্ভাবিত সমস্যাবলী সমাধানে জরুরি পরামর্শ পেশ করতে পারেন।
* পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, পরিবেশসচেতনতা ও নৈতিক শিক্ষার প্রতি ব্যাপকভাবে গণজোয়ার সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করতে পারেন। প্রয়োজনে মুসল্লিদের সঙ্গে নিয়ে ইমাম সাহেবের নেতৃত্বে পরিবেশ-সচেতনতা কমিটি গঠন করা যেতে পারে।
* ইমাম সাহেব শুধু বক্তব্য রেখে কিংবা পরামর্শ দিয়েই নিজেকে দায়মুক্ত করবেন না, বরং তার প্রতিটি কথা ও পরামর্শ যেন কার্যকর হয়, সে বিষয়ে নিজেকেই উদ্যোগী হতে হবে।
মোটকথা, ইসলামী সমাজের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে হলে মসজিদকে সামাজিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু বানাতে হবে এবং মসজিদের ইমাম সাহেবকে যথাযোগ্য মর্যাদা ও ক্ষমতা দিতে হবে। আর এর জন্য ইমামদের প্রতি সাধারণ লোকদের ধারণা যেমন স্বচ্ছ হওয়া জরুরি, তেমনি ইমাম সাহেবকেও এই মানসিকতা তৈরি করতে হবে যে ইমামতি নিছক কোনো চাকরি নয়, বরং এটা একটি মহান দ্বীনি
দায়িত্ব। তাই এ দায়িত্বের যথাযথভাবে পালন করতে হবে। 

জ হি র উ দ্দি ন বা ব র

রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ইসলামের নির্দেশনা

ইসলাম : ইসলাম আল্লাহর মনোনীত একমাত্র জীবনবিধান। দুনিয়া ও পরকালীন মুক্তির নির্দেশনা রয়েছে ইসলামে। যেহেতু ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান, এর মধ্যে আছে মানবজীবনের প্রয়োজনীয় সব নির্দেশনা। মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন থেকে নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার বিধিবিধান, আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক, কূটনীতি থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার বিষয়েও ইসলামের নির্দেশনা সুস্পষ্ট।
ইসলামী রাষ্ট্রের নিরাপত্তা : ইসলামী রাষ্ট্রে নিরাপত্তার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এই রাষ্ট্রের নিরাপত্তার বিষয়টি শুধু বৈদেশিক আক্রমণের দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং অভ্যন্তরীণ দিক থেকেও এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামী রাষ্ট্রে সমাজ কীভাবে নিরাপদ থাকবে, এর নিরাপত্তা কীভাবে বিধান করতে হবে তার সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে কোরআন ও হাদিসে। আর বাইরের শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করে ইসলামী রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিধানের নির্দেশনাও আছে ইসলামে। মুসলমানদের মান-ইজ্জত, ধন-সম্পদ এবং রক্ত যাতে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে নিপতিত না হয়, সে জন্য মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, ‘মুসলমান মুসলমানের ভাই। প্রত্যেক মুসলমানের মান, ইজ্জত, ধন-সম্পদ ও রক্ত অন্য মুসলমানের ওপর হারাম।’ (মুসলিম)। অর্থাত্ মানুষের সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে এমন কাজকে নবীজি কঠোরভাবে হারাম ঘোষণা করেছেন।
অর্থনৈতিক নিরাপত্তার বিষয়টিও ইসলামে গুরুত্বসহকারে বিবেচিত হয়েছে। এ জন্য যাকাত, ফিতরা ও উশরের বিধান চালু করা হয়েছে। আর এ নিরাপত্তার বিধানগুলো নিশ্চিত করার জন্য যাকাত প্রদানে আপত্তিকারী কিংবা অস্বীকারকারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা পর্যন্ত করা হয়েছে। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করা এবং দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নির্দেশ জারি করা হয়েছে। কুরআনে বলা হয়েছে, ‘যে সব লোক তোমাদের ওপর হামলা করেছে, তাদের সাথে যুদ্ধ কর, এ যুদ্ধ হবে খোদার পথে।’ শত্রুর আক্রমণকে মোকাবেলা করার জন্য কুরআনে আরো নির্দেশ এসেছে। শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করে ইসলামী রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজকে উত্সাহিত করার জন্য মহানবী (সা) ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহর পথে একদিন সীমান্ত পাহারা দেয়া দুনিয়া ও এর ওপরে অবস্থিত সব জিনিস থেকেও উত্তম।’
ইসলামী রাষ্ট্রের নিরাপত্তা তথা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার কৌশল সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো :
আদর্শিক শক্তি : কোনো আদর্শবাদী রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বা নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে তার আদর্শিক শক্তি। এর নমুনা আমরা দেখেছি রাসুলে করীম (সা.) ও তার সাহাবিদের জীবনে এবং পরবর্তীকালে ইসলামের ইতিহাসে। আমরা এর জলজ্যান্ত উদাহরণ পাই বদর, খন্দক ও ইয়ারমুকসহ অসংখ্য জিহাদে। ইসলামের প্রথম জিহাদ বদরে ঈমানি শক্তিতে বলীয়ান মাত্র ৩১৩ জন মুসলমান বিপুল অস্ত্র ও অন্যান্য শক্তিতে বলীয়ান ১০০০ কাফিরের বিরুদ্ধে সহজে বিজয় লাভ করে।
কোরআন মজিদ উল্লেখ করেছে, ‘উচ্চমানের ঈমান ও ইয়াকিন এবং পরিপূর্ণ সবর ও দৃঢ়তা যদি থাকে তাহলে তারা দশগুণ শক্তির ওপরে বিজয় লাভ করতে সক্ষম হবে।’ আমাদের কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্রের নিরাপত্তায় আজও আদর্শই মূল শক্তি। অস্ত্র, মারণাস্ত্র ও সমরশক্তি সহযোগী মাত্র।
নৈতিক ও মানসিক শক্তি : শত্রুকে মোকাবিলা করার পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয় তা হলো মানসিক বল ও নৈতিক শক্তি। মানসিক ও নৈতিক শক্তিতে দুর্বল বিশাল সৈন্যবাহিনী তার বিপুল রণসম্ভারসহ পরাজয়বরণ করেছে তার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে যথেষ্ট রয়েছে।
ভূরি ভূরি উদাহরণ দেয়া যায়, কীভাবে আদর্শ ও নৈতিকতা সহজে বিজয় লাভ করতে পারে। এ জন্য ইসলাম মানসিক মনোবলকে, শত্রুকে মোকাবিলা করার অন্যতম বলে গুরুত্ব দিয়েছে। এ ব্যাপারে কোরআন মাজিদে বলা হয়েছে, ‘তোমরা সাহসহীন হইও না, ভারাক্রান্ত হইও না, তোমরাই বিজয়ী হবে, যদি তোমরা ঈমান ও দৃঢ়প্রত্যয়ের অধিকারী হও।’ মানসিক দুর্বলতা যে পরাজয়ের মূল কারণ তা উল্লেখ করে কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা ঈমান ও দৃঢ়প্রত্যয়সম্পন্ন একশ’ লোক হলে কাফিরদের এক সহস্র ব্যক্তির ওপর জয়ী হতে পারবে। কেননা, কাফিরদের জ্ঞান-বুদ্ধি বলে কিছুই নেই।’
দৃঢ় ঐক্য ও শৃঙ্খলা : যুদ্ধে জয় এবং শত্রুর মোকাবিলায় ঐক্য ও শৃঙ্খলা যে কত জরুরি তা ওহুদ যুদ্ধের ঘটনা থকে মুসলমানরা শিক্ষা নিতে পারে। ইসলাম প্রতিষ্ঠা ও ইসলামী রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিধানের ক্ষেত্রে ঐক্য ও শৃঙ্খলার যে কোনো বিকল্প নেই তা সহজেই অনুমেয়। আজ গোটা বিশ্বে ও বিভিন্ন দেশে মুসলমানদের বিপর্যয়, পরাজয় এবং পরাধীনতার পেছনে আমরা তাদের মধ্যকার অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলাই লক্ষ্য করি।
মুসলমানদের ঐক্যের ব্যাপারে কোরআন মাজিদে বলা হয়েছে, ‘হে ঈমানদার লোকেরা! তোমরা যখন শত্রুবাহিনীর মুখোমুখি হবে তখন অবশ্যই দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত হবে। আল্লাহকে খুব বেশি করে স্মরণ করবে। আশা করা যায়, তোমরা সাফল্যমণ্ডিত হবে। আর তোমরা আনুগত্য করবে আল্লাহ এবং তার রাসুলের, আর তোমরা পরস্পরের অনৈক্য ঝগড়া-বিবাদে মশগুল হবে না। তা যদি হও, তবে তোমরা ভীরু ও কাপুরুষ হয়ে যাবে। তোমাদের শক্তি ও উন্নতি হাওয়ায় উড়ে যাবে। তোমরা অবশ্যই ধৈর্যধারণ করবে। আল্লাহও ধৈর্যশীলদের সঙ্গেই আছেন।
বৈষয়িক ও বস্তুগত শক্তি : যে কোনো রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য তার আদর্শিক শক্তি এবং মনোবল ও মানসিক দৃঢ়তা যেমন প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন বস্তুগত শক্তিরও। যদিও এটা কখনোই মুখ্য বিষয় বলে বিবেচিত হয়নি। ইসলামে এই বৈষয়িক প্রাধান্যকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়নি। তবে বৈষয়িক ও বস্তুগত উপকরণকে যুদ্ধে নিরুত্সাহিতও করা হয়নি। কোরআন মাজিদে বলা হয়েছে, ‘আর তোমরা যতদূর তোমাদের সাধ্য-সামর্থ্যে কুলায়, বেশি বেশি করে শক্তি-দক্ষতা এবং সদস্য ও ঘোড়া যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত রাখবে, যেন উহার সাহায্যে আল্লাহর ও তোমাদের নিজেদের শত্রুদের এবং এমনসব শত্রুদের যাদের তোমরা জান না, কিন্তু আল্লাহ জানেন ভীত-সন্ত্রস্ত করতে পার। আল্লাহর পথে তোমরা যা কিছু ব্যয় করবে তার পুরোপুরি প্রতিফল তোমাদের আদায় করে দেয়া হবে এবং তোমাদের প্রতি কোনোরূপ জুলুম করা হবে না।’
ইসলামী রাষ্ট্রের নিরাপত্তার বিষয়টিতে কোনোভাবেই হেলাফেলা করার সুযোগ নেই। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে অবশ্যই তা রাষ্ট্রের আদর্শেরও বিপর্যয় ঘটাতে পারে। তাছাড়া অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও যেসব বিষয় নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করার সম্ভাবনা রয়েছে সে দিকেও লক্ষ্য রাখা জরুরি। এ ব্যাপারে গোটা মুসলিম জনগোষ্ঠীরই অপরিসীম দায়িত্ব রয়েছে।
লেখক : ই ক বা ল ক বী র মো হ ন

শিশু সাহিত্যিক, প্রবন্ধকার ও ব্যাংকার

মার্কিন অভিনেত্রী প্যারিস হিলটনের ইসলাম গ্রহণ দুনিয়া কাঁপানো তারকাদের জীবনে রূপান্তরের বিপ্লব

যুক্তরাষ্ট্রের সাড়া জাগানো অভিনেত্রী প্যারিস হুইটনি হিলটন শান্তির ধর্ম ইসলাম গ্রহণ করেছেন। তার মুখপাত্র আয়ান ব্রিঙ্কহাম সিবিএস নিউজকে একথা জানিয়েছেন। ব্রিঙ্কহাম বলেছেন, তিনি বেশ কিছুদিন থেকে ইসলাম গ্রহণের কথা চিন্তাভাবনা করছিলেন। বিশেষ করে ২০০৪ সালে সেঞ্চুরি রিজিওনাল ডিটেনশন সেন্টারে অবস্থানের সময় ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার স্বপ্ন দেখতে থাকেন। ওই ডিটেনশন সেন্টারে তিনি ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত লোকের সংস্পর্শে এসে ইসলাম সম্পর্কে ধারণা লাভ করেন। ইসলাম গ্রহণের মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর অতীতের ক্লেদাক্ত জীবন থেকে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। জেদ্দায় একটি ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র থেকে তিনি বলেন, ‘আমি জীবনের পরিপূর্ণ শান্তি খুঁজে পেয়েছি। আগে আমি একটি নষ্টা মেয়ে হিসেবে পরিচিত ছিলাম। সে অবস্থার এখন পরিবর্তন ঘটেছে। এই পরিবর্তনের জন্য মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছি।
মিস হিলটন আগামী সপ্তাহে লস এঞ্জেলসে ফিরে গিয়ে বেভারলি হিলের মধ্যভাগে একটি ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র চালুর পরিকল্পনা করছেন। তার নামও পরিবর্তন করে তিনি ‘তাহিরা’ রাখতে চান। তার এই স্কুল তিনি বহু তারকাখ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিকে ধর্মীয় শিক্ষাদানের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে চান। উল্লেখ্য, প্যারিস হিলটন বিশ্বখ্যাত হিলটন হোটেলের প্রতিষ্ঠাতা কনারাড হিলটনের প্রপৌত্রী।
শোবিজ জগতের সুপার স্টার, স্বপ্নলোকের বাসিন্দা ও পৃথিবীর কোটি মানুষের হৃদয় কাঁপানো এই তারকার এমন ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত বর্তমান প্রজন্মের চিন্তার জগতে ঝড় তোলার সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। গত বছরের শেষের দিকে ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন মহাকাশবিজ্ঞানী নভোচারী সুনীতা উইলিয়াম সদলবলে ইসলাম গ্রহণ করে বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি খুলে দেয়ারও চেষ্টা করেছেন।
পশ্চিমা দুনিয়ায় ইসলাম একটি বিকাশমান ও নন্দিত জীবনব্যবস্থা হিসেবে আত্মপ্রকাশের খবর একেবারে নতুন না হলেও সম্প্রতি পাশ্চাত্যের খ্যাতিমান বেশ কয়েকজন ব্যক্তিত্বের ইসলাম গ্রহণ গোটা বিশ্বের নজর কেড়েছে। বিখ্যাত পপস্টার মাইকেল জ্যাকসনের রহস্যাবৃত মৃত্যুর পর তার মুসলিম পরিচয় নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে প্রচার-প্রোপাগাণ্ডা ও বিচিত্র তথ্য ছড়ানো হয়েছে। অনেকের মতে, তার ইসলাম গ্রহণের খবরটিকে পশ্চিমা মিডিয়া এবং সরকারগুলো প্রকাশ হতে দেয়নি এবং তিনি নিজেও এ ব্যাপারে প্রচণ্ড চাপে ছিলেন।
আফগানিস্তানের তালেবানদের হাতে বন্দি হয়ে ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য ও মাহাত্ম্যে বিমুগ্ধ ব্রিটিশ নারী সাংবাদিক র্যাডল তো তার ইসলাম গ্রহণের কথা গোটা দুনিয়ার সামনে সগর্বে ঘোষণা দিয়েছেন। আরেকজন বিখ্যাত নারী সাংবাদিক সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের শ্যালিকার ইসলাম গ্রহণের খবর পুরো পশ্চিমা বিশ্বকে অবাক করেছে। সাড়া জাগানো মার্কিন অভিনেত্রী প্যারিস হিলটন মুক্তির এই মিছিলে সংযোজিত সাম্প্রতিক সময়ের সর্বশেষ নাম।
যারা ইসলামকে সেকেলে, ব্যক্তি-স্বাধীনতা, আধুনিকতা, মানবাধিকার ও প্রগতির প্রতিবন্ধকরূপে (কেউ ইনিয়ে বিনিয়ে কেউবা সোজাসাপ্টাভাবে) চিত্রিত করার পণ্ডশ্রমে সময় ব্যয় করেন উল্লিখিত ব্যক্তিদের ইসলাম গ্রহণে ক্ষণিকের জন্য হলেও আশা করি তারা লজ্জায় মুখ লুকাবেন। গড্ডালিকা প্রবাহে চিন্তার ডিঙ্গি ভাসিয়ে না দিয়ে স্থির হয়ে ভাবতে বসবেন। এক সময়ের হার্টথ্রব নায়িকা, গ্লামার গার্ল এবং বিখ্যাত মিডিয়া ব্যক্তিত্ব যখন ইসলামের শালীন পোশাক তথা বোরকা বা হিজাব পরিহিতা হিসেবে নিজেকে সগৌরবে উপস্থাপন করেন, তখন আধুনিকতা ও নান্দনিকতার নামে অবাধ যৌনতাবাদীদের চেহারায় কালো মেঘের ছায়া নামে। আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন, সচেতন, শিক্ষিতা নারী সমাজ এতে খুঁজে পান জীবনে চলার আলোকিত পথ, নতুন উদ্যম, বিশ্বাসদীপ্ত প্রেরণা। প্রবল আত্মবিশ্বাসে উচ্চারণ করেন—‘আমি মুসলিম, ইসলাম আমার স্বপ্নের ঠিকানা’। অবস্থাদৃষ্টে এটা অনুমিত হওয়া স্বাভাবিক যে, ফ্যাশনের নামে স্বল্পবসন আর শিল্পের নামে নারীর পণ্যায়নসহ অবাধ ভোগের কৌশলগুলোকে হালাল করার জন্য যারা এতদিন নারীসমাজকে বিভ্রান্ত করেছেন; তাদের জগত ছোটো হয়ে আসছে। কারণ নারীরা জাগছে এবং খুঁজে নিচ্ছে নিজেদের নিরাপত্তা, মর্যাদা, স্বকীয়তা ও স্বাধীনতার ঠিকানা ‘ইসলাম’।
অন্যদিকে আপনি ক্রীড়াজগতের কীর্তিমান খেলোয়াড় বা সেরা তারকাদের খোঁজ নিলে সেখানেও দেখবেন ইসলামী আদর্শ ও অনুশাসনের প্রতি তাদের আগ্রহ দিন দিন প্রবলতর ও ক্রমবর্ধমান। তাদের পরিবর্তনগুলো বেশ চোখে পড়ার মতো। এখানে প্রাসঙ্গিক কারণে আমরা কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান ক্রিকেট তারকার নাম উল্লেখ করব যারা রাসুলের সুন্নাহ বা আদর্শ অনুসরণ করে চলছেন; অথচ এক সময় তারা সবাই ক্লিনশেভে ছিলেন। যথাক্রমে সাঈদ আনওয়ার, ইনজামাম উল হক, জুলকারনাইন ও মোস্তাক আহমদ, সাবেক ক্রিকেটার পাকিস্তান। শহীদ আফ্রিদী ও মুহাম্মদ ইউসুফ (যিনি আগে খ্রিস্টধর্মাবলম্বী ছিলেন, তখন তার নাম ছিল ইউসুফ ইউহানা) বর্তমান ক্রিকেটার পাকিস্তান। হাশিম আমলা বর্তমান ক্রিকেটার দক্ষিণ আফ্রিকা এবং সোহরাওয়ার্দী শুভ বাংলাদেশ দলের বর্তমান ক্রিকেটার। চিন্তাশীল ও বিচক্ষণ প্রজন্মের জন্য দুনিয়া কাঁপানো তারকাদের জীবনের এই বিপ্লবাত্মক মেরুকরণে চিন্তার খোরাক রয়েছে। মার্কিন অভিনেত্রী প্যারিস হিলটনের ইসলাম গ্রহণ এ ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক। ষ
লেখক : খ ন্দ কা র মু হা ম্ম দ হা মি দু ল্লা হ
প্রাবন্ধিক, অনুবাদক

ফতোওয়া প্রাথমিক ধারণা

এক.
ফতোওয়া বা ইফতা আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হলো, ‘যে কোনো প্রশ্নের উত্তর দেয়া।’
শরিয়তের পরিভাষায় এর অর্থ হলো, ‘দালায়েলে শরাইয়্যাহর (শরিয়তের সুস্পষ্ট প্রমাণের) ভিত্তিতে কোনো প্রশ্নের বা জিজ্ঞাসার জবাব দেয়া। শরিয়তের সর্বসম্মত দলিল ও প্রমাণ চারটি : যথা—
১. কোরআন, ২. সুন্নাহ ৩. ইজমা ৪. কিয়াস
ক. কোরআন : মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়ত লাভের পর মৃত্যু পর্যন্ত সুদীর্ঘ তেইশ বছরে প্রয়োজন ও চাহিদা অনুযায়ী পবিত্র কোরআন মাজিদ অবতীর্ণ হয়েছে। এতে সর্বমোট ৬৬৬৬টি আয়াত রয়েছে। এর মধ্যে পাঁচ শতাধিক আয়াত হলো শুধু আইনকানুন সম্পর্কীয়। অবশিষ্টগুলো হলো ওয়াজ-নসিহত ও ইতিহাস। তবে এই ওয়াজ-নসিহত ও ইতিহাসের মধ্য থেকেও কিছু আইনকানুন বের হয়েছে। এগুলোই ফিকহের মূল উত্স।
খ. সুন্নাহ : রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ ও অনুকরণ করার জন্য মহান আল্লাহ নির্দেশ প্রদান করেছেন। সে কারণেই সাহাবিরা সর্বদা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পদাঙ্ক অনুসরণ করতেন, যা করতে দেখতেন তাই করতেন এবং কখনও তারা কোনো সমস্যায় পড়লে তা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে জেনে নিতেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসংখ্য সুন্নাহ হতে প্রায় এক হাজার হাদিস ইসলামী ফিকহের মূল উত্স হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে।
গ. ইজমা : ইজমা হলো উম্মতে মুহাম্মদীর সর্বসম্মত অভিমত। কোরআন ও হাদিসে নব উদ্ভাবিত কোনো সমস্যার সুস্পষ্ট সমাধান না পাওয়া গেলে তখন এ উম্মতের মুজতাহিদরা কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে এর গবেষণা চালাতেন। এরপর কোনো নির্দিষ্ট সমাধান বের হলে যদি তাতে সবাই ঐকমত্য পোষণ করতেন, তবে তাকে ইজমা বলত। এটি ফিকহে ইসলামীর একটি মূল উত্স। যেমন—হজরত আবু বকরকে (রাজি.) খলীফা নিযুক্ত করার ব্যাপারে কোন সুস্পষ্ট নির্দেশনা না থাকার ফলে সবাই সাহাবিদের সর্বসম্মত অভিমত দ্বারা তার খিলাফতের বৈধতা প্রমাণিত হয়েছে।
ঘ. কিয়াস : কোরআন, সুন্নাহ ও ইজমা দ্বারা মীমাংসিত কোনো বিষয়ের সঙ্গে অনুরূপ কোনো বিষয়কে উপমা দ্বারা সাদৃশ্য বিধান করে হুকুম উদ্ভাবন করাকে কিয়াস বলে। এটা হাদিস দ্বারা সাবেত আছে। যেমন—দশম হিজরিতে হজরত মুআজকে (রাজি.) ইয়েমেনের বিচারক নিযুক্ত করে পাঠানোর সময় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোরআন ও সুন্নায় কোনো সমাধান না পাওয়া গেলে কীভাবে সমাধান করবে বলে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, জবাবে হজরত মুআজ (রাজি.) বললেন, আমি ইজতিহাদ করে তার ফয়সালা করব। এ জবাবে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন। এতে বোঝা যায়, কিয়াসও ইসলামী ফিকহের মূল উেসর অন্যতম।
এই দালায়েলে শরইয়্যাহর অভিজ্ঞ ব্যক্তিই ফতওয়া দিতে পারেন। অভিজ্ঞ ব্যক্তির ফতওয়া দেয়ার অধিকার কোরআন হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। সুতরাং ফতওয়ার এই অধিকার রহিত করার ক্ষমতা কারও নেই।
দুই.
কোরআন-সুন্নাহ এবং ইজমায়ে উম্মতের অকাট্য প্রমাণ দ্বারা শরীয়তের যেসব বিষয় প্রমাণিত আছে, যেমন—তাওহিদ, রেসালাত, আখিরাত, নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, হালাল, হারাম ইত্যাদি। এসব বিষয় কেউ অস্বীকার করলে সে কাফির হয়ে যাবে। আর কিয়াসের দ্বারা প্রমাণিত বিষয় অস্বীকার করলে কাফির না হলেও এটি গোমরাহির অন্তর্ভুক্ত।
তিন.
ফতওয়ার প্রথম উত্স কোরআন। কোরআনের সব আহকাম ও মাসায়েল আল্লাহর পক্ষ থেকে ফতওয়া। এজন্য প্রথম ফতওয়াদানকারী হলেন স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। কোরআনের দুটি আয়াতে আল্লাহতায়ালা ফতওয়া দেন বলে সুস্পষ্ট ঘোষণা রয়েছে—
‘(হে নবী) তারা আপনার কাছে নারীদের ব্যাপারে ফতওয়া (সিদ্ধান্ত) জানতে চায়, আপনি (তাদের) বলে দিন, আল্লাহ তায়ালা তাদের ব্যাপারে ফতওয়া (সিদ্ধান্ত) ঘোষণা করেছেন।’ [সূরা নিসা : আয়াত-১২৭]
আরো এরশাদ হয়েছে—
‘(হে নবী) তারা আপনার কাছে (বিভিন্ন বিষয়ে) ফতওয়া জানতে চায়, আপনি বলুন, আল্লাহতায়ালা সে ব্যক্তির উত্তরাধিকার সংক্রান্ত ব্যাপারে তোমাদের তাঁর ফতওয়া (সিদ্ধান্ত) জানাচ্ছেন।’ [সূরা নিসা : আয়াত-১৭৬]
যার অর্থ হলো, কোরআনের সব আহকাম আল্লাহর ফতওয়া।
হাদিসে বর্ণিত সব মাসায়েল, আইন, আহকাম হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে ফতওয়া। এজন্য তিনি হলেন, উম্মতের প্রধান ও প্রথম মুফতি। আল্লামা কারাফী বলেন : ‘তিনিই উম্মতের মুফতিয়ে আজম।’
চার.
এই দুই প্রধান উেসর ভিত্তিতেই পরবর্তীকালে ইজমা এবং কিয়াসের সৃষ্টি। এ দুটোর ভিত্তিতেও যে ফতওয়া দেয়া হয়, তাও শরয়ী ও অহিভিত্তিক ফতওয়া।
এখানে একথা মনে রাখা দরকার, অহি-ই হলো শরীয়তের মূল উত্স ও ভিত্তি।
অহি প্রথমত দুই প্রকার : যথা—১. অহিয়ে সরীহ বা স্পষ্ট অহি। ২. অহিয়ে গাইরে সরীহ বা অস্পষ্ট অহি।
অহিয়ে সরীহ দুই প্রকার। যথা—১. অহিয়ে মাতলু যা নামাজ ও নামাজের বাইরে তিলাওয়াত করা হয়। ২. অহিয়ে গাইরে মাতলু যা নামাজে তিলাওয়াত করা হয় না।
অহিয়ে মাতলু হলো কোরআন। আর অহিয়ে গাইরে মাতলু হলো হাদিস।
অহিয়ে গাইরে সরীহ যাকে অহিয়ে খফিও বলা হয়। তিন প্রকার। যথা—১. ইজতিহাদে নবী ২. ইজমায়ে উম্মত ৩. ইজতিহাদে মুজতাহিদীন এবং ফুকাহা।
কাজেই শরীয়তে ফতওয়ার মূল উত্সই হলো, অহি। আর অহির ওপর প্রচলিত আদালতের নিয়ন্ত্রণের কোনো অধিকার নেই।
পাঁচ.
ফতওয়া এবং কাজার (বিচার ব্যবস্থা) ভেতর পার্থক্য আছে। ফতওয়া হলো জিজ্ঞাসার ভিত্তিতে বা জিজ্ঞাসা ছাড়াও ইসলামের প্রয়োজনীয় বিষয় জনসাধারণকে অবহিত করা। এটি প্রত্যেক আলেম ও মুফতির জন্য ফরজ।
হাদিসে বলা হয়েছে—‘জিজ্ঞাসা করার পরও যারা জবাব না দেবে, কিয়ামতের দিন তাদের মুখে আগুনের বেড়ি পরিয়ে দেয়া হবে।’ কাজেই ফতওয়া বন্ধের অধিকার কোনো সরকারের নেই।
কাজার অর্থ হলো, ইসলামী আইন বাস্তবায়ন করা। এর সম্পর্ক হলো, ইসলামী আদালত ও হুকুমতের সঙ্গে। যেমন—হুদুদ, কিসাস, দিয়্যাত ইত্যাদি।
এ জাতীয় আইন বাস্তবায়নে প্রয়োজন ইসলামী সরকার। এ জাতীয় আইন সমাজের কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইসলামী আইন সম্পর্কে অজ্ঞ লোকদের দ্বারা বাস্তবায়নের অপচেষ্টার কোনো যৌক্তিকতা নেই; বরং এটি ফতওয়াকে বন্ধ করার একটি গভীর ষড়যন্ত্র। ষ
লেখক : মু ফ তি ফ জ লু ল হ ক আ মি নী

প্রধান মুফতি ও প্রিন্সিপাল, জামেয়া কোরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ, ঢাকা।