Wednesday, September 28, 2011
Tuesday, May 3, 2011
Friday, April 29, 2011
Wednesday, April 27, 2011
Friday, April 1, 2011
উত্তরাধিকারে নারীকে অর্ধেক দেয়া হবে কেন?
ইবনে হুসাইন
বস্তুত ইসলাম নারী উন্নয়ন ও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে নয়। বরং নারী নির্যাতনের এক চরম সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে সারা বিশ্বের নির্যাতিত ও নিগৃহীত নারীর পক্ষে ইসলামই সর্বাগ্রে আওয়াজ বুলন্দ করেছে। জীবন্ত প্রোথিত হওয়ার আবহ থেকে, পণ্য হিসেবে বাজারে বিক্রি হওয়ার পরিবেশ থেকে উঠিয়ে এনে নারীকে সম্মানের রাজাসনে ইসলামই সর্বপ্রথম অধিষ্ঠিত করেছে। সামাজিক সমূহ নিগ্রহের অক্টোপাস থেকে মুক্ত করে নারীকে স্বাধীন জীবন উপভোগ করার সুযোগ করে দিয়েছে। মাতৃত্বের গৌরবে বিভূষিত নারীর দেহবল্লরী যাতে যারতার লালসা ও লোলুপ দৃষ্টির শিকার না হয় সেজন্য পর্দার বিধান দিয়ে মানবরূপী পশুদের দৃষ্টিসীমার অন্তরালে নিয়ে নারীকে করেছে দুর্লভ, মহামূল্যবান ও মহাসম্মানী। বিয়েতে মোহরের প্রথার প্রবর্তন করে নারীর মূল্য যে পুরুষের তুলনায় বেশি সে বিষয়টি পরিষ্কার করে দিয়েছে। পারিবারিক অর্থ জোগানের দায়-দায়িত্ব ও কায়িক কষ্টকর শ্রমের বোঝা নারীর ওপর অর্পণ না করে পুরুষের কাঁধে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। আর নারীকে আগামী পৃথিবীর জন্য যোগ্য ও আদর্শবান, সত্পরায়ণ, ন্যায়নিষ্ঠ, মমত্ববোধসম্পন্ন নতুন প্রজন্ম গড়ে তোলার সর্বশ্রেষ্ঠ দায়িত্ব অর্পণ করে তাকে মর্যাদার শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছে দিয়েছে। কোনোরূপ আর্থিক ব্যয়ের দায়িত্ব নারীর ওপর অর্পণ না করেও পৈতৃক উত্তরাধিকারে তাকে পুরুষের অর্ধেক প্রদান করে তার জীবনের অর্থনৈতিক ভিতকে করা হয়েছে সুদৃঢ়; যাতে দুর্যোগের মোকাবিলা সে সহজেই করতে পারে। যৌথ জীবনে পুরুষকে তার অভিভাবক সাব্যস্ত করে সব জটিলতা ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত রেখে নারীকে দান করেছে টেনশনমুক্ত হাস্যোজ্জ্বল এক আনন্দময় জীবন। বলতে গেলে ইসলাম নারীকে যে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত করেছে তার চেয়ে বেশি সম্মান দেয়া আদৌ সম্ভব নয়। পৃথিবীতে কেউ দেয়নি, দিতে পারবে না কোনো কালেও।
বস্তুত নারী-পুরুষের স্বভাব ও মেজাজ বিবেচনা করে ইসলাম কোনো ক্ষেত্রে নারীকে দায়িত্ব দিয়েছে কম, পুরুষকে দিয়েছে বেশি, আবার কোনো ক্ষেত্রে পুরুষকে দায়িত্ব দিয়েছে কম নারীকে দিয়েছে বেশি। আবার অধিকারের প্রশ্নেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষকে দেয়া হয়েছে বেশি, আর নারীকে দেয়া হয়েছে কম। তবে এ ধরনের ক্ষেত্র খুব একটা বেশি নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইসলাম উভয়ের দায়িত্ব ও অধিকারে সাম্য বিধান করেছে যথার্থভাবেই। যেসব ক্ষেত্রে কাউকে বেশি ও কাউকে কম দেয়া হয়েছে, তার যুক্তিসঙ্গত কারণ ব্যাখ্যাা করে দিয়েছে ইসলাম। সামাজিক ভারসাম্য ও পারিবারিক বন্ধন অটুট রাখার জন্যই যে এরূপ করা হয়েছে তা বলাই বাহুল্য। ইসলামের এই ভারসাম্যপূর্ণ নীতি অনুসরণ করে ১৪শ’ বছর যাবত ইসলামী সমাজ নির্বিঘ্নে পরম শান্তি ও শৃঙ্খলার সঙ্গে অতিবাহিত করে আসছে তাদের জীবন। কিন্তু পাশ্চাত্য জগতের নারীরা ইসলাম প্রদত্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকার কারণে ছিল চরম নিগ্রহের শিকার। সেই নিগ্রহের জাঁতাকলে পিষ্ট হতে হতে একদিন তথাকার নারীরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে; তারা তাদের অধিকারের দাবি নিয়ে রাজপথে অবতীর্ণ হয়। সেই আন্দোলন জোরদার হয়ে একদিন তা সমঅধিকার দাবিতে পরিণত হয়। বস্তুত সেই প্রেক্ষাপটেই অনুষ্ঠিত হয় ‘কনভেনশন অন দ্য এলিমিনেশন অব-অলফম অব ডিসক্রিমিনেশন এগেইনস্ট উইমেন’ সংক্ষেপে (সিডও)। সেই সম্মেলনের সিদ্ধান্তবলিকে বলা হয় ‘সিডও সনদ’। জাতিসংঘ এ সনদ জারি করতে চাইলে বিশ্বের বহু দেশই তা মেনে নেয়নি। কেননা সেই সনদে নারীকে যেভাবে চিত্রায়ন করা হয়েছে, তা স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করে বাস্তবায়ন করা সম্ভব ছিল না। অধিকাংশ মুসলিম দেশও তা মেনে নেয়নি। কেননা তার বহু ধারা ইসলামের সঙ্গে ছিল সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক।
বিশেষ করে উত্তরাধিকারে নারী-পুরুষের সমতার নীতি এবং তালাকের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতার নীতি ছিল সম্পূর্ণরূপে কোরআনের বিধানের পরিপন্থী। একই পিতামাতার সন্তান হয়ে বোন পাবে ভাইয়ের অর্ধেক। এই নীতি অনেকের কাছেই যুক্তিগ্রাহ্য নয়। এ নীতির মাঝে অনেকেই অবিচারের গন্ধ পান, নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের তত্ত্ব আবিষ্কার করার চেষ্টা করেন। আসলে মহান আল্লাহ তায়ালা নারীদের প্রতি কতটা সহানুভূতি প্রদর্শন করেছেন, সে বিষয়টি তারা তলিয়ে দেখেন না।
নারীকে উত্তরাধিকারে সমান না দেয়ার প্রশ্ন উঠিয়ে একশ্রেণীর তথাকথিত বুদ্ধিজীবী নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যে মায়াকান্না করছেন তারা আসলে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে আদৌ ধারণাই রাখেন না। কেননা, পৈতৃক উত্তরাধিকারই নারীর একমাত্র উত্তরাধিকারের সূত্র নয়; বরং নারীরা পিতামাতার সম্পদে উত্তরাধিকার লাভের সঙ্গে সঙ্গে স্বামীর সম্পদেও উত্তরাধিকার লাভ করে থাকেন। স্বামী নিঃসন্তান হলে তার সম্পদের এক-চতুর্থাংশ লাভ করেন। আর স্বামীর সন্তান থাকলে তখন এক অষ্টমাংশ লাভ করেন। আর নারীর জীবদ্দশায় তার সন্তান মারা গেলে তার সম্পদের এক ষষ্ঠাংশ লাভ করে থাকেন। এভাবে বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তার সম্পদের পরিমাণ তার দায়-দায়িত্ব ও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি।
ইসলামী সমাজে নারীকে কোনো অর্থনৈতিক দায়িত্ব বহন করতে হয় না। এমনকি তার নিজের দায়িত্বও তাকে বহন করতে হয় না। জন্মের পর থেকে বিয়ের আগ পর্যন্ত তার লালন-পালন ও ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পিতার। বিয়ের পর তার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব স্বামীর। স্বামীর মৃত্যুর পর তার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব ছেলের (যদি সে বালেগ হয়)। সুতরাং কোনো এক সন্ধিক্ষণেও তার নিজের দায়িত্ব তাকে বহন করতে হয় না। সন্তানের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পিতার, মাতার নয়। বাবা-মা বৃদ্ধ হয়ে গেলে তাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব ছেলের। পারিবারিক আত্মীয়-স্বজনের আপ্যায়নের দায়িত্ব পুরুষের, নারীর নয়। সারকথা এই দাঁড়ায়, জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই নারীকে তার নিজের বা অন্যের দায়িত্ব বহন করতে হয় না। অথচ ছেলে সন্তান হলে বালেগ হওয়ার আগ পর্যন্ত তার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পিতার। বালেগ হওয়ার পর থেকে তার নিজের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব আইনগতভাবে তার নিজের। বিয়ে করলে স্ত্রীর ভরণ-পোষণের
দায়িত্ব তার ওপর বর্তায়। সন্তান জন্মালে তাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব বাবা হিসেবে তার ওপর এসে যায়। পিতা-মাতা বৃদ্ধ হয়ে গেল তাদের সম্পদ না থাকলে এবং তারা উপার্জনে অক্ষম হলে তাদের দায়-দায়িত্ব ছেলের। আত্মীয়-স্বজনের আপ্যায়নের দায়িত্ব ছেলের ওপর। বেচারা পুরুষ নিজের, স্ত্রী-সন্তান ও পিতা-মাতাসহ সবার দায়িত্ব বহন করে যা পায়, তা নারীর প্রাপ্তির তুলনায় যথেষ্ট কম। পক্ষান্তরে রমণী নিজের দায়িত্বও বহন করে না, আর অন্য কারও কোনো দায়িত্ব বহন না করার পরও তাকে যদি পৈতৃক উত্তরাধিকারে পুরুষের অর্ধেকসহ অন্য সূত্রেও উত্তরাধিকারে অংশ দেয়া হয়ে থাকে, তাহলে কি বিষয়টা অবিচার করা হয়েছে বলে মনে হয়? তদুপরি মোহর হিসেবে প্রাপ্ত টাকা, বৈধ পন্থায় উপার্জিত সম্পদে তার পূর্ণ অধিকার থাকে। স্বামী অভাবে পড়লেও স্ত্রীর ব্যক্তিগত সম্পদে হস্তক্ষেপ করার কোনো অধিকার তার নেই। সুতরাং বলা যায়, দায়-দায়িত্ব ও প্রয়োজনের বিচারে নারীকে উত্তরাধিকার হিসেবে যতটুকু দেয়া হয়েছে তা অনেক বেশি। নারী দুর্বল বলেই দায়িত্ব না দিয়েও তাকে পিতা-মাতার উত্তরাধিকারে অর্ধেক দেয়া হয়েছে। যাতে দুর্যোগের সময় বা কারও অসহযোগিতার মুহূর্তে তার জীবন সঙ্কটে নিপতিত না হয়। ইসলামী সমাজের এই স্ট্রাকচারাল দিক সম্পর্কে যারা অবগত নয়, তারাই আল্লাহর বিচারে সন্তুষ্ট হতে না পেরে নিজেরাই নারীর পক্ষে মায়াকান্না শুরু করে দেন। তাদের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয়, (নাউজুবিল্লাহ) মহান আল্লাহ তায়ালা ভুল করলেও তারা সে ভুল সংশোধন করে ফেলতে চান। তাই তারা সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু করেন। জাতিসংঘ প্রণীত সিডও সনদ পড়ে সেরূপই মনে হয়। তবে মুসলিম জাতিকে মনে রাখতে হবে, আল্লাহর চেয়ে ইনসাফগার কেউ হতে পারে না। যদি কেউ সেরূপ দাবি নিয়ে উপস্থিত হয়, তাহলে মনে করতে হবে এর পেছনে কোনো অসত্ উদ্দেশ্য লুকায়িত আছে। ষ
লেখক : গবেষক, গ্রন্থকার, ইসলামী চিন্তাবিদ
বস্তুত ইসলাম নারী উন্নয়ন ও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে নয়। বরং নারী নির্যাতনের এক চরম সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে সারা বিশ্বের নির্যাতিত ও নিগৃহীত নারীর পক্ষে ইসলামই সর্বাগ্রে আওয়াজ বুলন্দ করেছে। জীবন্ত প্রোথিত হওয়ার আবহ থেকে, পণ্য হিসেবে বাজারে বিক্রি হওয়ার পরিবেশ থেকে উঠিয়ে এনে নারীকে সম্মানের রাজাসনে ইসলামই সর্বপ্রথম অধিষ্ঠিত করেছে। সামাজিক সমূহ নিগ্রহের অক্টোপাস থেকে মুক্ত করে নারীকে স্বাধীন জীবন উপভোগ করার সুযোগ করে দিয়েছে। মাতৃত্বের গৌরবে বিভূষিত নারীর দেহবল্লরী যাতে যারতার লালসা ও লোলুপ দৃষ্টির শিকার না হয় সেজন্য পর্দার বিধান দিয়ে মানবরূপী পশুদের দৃষ্টিসীমার অন্তরালে নিয়ে নারীকে করেছে দুর্লভ, মহামূল্যবান ও মহাসম্মানী। বিয়েতে মোহরের প্রথার প্রবর্তন করে নারীর মূল্য যে পুরুষের তুলনায় বেশি সে বিষয়টি পরিষ্কার করে দিয়েছে। পারিবারিক অর্থ জোগানের দায়-দায়িত্ব ও কায়িক কষ্টকর শ্রমের বোঝা নারীর ওপর অর্পণ না করে পুরুষের কাঁধে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। আর নারীকে আগামী পৃথিবীর জন্য যোগ্য ও আদর্শবান, সত্পরায়ণ, ন্যায়নিষ্ঠ, মমত্ববোধসম্পন্ন নতুন প্রজন্ম গড়ে তোলার সর্বশ্রেষ্ঠ দায়িত্ব অর্পণ করে তাকে মর্যাদার শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছে দিয়েছে। কোনোরূপ আর্থিক ব্যয়ের দায়িত্ব নারীর ওপর অর্পণ না করেও পৈতৃক উত্তরাধিকারে তাকে পুরুষের অর্ধেক প্রদান করে তার জীবনের অর্থনৈতিক ভিতকে করা হয়েছে সুদৃঢ়; যাতে দুর্যোগের মোকাবিলা সে সহজেই করতে পারে। যৌথ জীবনে পুরুষকে তার অভিভাবক সাব্যস্ত করে সব জটিলতা ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত রেখে নারীকে দান করেছে টেনশনমুক্ত হাস্যোজ্জ্বল এক আনন্দময় জীবন। বলতে গেলে ইসলাম নারীকে যে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত করেছে তার চেয়ে বেশি সম্মান দেয়া আদৌ সম্ভব নয়। পৃথিবীতে কেউ দেয়নি, দিতে পারবে না কোনো কালেও।
বস্তুত নারী-পুরুষের স্বভাব ও মেজাজ বিবেচনা করে ইসলাম কোনো ক্ষেত্রে নারীকে দায়িত্ব দিয়েছে কম, পুরুষকে দিয়েছে বেশি, আবার কোনো ক্ষেত্রে পুরুষকে দায়িত্ব দিয়েছে কম নারীকে দিয়েছে বেশি। আবার অধিকারের প্রশ্নেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষকে দেয়া হয়েছে বেশি, আর নারীকে দেয়া হয়েছে কম। তবে এ ধরনের ক্ষেত্র খুব একটা বেশি নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইসলাম উভয়ের দায়িত্ব ও অধিকারে সাম্য বিধান করেছে যথার্থভাবেই। যেসব ক্ষেত্রে কাউকে বেশি ও কাউকে কম দেয়া হয়েছে, তার যুক্তিসঙ্গত কারণ ব্যাখ্যাা করে দিয়েছে ইসলাম। সামাজিক ভারসাম্য ও পারিবারিক বন্ধন অটুট রাখার জন্যই যে এরূপ করা হয়েছে তা বলাই বাহুল্য। ইসলামের এই ভারসাম্যপূর্ণ নীতি অনুসরণ করে ১৪শ’ বছর যাবত ইসলামী সমাজ নির্বিঘ্নে পরম শান্তি ও শৃঙ্খলার সঙ্গে অতিবাহিত করে আসছে তাদের জীবন। কিন্তু পাশ্চাত্য জগতের নারীরা ইসলাম প্রদত্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকার কারণে ছিল চরম নিগ্রহের শিকার। সেই নিগ্রহের জাঁতাকলে পিষ্ট হতে হতে একদিন তথাকার নারীরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে; তারা তাদের অধিকারের দাবি নিয়ে রাজপথে অবতীর্ণ হয়। সেই আন্দোলন জোরদার হয়ে একদিন তা সমঅধিকার দাবিতে পরিণত হয়। বস্তুত সেই প্রেক্ষাপটেই অনুষ্ঠিত হয় ‘কনভেনশন অন দ্য এলিমিনেশন অব-অলফম অব ডিসক্রিমিনেশন এগেইনস্ট উইমেন’ সংক্ষেপে (সিডও)। সেই সম্মেলনের সিদ্ধান্তবলিকে বলা হয় ‘সিডও সনদ’। জাতিসংঘ এ সনদ জারি করতে চাইলে বিশ্বের বহু দেশই তা মেনে নেয়নি। কেননা সেই সনদে নারীকে যেভাবে চিত্রায়ন করা হয়েছে, তা স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করে বাস্তবায়ন করা সম্ভব ছিল না। অধিকাংশ মুসলিম দেশও তা মেনে নেয়নি। কেননা তার বহু ধারা ইসলামের সঙ্গে ছিল সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক।
বিশেষ করে উত্তরাধিকারে নারী-পুরুষের সমতার নীতি এবং তালাকের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতার নীতি ছিল সম্পূর্ণরূপে কোরআনের বিধানের পরিপন্থী। একই পিতামাতার সন্তান হয়ে বোন পাবে ভাইয়ের অর্ধেক। এই নীতি অনেকের কাছেই যুক্তিগ্রাহ্য নয়। এ নীতির মাঝে অনেকেই অবিচারের গন্ধ পান, নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের তত্ত্ব আবিষ্কার করার চেষ্টা করেন। আসলে মহান আল্লাহ তায়ালা নারীদের প্রতি কতটা সহানুভূতি প্রদর্শন করেছেন, সে বিষয়টি তারা তলিয়ে দেখেন না।
নারীকে উত্তরাধিকারে সমান না দেয়ার প্রশ্ন উঠিয়ে একশ্রেণীর তথাকথিত বুদ্ধিজীবী নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যে মায়াকান্না করছেন তারা আসলে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে আদৌ ধারণাই রাখেন না। কেননা, পৈতৃক উত্তরাধিকারই নারীর একমাত্র উত্তরাধিকারের সূত্র নয়; বরং নারীরা পিতামাতার সম্পদে উত্তরাধিকার লাভের সঙ্গে সঙ্গে স্বামীর সম্পদেও উত্তরাধিকার লাভ করে থাকেন। স্বামী নিঃসন্তান হলে তার সম্পদের এক-চতুর্থাংশ লাভ করেন। আর স্বামীর সন্তান থাকলে তখন এক অষ্টমাংশ লাভ করেন। আর নারীর জীবদ্দশায় তার সন্তান মারা গেলে তার সম্পদের এক ষষ্ঠাংশ লাভ করে থাকেন। এভাবে বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তার সম্পদের পরিমাণ তার দায়-দায়িত্ব ও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি।
ইসলামী সমাজে নারীকে কোনো অর্থনৈতিক দায়িত্ব বহন করতে হয় না। এমনকি তার নিজের দায়িত্বও তাকে বহন করতে হয় না। জন্মের পর থেকে বিয়ের আগ পর্যন্ত তার লালন-পালন ও ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পিতার। বিয়ের পর তার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব স্বামীর। স্বামীর মৃত্যুর পর তার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব ছেলের (যদি সে বালেগ হয়)। সুতরাং কোনো এক সন্ধিক্ষণেও তার নিজের দায়িত্ব তাকে বহন করতে হয় না। সন্তানের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পিতার, মাতার নয়। বাবা-মা বৃদ্ধ হয়ে গেলে তাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব ছেলের। পারিবারিক আত্মীয়-স্বজনের আপ্যায়নের দায়িত্ব পুরুষের, নারীর নয়। সারকথা এই দাঁড়ায়, জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই নারীকে তার নিজের বা অন্যের দায়িত্ব বহন করতে হয় না। অথচ ছেলে সন্তান হলে বালেগ হওয়ার আগ পর্যন্ত তার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পিতার। বালেগ হওয়ার পর থেকে তার নিজের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব আইনগতভাবে তার নিজের। বিয়ে করলে স্ত্রীর ভরণ-পোষণের
দায়িত্ব তার ওপর বর্তায়। সন্তান জন্মালে তাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব বাবা হিসেবে তার ওপর এসে যায়। পিতা-মাতা বৃদ্ধ হয়ে গেল তাদের সম্পদ না থাকলে এবং তারা উপার্জনে অক্ষম হলে তাদের দায়-দায়িত্ব ছেলের। আত্মীয়-স্বজনের আপ্যায়নের দায়িত্ব ছেলের ওপর। বেচারা পুরুষ নিজের, স্ত্রী-সন্তান ও পিতা-মাতাসহ সবার দায়িত্ব বহন করে যা পায়, তা নারীর প্রাপ্তির তুলনায় যথেষ্ট কম। পক্ষান্তরে রমণী নিজের দায়িত্বও বহন করে না, আর অন্য কারও কোনো দায়িত্ব বহন না করার পরও তাকে যদি পৈতৃক উত্তরাধিকারে পুরুষের অর্ধেকসহ অন্য সূত্রেও উত্তরাধিকারে অংশ দেয়া হয়ে থাকে, তাহলে কি বিষয়টা অবিচার করা হয়েছে বলে মনে হয়? তদুপরি মোহর হিসেবে প্রাপ্ত টাকা, বৈধ পন্থায় উপার্জিত সম্পদে তার পূর্ণ অধিকার থাকে। স্বামী অভাবে পড়লেও স্ত্রীর ব্যক্তিগত সম্পদে হস্তক্ষেপ করার কোনো অধিকার তার নেই। সুতরাং বলা যায়, দায়-দায়িত্ব ও প্রয়োজনের বিচারে নারীকে উত্তরাধিকার হিসেবে যতটুকু দেয়া হয়েছে তা অনেক বেশি। নারী দুর্বল বলেই দায়িত্ব না দিয়েও তাকে পিতা-মাতার উত্তরাধিকারে অর্ধেক দেয়া হয়েছে। যাতে দুর্যোগের সময় বা কারও অসহযোগিতার মুহূর্তে তার জীবন সঙ্কটে নিপতিত না হয়। ইসলামী সমাজের এই স্ট্রাকচারাল দিক সম্পর্কে যারা অবগত নয়, তারাই আল্লাহর বিচারে সন্তুষ্ট হতে না পেরে নিজেরাই নারীর পক্ষে মায়াকান্না শুরু করে দেন। তাদের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয়, (নাউজুবিল্লাহ) মহান আল্লাহ তায়ালা ভুল করলেও তারা সে ভুল সংশোধন করে ফেলতে চান। তাই তারা সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু করেন। জাতিসংঘ প্রণীত সিডও সনদ পড়ে সেরূপই মনে হয়। তবে মুসলিম জাতিকে মনে রাখতে হবে, আল্লাহর চেয়ে ইনসাফগার কেউ হতে পারে না। যদি কেউ সেরূপ দাবি নিয়ে উপস্থিত হয়, তাহলে মনে করতে হবে এর পেছনে কোনো অসত্ উদ্দেশ্য লুকায়িত আছে। ষ
লেখক : গবেষক, গ্রন্থকার, ইসলামী চিন্তাবিদ
মুমিনের জীবনে দোয়ার শক্তি ও প্রভাব
খা লি দ বে গ
একদিন রাসুল মোহাম্মদ (সা.) কিছু দুর্যোগপীড়িত মানুষকে অতিক্রম করে যাওয়ার পর বললেন, ‘তারা আল্লাহপাকের কাছে রহমত ও নিরাপত্তার জন্য দোয়া করে না কেন?’ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মুসলমান আজ যে দুর্ভোগ ও বিপর্যয়ের শিকার, সেই পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্নটি আজ আমাদের উদ্দেশ্যেও করা যেতে পারে।
এমন নয় যে, আমরা দোয়া করার কথা পুরোপুরি বিস্মৃত হয়েছি; আমরা বরং প্রতিনিয়তই নিয়মিতভাবে দোয়া করি। কিন্তু দোয়া সম্পর্কে আমাদের ধারণা ও ক্রিয়াকর্মাদি আসলে রীতিমত বিকৃতির শিকার এবং আমাদের দোয়ার অধিকাংশ সময়ই নিতান্ত আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। সাধারণভাবে এটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, যখন আমাদের সব চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, তখন একেবারে শেষ অবলম্বন হিসেবে দোয়ার কাছে আশ্রয় গ্রহণ করি এবং এটাও লক্ষণীয় যে, কাজে-কর্মে তো বটেই, অমানবিক কথার দ্বারাও দোয়াকে অবজ্ঞা ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয় এবং এটা আদৌ আশ্চর্যজনক নয় যে, দোয়ার এখন অর্থ দাঁড়িয়েছে পরিস্থিতি থেকে উদ্ভুত নৈরাশ্য, হতাশা ও ব্যর্থতার মোকাবিলায় দোয়া যেন এক ব্যর্থ ও অনাবশ্যক আকুতি।
কী দুর্ভাগ্য! অথচ দোয়া হলো বিশ্বাসীদের জন্য সর্বাধিক শক্তিশালী ও সর্বাধিক ফলপ্রসূ একটি হাতিয়ার। দোয়া ভাগ্যলিপিকে পরিবত
ন করতে পারে, যা আমাদের কোনো চেষ্টা-প্রচেষ্টার দ্বারা সম্ভব নয়। দোয়া হলো সব ইবাদতের সৌরভ ও সারবস্তু। দোয়া আমাদের কোনো কাজে কখনও ব্যর্থ হতে দেয় না, আর দোয়া ছাড়া আমরা কখনও সাফল্যও লাভ করতে পারি না। কোনো বিষয়ে সুষ্ঠু পরিকল্পনা-গ্রহণের আগে ও শেষে আল্লাহর সমীপে দোয়া পেশ করা বিশ্বাসীদের জন্য প্রথম ও শেষ ভরসাস্থল; কারণ বিশ্বাসীদের (ঈমানদার) সব পরিকল্পনা ও কার্যক্রম পূর্বাপর দোয়ার মধ্যস্থলে অবস্থিত।
দোয়া হলো আল্লাহপাকের সঙ্গে আমাদের একান্ত বাক্যালাপ, সেই আল্লাহ যিনি আমাদের স্রষ্টা ও অভিভাবক, যিনি আমাদের প্রভু ও প্রতিপালক, যিনি সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান। বস্তুতই, দোয়া এক অসামান্য তাত্পর্য বহন করে। দোয়া ঊর্ধারোহণের শ্রেষ্ঠ সোপান, মুক্তির বার্তা, ক্ষমতাপ্রাপ্তির পাথেয়, রুপান্তর-প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত এক অতীব ফলপ্রসূ জীবনচেতনা, যা কোনো মানুষের পক্ষে অর্জন করা অসম্ভব। দোয়ার মধ্য দিয়ে আমরা আল্লাহর দিকে ফিরে আসি, কারণ আমরা জানি, একমাত্র তিনিই আমাদের সব দুর্ভোগ থেকে মুক্তি দিতে পারেন; এবং একমাত্র তিনিই পারেন আমাদের সব সমস্যার সমাধান করে দিতে। এবং স্রষ্টার কাছে আমাদের সব বিপদ-মুসিবত ও দুর্যোগ-দুর্ভোগের কথা নিবেদন করে আমরা স্বস্তি অনুভব করি; সর্বশক্তিমান আল্লাহর সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে আমরা নিজের মধ্যে শক্তি খুঁজে পাই। অনন্ত-অসীম ক্ষমা ও করুণার যিনি আঁধার, তাঁর কাছে আকুতি জানিয়ে আমরা আমাদের চতুর্দিকে তাঁরই করুণার উপস্থিতি উপলব্ধি করি এবং তাঁর প্রদর্শিত পথে চলার জন্য আমরা নতুনভাবে অঙ্গীকারে সমৃদ্ধ হয়ে উঠি, বুঝতে পারি তাঁর পথই কামিয়াবির একমাত্র পথ। আর এভাবেই আমাদের বিশ্বাস ও অঙ্গীকার নিয়ে আমরা এক অবর্ণনীয় রহমতের আস্বাদ অনুভব করি।
প্রতিটি বিপদের মুহূর্তে আমাদের প্রথম কাজই হলো দোয়া এবং শেষেও দোয়া। আমরা আল্লাহপাকের কাছে প্রার্থনা জানাই বিপদ মোকাবিলার জন্য সঠিক পথ তিনি দেখিয়ে দেবেন। আমরা তাঁরই কাছে সাহায্য কামনা করি যাতে তার প্রদর্শিত পথে আমরা চলতে সক্ষম হই এবং আমাদের সব কাজে লাভ করতে পারি সাফল্য। আমরা যখন রোগগ্রস্ত হয়ে পড়ি, আমরা জানি, আল্লাহর অভিপ্রায় ছাড়া আমরা সঠিক চিকিত্সকের সন্ধান পাব না; জানি তার আদেশ ব্যতীত সর্বোত্তম চিকিত্সকও রোগ-নির্ণয়ে ব্যর্থ হবেন এবং এ কথাও জানি সর্বোত্তম চিকিত্সাও তার অনুমতি ছাড়া নিষম্ফল হতে বাধ্য। আমরা আল্লাহপাকের কাছে এ সবকিছুর জন্যই অনুগ্রহ প্রার্থনা করি। আমরা চিকিত্সা-সাহায্যের জন্য দোয়া করি, চিকিত্সা-লাভের পর নিরাময় হয়েও করি। জীবনের সব বিপদে-মুসিবতে দুঃখে-দুর্যোগে আল্লাহর কাছে আমাদের এই অনুগ্রহ প্রার্থনা একইভাবে একই রকম সত্য।
দোয়া হলো আমাদের সব ইবাদতের সুরভি ও সারবস্তু। আল্লাহপাকের কাছে প্রার্থনারত একজন ব্যক্তি তার তাওহিদী-বিশ্বাসকে (একত্ববাদ, গড়হড়ঃযবরংস) দৃঢ়তার সঙ্গে সত্যায়িত করে এবং সব মিথ্যা-ঈশ্বরকে পরিত্যাগ করে। প্রত্যেক দোয়ার মধ্য দিয়ে আল্লাহপাকের প্রতি তার আস্থা ও বিশ্বাসের পুন: পুন: নবজন্ম ঘটে; এবং তার সানুরাগ প্রার্থনা তার নিজের মধ্যে নিজের অক্ষমতা ও শক্তিহীনতার অনুভূতিও জাগ্রত করে। গুরুত্ব ও আন্তরিকতার সঙ্গে প্রার্থনারত একজন ব্যক্তি যথার্থভাবেই অনুধাবন করতে পারে, স্রষ্টার সঙ্গে তার কী-অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক; এবং এই বিষয়টি তার বাস্তব জীবনের ক্রিয়াকর্মেও ফুটে ওঠে, প্রতিফলিত হয়। আর এটাই তো সব ইবাদত বন্দেগির প্রাণবস্তু। উপরন্তু এ ধরনের মানুষ কখনও দাম্ভিক ও উদ্ধত হতে পারে না, যা আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদিত আমাদের সব আন্তরিক দোয়া ও ইবাদতের যৌক্তিক ফলাফল।
দোয়া আমাদের জীবন সংগ্রামে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী হাতিয়ার, এমনকি যুদ্ধের ময়দানে প্রত্যক্ষ জিহাদেও এই দোয়ার কার্যকারিতা অসামান্য। বদরযুদ্ধ ছিল বিপুল অস্ত্রশস্ত্র-সজ্জিত এক বিশাল মুশরিক বাহিনীর মোকাবিলায় মুসলমানদের একটি অসম যুদ্ধ। যুদ্ধের পূর্বরাতে রাসুল (সা.) আল্লাহপাকের সাহায্য কামনায় নামাজে দাঁড়িয়ে সারারাত অতিবাহিত করলেন। ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত যুদ্ধে সুলতান সালাউদ্দীন আইয়ুবী দিবারাত্রি সমানভাবে ব্যস্ত। তার দিনগুলো কাটত জিহাদে আর রাত্রিগুলো অতিবাহিত হতো আল্লাহর সাহায্য-প্রার্থনায় ক্রন্দনরত অবস্থায় দোয়া ও ইবাদতে।
আমাদের মনে রাখা আবশ্যক, ক্ষুদ্র-বৃহত্ সব বিষয়েই আমরা আল্লাহপাকের কাছে আরজু পেশ করতে পারি। এটাই আসলে প্রজ্ঞার প্রথম কথা যে, ক্ষুদ্র বা বৃহত্ বলে কিছু নেই, এটা মূলত মানুষের প্রয়োজন ও ব্যক্তিগত বিবেচনার ওপর নির্ভরশীল। অতএব এ ধরনের পার্থক্য রচনা একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। বিশেষ করে আমরা যার কাছে প্রার্থনা-করছি, তার কাছে বড় বলে কিছু নেই; আর আমরা যারা কিছু পাওয়ার আশায় প্রার্থনা করি, তাদের কাছে কোনো কিছুই ছোট নয়। এইজন্যই আল্লাহর রাসূল (সা.) শিক্ষা দিয়েছেন, আমরা আল্লাহপাকের কাছে আমাদের প্রয়োজনমত সবকিছুই চাইতে পারি, এমনকি তা যদি জুতার ফিতার মতো কোনো তুচ্ছ জিনিসও হয়। তবে আমাদের চাওয়া উচিত একেবারে ভিখারির মতো, একেবারে রিক্ত নিঃসম্বল অসহায় মানুষের মতো; আর বাস্তব ক্ষেত্রে আল্লাহপাকের সঙ্গে এটাই তো আমাদের প্রকৃত সম্পর্ক এবং এটাও উল্লেখযোগ্য যে, আমাদের প্রার্থনা হতে হবে সর্বোচ্চ আশা ও সুদৃঢ় আস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত; অর্থাত্ আল্লাহপাক অবশ্যই আমাদের প্রার্থনা পূর্ণ করবেন, এই আশা আমাদের অন্তরে সর্বদা জাগরুক থাকবে। প্রসঙ্গত, আমরা একটি হাদিস স্মরণ করতে পারি: ‘আল্লাহর কাছে তার বান্দাহর দোয়া বা প্রার্থনার চেয়ে অধিক প্রিয় আর কিছু নেই’। অন্যদিকে দোয়ার মধ্যে যদি বিশ্বাস, নিষ্ঠা ও একাগ্রতার অভাব থাকে, তাহলে সেই দোয়া আদৌ কোনো দোয়া-ই নয়।
শুধু দুঃসময় কি দুঃখ-দুর্যোগের মধ্যে নয়, আমাদের উচিত সর্বদা ও সর্বাবস্থায়ই দোয়া করা। মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি চায় যে বিপদে ও প্রতিকূল অবস্থায় আল্লাহপাক তাকে সাহায্য করুন, তার প্রার্থনা গ্রহণ করুন, সে যেন সুখে ও সুসময়েও আল্লাহর কাছে সর্বদা দোয়া করে’। রাসূল (সা.) আরও বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহপাকের নিকট কিছু চায় না, আল্লাহ সুবহানুতায়ালা তার প্রতি ক্রোধান্বিত।’
আমাদের উচিত, দুনিয়া এবং আখেরাতের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত আমাদের যে কোনো বিষয়েই আল্লাহপাকের কাছে প্রার্থনা জ্ঞাপন করা। অবশ্য যারা শুধু দুনিয়াকেই একমাত্র বিবেচনা করে এবং দুনিয়াই যাদের প্রার্থনার একমাত্র লক্ষ্যবস্তু, আল কোরআন বলছে, যেখানে তাদের স্থায়ী আবাস সেই আখেরাতে তারা কিছুই পাবে না। তখন নিজেকে ছাড়া তারা তাদের পরকালীন ধ্বংসের জন্য অন্য আর কাউকে দায়ী ও দোষারোপ করতে পারবে না। আল কোরআন আমাদেরকে নিশ্চিতভাবে জানিয়ে দিচ্ছে, সেই ধ্বংস ও বিনাশের জন্য তাদের অপেক্ষা করতে দাও। আবার যারা আখেরাতের প্রতি অত্যধিক মনোযোগী, তারা ভারসাম্য রক্ষা করছেন না; কারণ আল্লাহর সাহায্য আমাদের পার্থিব ও পারলৌকিক উভয় জিন্দেগির জন্যই অত্যাবশ্যক।
উল্লেখ করা আবশ্যক, আমাদের দোয়া শুধু আমাদের নিজের জন্যই নয়। আমাদের পিতামাতা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু-শিক্ষক-শুভানুধ্যায়ী, পীড়িত-অভাবগ্রস্ত এবং বিশ্বব্যাপী সংগ্রামরত মুসলিম ভাই-বোন সবার জন্যই দোয়া করা উচিত। তাদের ঐহিক ও পারত্রিক উভয় জিন্দেগির কল্যাণ ও কামিয়াবির জন্য আন্তরিকভাবে দোয়া করা আমাদের কর্তব্য। রাসুল (সা.) বলেন: ‘একজন মুসিলম যখন তার কোনো মুসলিম ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে দোয়া করে, সেই দোয়া সঙ্গে সঙ্গে গৃহীত হয়। একজন ফেরেশতাকে তার পাশে নিযুক্ত রাখা হয়; যখন সে তার ভাইয়ের কল্যাণের জন্য দোয়া করে, তখন সেই নিযুক্ত ফেরেশতা বলেন, ‘আমীন, এবং তোমার উপরও একই রহমত বর্ষিত হোক’।’ (মুসলিম শরিফ, হাদিস-৪৯১৪)।
অনুবাদ : অধ্যাপক আবু জাফর
একদিন রাসুল মোহাম্মদ (সা.) কিছু দুর্যোগপীড়িত মানুষকে অতিক্রম করে যাওয়ার পর বললেন, ‘তারা আল্লাহপাকের কাছে রহমত ও নিরাপত্তার জন্য দোয়া করে না কেন?’ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মুসলমান আজ যে দুর্ভোগ ও বিপর্যয়ের শিকার, সেই পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্নটি আজ আমাদের উদ্দেশ্যেও করা যেতে পারে।
এমন নয় যে, আমরা দোয়া করার কথা পুরোপুরি বিস্মৃত হয়েছি; আমরা বরং প্রতিনিয়তই নিয়মিতভাবে দোয়া করি। কিন্তু দোয়া সম্পর্কে আমাদের ধারণা ও ক্রিয়াকর্মাদি আসলে রীতিমত বিকৃতির শিকার এবং আমাদের দোয়ার অধিকাংশ সময়ই নিতান্ত আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। সাধারণভাবে এটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, যখন আমাদের সব চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, তখন একেবারে শেষ অবলম্বন হিসেবে দোয়ার কাছে আশ্রয় গ্রহণ করি এবং এটাও লক্ষণীয় যে, কাজে-কর্মে তো বটেই, অমানবিক কথার দ্বারাও দোয়াকে অবজ্ঞা ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয় এবং এটা আদৌ আশ্চর্যজনক নয় যে, দোয়ার এখন অর্থ দাঁড়িয়েছে পরিস্থিতি থেকে উদ্ভুত নৈরাশ্য, হতাশা ও ব্যর্থতার মোকাবিলায় দোয়া যেন এক ব্যর্থ ও অনাবশ্যক আকুতি।
কী দুর্ভাগ্য! অথচ দোয়া হলো বিশ্বাসীদের জন্য সর্বাধিক শক্তিশালী ও সর্বাধিক ফলপ্রসূ একটি হাতিয়ার। দোয়া ভাগ্যলিপিকে পরিবত
ন করতে পারে, যা আমাদের কোনো চেষ্টা-প্রচেষ্টার দ্বারা সম্ভব নয়। দোয়া হলো সব ইবাদতের সৌরভ ও সারবস্তু। দোয়া আমাদের কোনো কাজে কখনও ব্যর্থ হতে দেয় না, আর দোয়া ছাড়া আমরা কখনও সাফল্যও লাভ করতে পারি না। কোনো বিষয়ে সুষ্ঠু পরিকল্পনা-গ্রহণের আগে ও শেষে আল্লাহর সমীপে দোয়া পেশ করা বিশ্বাসীদের জন্য প্রথম ও শেষ ভরসাস্থল; কারণ বিশ্বাসীদের (ঈমানদার) সব পরিকল্পনা ও কার্যক্রম পূর্বাপর দোয়ার মধ্যস্থলে অবস্থিত।
দোয়া হলো আল্লাহপাকের সঙ্গে আমাদের একান্ত বাক্যালাপ, সেই আল্লাহ যিনি আমাদের স্রষ্টা ও অভিভাবক, যিনি আমাদের প্রভু ও প্রতিপালক, যিনি সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান। বস্তুতই, দোয়া এক অসামান্য তাত্পর্য বহন করে। দোয়া ঊর্ধারোহণের শ্রেষ্ঠ সোপান, মুক্তির বার্তা, ক্ষমতাপ্রাপ্তির পাথেয়, রুপান্তর-প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত এক অতীব ফলপ্রসূ জীবনচেতনা, যা কোনো মানুষের পক্ষে অর্জন করা অসম্ভব। দোয়ার মধ্য দিয়ে আমরা আল্লাহর দিকে ফিরে আসি, কারণ আমরা জানি, একমাত্র তিনিই আমাদের সব দুর্ভোগ থেকে মুক্তি দিতে পারেন; এবং একমাত্র তিনিই পারেন আমাদের সব সমস্যার সমাধান করে দিতে। এবং স্রষ্টার কাছে আমাদের সব বিপদ-মুসিবত ও দুর্যোগ-দুর্ভোগের কথা নিবেদন করে আমরা স্বস্তি অনুভব করি; সর্বশক্তিমান আল্লাহর সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে আমরা নিজের মধ্যে শক্তি খুঁজে পাই। অনন্ত-অসীম ক্ষমা ও করুণার যিনি আঁধার, তাঁর কাছে আকুতি জানিয়ে আমরা আমাদের চতুর্দিকে তাঁরই করুণার উপস্থিতি উপলব্ধি করি এবং তাঁর প্রদর্শিত পথে চলার জন্য আমরা নতুনভাবে অঙ্গীকারে সমৃদ্ধ হয়ে উঠি, বুঝতে পারি তাঁর পথই কামিয়াবির একমাত্র পথ। আর এভাবেই আমাদের বিশ্বাস ও অঙ্গীকার নিয়ে আমরা এক অবর্ণনীয় রহমতের আস্বাদ অনুভব করি।
প্রতিটি বিপদের মুহূর্তে আমাদের প্রথম কাজই হলো দোয়া এবং শেষেও দোয়া। আমরা আল্লাহপাকের কাছে প্রার্থনা জানাই বিপদ মোকাবিলার জন্য সঠিক পথ তিনি দেখিয়ে দেবেন। আমরা তাঁরই কাছে সাহায্য কামনা করি যাতে তার প্রদর্শিত পথে আমরা চলতে সক্ষম হই এবং আমাদের সব কাজে লাভ করতে পারি সাফল্য। আমরা যখন রোগগ্রস্ত হয়ে পড়ি, আমরা জানি, আল্লাহর অভিপ্রায় ছাড়া আমরা সঠিক চিকিত্সকের সন্ধান পাব না; জানি তার আদেশ ব্যতীত সর্বোত্তম চিকিত্সকও রোগ-নির্ণয়ে ব্যর্থ হবেন এবং এ কথাও জানি সর্বোত্তম চিকিত্সাও তার অনুমতি ছাড়া নিষম্ফল হতে বাধ্য। আমরা আল্লাহপাকের কাছে এ সবকিছুর জন্যই অনুগ্রহ প্রার্থনা করি। আমরা চিকিত্সা-সাহায্যের জন্য দোয়া করি, চিকিত্সা-লাভের পর নিরাময় হয়েও করি। জীবনের সব বিপদে-মুসিবতে দুঃখে-দুর্যোগে আল্লাহর কাছে আমাদের এই অনুগ্রহ প্রার্থনা একইভাবে একই রকম সত্য।
দোয়া হলো আমাদের সব ইবাদতের সুরভি ও সারবস্তু। আল্লাহপাকের কাছে প্রার্থনারত একজন ব্যক্তি তার তাওহিদী-বিশ্বাসকে (একত্ববাদ, গড়হড়ঃযবরংস) দৃঢ়তার সঙ্গে সত্যায়িত করে এবং সব মিথ্যা-ঈশ্বরকে পরিত্যাগ করে। প্রত্যেক দোয়ার মধ্য দিয়ে আল্লাহপাকের প্রতি তার আস্থা ও বিশ্বাসের পুন: পুন: নবজন্ম ঘটে; এবং তার সানুরাগ প্রার্থনা তার নিজের মধ্যে নিজের অক্ষমতা ও শক্তিহীনতার অনুভূতিও জাগ্রত করে। গুরুত্ব ও আন্তরিকতার সঙ্গে প্রার্থনারত একজন ব্যক্তি যথার্থভাবেই অনুধাবন করতে পারে, স্রষ্টার সঙ্গে তার কী-অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক; এবং এই বিষয়টি তার বাস্তব জীবনের ক্রিয়াকর্মেও ফুটে ওঠে, প্রতিফলিত হয়। আর এটাই তো সব ইবাদত বন্দেগির প্রাণবস্তু। উপরন্তু এ ধরনের মানুষ কখনও দাম্ভিক ও উদ্ধত হতে পারে না, যা আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদিত আমাদের সব আন্তরিক দোয়া ও ইবাদতের যৌক্তিক ফলাফল।
দোয়া আমাদের জীবন সংগ্রামে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী হাতিয়ার, এমনকি যুদ্ধের ময়দানে প্রত্যক্ষ জিহাদেও এই দোয়ার কার্যকারিতা অসামান্য। বদরযুদ্ধ ছিল বিপুল অস্ত্রশস্ত্র-সজ্জিত এক বিশাল মুশরিক বাহিনীর মোকাবিলায় মুসলমানদের একটি অসম যুদ্ধ। যুদ্ধের পূর্বরাতে রাসুল (সা.) আল্লাহপাকের সাহায্য কামনায় নামাজে দাঁড়িয়ে সারারাত অতিবাহিত করলেন। ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত যুদ্ধে সুলতান সালাউদ্দীন আইয়ুবী দিবারাত্রি সমানভাবে ব্যস্ত। তার দিনগুলো কাটত জিহাদে আর রাত্রিগুলো অতিবাহিত হতো আল্লাহর সাহায্য-প্রার্থনায় ক্রন্দনরত অবস্থায় দোয়া ও ইবাদতে।
আমাদের মনে রাখা আবশ্যক, ক্ষুদ্র-বৃহত্ সব বিষয়েই আমরা আল্লাহপাকের কাছে আরজু পেশ করতে পারি। এটাই আসলে প্রজ্ঞার প্রথম কথা যে, ক্ষুদ্র বা বৃহত্ বলে কিছু নেই, এটা মূলত মানুষের প্রয়োজন ও ব্যক্তিগত বিবেচনার ওপর নির্ভরশীল। অতএব এ ধরনের পার্থক্য রচনা একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। বিশেষ করে আমরা যার কাছে প্রার্থনা-করছি, তার কাছে বড় বলে কিছু নেই; আর আমরা যারা কিছু পাওয়ার আশায় প্রার্থনা করি, তাদের কাছে কোনো কিছুই ছোট নয়। এইজন্যই আল্লাহর রাসূল (সা.) শিক্ষা দিয়েছেন, আমরা আল্লাহপাকের কাছে আমাদের প্রয়োজনমত সবকিছুই চাইতে পারি, এমনকি তা যদি জুতার ফিতার মতো কোনো তুচ্ছ জিনিসও হয়। তবে আমাদের চাওয়া উচিত একেবারে ভিখারির মতো, একেবারে রিক্ত নিঃসম্বল অসহায় মানুষের মতো; আর বাস্তব ক্ষেত্রে আল্লাহপাকের সঙ্গে এটাই তো আমাদের প্রকৃত সম্পর্ক এবং এটাও উল্লেখযোগ্য যে, আমাদের প্রার্থনা হতে হবে সর্বোচ্চ আশা ও সুদৃঢ় আস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত; অর্থাত্ আল্লাহপাক অবশ্যই আমাদের প্রার্থনা পূর্ণ করবেন, এই আশা আমাদের অন্তরে সর্বদা জাগরুক থাকবে। প্রসঙ্গত, আমরা একটি হাদিস স্মরণ করতে পারি: ‘আল্লাহর কাছে তার বান্দাহর দোয়া বা প্রার্থনার চেয়ে অধিক প্রিয় আর কিছু নেই’। অন্যদিকে দোয়ার মধ্যে যদি বিশ্বাস, নিষ্ঠা ও একাগ্রতার অভাব থাকে, তাহলে সেই দোয়া আদৌ কোনো দোয়া-ই নয়।
শুধু দুঃসময় কি দুঃখ-দুর্যোগের মধ্যে নয়, আমাদের উচিত সর্বদা ও সর্বাবস্থায়ই দোয়া করা। মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি চায় যে বিপদে ও প্রতিকূল অবস্থায় আল্লাহপাক তাকে সাহায্য করুন, তার প্রার্থনা গ্রহণ করুন, সে যেন সুখে ও সুসময়েও আল্লাহর কাছে সর্বদা দোয়া করে’। রাসূল (সা.) আরও বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহপাকের নিকট কিছু চায় না, আল্লাহ সুবহানুতায়ালা তার প্রতি ক্রোধান্বিত।’
আমাদের উচিত, দুনিয়া এবং আখেরাতের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত আমাদের যে কোনো বিষয়েই আল্লাহপাকের কাছে প্রার্থনা জ্ঞাপন করা। অবশ্য যারা শুধু দুনিয়াকেই একমাত্র বিবেচনা করে এবং দুনিয়াই যাদের প্রার্থনার একমাত্র লক্ষ্যবস্তু, আল কোরআন বলছে, যেখানে তাদের স্থায়ী আবাস সেই আখেরাতে তারা কিছুই পাবে না। তখন নিজেকে ছাড়া তারা তাদের পরকালীন ধ্বংসের জন্য অন্য আর কাউকে দায়ী ও দোষারোপ করতে পারবে না। আল কোরআন আমাদেরকে নিশ্চিতভাবে জানিয়ে দিচ্ছে, সেই ধ্বংস ও বিনাশের জন্য তাদের অপেক্ষা করতে দাও। আবার যারা আখেরাতের প্রতি অত্যধিক মনোযোগী, তারা ভারসাম্য রক্ষা করছেন না; কারণ আল্লাহর সাহায্য আমাদের পার্থিব ও পারলৌকিক উভয় জিন্দেগির জন্যই অত্যাবশ্যক।
উল্লেখ করা আবশ্যক, আমাদের দোয়া শুধু আমাদের নিজের জন্যই নয়। আমাদের পিতামাতা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু-শিক্ষক-শুভানুধ্যায়ী, পীড়িত-অভাবগ্রস্ত এবং বিশ্বব্যাপী সংগ্রামরত মুসলিম ভাই-বোন সবার জন্যই দোয়া করা উচিত। তাদের ঐহিক ও পারত্রিক উভয় জিন্দেগির কল্যাণ ও কামিয়াবির জন্য আন্তরিকভাবে দোয়া করা আমাদের কর্তব্য। রাসুল (সা.) বলেন: ‘একজন মুসিলম যখন তার কোনো মুসলিম ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে দোয়া করে, সেই দোয়া সঙ্গে সঙ্গে গৃহীত হয়। একজন ফেরেশতাকে তার পাশে নিযুক্ত রাখা হয়; যখন সে তার ভাইয়ের কল্যাণের জন্য দোয়া করে, তখন সেই নিযুক্ত ফেরেশতা বলেন, ‘আমীন, এবং তোমার উপরও একই রহমত বর্ষিত হোক’।’ (মুসলিম শরিফ, হাদিস-৪৯১৪)।
অনুবাদ : অধ্যাপক আবু জাফর
নারী উন্নয়ন নীতিমালা-২০১১ কয়েকটি ধারা ও কোরআনের ভাষ্য
বর্তমান সরকার নারী উন্নয়ন নীতিমালার নামে যে খসড়া নীতি অনুমোদন করেছে, তা সিডও বাস্তবায়নের অঙ্গীকারের একটি কৌশলপত্র মাত্র। সিডও সনদের ধারাগুলোর হুবহু প্রতিধ্বনি করা হয়েছে নারী উন্নয়ন নীতিমালা-২০১১ এর খসড়ায়।
সিডও সনদে মুসলিম দেশগুলোর পক্ষ থেকে যেসব ধারার উপর আপত্তি জানানো হয়েছে সেগুলো হলো— ২, ৩, ৯, ১৩ এবং ১৬ নং ধারা। এই ধারাগুলোর বক্তব্য আমরা হুবহু উদ্ধৃত করছি।
২. অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে—নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্যের প্রতি নিন্দা জানিয়েছে সনদে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো। নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য দূর করতে তারা নিজ নিজ দেশে প্রয়োজনীয় আইন তৈরির ঘোষণা দিচ্ছে। সংবিধানে সমঅধিকারের ঘোষণা না থাকলে সমঅধিকারের নিশ্চয়তা দিয়ে সংবিধান নতুন করে প্রণয়ন করবে। নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক সব আইনকানুন ও বিধিবিধান বিলোপ করবে।
৩. রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সবক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি নারীর সমান অধিকার নিশ্চিত করবে রাষ্ট্র।
১৩. অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনের সবক্ষেত্রে নারীর প্রতি সব বৈষম্য দূর করে সমতার ভিত্তিতে নারী ও পুরুষেরা সমান অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্র পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এ অধিকারের মাঝে পারিবারিক সুযোগ-সুবিধা ও ব্যাংক লোনও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
১৫. চলাফেরার স্বাধীনতা, বাসস্থান পছন্দ এবং স্থায়ী নিবাস স্থাপনের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা।
১৬. বিয়ে এবং পারিবারিক সম্পর্কসহ সব বিষয়ে নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য দূর করতে রাষ্ট্র পদক্ষেপ নেবে এবং এসব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করবে।
১৬-১. বিবাহিত জীবনে প্রবেশের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার থাকবে।
১৬.২ বিবাহ, স্বামী নির্বাচনের ক্ষেত্রে স্বাধিকার।
১৬-৩. বিয়ে এবং তালাকের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও সমান দায়দায়িত্ব থাকবে।
১৬-৫. শিশু লালন-পালনের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও সমান দায়দায়িত্ব থাকবে।
১৬.৭ : সম্পত্তির মালিকানা, ব্যবস্থাপনা এবং বিক্রয়ের ক্ষেত্রে সমান দায়িত্ব ও অধিকার।
বাংলাদেশ এই ধারাগুলোর ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছিল। এতে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, কোরআন সুন্নাহ ও ইসলামী আইন এবং মুসলিম সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। যে কারণে অতীতের সব কটি সরকার সিডও সনদের ইসলাম ও কোরআনবিরোধী ধারাগুলো প্রত্যাখ্যান করে আসছে। তারপরও কোন স্বার্থে বর্তমান সরকার সেই আপত্তি প্রত্যাহার করেছে? ইসলামপ্রিয় ৯০ শতাংশ নাগরিকের আজ সেটিই জিজ্ঞাসা।
বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, নারী উন্নয়ন নীতিমালায় ইসলামবিরোধী কোন কিছু নেই। অথচ দেশের বিজ্ঞ আলেম-ওলামা ও ইসলামী বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নারী উন্নয়ন নীতিমালা কোরআন সুন্নাহ ও ইসলামী শরীয়ার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
বিগত ৭ মার্চ মন্ত্রিসভায় নারী উন্নয়ন নীতিমালা অনুমোদনের পর বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) পরিবেশিত খবরে বলা হয়, ‘ভূমিসহ সম্পদ-সম্পত্তিতেও উত্তরাধিকারে নারীর সমান অধিকার স্বীকৃতি দিয়ে নারী উন্নয়ন নীতি-২০১১ এর খসড়া অনুমোদন করছে মন্ত্রিসভা’। (প্রথম আলো, যুগান্তর, কালের কণ্ঠ)
আমাদের দৃষ্টিতে নারী উন্নয়ন নীতিমালার সমস্যাগুলো এবং ইসলামের সঙ্গে তথা কোরআন সুন্নাহর সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিষয়গুলো নিম্নরূপ :
১. এই নীতিমালা সিডও সনদ বাস্তবায়নের অঙ্গীকারের কৌশল হিসাবে প্রণয়ন করা হয়েছে। সিডও সনদের ২, ৩, ৯, ১৩, ১৬ ধারায় ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। নারীর নীতিতে সিডও বাস্তবায়নের অঙ্গীকার স্পষ্ট ভাষায় বারবার ব্যক্ত করা হয়েছে। (দ্রষ্টব্য নারী উন্নয়ন নীতিমালা ৪ নং ধারার শেষ প্যারা। ৪.১, ১৭.২)
২. এই নীতিমালায় সিডও-এরই প্রতিধ্বনি করা হয়েছে মাত্র। সিডও সনদে নারীকে উপস্থাপন করা হয়েছে ইউরোপিয়ান জীবন ধারা ও সংস্কৃতির আলোকে। ফলে এই নীতিমালায় মুসলিম নারীর জীবন ধারা ও ইসলামী সংস্কৃতির মোটেই প্রতিফলন ঘটেনি, যে কারণে এই নীতিমালা ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশের জীবনাচারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। আমাদের বিশ্বাস, এই নীতিমালার মাধ্যমে মুসলমানদের মুসলিম সংস্কৃতি বর্জন করে ইউরোপিয়ান সংস্কৃতি অবলম্বনের দক্ষ কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে।
৩. ইসলাম নারী উন্নয়ন ও নারী অধিকারে সর্বোচ্চ প্রবক্তা হলেও এবং নারী নির্যাতনরোধে সর্বাধিক বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করলেও পুরুষ প্রধান সমাজব্যবস্থার প্রবক্তা। পরামর্শের সব পর্যায়ে নারীকে সমঅধিকার প্রদান করলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের অধিকার পুরুষকেই প্রদান করেছে। আল-কোরআনে এ মর্মে স্পষ্টতই উল্লেখ আছে।
দ্রষ্টব্য : সূরা বাকারা আয়াত-২২৮, সূরা নিসা : আয়াত-৩৮, বুখারি শরীফ : খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-১০৫৭, মুসলিম শরীফ : খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-১২২
৪. নারী উন্নয়ন নীতিমালা যেহেতু ইউরোপিয়ান নারীর কল্পচিত্রকে সামনে রেখে প্রণীত হয়েছে। অতএব, নীতিমালাটি প্রণয়নের ক্ষেত্রে ইসলামের অলংঘনীয় বিধান পর্দার বিষয়টির প্রতি মোটেও লক্ষ রাখা হয়নি, ফলে এর অধিকাংশ ধারা পর্দার বিধান লংঘন না করে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। ফলে উন্নয়ন পরিকল্পনা হিসেবে উপস্থাপিত বিষয়গুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোরআনের বিরুদ্ধে প্রকাশ পেয়েছে এবং পর্দার বিধান লংঘন হওয়ার কারণে তা কোরআনবিরোধী বলে প্রতিপন্ন হয়েছে।
৫. ইসলাম মূলত নারী-পুরুষের পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে যে সৌহার্দ্যপূর্ণ পারিবারিক জীবন গড়ে তুলতে চেয়েছে, নারী নীতি বাস্তবায়ন হলে তা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যাবে। অধিকারের টানাটানিতে পারিবারিক জীবন এক সংঘাতময় যুদ্ধ ক্ষেত্রে পরিণত হবে। পারিবারিক সৌহার্দ্য শেষ হয়ে যাবে, যা এখন ইউরোপের সমাজ ব্যবস্থায় নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং এদিক থেকে এই নীতিমালা ইসলামের পারিবারিক নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
৬. ইসলাম পৈতৃক উত্তরাধিকারে নারীকে পুরুষের তুলনায় অর্ধেক প্রদান করেছে। এই বিধান সূরা নিসার ১১নং আয়াতের সুস্পষ্টভাবে বিবৃত হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে :
‘আল্লাহ তোমাদের সন্তানদের (উত্তরাধিকার প্রাপ্তির) ব্যাপারে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, পুত্র সন্তান পাবে দুই কন্যা সন্তানের সমান। এ হলো আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞাতা ও প্রজ্ঞাময়।’ [সূরা নিসা : আয়াত-১১]
সুতরাং উত্তরাধিকারে যদি নারীকে পুরুষের সমান প্রদান করা হয়, তাহলে এটি হবে সুস্পষ্ট কোরআনবিরোধী।
অথচ সরকার মুখে বলছে, কোরআনবিরোধী কোনো বিষয় নারী নীতিতে নেই। সরকারের এই বক্তব্যকে অন্যক্ষেত্রে না হলেও শুধু উত্তরাধিকারের প্রশ্নে সরল অর্থে গ্রহণ করা যেত যদি সিডও বাস্তবায়নের অঙ্গীকার দৃঢ়তার সঙ্গে নারী নীতিতে ব্যক্ত না করা হতো। সিডও সনদের আগে ধারাগুলো যে কুরআন সুন্নাহ ও ইসলামী জীবন দর্শনের পরিপন্থী তা আন্তর্জাতিকভাবেই স্বীকৃত। যে কারণে মুসলিম দেশগুলো তা মেনে নেয়নি। স্বয়ং বাংলাদেশও সেগুলোকে কোরআন সুন্নাহর পরিপন্থী মনে করে সেগুলো সংরক্ষণ করে সিডও সনদে স্বাক্ষর করেছিল। সবক্ষেত্রে নারীর সম-অধিকারের ঘোষণার মাধ্যমে মুসলিম উত্তরাধিকার আইনকে অকার্যকর করাই যে সিডও সনদের মূল লক্ষ্য তা অন্ধজনও বুঝতে সক্ষম।
নারী নীতির ভূমিকা ২য় লাইন ৪, ৪.১, ১৬.১, ১৬.৮, ১৬.১২, ১৭.১, ১৭.৪, ২৩.৫ ধারাগুলো যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, তাতে যে কোনো ব্যক্তি তাদ্বারা উত্তরাধিকারে নারী-পুরুষের সমান পাবে এই সিদ্ধান্ত উপনীত হতে পারবে। সিডও বাস্তয়নের অঙ্গীকারে আবদ্ধ সরকার পরে সেই ধারাগুলোকে উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে সমতার ব্যাখ্যা করবে না এ নিশ্চয়তা কে দেবে?
লেখক : গবেষক, গ্রন্থকার, ইসলামী চিন্তাদিব
সিডও সনদে মুসলিম দেশগুলোর পক্ষ থেকে যেসব ধারার উপর আপত্তি জানানো হয়েছে সেগুলো হলো— ২, ৩, ৯, ১৩ এবং ১৬ নং ধারা। এই ধারাগুলোর বক্তব্য আমরা হুবহু উদ্ধৃত করছি।
২. অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে—নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্যের প্রতি নিন্দা জানিয়েছে সনদে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো। নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য দূর করতে তারা নিজ নিজ দেশে প্রয়োজনীয় আইন তৈরির ঘোষণা দিচ্ছে। সংবিধানে সমঅধিকারের ঘোষণা না থাকলে সমঅধিকারের নিশ্চয়তা দিয়ে সংবিধান নতুন করে প্রণয়ন করবে। নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক সব আইনকানুন ও বিধিবিধান বিলোপ করবে।
৩. রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সবক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি নারীর সমান অধিকার নিশ্চিত করবে রাষ্ট্র।
১৩. অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনের সবক্ষেত্রে নারীর প্রতি সব বৈষম্য দূর করে সমতার ভিত্তিতে নারী ও পুরুষেরা সমান অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্র পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এ অধিকারের মাঝে পারিবারিক সুযোগ-সুবিধা ও ব্যাংক লোনও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
১৫. চলাফেরার স্বাধীনতা, বাসস্থান পছন্দ এবং স্থায়ী নিবাস স্থাপনের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা।
১৬. বিয়ে এবং পারিবারিক সম্পর্কসহ সব বিষয়ে নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য দূর করতে রাষ্ট্র পদক্ষেপ নেবে এবং এসব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করবে।
১৬-১. বিবাহিত জীবনে প্রবেশের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার থাকবে।
১৬.২ বিবাহ, স্বামী নির্বাচনের ক্ষেত্রে স্বাধিকার।
১৬-৩. বিয়ে এবং তালাকের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও সমান দায়দায়িত্ব থাকবে।
১৬-৫. শিশু লালন-পালনের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও সমান দায়দায়িত্ব থাকবে।
১৬.৭ : সম্পত্তির মালিকানা, ব্যবস্থাপনা এবং বিক্রয়ের ক্ষেত্রে সমান দায়িত্ব ও অধিকার।
বাংলাদেশ এই ধারাগুলোর ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছিল। এতে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, কোরআন সুন্নাহ ও ইসলামী আইন এবং মুসলিম সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। যে কারণে অতীতের সব কটি সরকার সিডও সনদের ইসলাম ও কোরআনবিরোধী ধারাগুলো প্রত্যাখ্যান করে আসছে। তারপরও কোন স্বার্থে বর্তমান সরকার সেই আপত্তি প্রত্যাহার করেছে? ইসলামপ্রিয় ৯০ শতাংশ নাগরিকের আজ সেটিই জিজ্ঞাসা।
বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, নারী উন্নয়ন নীতিমালায় ইসলামবিরোধী কোন কিছু নেই। অথচ দেশের বিজ্ঞ আলেম-ওলামা ও ইসলামী বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নারী উন্নয়ন নীতিমালা কোরআন সুন্নাহ ও ইসলামী শরীয়ার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
বিগত ৭ মার্চ মন্ত্রিসভায় নারী উন্নয়ন নীতিমালা অনুমোদনের পর বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) পরিবেশিত খবরে বলা হয়, ‘ভূমিসহ সম্পদ-সম্পত্তিতেও উত্তরাধিকারে নারীর সমান অধিকার স্বীকৃতি দিয়ে নারী উন্নয়ন নীতি-২০১১ এর খসড়া অনুমোদন করছে মন্ত্রিসভা’। (প্রথম আলো, যুগান্তর, কালের কণ্ঠ)
আমাদের দৃষ্টিতে নারী উন্নয়ন নীতিমালার সমস্যাগুলো এবং ইসলামের সঙ্গে তথা কোরআন সুন্নাহর সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিষয়গুলো নিম্নরূপ :
১. এই নীতিমালা সিডও সনদ বাস্তবায়নের অঙ্গীকারের কৌশল হিসাবে প্রণয়ন করা হয়েছে। সিডও সনদের ২, ৩, ৯, ১৩, ১৬ ধারায় ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। নারীর নীতিতে সিডও বাস্তবায়নের অঙ্গীকার স্পষ্ট ভাষায় বারবার ব্যক্ত করা হয়েছে। (দ্রষ্টব্য নারী উন্নয়ন নীতিমালা ৪ নং ধারার শেষ প্যারা। ৪.১, ১৭.২)
২. এই নীতিমালায় সিডও-এরই প্রতিধ্বনি করা হয়েছে মাত্র। সিডও সনদে নারীকে উপস্থাপন করা হয়েছে ইউরোপিয়ান জীবন ধারা ও সংস্কৃতির আলোকে। ফলে এই নীতিমালায় মুসলিম নারীর জীবন ধারা ও ইসলামী সংস্কৃতির মোটেই প্রতিফলন ঘটেনি, যে কারণে এই নীতিমালা ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশের জীবনাচারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। আমাদের বিশ্বাস, এই নীতিমালার মাধ্যমে মুসলমানদের মুসলিম সংস্কৃতি বর্জন করে ইউরোপিয়ান সংস্কৃতি অবলম্বনের দক্ষ কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে।
৩. ইসলাম নারী উন্নয়ন ও নারী অধিকারে সর্বোচ্চ প্রবক্তা হলেও এবং নারী নির্যাতনরোধে সর্বাধিক বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করলেও পুরুষ প্রধান সমাজব্যবস্থার প্রবক্তা। পরামর্শের সব পর্যায়ে নারীকে সমঅধিকার প্রদান করলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের অধিকার পুরুষকেই প্রদান করেছে। আল-কোরআনে এ মর্মে স্পষ্টতই উল্লেখ আছে।
দ্রষ্টব্য : সূরা বাকারা আয়াত-২২৮, সূরা নিসা : আয়াত-৩৮, বুখারি শরীফ : খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-১০৫৭, মুসলিম শরীফ : খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-১২২
৪. নারী উন্নয়ন নীতিমালা যেহেতু ইউরোপিয়ান নারীর কল্পচিত্রকে সামনে রেখে প্রণীত হয়েছে। অতএব, নীতিমালাটি প্রণয়নের ক্ষেত্রে ইসলামের অলংঘনীয় বিধান পর্দার বিষয়টির প্রতি মোটেও লক্ষ রাখা হয়নি, ফলে এর অধিকাংশ ধারা পর্দার বিধান লংঘন না করে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। ফলে উন্নয়ন পরিকল্পনা হিসেবে উপস্থাপিত বিষয়গুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোরআনের বিরুদ্ধে প্রকাশ পেয়েছে এবং পর্দার বিধান লংঘন হওয়ার কারণে তা কোরআনবিরোধী বলে প্রতিপন্ন হয়েছে।
৫. ইসলাম মূলত নারী-পুরুষের পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে যে সৌহার্দ্যপূর্ণ পারিবারিক জীবন গড়ে তুলতে চেয়েছে, নারী নীতি বাস্তবায়ন হলে তা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যাবে। অধিকারের টানাটানিতে পারিবারিক জীবন এক সংঘাতময় যুদ্ধ ক্ষেত্রে পরিণত হবে। পারিবারিক সৌহার্দ্য শেষ হয়ে যাবে, যা এখন ইউরোপের সমাজ ব্যবস্থায় নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং এদিক থেকে এই নীতিমালা ইসলামের পারিবারিক নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
৬. ইসলাম পৈতৃক উত্তরাধিকারে নারীকে পুরুষের তুলনায় অর্ধেক প্রদান করেছে। এই বিধান সূরা নিসার ১১নং আয়াতের সুস্পষ্টভাবে বিবৃত হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে :
‘আল্লাহ তোমাদের সন্তানদের (উত্তরাধিকার প্রাপ্তির) ব্যাপারে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, পুত্র সন্তান পাবে দুই কন্যা সন্তানের সমান। এ হলো আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞাতা ও প্রজ্ঞাময়।’ [সূরা নিসা : আয়াত-১১]
সুতরাং উত্তরাধিকারে যদি নারীকে পুরুষের সমান প্রদান করা হয়, তাহলে এটি হবে সুস্পষ্ট কোরআনবিরোধী।
অথচ সরকার মুখে বলছে, কোরআনবিরোধী কোনো বিষয় নারী নীতিতে নেই। সরকারের এই বক্তব্যকে অন্যক্ষেত্রে না হলেও শুধু উত্তরাধিকারের প্রশ্নে সরল অর্থে গ্রহণ করা যেত যদি সিডও বাস্তবায়নের অঙ্গীকার দৃঢ়তার সঙ্গে নারী নীতিতে ব্যক্ত না করা হতো। সিডও সনদের আগে ধারাগুলো যে কুরআন সুন্নাহ ও ইসলামী জীবন দর্শনের পরিপন্থী তা আন্তর্জাতিকভাবেই স্বীকৃত। যে কারণে মুসলিম দেশগুলো তা মেনে নেয়নি। স্বয়ং বাংলাদেশও সেগুলোকে কোরআন সুন্নাহর পরিপন্থী মনে করে সেগুলো সংরক্ষণ করে সিডও সনদে স্বাক্ষর করেছিল। সবক্ষেত্রে নারীর সম-অধিকারের ঘোষণার মাধ্যমে মুসলিম উত্তরাধিকার আইনকে অকার্যকর করাই যে সিডও সনদের মূল লক্ষ্য তা অন্ধজনও বুঝতে সক্ষম।
নারী নীতির ভূমিকা ২য় লাইন ৪, ৪.১, ১৬.১, ১৬.৮, ১৬.১২, ১৭.১, ১৭.৪, ২৩.৫ ধারাগুলো যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, তাতে যে কোনো ব্যক্তি তাদ্বারা উত্তরাধিকারে নারী-পুরুষের সমান পাবে এই সিদ্ধান্ত উপনীত হতে পারবে। সিডও বাস্তয়নের অঙ্গীকারে আবদ্ধ সরকার পরে সেই ধারাগুলোকে উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে সমতার ব্যাখ্যা করবে না এ নিশ্চয়তা কে দেবে?
লেখক : গবেষক, গ্রন্থকার, ইসলামী চিন্তাদিব
Friday, March 25, 2011
চাই নামাজ উপযোগী কোরআন শিক্ষা
দি দা র উ ল আ ল ম
ঈমানদার মুসলমান হলেও আমাদের অনেকে ১. যথাযথ সহিহভাবে কোরআন পড়তে জানেন না। শৈশবে শিখলেও পরবর্তীকালে নানাবিধ ব্যস্ততার কারণে না পড়ায় এখন মাঝে মধ্যে পড়লেও আগের মতো আর সহিহ-শুদ্ধ হয় না। ২. কোরআন আগে শিখলেও না পড়ার কারণে ভুলে গেছেন। ৩. ভুলে গেছেন মনে করে এখন আর কোরআন পড়েন না এবং সহিহ-শুদ্ধতা যাচাইয়ের ব্যাপারে কারও শরণাপন্নও হন না বা কোনো পদক্ষেপও গ্রহণ করেন না এবং ৪. এমনও অনেকে আছেন যারা কোরআন পড়া মোটেই শিখেননি, কোরআন পড়তেই জানেন না।
এ দেশের বেশিরভাগ মুসলমান শুনে শুনে নামাজ আদায়ের উপযোগী কিছু সূরা-কেরাত শিখে তা দিয়ে নামাজ আদায় করে তৃপ্তি লাভ করে থাকলেও সূরা-কেরাতগুলোর শুদ্ধাশুদ্ধি যাচাইয়ের জন্য কাউকে শোনানোর প্রয়োজন মনে করেন না। অথচ নামাজ যথারীতি আদায় করলেও নামাজের মধ্যে কেরাত অশুদ্ধ পড়লে, সূরা অশুদ্ধ পড়লে যে নামাজ ভঙ্গ হয়ে যায়, নামাজ হয় না, এটুকু তিনি জানার প্রয়োজনও মনে করেননি, কেউ হয়তো যথাযথ গুরুত্ব সহকারে তা তাকে জানায়নি। যারা সমাজসেবক হিসেবে সমাজসেবায় আর শিক্ষানুরাগী হিসেবে শিক্ষাক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে কিছুটা হলেও অবদান রাখছেন, সমাজসেবার আর শিক্ষার অংশ হিসেবে কোরআনবিমুখ আর কোরআন শিক্ষা বঞ্চিত অসহায় ও হতভাগ্যদের ব্যাপারে সমাজসেবী আর শিক্ষানুরাগীদের, জনপ্রতিনিধিদের, বিভিন্ন পর্যায়ের প্রধানদের বিশেষ করে সরকারের ন্যূনতম কিছুই কি করণীয় নেই?
যারা অর্থ সম্পদের মালিক এবং ক্ষমতা কর্তৃত্বের অধিকারী তাদের সমাজসেবায় আর শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের পাশাপাশি ধর্মের ব্যাপারেও কাজ করতে হবে। কারণ স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টির প্রয়োজনে দুনিয়ার কথা যেমনি বলেছেন, তেমনি বলেছেন আখেরাতের কথাও। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘আর মানুষের মধ্যে এমন লোকও আছে যে বলে—হে আমাদের প্রভু! এ দুনিয়াতেই আমাদের দাও। বস্তুত আখেরাতে তার জন্য কোনো অংশ নেই। তাদের মধ্যে এমন লোকও রয়েছে যে বলে, হে আমাদের প্রভু! এ দুনিয়াতে আমাদের কল্যাণ দাও এবং আখেরাতের কল্যাণও দাও আর আমাদের দোজখের আগুন থেকে রক্ষা কর। এদের জন্য অংশ রয়েছে এরা যা অর্জন করেছে তাতে’ (সূরা বাকারা : ২০০ থেকে ২০২ আয়াত)। কাজেই ধর্মের জন্য, কোরআনের শিক্ষার জন্য, ধর্মীয় শিক্ষার প্রচার ও প্রসারে, বিশেষ করে নামাজ সহিহভাবে আদায় উপযোগী শিক্ষায় সাধারণ মানুষকে শিক্ষিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে, কর্মসূচি চালু করতে হবে। বিত্তশালী এবং কর্তৃত্বের অধিকারীরা ধর্মের ব্যাপারে ন্যূনতম কিছু কাজ না করলে শেষ পরিণতি হবে আফসোসের। আল্লাহর আগাম ঘোষণা হচ্ছে, ‘হায়! মৃত্যুই যদি আমাকে শেষ করে দিত! আমার ধন-সম্পদ আমার কোনো কাজেই এলো না। আর আমার ক্ষমতা-প্রতিপত্তিও আমার থেকে বরবাদ হয়ে গেল’ (সূরা হাক্কাহ : ২৭ থেকে ২৯ আয়াত)।
কোরআন শিক্ষাসহ ধর্মীয় শিক্ষার প্রচার ও প্রসারে এবং নামাজ শেখার ব্যাপারে সরকার, সমাজসেবক, শিক্ষানুরাগীসহ সংশ্লিষ্ট সবার নজর দেয়া অতীব প্রয়োজন। কোনোরকম অবকাঠামো নির্মাণ ছাড়াই ওই কাজটি অনায়াসে আনজাম দেয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে যা জরুরি তা হচ্ছে শুধু একটু সচেতনতা, একটু উদ্যোগ, একটু চিন্তা-ফিকির। পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও সময়-সুযোগের আলোকে কাজটি শুরু করার ক্ষেত্রে নিজের পদ্ধতিই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি। কর্মসূচির আওতায় যা থাকবে তা হচ্ছে স্রেফ নামাজ সহিহভাবে আদায় উপযোগী ব্যবস্থা তথা আরবি ২৯টি হরফের পরিচয়, সূরা ফাতিহাসহ ৪ থেকে ১০টি সুরা (দুর্বল ব্যক্তিবিশেষের জন্য প্রয়োজনে সূরা ফাতিহা ও মাত্র ৪টি সূরা), তাকবিরে তাহরিমা (নামাজ শুরুর আল্লাহু আকবার) থেকে নামাজ শেষের আচ্ছালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ্ পর্যন্ত ভেতরের প্রয়োজনীয় দোয়া-দরুদগুলো শেখানোর ব্যবস্থা; সঙ্গে থাকবে সহজ সরল বাংলা, গণিত (সাধারণ হিসাব-নিকাশ) এবং ইংরেজি (ব্যক্তিবিশেষের জন্য) শিক্ষা। কর্মসূচি বাস্তবায়নে দৈনিক বাঁধাধরা সময় নির্ধারণ না করে স্থান-কাল-পাত্র ভেদে দৈনিকের পরিবর্তে অর্ধ-সাপ্তাহিক বা সাপ্তাহিক সময় নির্ধারণ করা যেতে পারে সর্বোচ্চ ১ ঘণ্টা সময়ের জন্য।
ওই কর্মসূচি বাস্তবায়নে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রাইমারি, হাই স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় বয়স্ক শিক্ষার আদলে এ কার্যক্রম শুরু করে শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিবর্গকে ইমাম, মোয়াজ্জিন এবং শিক্ষকদের কাজে লাগাতে পারে, জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করা এবং উপজেলা কর্মকর্তাদের তদারকির দায়িত্বও দেয়া যেতে পারে। রাজনৈতিক অফিসে, বিভিন্ন ক্লাবে, সামাজিক সংগঠনের অফিসে, বাজারে ও মসজিদে এ কর্মসূচি চালু করা যায়। এনজিওদের সব কাজ ঠিক রেখে সঙ্গে সরকার নিয়ম করে দিয়ে ওই কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য নির্দেশ দিতে বা অনুরোধ করতে পারেন। যিনি সহিহভাবে কোরআন পড়তে পারেন, ব্যক্তিগত উদ্যোগে তিনি বাড়িতে, পরিবারে, অফিসেও এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে পারেন। এ প্রসঙ্গে দুটি বর্ণনা অতীব জরুরি—১. আবু মুসা (রা.) থেকে বর্ণিত যে, একদিন রাসুল (সা.) তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে নামাজ পড়ে বসলেন। এ সময় এক ব্যক্তি এসে তাড়াতাড়ি রুকু-সিজদা করে নামাজ পড়ল। রাসুল (সা.) বললেন, তোমরা ওই ব্যক্তিকে দেখতে পাচ্ছ? সে যদি এ অবস্থায় মারা যায় তবে মোহাম্মদের (সা.) উম্মতের বহির্ভূত অবস্থায় মারা যাবে (সহিহে আবু বকর বিন খুজাইমা)। ২. হজরত হুযায়ফা (রা.) এক ব্যক্তিকে দেখলেন ভালোভাবে রুকু-সিজদা না করে নামাজ পড়ছে। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, এভাবে কতদিন যাবত্ নামাজ পড়ছ? সে বলল, ৪০ বছর। তিনি বললেন, ‘তুমি ৪০ বছর যাবত্ কোনো নামাজই পড়নি। এ অবস্থায় মারা গেলে তুমি অমুসলিম অবস্থায় মারা যাবে।’ কোরআন ও হাদিসের আলোকে এটুকু সুস্পষ্ট যে কোরআন শেখা সহজ। এছাড়া আরবি ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা তিন কারণে আরবিকে ভালোবাস—১. আমি আরাবি, ২. কোরআনের ভাষা আরবি ও ৩. জান্নাতিদের ভাষা আরবি’ (হাদিস)। আমরা জানি চ এর স্থলে ঋ দিলে নাম্বার পাওয়া যায় না, ব-এর স্থলে ভ দিলে অর্থ পাল্টে যায়, আরবি হরফ একটির স্থলে আরেকটি পড়লে কি সওয়াব পাওয়া যাবে? কাজেই মুসলমান হিসেবে মাত্র ২৯টি আরবি হরফ সম্পর্কে আমাদের জানতে হবে, জানাতে হবে, নামাজ আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়ার জন্য হলেও আমাদের কোরআন শিখতে হবে। নামাজ পড়া এবং পরিবার-পরিজনকে, অধিনস্থদের নামাজের আদেশ দেয়া আল্লাহর সুস্পষ্ট নির্দেশ। আল্লাহ বলেন, ‘পরিবার-পরিজনকেও নামাজের নির্দেশ দাও এবং নিজেও এতে অবিচল থাক’ (সূরা ত্বহা ১৩২ আয়াত)। আল্লাহ আমাদের ওই ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করার, কাজ করার, নামাজ উপযোগী কোরআন শিক্ষা কর্মসূচি চালু করার এবং সহিহ তরিকায় নামাজ শেখার ও শিক্ষা দেয়ার তৌফিক দিন। আমিন। ষ
লেখক : শিক্ষাবিদ ও সাংবাদিক
ঈমানদার মুসলমান হলেও আমাদের অনেকে ১. যথাযথ সহিহভাবে কোরআন পড়তে জানেন না। শৈশবে শিখলেও পরবর্তীকালে নানাবিধ ব্যস্ততার কারণে না পড়ায় এখন মাঝে মধ্যে পড়লেও আগের মতো আর সহিহ-শুদ্ধ হয় না। ২. কোরআন আগে শিখলেও না পড়ার কারণে ভুলে গেছেন। ৩. ভুলে গেছেন মনে করে এখন আর কোরআন পড়েন না এবং সহিহ-শুদ্ধতা যাচাইয়ের ব্যাপারে কারও শরণাপন্নও হন না বা কোনো পদক্ষেপও গ্রহণ করেন না এবং ৪. এমনও অনেকে আছেন যারা কোরআন পড়া মোটেই শিখেননি, কোরআন পড়তেই জানেন না।
এ দেশের বেশিরভাগ মুসলমান শুনে শুনে নামাজ আদায়ের উপযোগী কিছু সূরা-কেরাত শিখে তা দিয়ে নামাজ আদায় করে তৃপ্তি লাভ করে থাকলেও সূরা-কেরাতগুলোর শুদ্ধাশুদ্ধি যাচাইয়ের জন্য কাউকে শোনানোর প্রয়োজন মনে করেন না। অথচ নামাজ যথারীতি আদায় করলেও নামাজের মধ্যে কেরাত অশুদ্ধ পড়লে, সূরা অশুদ্ধ পড়লে যে নামাজ ভঙ্গ হয়ে যায়, নামাজ হয় না, এটুকু তিনি জানার প্রয়োজনও মনে করেননি, কেউ হয়তো যথাযথ গুরুত্ব সহকারে তা তাকে জানায়নি। যারা সমাজসেবক হিসেবে সমাজসেবায় আর শিক্ষানুরাগী হিসেবে শিক্ষাক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে কিছুটা হলেও অবদান রাখছেন, সমাজসেবার আর শিক্ষার অংশ হিসেবে কোরআনবিমুখ আর কোরআন শিক্ষা বঞ্চিত অসহায় ও হতভাগ্যদের ব্যাপারে সমাজসেবী আর শিক্ষানুরাগীদের, জনপ্রতিনিধিদের, বিভিন্ন পর্যায়ের প্রধানদের বিশেষ করে সরকারের ন্যূনতম কিছুই কি করণীয় নেই?
যারা অর্থ সম্পদের মালিক এবং ক্ষমতা কর্তৃত্বের অধিকারী তাদের সমাজসেবায় আর শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের পাশাপাশি ধর্মের ব্যাপারেও কাজ করতে হবে। কারণ স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টির প্রয়োজনে দুনিয়ার কথা যেমনি বলেছেন, তেমনি বলেছেন আখেরাতের কথাও। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘আর মানুষের মধ্যে এমন লোকও আছে যে বলে—হে আমাদের প্রভু! এ দুনিয়াতেই আমাদের দাও। বস্তুত আখেরাতে তার জন্য কোনো অংশ নেই। তাদের মধ্যে এমন লোকও রয়েছে যে বলে, হে আমাদের প্রভু! এ দুনিয়াতে আমাদের কল্যাণ দাও এবং আখেরাতের কল্যাণও দাও আর আমাদের দোজখের আগুন থেকে রক্ষা কর। এদের জন্য অংশ রয়েছে এরা যা অর্জন করেছে তাতে’ (সূরা বাকারা : ২০০ থেকে ২০২ আয়াত)। কাজেই ধর্মের জন্য, কোরআনের শিক্ষার জন্য, ধর্মীয় শিক্ষার প্রচার ও প্রসারে, বিশেষ করে নামাজ সহিহভাবে আদায় উপযোগী শিক্ষায় সাধারণ মানুষকে শিক্ষিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে, কর্মসূচি চালু করতে হবে। বিত্তশালী এবং কর্তৃত্বের অধিকারীরা ধর্মের ব্যাপারে ন্যূনতম কিছু কাজ না করলে শেষ পরিণতি হবে আফসোসের। আল্লাহর আগাম ঘোষণা হচ্ছে, ‘হায়! মৃত্যুই যদি আমাকে শেষ করে দিত! আমার ধন-সম্পদ আমার কোনো কাজেই এলো না। আর আমার ক্ষমতা-প্রতিপত্তিও আমার থেকে বরবাদ হয়ে গেল’ (সূরা হাক্কাহ : ২৭ থেকে ২৯ আয়াত)।
কোরআন শিক্ষাসহ ধর্মীয় শিক্ষার প্রচার ও প্রসারে এবং নামাজ শেখার ব্যাপারে সরকার, সমাজসেবক, শিক্ষানুরাগীসহ সংশ্লিষ্ট সবার নজর দেয়া অতীব প্রয়োজন। কোনোরকম অবকাঠামো নির্মাণ ছাড়াই ওই কাজটি অনায়াসে আনজাম দেয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে যা জরুরি তা হচ্ছে শুধু একটু সচেতনতা, একটু উদ্যোগ, একটু চিন্তা-ফিকির। পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও সময়-সুযোগের আলোকে কাজটি শুরু করার ক্ষেত্রে নিজের পদ্ধতিই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি। কর্মসূচির আওতায় যা থাকবে তা হচ্ছে স্রেফ নামাজ সহিহভাবে আদায় উপযোগী ব্যবস্থা তথা আরবি ২৯টি হরফের পরিচয়, সূরা ফাতিহাসহ ৪ থেকে ১০টি সুরা (দুর্বল ব্যক্তিবিশেষের জন্য প্রয়োজনে সূরা ফাতিহা ও মাত্র ৪টি সূরা), তাকবিরে তাহরিমা (নামাজ শুরুর আল্লাহু আকবার) থেকে নামাজ শেষের আচ্ছালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ্ পর্যন্ত ভেতরের প্রয়োজনীয় দোয়া-দরুদগুলো শেখানোর ব্যবস্থা; সঙ্গে থাকবে সহজ সরল বাংলা, গণিত (সাধারণ হিসাব-নিকাশ) এবং ইংরেজি (ব্যক্তিবিশেষের জন্য) শিক্ষা। কর্মসূচি বাস্তবায়নে দৈনিক বাঁধাধরা সময় নির্ধারণ না করে স্থান-কাল-পাত্র ভেদে দৈনিকের পরিবর্তে অর্ধ-সাপ্তাহিক বা সাপ্তাহিক সময় নির্ধারণ করা যেতে পারে সর্বোচ্চ ১ ঘণ্টা সময়ের জন্য।
ওই কর্মসূচি বাস্তবায়নে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রাইমারি, হাই স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় বয়স্ক শিক্ষার আদলে এ কার্যক্রম শুরু করে শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিবর্গকে ইমাম, মোয়াজ্জিন এবং শিক্ষকদের কাজে লাগাতে পারে, জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করা এবং উপজেলা কর্মকর্তাদের তদারকির দায়িত্বও দেয়া যেতে পারে। রাজনৈতিক অফিসে, বিভিন্ন ক্লাবে, সামাজিক সংগঠনের অফিসে, বাজারে ও মসজিদে এ কর্মসূচি চালু করা যায়। এনজিওদের সব কাজ ঠিক রেখে সঙ্গে সরকার নিয়ম করে দিয়ে ওই কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য নির্দেশ দিতে বা অনুরোধ করতে পারেন। যিনি সহিহভাবে কোরআন পড়তে পারেন, ব্যক্তিগত উদ্যোগে তিনি বাড়িতে, পরিবারে, অফিসেও এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে পারেন। এ প্রসঙ্গে দুটি বর্ণনা অতীব জরুরি—১. আবু মুসা (রা.) থেকে বর্ণিত যে, একদিন রাসুল (সা.) তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে নামাজ পড়ে বসলেন। এ সময় এক ব্যক্তি এসে তাড়াতাড়ি রুকু-সিজদা করে নামাজ পড়ল। রাসুল (সা.) বললেন, তোমরা ওই ব্যক্তিকে দেখতে পাচ্ছ? সে যদি এ অবস্থায় মারা যায় তবে মোহাম্মদের (সা.) উম্মতের বহির্ভূত অবস্থায় মারা যাবে (সহিহে আবু বকর বিন খুজাইমা)। ২. হজরত হুযায়ফা (রা.) এক ব্যক্তিকে দেখলেন ভালোভাবে রুকু-সিজদা না করে নামাজ পড়ছে। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, এভাবে কতদিন যাবত্ নামাজ পড়ছ? সে বলল, ৪০ বছর। তিনি বললেন, ‘তুমি ৪০ বছর যাবত্ কোনো নামাজই পড়নি। এ অবস্থায় মারা গেলে তুমি অমুসলিম অবস্থায় মারা যাবে।’ কোরআন ও হাদিসের আলোকে এটুকু সুস্পষ্ট যে কোরআন শেখা সহজ। এছাড়া আরবি ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা তিন কারণে আরবিকে ভালোবাস—১. আমি আরাবি, ২. কোরআনের ভাষা আরবি ও ৩. জান্নাতিদের ভাষা আরবি’ (হাদিস)। আমরা জানি চ এর স্থলে ঋ দিলে নাম্বার পাওয়া যায় না, ব-এর স্থলে ভ দিলে অর্থ পাল্টে যায়, আরবি হরফ একটির স্থলে আরেকটি পড়লে কি সওয়াব পাওয়া যাবে? কাজেই মুসলমান হিসেবে মাত্র ২৯টি আরবি হরফ সম্পর্কে আমাদের জানতে হবে, জানাতে হবে, নামাজ আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়ার জন্য হলেও আমাদের কোরআন শিখতে হবে। নামাজ পড়া এবং পরিবার-পরিজনকে, অধিনস্থদের নামাজের আদেশ দেয়া আল্লাহর সুস্পষ্ট নির্দেশ। আল্লাহ বলেন, ‘পরিবার-পরিজনকেও নামাজের নির্দেশ দাও এবং নিজেও এতে অবিচল থাক’ (সূরা ত্বহা ১৩২ আয়াত)। আল্লাহ আমাদের ওই ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করার, কাজ করার, নামাজ উপযোগী কোরআন শিক্ষা কর্মসূচি চালু করার এবং সহিহ তরিকায় নামাজ শেখার ও শিক্ষা দেয়ার তৌফিক দিন। আমিন। ষ
লেখক : শিক্ষাবিদ ও সাংবাদিক
ইসলামে দাওয়াতের গুরুত্ব
ড. মু. বি লা ল হু সা ই ন
ইসলামে দাওয়াতের গুরুত্ব্ব অপরিসীম। যে কারণে অসংখ্য নবী-রাসুল এ পৃথিবীতে আগমন করেছেন। ‘দাওয়াহ’ আরবি শব্দ। যার শাব্দিক অর্থ—আহ্বান করা, ডাকা। পরিভাষায় সব মানব সমাজকে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সুখ-শান্তি, কল্যাণ ও মুক্তি লাভের উদ্দেশ্যে পরিচালিত কার্যক্রমকে ইসলামে দাওয়াত হিসেবে গণ্য করা হয়। এ দাওয়াত মানুষকে অশান্তি থেকে শান্তির দিকে, অকল্যাণ থেকে কল্যাণের দিকে, সঙ্কীর্ণতা থেকে উদারতার দিকে, জাহান্নাম থেকে জান্নাতের দিকে এবং পশ্চাত্পদতা থেকে প্রগতির দিকে ধাবিত করে। আল্লাহর সঙ্গে মানব জাতির সম্পর্ক দৃঢ় করতে দাওয়াত সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
ইসলামী দাওয়াতের কর্মসূচি আল্লাহর পক্ষ থেকে মানবজাতির জন্য এক বিরাট নিয়ামত। তিনি মানবজাতির মধ্য থেকে কিছু লোককে বাছাই করে দাওয়াতের জন্য মনোনীত করেছেন। তাদের আল্লাহ তায়ালা বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন। পৃথিবীর প্রথম মানব ও নবী হজরত আদম (আ.) এ দাওয়াতের কার্যক্রমের সূচনা করেন। পরবর্তী সময়ে হজরত নূহ, হুদ, সালিহ, ইয়াকুব ও ইউসুফ (আ.) থেকে হজরত ঈসা (আ.) পর্যন্ত অসংখ্য নবী-রাসুলের মাধ্যমে এ ধারা অব্যাহত রাখেন। তারা আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আসা বাণীগুলো সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতেন।
মহানবীর (সা.) দাওয়াত ছিল সার্বজনীন। পূর্ববতী নবী ও রাসুলরা বিশেষ কোনো গোত্র, গোষ্ঠী বা অঞ্চলের অধিবাসীকে দাওয়াত দিয়েছেন। ফলে তাদের দাওয়াত সার্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্য হয়নি। মহানবী (সা.) সব জাতি-গোষ্ঠীর কাছে আল্লাহ প্রদত্ত দাওয়াত দিয়েছেন। মহান আল্লাহ তায়ালা এ জন্যই তাকে ঘোষণা দেয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘আপনি বলুন, হে মানবমণ্ডলী! আমি তোমাদের সবার প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত রাসুল’ (সূরা আল-আ’রাফ : ১৫৮)। তাঁর অবর্তমানে দাওয়াতের এ গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয় মুসলিম উম্মাহর প্রতি। যারা কিয়ামত পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখবে।
সমাজের সব ধরনের অন্যায়, অবিচার, পাপাচার, মারামারি, দুর্নীতি, ব্যক্তি চরিত্র নষ্টসহ সব অপরাধ নির্মূলে ইসলামী দাওয়াত বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে। কেননা, এ দাওয়াতের মূল বিষয়বস্তু হলো সত্ কাজের আদেশ এবং অসত্ কাজের নিষেধ। সেহেতু ব্যক্তি সব ধরনের অন্যায় কাজ থেকে বিরত থেকে সমাজে সুবিচার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করবে। পাপাচারযুক্ত এ সমাজে ইসলামী দাওয়াতই মানব সমাজের কাছে আশার আলো প্রজ্বলিত করতে পারে।
পৃথিবীকে সবার কাছে সুন্দর করতে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে খিলাফতের দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। এ দায়িত্ব সুন্দরভাবে পালনের জন্য মুসলিম উম্মাহর উপর দাওয়াতি ও তাবলিগের কাজ ফরজ করে দিয়েছেন। এ দায়িত্ব পালনে পবিত্র কোরআনে দায়ীদের উত্সাহিত করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তাঁর কথার চেয়ে কার কথা উত্তম হতে পারে, যে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়, সত্কর্ম করে এবং বলে আমি মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত’ (হা-মীম আস সাজদাহ : ৩)। আল্লাহ তায়ালা অন্যত্র বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে অবশ্যই এমন একটি দল থাকতে হবে, যারা মানব জাতিকে কল্যাণের দাওয়াত দেবে, সত্কাজের আদেশ করবে এবং অসত্কাজে নিষেধ করবে, তারাই সফলকাম’ (আলে ইমরান : ১০৪)।
দাওয়াতি কার্যক্রম একটি চলমান প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়া থেকে বিরত থাকার কোনো সুযোগ মুসলিম উম্মাহর নেই। সব ধরনের অন্যায়-অবিচারে পৃথিবী যখন জর্জরিত তখনই অবিরাম দাওয়াতি কার্যক্রমই পারে বিপন্ন মানবতাকে মুক্তির সন্ধান দিতে। মানুষকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে দাওয়াতে বিকল্প কিছুই নেই। এ দাওয়াতের মাধ্যমে সমাজ-দেশ-জাতি-রাষ্ট্রের মধ্যে বসবাসকারী মানবতা মুক্তি ও কল্যাণ লাভ করতে পারে। এতে ছেদ পড়লে মানব সমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে। মহানবীও (সা.) এ বিষয়ে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেন, আমি সেই সত্তার শপথ করে বলছি, যার হাতে রয়েছে আমার প্রাণ, অবশ্যই তোমরা সত্কাজের নির্দেশ দেবে এবং অসত্ কাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখবে। নতুবা তোমাদের ওপর শীঘ্রই আল্লাহ শাস্তি অবতীর্ণ করবেন। তখন তোমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানাতে থাকবে কিন্তু তোমাদের প্রার্থনা কবুল করা হবে না। (তিরমিজি)
অতএব সামাজিক অশান্তি দূর করা ও মানবতার মুক্তির জন্য সবাইকে একযোগে দাওয়াতি কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে হবে। নিজেদের পরিশুদ্ধ হতে হবে এবং অন্যদের মাঝে চিন্তার পরিশুদ্ধি ঘটাতে হবে। তবে আমরা নতুন প্রজন্মের মাঝে একটি কল্যাণময় সমাজ উপহার দিতে সক্ষম হবো এবং পরকালে লাভ করতে পারব চূড়ান্ত সফলতা। ষ
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ইসলামে দাওয়াতের গুরুত্ব্ব অপরিসীম। যে কারণে অসংখ্য নবী-রাসুল এ পৃথিবীতে আগমন করেছেন। ‘দাওয়াহ’ আরবি শব্দ। যার শাব্দিক অর্থ—আহ্বান করা, ডাকা। পরিভাষায় সব মানব সমাজকে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সুখ-শান্তি, কল্যাণ ও মুক্তি লাভের উদ্দেশ্যে পরিচালিত কার্যক্রমকে ইসলামে দাওয়াত হিসেবে গণ্য করা হয়। এ দাওয়াত মানুষকে অশান্তি থেকে শান্তির দিকে, অকল্যাণ থেকে কল্যাণের দিকে, সঙ্কীর্ণতা থেকে উদারতার দিকে, জাহান্নাম থেকে জান্নাতের দিকে এবং পশ্চাত্পদতা থেকে প্রগতির দিকে ধাবিত করে। আল্লাহর সঙ্গে মানব জাতির সম্পর্ক দৃঢ় করতে দাওয়াত সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
ইসলামী দাওয়াতের কর্মসূচি আল্লাহর পক্ষ থেকে মানবজাতির জন্য এক বিরাট নিয়ামত। তিনি মানবজাতির মধ্য থেকে কিছু লোককে বাছাই করে দাওয়াতের জন্য মনোনীত করেছেন। তাদের আল্লাহ তায়ালা বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন। পৃথিবীর প্রথম মানব ও নবী হজরত আদম (আ.) এ দাওয়াতের কার্যক্রমের সূচনা করেন। পরবর্তী সময়ে হজরত নূহ, হুদ, সালিহ, ইয়াকুব ও ইউসুফ (আ.) থেকে হজরত ঈসা (আ.) পর্যন্ত অসংখ্য নবী-রাসুলের মাধ্যমে এ ধারা অব্যাহত রাখেন। তারা আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আসা বাণীগুলো সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতেন।
মহানবীর (সা.) দাওয়াত ছিল সার্বজনীন। পূর্ববতী নবী ও রাসুলরা বিশেষ কোনো গোত্র, গোষ্ঠী বা অঞ্চলের অধিবাসীকে দাওয়াত দিয়েছেন। ফলে তাদের দাওয়াত সার্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্য হয়নি। মহানবী (সা.) সব জাতি-গোষ্ঠীর কাছে আল্লাহ প্রদত্ত দাওয়াত দিয়েছেন। মহান আল্লাহ তায়ালা এ জন্যই তাকে ঘোষণা দেয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘আপনি বলুন, হে মানবমণ্ডলী! আমি তোমাদের সবার প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত রাসুল’ (সূরা আল-আ’রাফ : ১৫৮)। তাঁর অবর্তমানে দাওয়াতের এ গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয় মুসলিম উম্মাহর প্রতি। যারা কিয়ামত পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখবে।
সমাজের সব ধরনের অন্যায়, অবিচার, পাপাচার, মারামারি, দুর্নীতি, ব্যক্তি চরিত্র নষ্টসহ সব অপরাধ নির্মূলে ইসলামী দাওয়াত বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে। কেননা, এ দাওয়াতের মূল বিষয়বস্তু হলো সত্ কাজের আদেশ এবং অসত্ কাজের নিষেধ। সেহেতু ব্যক্তি সব ধরনের অন্যায় কাজ থেকে বিরত থেকে সমাজে সুবিচার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করবে। পাপাচারযুক্ত এ সমাজে ইসলামী দাওয়াতই মানব সমাজের কাছে আশার আলো প্রজ্বলিত করতে পারে।
পৃথিবীকে সবার কাছে সুন্দর করতে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে খিলাফতের দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। এ দায়িত্ব সুন্দরভাবে পালনের জন্য মুসলিম উম্মাহর উপর দাওয়াতি ও তাবলিগের কাজ ফরজ করে দিয়েছেন। এ দায়িত্ব পালনে পবিত্র কোরআনে দায়ীদের উত্সাহিত করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তাঁর কথার চেয়ে কার কথা উত্তম হতে পারে, যে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়, সত্কর্ম করে এবং বলে আমি মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত’ (হা-মীম আস সাজদাহ : ৩)। আল্লাহ তায়ালা অন্যত্র বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে অবশ্যই এমন একটি দল থাকতে হবে, যারা মানব জাতিকে কল্যাণের দাওয়াত দেবে, সত্কাজের আদেশ করবে এবং অসত্কাজে নিষেধ করবে, তারাই সফলকাম’ (আলে ইমরান : ১০৪)।
দাওয়াতি কার্যক্রম একটি চলমান প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়া থেকে বিরত থাকার কোনো সুযোগ মুসলিম উম্মাহর নেই। সব ধরনের অন্যায়-অবিচারে পৃথিবী যখন জর্জরিত তখনই অবিরাম দাওয়াতি কার্যক্রমই পারে বিপন্ন মানবতাকে মুক্তির সন্ধান দিতে। মানুষকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে দাওয়াতে বিকল্প কিছুই নেই। এ দাওয়াতের মাধ্যমে সমাজ-দেশ-জাতি-রাষ্ট্রের মধ্যে বসবাসকারী মানবতা মুক্তি ও কল্যাণ লাভ করতে পারে। এতে ছেদ পড়লে মানব সমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে। মহানবীও (সা.) এ বিষয়ে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেন, আমি সেই সত্তার শপথ করে বলছি, যার হাতে রয়েছে আমার প্রাণ, অবশ্যই তোমরা সত্কাজের নির্দেশ দেবে এবং অসত্ কাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখবে। নতুবা তোমাদের ওপর শীঘ্রই আল্লাহ শাস্তি অবতীর্ণ করবেন। তখন তোমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানাতে থাকবে কিন্তু তোমাদের প্রার্থনা কবুল করা হবে না। (তিরমিজি)
অতএব সামাজিক অশান্তি দূর করা ও মানবতার মুক্তির জন্য সবাইকে একযোগে দাওয়াতি কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে হবে। নিজেদের পরিশুদ্ধ হতে হবে এবং অন্যদের মাঝে চিন্তার পরিশুদ্ধি ঘটাতে হবে। তবে আমরা নতুন প্রজন্মের মাঝে একটি কল্যাণময় সমাজ উপহার দিতে সক্ষম হবো এবং পরকালে লাভ করতে পারব চূড়ান্ত সফলতা। ষ
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ইসলাম এবং সহিষ্ণুতার সৌন্দর্য
খা লি দ বে গ
খলিফা হজরত উমর বিন খাত্তাব (রা.) যখন মৃত্যুশয্যায়, তিনি তার পরবর্তী খলিফার উদ্দেশে নানা নির্দেশ ও উপদেশ সংবলিত একটি দীর্ঘ অসিয়তনামা (উইল) প্রণয়ন করে গেলেন। সেই ঐতিহাসিক দলিলের সর্বশেষ বাক্যটি হলো, ‘জনগণের পক্ষ থেকে আমি তোমাকে এই নির্দেশ দান করছি যে, আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের (সা.) নামে যাদের নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে তাদের ব্যাপারে কর্তব্যবিমুখ হয়ো না; অর্থাত্ (ইসলামী রাষ্ট্রে যারা অমুসলিম সংখ্যালঘু বা জিম্মি) তাদের সঙ্গে আমাদের যে চুক্তি তা কখনও লঙ্ঘন করো না, তাদের নিরাপত্তা রক্ষায় আমরা অবশ্যই সর্বাত্মকভাবে সচেষ্ট থাকব এবং তাদের ওপর এমন ভার চাপানো যাবে না, যা বহন করতে তারা অক্ষম।’
এই নির্দেশনামা যখন লেখা হচ্ছিল, সায়্যিদানা উমর (রা.) তখন যন্ত্রণাগ্রস্ত অবস্থায় শয্যাশায়ী। ফজরের সালাতে ইমামতি করার সময় এক অমুসলিম তাকে বিষমাখানো ছোরা দ্বারা আঘাত করে। এই মারাত্মক ছুরিকাঘাতে আহত অবস্থায় তিনি আলোচ্য অসিয়াতনামাটি লিপিবদ্ধ করান। মনে রাখা আবশ্যক, উমর ফারুক (রা.) তখন এমন এক বিশাল সাম্রাজ্যের শাসক, যে সাম্রাজ্য মিসর থেকে পারস্য পর্যন্ত বিস্তৃত। নিশ্চয়ই এই প্রশ্ন স্বাভাবিক যে, দুশমন কর্তৃক আক্রান্ত অবস্থায় তার সময়ের এবং আমাদের এই সময়েরও একজন সাধারণ শাসকের প্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে? অবশ্যই দ্রুত প্রতিশোধ গ্রহণ। (আজকালের ‘প্রাজ্ঞ ও জ্ঞানদীপ্ত’ শাসকরা তো হত্যা চক্রান্তে সত্যিই যুক্ত কি যুক্ত নয়, সে কথা সঠিকভাবে না জেনেই, শুধু সন্দেহবশতই বোমাবর্ষণ করে থাকে) একজন ক্ষমাশীল ও সদ্বিবেচক শাসকের কাছ থেকেও, খুব বেশি হলে আমরা শুধু এটুকু আশা করতে পারি যে, তিনি বিষয়টি ভুলে যাবেন ও ক্ষমা করবেন এবং সেটাই উচ্চতম আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হবে। কিন্তু সংখ্যালঘুদের সার্বিক নিরাপত্তা বিধান এবং তাদের ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের এই নির্দেশকে কি শুধুই অনন্য বলে অভিহিত করা যায়? না। কারণ অপর একটি বিষয় খুবই উল্লেখযোগ্য যে, মুসলিম ঐতিহাসিকদের অভিমত হলো, খলিফা উমরের এই নির্দেশনামা ছিল খুবই স্বাভাবিক। বিশেষ করে দেশের পর দেশ যখন মুসলিম শাসনাধীনে চলে আসছে এবং খলিফা নিজেই যখন তার শাসনামলে বিধির পর বিধি জারি করে সব নাগরিকের, জীবন সম্পদ ও ধর্মের সার্বিক নিরাপত্তা বিধানের একটি সুনিশ্চিত ও সুরক্ষিত আদর্শ স্থাপন করেছেন, তখন এই মৃত্যুকালীন অসিয়ত আদৌ অস্বাভাবিক কিছু নয়। বলা আবশ্যক, প্রতিষ্ঠিত এই আদর্শ মুসলিম বিশ্বে শতাব্দীর পর শতাব্দী একইভাবে অব্যাহত আছে।
অবশ্য সায়্যিদানা উমর (রা.) যা করেছেন, তা সবই রাসুলের (সা.) শিক্ষা ও জীবনাদর্শের বিশ্বস্ত প্রতিরূপ। আসলে সংখ্যালঘুদের জীবন, সম্পদ ও ধর্মপালনের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বিধান যে কোনো ইসলামী রাষ্ট্রের একটি ধর্মীয় কর্তব্য। কারণ সংখ্যালঘুদের ওপর যে কোনো ধরনের অবিচার-অত্যাচারের জন্য রাসুল (সা.) নিজে আখিরাতে অত্যাচারী মুসলমানের বিরুদ্ধে বিচার দাবি করবেন। আর ইসলামে যেহেতু ধর্মের ক্ষেত্রে কোনো জোরজবরদস্তি ও বাধ্যবাধকতার অবকাশ নেই, মুসলমানকে শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সবার প্রতি একই রকম ইনসাফ রক্ষা করা অবশ্যকর্তব্য।
এই শিক্ষার ফলেই মুসলিম শাসনাধীনে ধর্মীয় স্বাধীনতার এমন একটি মূল্যবান আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হলো, যে বিষয়ে কারও কোনো ধারণাই ছিল না। শুধু যে মুসলমানদের ইতিহাসই উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন বয়ে আনল তা নয়, ইসলামের সংস্পর্শে পুরো পৃথিবীর দৃষ্টিভঙ্গিই বদলে গেল। বিরুদ্ধ ধর্মমতের দমন, নিগ্রহ-নির্যাতন, হত্যাকাণ্ড (ঐড়ষড়পধঁংঃ) ইত্যাদি, যা অন্য সব সভ্যতার একটি কলঙ্কজনক সাধারণ বৈশিষ্ট্য, সেই বৈশিষ্ট্যে দেখা দিল এমন পরিবর্তন, যার ফলে নিপীড়ন-নির্যাতন থেকে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা অনেকখানি নিশ্চিত হলো এবং এরই ফলে ইহুদিরা খ্রিস্টানদের হাত থেকে এবং পূর্বাঞ্চলীয় খ্রিস্টানরা রোমান ক্যাথলিকদের নিপীড়ন থেকে অনেকটই রক্ষা পেল। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, উমাইয়াদের শাসনাধীন স্পেনে এবং আব্বাসীয় খেলাফতের অধীন বাগদাদে খ্রিস্টান ও ইহুদিরা সম্পূর্ণরূপে ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করত; আর এই যে পারস্পরিক ধর্মীয় সহাবস্থান, আগে তাদের মধ্যে কোনো সময়েই বিদ্যমান ছিল না।
উল্লেখযোগ্য যে, এই দৃষ্টান্তমূলক সহিষ্ণুতা ইসলামী শিক্ষার ফলেই গড়ে উঠেছে। ইসলামের মূল পয়গামই হলো, পার্থিব জীবন একটি পরীক্ষা। আমরা এখানে জাহান্নাম কি জান্নাতের যে পথ, তার যে কোনো একটিকেই গ্রহণ করতে পারি। নবী-রাসুলদের মানব সম্প্রদায়ের কাছে এই পয়গাম দিয়ে পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করার জন্যই প্রেরণ করা হয়েছে। তাঁদের এজন্য পাঠানো হয়নি যে, তাঁরা শক্তিপ্রয়োগে মানুষকে সঠিক পথে নিয়ে আসবেন। মুসলিমদের দায়িত্বও ঠিক একই রকম। তারা মানুষের কাছে ইসলামের যে প্রকৃত পয়গাম, সেটাই যথাসাধ্য পৌঁছে দেবে। তাদের কাজ ইসলামকে রদবদল করে মানুষের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলাও নয়, মানুষের নিজস্ব পছন্দকে দমন করে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করাও নয়। এই সঙ্গে এটা মনে রাখা আবশ্যক, আখিরাতের যে ফলাফল সেটা বিশ্বাসের (ঈমান) ওপর নির্ভরশীল। অতএব সব সত্ ও মহত্কর্মই পুরোপুরি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে, যদি সঠিক বিশ্বাস না থাকে। আর বিশ্বাস যেহেতু অন্তরের সম্পদ, এক্ষেত্রে কোনোরূপ শক্তিপ্রয়োগ চলে না।
এই ধারণা ভুল যে, অন্য যে কোনো ধর্মাবলম্বীরাও নিজ ধর্মকে অক্ষত রেখে ইসলামের অংশীদার হতে পারে। এরকম হলে, সহিষ্ণুতা অবলম্বনের ক্ষেত্রে মুসলমানদের যে আদর্শ, সেটা অবশিষ্ট পৃথিবীর বক্তব্যের সঙ্গে রীতিমত সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে। মার্মাডিউক পিকথল উল্লেখ করেন, ‘পশ্চিমা জাতিগুলো যে কিছুটা হলেও সহিষ্ণুতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে, সেটা তাদের ধর্মীয় বিধান পরিহার বা অস্বীকার করার সুফল, অথচ অন্যদিকে, মুসলমানদের ক্ষেত্রে ধর্মীয় আদর্শ শিথিল ও খর্ব হওয়ার কারণেই অসহিষ্ণুতার সৃষ্টি।’
পশ্চিমা বিশ্ব সামাজিক সাম্য ও মিলনের যে পথ তৈরি করেছে সেটা জনজীবন থেকে ধর্মের প্রভাবকে যথাসম্ভব নিশ্চিহ্ন করার ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং এই অর্জন, তাদের ধারণা, আলোচ্য বিষয়ে যথাযথ প্রচার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ফলেই সম্ভব হয়েছে। সুতরাং এটা স্মরণ রাখা উত্তম যে গত শতাব্দীতে সহিষ্ণুতার ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের যে বিশাল অগ্রগতি (যা অভিনন্দন লাভের যোগ্য), তাকে ইসলাম কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত নীতি-আদর্শের কাছে পৌঁছতে অনেক পথ ও সময় অতিক্রম করতে হয়েছে। প্রথমত, মুসলমানদের যে ব্যক্তিগত-পারিবারিক বিধান, সেটা পাশ্চাত্যে অস্বীকৃত; অথচ অমুসলিম সংখ্যালঘুদের ব্যক্তিগত বিধান ও অধিকার মুসলিম বিশ্বের কোথাও কোনোদিন এতটুকু ক্ষুণ্ন হয়নি। দ্বিতীয়ত, ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বত্রই মাইক্রোফোনে আজান প্রচারের কোনো অনুমতি নেই; অথচ মুসলিম বিশ্বে গির্জায় ঘণ্টাধ্বনি নির্বিঘ্নে ও যথানিয়মে প্রচারিত হচ্ছে। তৃতীয়ত, পাশ্চাত্য প্রচার মাধ্যমের যে বিশ্ববিস্তৃত ইসলামবৈরী পক্ষপাতদুষ্ট ও কুসংস্কারাশ্রিত ভূমিকা, সেই ভূমিকাও মৌলিক-অসহিষ্ণুতার বিশেষ কারণও পরিণতি। চতুর্থত, সাম্প্রদায়িক হিংসাশ্রিত অপরাধকর্ম পশ্চিমা জীবনধারার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, অবশ্য এই বিষয়টি সততই বেশ কৌশলে আড়ালে রাখা হয়। পঞ্চমত, ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ব্যাপারটি কখনোই খুব একটা গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয় না, যথেষ্ট প্রাধান্যও দেয়া হয় না। এ বিষয়ে একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যায় : ১৯৯৯ সালে মুসলমানদের অনুকূলে দুটি প্রস্তাব মার্কিন সিনেটে উত্থাপিত হলো। প্রস্তাবটির শীর্ষ নাম ছিল, ‘মুসলমানদের প্রতি ধর্মীয় সহিষ্ণুতা রক্ষাকল্পে সমর্থন’ (অ জবংড়ষঁঃরড়হ ঝঁঢ়ঢ়ড়ত্ঃরহম ত্বষরমরড়ঁং ঃড়ষবত্ধহবপ ঃড়ধিত্ফ গঁংষরসং)। কিন্তু সিনেটে যদিও প্রস্তাবটি পাস হলো, কিছু কিছু ইহুদি ও খ্রিস্টানের একগুঁয়ে চাপের কারণে উচ্চকক্ষে তা আর গৃহীত হলো না। ঘটনাটি ছিল ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর দুর্ঘটনার দুই বছর আগের। তারপর তো সবই আমূল বদলে গেল। আসলে সেপ্টেম্বরের ‘দৈব দুর্ঘটনাটি’ অভিনব বটে, তবে এর মধ্য দিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব তার বহু দিনের লালিত অসহিষ্ণুতা ও প্রতিহিংসা ক্রমবর্ধমান হারে অব্যাহত রাখার একটা ‘যৌক্তিক’ ভিত্তি দাঁড় করাতে সক্ষম হলো।
শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয়, অবশিষ্ট ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের’ কাছেও পরিস্থিতি প্রায় একই রূপ পরিগ্রহ করল। জার্মানি এবং ফ্রান্সের কথা উল্লেখ করতে পারি; সেখানে এখন সরকারি শক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় মুসলিম মহিলাদের মস্তক থেকে হিজাব ছিনিয়ে নেয়া হচ্ছে। এরপরও এই গোঁড়া-ধর্মান্ধরাই নারী অধিকার এবং সহিষ্ণুতার প্রবক্তা এবং তারা এখন সরব দাবি তুলেছে, ‘অসহিষ্ণুতা’ নিরসনকল্পে মুসলিম বিশ্বের শিক্ষাক্রমে যথোচিত পরিবর্তন আনতে হবে। যাই হোক, মুসলমানদের মধ্যে বিরাজমান যে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, সেটা কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নাটকীয়তা নয়; এটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি অপরিহার্য ধর্মীয় কর্তব্য। সব অসহিষ্ণুতার মোকাবিলায় তাদের প্রবল হয়ে উঠতে হবে, এমনকি সেই অবস্থার বিরুদ্ধেও যখন তা সহিষ্ণুতার ভান ও কপট ছদ্মবেশ মাত্র।
অনুবাদ : অধ্যাপক আবু জাফর
খলিফা হজরত উমর বিন খাত্তাব (রা.) যখন মৃত্যুশয্যায়, তিনি তার পরবর্তী খলিফার উদ্দেশে নানা নির্দেশ ও উপদেশ সংবলিত একটি দীর্ঘ অসিয়তনামা (উইল) প্রণয়ন করে গেলেন। সেই ঐতিহাসিক দলিলের সর্বশেষ বাক্যটি হলো, ‘জনগণের পক্ষ থেকে আমি তোমাকে এই নির্দেশ দান করছি যে, আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের (সা.) নামে যাদের নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে তাদের ব্যাপারে কর্তব্যবিমুখ হয়ো না; অর্থাত্ (ইসলামী রাষ্ট্রে যারা অমুসলিম সংখ্যালঘু বা জিম্মি) তাদের সঙ্গে আমাদের যে চুক্তি তা কখনও লঙ্ঘন করো না, তাদের নিরাপত্তা রক্ষায় আমরা অবশ্যই সর্বাত্মকভাবে সচেষ্ট থাকব এবং তাদের ওপর এমন ভার চাপানো যাবে না, যা বহন করতে তারা অক্ষম।’
এই নির্দেশনামা যখন লেখা হচ্ছিল, সায়্যিদানা উমর (রা.) তখন যন্ত্রণাগ্রস্ত অবস্থায় শয্যাশায়ী। ফজরের সালাতে ইমামতি করার সময় এক অমুসলিম তাকে বিষমাখানো ছোরা দ্বারা আঘাত করে। এই মারাত্মক ছুরিকাঘাতে আহত অবস্থায় তিনি আলোচ্য অসিয়াতনামাটি লিপিবদ্ধ করান। মনে রাখা আবশ্যক, উমর ফারুক (রা.) তখন এমন এক বিশাল সাম্রাজ্যের শাসক, যে সাম্রাজ্য মিসর থেকে পারস্য পর্যন্ত বিস্তৃত। নিশ্চয়ই এই প্রশ্ন স্বাভাবিক যে, দুশমন কর্তৃক আক্রান্ত অবস্থায় তার সময়ের এবং আমাদের এই সময়েরও একজন সাধারণ শাসকের প্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে? অবশ্যই দ্রুত প্রতিশোধ গ্রহণ। (আজকালের ‘প্রাজ্ঞ ও জ্ঞানদীপ্ত’ শাসকরা তো হত্যা চক্রান্তে সত্যিই যুক্ত কি যুক্ত নয়, সে কথা সঠিকভাবে না জেনেই, শুধু সন্দেহবশতই বোমাবর্ষণ করে থাকে) একজন ক্ষমাশীল ও সদ্বিবেচক শাসকের কাছ থেকেও, খুব বেশি হলে আমরা শুধু এটুকু আশা করতে পারি যে, তিনি বিষয়টি ভুলে যাবেন ও ক্ষমা করবেন এবং সেটাই উচ্চতম আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হবে। কিন্তু সংখ্যালঘুদের সার্বিক নিরাপত্তা বিধান এবং তাদের ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের এই নির্দেশকে কি শুধুই অনন্য বলে অভিহিত করা যায়? না। কারণ অপর একটি বিষয় খুবই উল্লেখযোগ্য যে, মুসলিম ঐতিহাসিকদের অভিমত হলো, খলিফা উমরের এই নির্দেশনামা ছিল খুবই স্বাভাবিক। বিশেষ করে দেশের পর দেশ যখন মুসলিম শাসনাধীনে চলে আসছে এবং খলিফা নিজেই যখন তার শাসনামলে বিধির পর বিধি জারি করে সব নাগরিকের, জীবন সম্পদ ও ধর্মের সার্বিক নিরাপত্তা বিধানের একটি সুনিশ্চিত ও সুরক্ষিত আদর্শ স্থাপন করেছেন, তখন এই মৃত্যুকালীন অসিয়ত আদৌ অস্বাভাবিক কিছু নয়। বলা আবশ্যক, প্রতিষ্ঠিত এই আদর্শ মুসলিম বিশ্বে শতাব্দীর পর শতাব্দী একইভাবে অব্যাহত আছে।
অবশ্য সায়্যিদানা উমর (রা.) যা করেছেন, তা সবই রাসুলের (সা.) শিক্ষা ও জীবনাদর্শের বিশ্বস্ত প্রতিরূপ। আসলে সংখ্যালঘুদের জীবন, সম্পদ ও ধর্মপালনের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বিধান যে কোনো ইসলামী রাষ্ট্রের একটি ধর্মীয় কর্তব্য। কারণ সংখ্যালঘুদের ওপর যে কোনো ধরনের অবিচার-অত্যাচারের জন্য রাসুল (সা.) নিজে আখিরাতে অত্যাচারী মুসলমানের বিরুদ্ধে বিচার দাবি করবেন। আর ইসলামে যেহেতু ধর্মের ক্ষেত্রে কোনো জোরজবরদস্তি ও বাধ্যবাধকতার অবকাশ নেই, মুসলমানকে শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সবার প্রতি একই রকম ইনসাফ রক্ষা করা অবশ্যকর্তব্য।
এই শিক্ষার ফলেই মুসলিম শাসনাধীনে ধর্মীয় স্বাধীনতার এমন একটি মূল্যবান আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হলো, যে বিষয়ে কারও কোনো ধারণাই ছিল না। শুধু যে মুসলমানদের ইতিহাসই উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন বয়ে আনল তা নয়, ইসলামের সংস্পর্শে পুরো পৃথিবীর দৃষ্টিভঙ্গিই বদলে গেল। বিরুদ্ধ ধর্মমতের দমন, নিগ্রহ-নির্যাতন, হত্যাকাণ্ড (ঐড়ষড়পধঁংঃ) ইত্যাদি, যা অন্য সব সভ্যতার একটি কলঙ্কজনক সাধারণ বৈশিষ্ট্য, সেই বৈশিষ্ট্যে দেখা দিল এমন পরিবর্তন, যার ফলে নিপীড়ন-নির্যাতন থেকে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা অনেকখানি নিশ্চিত হলো এবং এরই ফলে ইহুদিরা খ্রিস্টানদের হাত থেকে এবং পূর্বাঞ্চলীয় খ্রিস্টানরা রোমান ক্যাথলিকদের নিপীড়ন থেকে অনেকটই রক্ষা পেল। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, উমাইয়াদের শাসনাধীন স্পেনে এবং আব্বাসীয় খেলাফতের অধীন বাগদাদে খ্রিস্টান ও ইহুদিরা সম্পূর্ণরূপে ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করত; আর এই যে পারস্পরিক ধর্মীয় সহাবস্থান, আগে তাদের মধ্যে কোনো সময়েই বিদ্যমান ছিল না।
উল্লেখযোগ্য যে, এই দৃষ্টান্তমূলক সহিষ্ণুতা ইসলামী শিক্ষার ফলেই গড়ে উঠেছে। ইসলামের মূল পয়গামই হলো, পার্থিব জীবন একটি পরীক্ষা। আমরা এখানে জাহান্নাম কি জান্নাতের যে পথ, তার যে কোনো একটিকেই গ্রহণ করতে পারি। নবী-রাসুলদের মানব সম্প্রদায়ের কাছে এই পয়গাম দিয়ে পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করার জন্যই প্রেরণ করা হয়েছে। তাঁদের এজন্য পাঠানো হয়নি যে, তাঁরা শক্তিপ্রয়োগে মানুষকে সঠিক পথে নিয়ে আসবেন। মুসলিমদের দায়িত্বও ঠিক একই রকম। তারা মানুষের কাছে ইসলামের যে প্রকৃত পয়গাম, সেটাই যথাসাধ্য পৌঁছে দেবে। তাদের কাজ ইসলামকে রদবদল করে মানুষের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলাও নয়, মানুষের নিজস্ব পছন্দকে দমন করে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করাও নয়। এই সঙ্গে এটা মনে রাখা আবশ্যক, আখিরাতের যে ফলাফল সেটা বিশ্বাসের (ঈমান) ওপর নির্ভরশীল। অতএব সব সত্ ও মহত্কর্মই পুরোপুরি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে, যদি সঠিক বিশ্বাস না থাকে। আর বিশ্বাস যেহেতু অন্তরের সম্পদ, এক্ষেত্রে কোনোরূপ শক্তিপ্রয়োগ চলে না।
এই ধারণা ভুল যে, অন্য যে কোনো ধর্মাবলম্বীরাও নিজ ধর্মকে অক্ষত রেখে ইসলামের অংশীদার হতে পারে। এরকম হলে, সহিষ্ণুতা অবলম্বনের ক্ষেত্রে মুসলমানদের যে আদর্শ, সেটা অবশিষ্ট পৃথিবীর বক্তব্যের সঙ্গে রীতিমত সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে। মার্মাডিউক পিকথল উল্লেখ করেন, ‘পশ্চিমা জাতিগুলো যে কিছুটা হলেও সহিষ্ণুতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে, সেটা তাদের ধর্মীয় বিধান পরিহার বা অস্বীকার করার সুফল, অথচ অন্যদিকে, মুসলমানদের ক্ষেত্রে ধর্মীয় আদর্শ শিথিল ও খর্ব হওয়ার কারণেই অসহিষ্ণুতার সৃষ্টি।’
পশ্চিমা বিশ্ব সামাজিক সাম্য ও মিলনের যে পথ তৈরি করেছে সেটা জনজীবন থেকে ধর্মের প্রভাবকে যথাসম্ভব নিশ্চিহ্ন করার ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং এই অর্জন, তাদের ধারণা, আলোচ্য বিষয়ে যথাযথ প্রচার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ফলেই সম্ভব হয়েছে। সুতরাং এটা স্মরণ রাখা উত্তম যে গত শতাব্দীতে সহিষ্ণুতার ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের যে বিশাল অগ্রগতি (যা অভিনন্দন লাভের যোগ্য), তাকে ইসলাম কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত নীতি-আদর্শের কাছে পৌঁছতে অনেক পথ ও সময় অতিক্রম করতে হয়েছে। প্রথমত, মুসলমানদের যে ব্যক্তিগত-পারিবারিক বিধান, সেটা পাশ্চাত্যে অস্বীকৃত; অথচ অমুসলিম সংখ্যালঘুদের ব্যক্তিগত বিধান ও অধিকার মুসলিম বিশ্বের কোথাও কোনোদিন এতটুকু ক্ষুণ্ন হয়নি। দ্বিতীয়ত, ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বত্রই মাইক্রোফোনে আজান প্রচারের কোনো অনুমতি নেই; অথচ মুসলিম বিশ্বে গির্জায় ঘণ্টাধ্বনি নির্বিঘ্নে ও যথানিয়মে প্রচারিত হচ্ছে। তৃতীয়ত, পাশ্চাত্য প্রচার মাধ্যমের যে বিশ্ববিস্তৃত ইসলামবৈরী পক্ষপাতদুষ্ট ও কুসংস্কারাশ্রিত ভূমিকা, সেই ভূমিকাও মৌলিক-অসহিষ্ণুতার বিশেষ কারণও পরিণতি। চতুর্থত, সাম্প্রদায়িক হিংসাশ্রিত অপরাধকর্ম পশ্চিমা জীবনধারার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, অবশ্য এই বিষয়টি সততই বেশ কৌশলে আড়ালে রাখা হয়। পঞ্চমত, ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ব্যাপারটি কখনোই খুব একটা গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয় না, যথেষ্ট প্রাধান্যও দেয়া হয় না। এ বিষয়ে একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যায় : ১৯৯৯ সালে মুসলমানদের অনুকূলে দুটি প্রস্তাব মার্কিন সিনেটে উত্থাপিত হলো। প্রস্তাবটির শীর্ষ নাম ছিল, ‘মুসলমানদের প্রতি ধর্মীয় সহিষ্ণুতা রক্ষাকল্পে সমর্থন’ (অ জবংড়ষঁঃরড়হ ঝঁঢ়ঢ়ড়ত্ঃরহম ত্বষরমরড়ঁং ঃড়ষবত্ধহবপ ঃড়ধিত্ফ গঁংষরসং)। কিন্তু সিনেটে যদিও প্রস্তাবটি পাস হলো, কিছু কিছু ইহুদি ও খ্রিস্টানের একগুঁয়ে চাপের কারণে উচ্চকক্ষে তা আর গৃহীত হলো না। ঘটনাটি ছিল ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর দুর্ঘটনার দুই বছর আগের। তারপর তো সবই আমূল বদলে গেল। আসলে সেপ্টেম্বরের ‘দৈব দুর্ঘটনাটি’ অভিনব বটে, তবে এর মধ্য দিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব তার বহু দিনের লালিত অসহিষ্ণুতা ও প্রতিহিংসা ক্রমবর্ধমান হারে অব্যাহত রাখার একটা ‘যৌক্তিক’ ভিত্তি দাঁড় করাতে সক্ষম হলো।
শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয়, অবশিষ্ট ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের’ কাছেও পরিস্থিতি প্রায় একই রূপ পরিগ্রহ করল। জার্মানি এবং ফ্রান্সের কথা উল্লেখ করতে পারি; সেখানে এখন সরকারি শক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় মুসলিম মহিলাদের মস্তক থেকে হিজাব ছিনিয়ে নেয়া হচ্ছে। এরপরও এই গোঁড়া-ধর্মান্ধরাই নারী অধিকার এবং সহিষ্ণুতার প্রবক্তা এবং তারা এখন সরব দাবি তুলেছে, ‘অসহিষ্ণুতা’ নিরসনকল্পে মুসলিম বিশ্বের শিক্ষাক্রমে যথোচিত পরিবর্তন আনতে হবে। যাই হোক, মুসলমানদের মধ্যে বিরাজমান যে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, সেটা কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নাটকীয়তা নয়; এটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি অপরিহার্য ধর্মীয় কর্তব্য। সব অসহিষ্ণুতার মোকাবিলায় তাদের প্রবল হয়ে উঠতে হবে, এমনকি সেই অবস্থার বিরুদ্ধেও যখন তা সহিষ্ণুতার ভান ও কপট ছদ্মবেশ মাত্র।
অনুবাদ : অধ্যাপক আবু জাফর
তাবলিগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা : মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস রহ. জীবনদর্শন
মাওলানা মোঃ আবুল হোসাইন পাটওয়ারী
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে ভারতবর্ষের দিল্লি এলাকার সর্ব বিখ্যাত অলি নিজাম উদ্দিন রহ. মাজার এলাকায় বাস করতেন যুগশ্রেষ্ঠ আবেদ হজরত মাওলানা ইসমাইল রহ.। তিনি ছিলেন আবেদ ও মানবসেবক। তিনি যত বেশি মানবসেবা করতে পারতেন তত বেশি আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়া আদায় করতেন। তার পর্ণকুটিরে জন্মলাভ করেন বর্তমান বিশ্বখ্যাত বিশ্ব ইজতেমার অগ্রদূত হজরত মাওলানা ইলিয়াস শাহ আখতার রহ.। তিনি ১৩০৩ হিজরি সালে জন্মগ্রহণ করেন।
তার পূর্ব পুরুষরা ছিলেন ধর্মীয় ও সামাজিক নেতৃত্বের অগ্রদূত। তার জীবন অতিবাহিত হয় অনুকূল সামাজিক পরিবেশে। যার ফলে তিনি তার পূর্ব পুরুষদের চেয়ে অনেক বেশি খ্যাতি অর্জন করেন।
হজরত মাওলানা ইলিয়াস শাহ রহ. বাল্যশিক্ষা গ্রহণ করেন পিতা হজরত মাওলানা ইসমাইল রহ.-এর কাছ থেকে। ১৩১৪ হিজরিতে তিনি বড় ভাইয়ের সঙ্গে লেখাপড়ার জন্য নিজ গ্রাম ছেড়ে চলে যান। এ সময় তিনি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৩২৬ হিজরি সালে তিনি দাওরা হাদিস বিভাগ থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভ করেন। হাদিস শাস্ত্রে তিনি গভীর জ্ঞান অর্জন করেন।
১৩২৮ হিজরি সাল থেকে ভারতবর্ষের সাহারানপুর মাজাহিরুল উলুম মাদ্রাসায় শিক্ষকতার পদে যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। এখানে প্রায় ৮ বছর ধরে ইলমে দ্বীনের তালিম দেন। এরপর তার পিতা ও বড় ভাইয়ের ইন্তেকালের পরে এলাকাবাসীর অনুরোধে তিনি নিজ গ্রাম মেওয়াতে ইলমে দ্বীনের খেদমতে আত্মনিয়োগ করেন। তত্কালে মেওয়াত এলাকার অধিবাসীরা শিক্ষা-দীক্ষা, ঈমান-আমলে ছিল খুবই নগণ্য। তারা নাম মাত্র মুসলমান ছিলেন।
তাবলিগ জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা হজরত মাওলানা ইলিয়াস শাহ আখতার রহ. তার পিতা হজরত মাওলানা ইসমাইল রহ. প্রতিষ্ঠিত মক্তব পরিচালনার মাধ্যমে এলাকাবাসীর মধ্যে হেদায়াতমূলক কার্য পরিচালনা শুরু করেন। আর এরই সূত্র ধরে শুরু হয় মানুষকে ঈমান ও আমলের প্রতি আহ্বান। আর সেই আহ্বানকে আজকের বিশ্বের দরবারে তাবলিগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমা হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে, যা ১৯৪৪ সাল থেকে অদ্যাবধি আমাদের বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
হজরত মাওলানা ইলিয়াস শাহ আখতার রহ.-এর মানব কল্যাণ সাধনে তার নিজ এলাকা মেওয়াত অঞ্চলে ঈমান ও আমলের যে বিপ্লব সৃষ্টি করেছিলেন তার বাস্তব নমুনা আমাদের বাংলাদেশে ঢাকা শহরের উত্তরাঞ্চলে তুরাগ নদীর তীরে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ইজতেমার অনুষ্ঠানটি। মাওলানা ইলিয়াস শাহ রহ. তার দাওয়াতের মাধ্যমে মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন পরকালের চিন্তা-চেতনা আর আল্লাহ তায়ালার উপর দৃঢ়বিশ্বাস। আমরা দুনিয়াতে এসেছি আবার চলে যাব। কি নিয়ে যাব সেই সম্পদ তৈরির লক্ষ্যেই আজকের তাবলিগ জামাতের বিশ্বজোড়া আন্দোলন ও ইজতেমার অনুষ্ঠান। এখানে বিশেষ করে ঈমান, আমল ও দুনিয়ার কল্যাণ, আখিরাতের মুক্তির কথাগুলোই বয়ান করা হয়।
ইলিয়াস শাহ রহ.-এর মূল কথা ছিল হে মুসলমানেরা! তোমরা মুসলমান হও। মানব কল্যাণই ছিল তার জীবনের একমাত্র ব্রত। তাবলিগ জামাতের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সর্বোচ্চ ত্যাগ সাধনার মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত সফলতা অর্জন। অকৃত্রিম ভালোবাসা, অক্লান্ত সাধনা, সর্বোপরি ইখলাছ ও লিল্লাহিয়াতের পরাকাষ্ঠার কারণেই তাবলিগ জামাত আজ মানুষের হৃদয়রাজ্য জয় করতে পেরেছে। সর্বোচ্চ ত্যাগ ও সাধনার মাধ্যমে জীবনের কাঙ্ক্ষিত সফলতার পথে এগিয়ে চলাই তাবলিগ জামাতের মূল টার্গেট। তাই তো বাংলাদেশের বিশ্ব ইজতেমা তিন দিনের পরিবর্তে একই সময়ে দুই বারে ৬ দিনে উন্নীত করা হয়েছে।
তাই আমি বলছি যে, তাবলিগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মহান ব্যক্তি মাওলানা ইলিয়াস শাহ রহ. আজও আমাদের মাঝে চির বিদ্যমান হয়ে আছেন এবং ভবিষ্যতেও থাকবেন ইনশাআল্লাহ।
লেখক : শিক্ষক, খতিব।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে ভারতবর্ষের দিল্লি এলাকার সর্ব বিখ্যাত অলি নিজাম উদ্দিন রহ. মাজার এলাকায় বাস করতেন যুগশ্রেষ্ঠ আবেদ হজরত মাওলানা ইসমাইল রহ.। তিনি ছিলেন আবেদ ও মানবসেবক। তিনি যত বেশি মানবসেবা করতে পারতেন তত বেশি আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়া আদায় করতেন। তার পর্ণকুটিরে জন্মলাভ করেন বর্তমান বিশ্বখ্যাত বিশ্ব ইজতেমার অগ্রদূত হজরত মাওলানা ইলিয়াস শাহ আখতার রহ.। তিনি ১৩০৩ হিজরি সালে জন্মগ্রহণ করেন।
তার পূর্ব পুরুষরা ছিলেন ধর্মীয় ও সামাজিক নেতৃত্বের অগ্রদূত। তার জীবন অতিবাহিত হয় অনুকূল সামাজিক পরিবেশে। যার ফলে তিনি তার পূর্ব পুরুষদের চেয়ে অনেক বেশি খ্যাতি অর্জন করেন।
হজরত মাওলানা ইলিয়াস শাহ রহ. বাল্যশিক্ষা গ্রহণ করেন পিতা হজরত মাওলানা ইসমাইল রহ.-এর কাছ থেকে। ১৩১৪ হিজরিতে তিনি বড় ভাইয়ের সঙ্গে লেখাপড়ার জন্য নিজ গ্রাম ছেড়ে চলে যান। এ সময় তিনি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৩২৬ হিজরি সালে তিনি দাওরা হাদিস বিভাগ থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভ করেন। হাদিস শাস্ত্রে তিনি গভীর জ্ঞান অর্জন করেন।
১৩২৮ হিজরি সাল থেকে ভারতবর্ষের সাহারানপুর মাজাহিরুল উলুম মাদ্রাসায় শিক্ষকতার পদে যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। এখানে প্রায় ৮ বছর ধরে ইলমে দ্বীনের তালিম দেন। এরপর তার পিতা ও বড় ভাইয়ের ইন্তেকালের পরে এলাকাবাসীর অনুরোধে তিনি নিজ গ্রাম মেওয়াতে ইলমে দ্বীনের খেদমতে আত্মনিয়োগ করেন। তত্কালে মেওয়াত এলাকার অধিবাসীরা শিক্ষা-দীক্ষা, ঈমান-আমলে ছিল খুবই নগণ্য। তারা নাম মাত্র মুসলমান ছিলেন।
তাবলিগ জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা হজরত মাওলানা ইলিয়াস শাহ আখতার রহ. তার পিতা হজরত মাওলানা ইসমাইল রহ. প্রতিষ্ঠিত মক্তব পরিচালনার মাধ্যমে এলাকাবাসীর মধ্যে হেদায়াতমূলক কার্য পরিচালনা শুরু করেন। আর এরই সূত্র ধরে শুরু হয় মানুষকে ঈমান ও আমলের প্রতি আহ্বান। আর সেই আহ্বানকে আজকের বিশ্বের দরবারে তাবলিগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমা হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে, যা ১৯৪৪ সাল থেকে অদ্যাবধি আমাদের বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
হজরত মাওলানা ইলিয়াস শাহ আখতার রহ.-এর মানব কল্যাণ সাধনে তার নিজ এলাকা মেওয়াত অঞ্চলে ঈমান ও আমলের যে বিপ্লব সৃষ্টি করেছিলেন তার বাস্তব নমুনা আমাদের বাংলাদেশে ঢাকা শহরের উত্তরাঞ্চলে তুরাগ নদীর তীরে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ইজতেমার অনুষ্ঠানটি। মাওলানা ইলিয়াস শাহ রহ. তার দাওয়াতের মাধ্যমে মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন পরকালের চিন্তা-চেতনা আর আল্লাহ তায়ালার উপর দৃঢ়বিশ্বাস। আমরা দুনিয়াতে এসেছি আবার চলে যাব। কি নিয়ে যাব সেই সম্পদ তৈরির লক্ষ্যেই আজকের তাবলিগ জামাতের বিশ্বজোড়া আন্দোলন ও ইজতেমার অনুষ্ঠান। এখানে বিশেষ করে ঈমান, আমল ও দুনিয়ার কল্যাণ, আখিরাতের মুক্তির কথাগুলোই বয়ান করা হয়।
ইলিয়াস শাহ রহ.-এর মূল কথা ছিল হে মুসলমানেরা! তোমরা মুসলমান হও। মানব কল্যাণই ছিল তার জীবনের একমাত্র ব্রত। তাবলিগ জামাতের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সর্বোচ্চ ত্যাগ সাধনার মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত সফলতা অর্জন। অকৃত্রিম ভালোবাসা, অক্লান্ত সাধনা, সর্বোপরি ইখলাছ ও লিল্লাহিয়াতের পরাকাষ্ঠার কারণেই তাবলিগ জামাত আজ মানুষের হৃদয়রাজ্য জয় করতে পেরেছে। সর্বোচ্চ ত্যাগ ও সাধনার মাধ্যমে জীবনের কাঙ্ক্ষিত সফলতার পথে এগিয়ে চলাই তাবলিগ জামাতের মূল টার্গেট। তাই তো বাংলাদেশের বিশ্ব ইজতেমা তিন দিনের পরিবর্তে একই সময়ে দুই বারে ৬ দিনে উন্নীত করা হয়েছে।
তাই আমি বলছি যে, তাবলিগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মহান ব্যক্তি মাওলানা ইলিয়াস শাহ রহ. আজও আমাদের মাঝে চির বিদ্যমান হয়ে আছেন এবং ভবিষ্যতেও থাকবেন ইনশাআল্লাহ।
লেখক : শিক্ষক, খতিব।
বিশ্বাসের আলো ও সেক্যুলারিজম
এমএ করিম ইবনে মছব্বির
সেক্যুলারিজমের (ঝবপঁষধত্রংস) শাব্দিক অর্থ ধর্মনিরপেক্ষতা। আর আভিধানিক অর্থ শিক্ষা, রাজনীতি, নৈতিক মূল্যবোধ প্রভৃতিকে ধর্মের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখার মতবাদ। আমাদের দেশের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা সেক্যুলারিজমের সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে—কোনো ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব না করা, কোনো ধর্মের প্রতি বিদ্বেষভাব পোষণ না করা এবং যার যার ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনে অবাধ অধিকার। অভিধানের সংজ্ঞার সঙ্গে এই ব্যাখ্যার মিল কোথায়?
বস্তুত সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করতেই ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’ শব্দের এভাবে অপব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে যেন তারা কোনোভাবেই অনুভব করতে না পারেন যে, ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদের আবরণে তাদের ধর্মহীন মতবাদে দীক্ষিত করে তোলা হচ্ছে। নৈতিক মূল্যবোধে ন্যায়, অন্যায়, বৈধ, অবৈধ, পাক, নাপাক প্রভৃতি শিক্ষার উত্স হচ্ছে ধর্মীয় বিধিবিধান তথা শরিয়ত। অপরদিকে ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদ হচ্ছে নৈতিক মূল্যবোধবর্জিত একটি মতবাদ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, পাশ্চাত্যে লিভ টুগেদার বৈধ অধিকার বলে স্বীকৃতি পেয়েছে, আবার অরুচি ধরে গেলে যার যেদিকে ইচ্ছা চলে যাওয়ার অধিকারও সংরক্ষিত হয়েছে। এর চেয়ে আরও আশ্চর্যের বিষয়, সমকামিতার মতো ঘৃণ্য কাজকেও সেসব দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে বৈধতার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
এসবই হয়েছে ধর্মীয় প্রভাববিবর্জিত নীতিহীনতা তথা ধর্ম নিরপেক্ষতা থেকে। এর ফলে মানুষ আজ মনুষ্যত্ব তথা নৈতিক মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়েছে। মানুষ অনেক নিচে নেমে গেছে। একদিক থেকে আজকের মানুষের চেয়ে পশুরা অনেক পরিচ্ছন্ন, অনেক ভদ্র ও পবিত্র। কারণ প্রকৃতির অনুশাসন দ্বারা পশু শাসিত ও চালিত হয়। তারা প্রকৃতির বিধান কখনও লঙ্ঘন করে না। আসলে বিশ্বাসের বিধানমুক্ত হয়ে লোভ-লালসার পেছনে ছুটে গিয়ে মানুষ অনেক নিচে নেমে যেতে পারে। যে জাহিলিয়াত থেকে একদিন আল্লাহ মানুষকে মুক্ত করেছিলেন আজ মানুষ সেদিকেই ঝাঁপিয়ে পড়ছে।
আরবে ইসলামের পূর্ববর্তী সময়কে জাহিলিয়াত বলা হয়। মানুষ যখন তার চিন্তা-চেতনা, নীতি-আদর্শ, মানদণ্ড, মূল্যবোধ, বিধি-বিধান, প্রথা, রীতি-নীতি আরেক মানুষের কাছ থেকে গ্রহণ করে থাকে, তখন সেটাই হচ্ছে যাবতীয় উপাদানসহ পূর্ণ জাহিলিয়াত। পক্ষান্তরে আল্লাহপাক মানবজাতিকে হেদায়েতের জন্য যুগে যুগে প্রেরিত রাসুলদের প্রতি শরীয়তের যে বিধি-বিধান নাজিল করেছেন, তার অনুসরণ করাই হচ্ছে জাহিলিয়াত থেকে মুক্তির উপায়। ইসলামের অনুসারীদের তাই বিশ্বাসের আলোয় জীবনের পথে চলা ছাড়া উপায় নেই। আমরা অনেকেই নিজেকে মুসলমান বলে দাবি করি এবং সেইসঙ্গে নিজেকে ধর্ম নিরপেক্ষ মতবাদের অনুসারী বলেও গর্ব করি।
পক্ষান্তরে আল্লাহপাক বলেন, হে ইমানদাররা, তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবিষ্ট হও। (। আল্লাহ পাক আরও বলেন, হে ইমানদাররা, তোমরা আল্লাহকে যথাযথভাবে ভয় কর এবং তোমরা মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না। (আল-কোরআন)
উপরের উদ্ধৃত আয়াতগুলোর মর্ম হচ্ছে, ইসলাম গ্রহণ করলে সম্পূর্ণভাবেই করতে হবে। কাটছাঁট করার, অর্থাত্ সুবিধাজনক অংশটি গ্রহণ আর অপছন্দনীয় অংশটুকু বর্জন করার সুযোগ নেই। যারা আংশিকভাবে ইসলামকে মেনে চলতে চান, পার্থিব জীবনে তাদের জন্য লাঞ্ছনা আর কিয়ামত দিবসে কঠোর শাস্তি ছাড়া আর কী পরিণতি হতে পারে! প্রকৃতপক্ষে ইসলাম মানবজাতিকে পার্থিব জীবনের প্রতিটি বাঁকে চলার পদ্ধতি বলে দিয়েছে। এমন কোনো অঙ্গন নেই যেখানে ইসলামী বিধিবিধান ও আদেশ-নিষেধ প্রযোজ্য নয়। মানবজীবনে এর যে কোনো একটি অঙ্গনে ইসলামী বিধিবিধান অস্বীকার করলে তার ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে আল্লাহপাক বলেন, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, যেসব লোক তদানুযায়ী ফয়সালা করে না, তারা কাফির (আল কোরআন)।’ অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ পাক যা অবতীর্ণ করেছেন, তদানুযায়ী যারা ফয়সালা করে না, তারা ফাসিক-পাপাচারী (আল-কোরআন ২:৮৫)।’
বিশ্বাস ও আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিহীন চেতনার ধারক-বাহক ও আহ্বায়কদের পরিণাম সম্পর্কে মহানবী (সা.)-এর একটি বিখ্যাত হাদিস নিচে দেয়া হলো। প্রিয় নবী (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি জাহিলিয়াতের দিকে আহ্বান জানাবে, সে হবে জাহান্নামি। জনৈক সাহাবি (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.), নামাজ-রোজা আদায় করা সত্ত্বেও কি সে জাহান্নামি হবে? মহানবী (সা.) বললেন, হ্যাঁ নামাজ-রোজা আদায় করলেও এবং নিজেকে মুসলমান বলে দাবি করলেও তাকে জাহান্নামেই যেতে হবে (মুসনাদে আহমাদ, হাকিম)।
সাহাবায়ে কেরামরা (রা.) ছিলেন খাঁটি ইমানদার। তাদের সাধারণ ইবাদতও ছিল অত্যন্ত উচ্চমানের ও নিখুঁত। হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী জাহিলিয়াতের দিকে আহ্বান জানানোর মতো একটি অপরাধের কারণে তাদের জাহান্নামে যেতে হবে।
এ অবস্থায় ধর্ম নিরপেক্ষতার মতো মারাত্মক পথে থাকলে তার অবিলম্বে আল্লাহর কাছে তওবা করে সঠিক পথে ফিরে আসা অপরিহার্য।
সেক্যুলারিজমের (ঝবপঁষধত্রংস) শাব্দিক অর্থ ধর্মনিরপেক্ষতা। আর আভিধানিক অর্থ শিক্ষা, রাজনীতি, নৈতিক মূল্যবোধ প্রভৃতিকে ধর্মের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখার মতবাদ। আমাদের দেশের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা সেক্যুলারিজমের সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে—কোনো ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব না করা, কোনো ধর্মের প্রতি বিদ্বেষভাব পোষণ না করা এবং যার যার ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনে অবাধ অধিকার। অভিধানের সংজ্ঞার সঙ্গে এই ব্যাখ্যার মিল কোথায়?
বস্তুত সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করতেই ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’ শব্দের এভাবে অপব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে যেন তারা কোনোভাবেই অনুভব করতে না পারেন যে, ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদের আবরণে তাদের ধর্মহীন মতবাদে দীক্ষিত করে তোলা হচ্ছে। নৈতিক মূল্যবোধে ন্যায়, অন্যায়, বৈধ, অবৈধ, পাক, নাপাক প্রভৃতি শিক্ষার উত্স হচ্ছে ধর্মীয় বিধিবিধান তথা শরিয়ত। অপরদিকে ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদ হচ্ছে নৈতিক মূল্যবোধবর্জিত একটি মতবাদ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, পাশ্চাত্যে লিভ টুগেদার বৈধ অধিকার বলে স্বীকৃতি পেয়েছে, আবার অরুচি ধরে গেলে যার যেদিকে ইচ্ছা চলে যাওয়ার অধিকারও সংরক্ষিত হয়েছে। এর চেয়ে আরও আশ্চর্যের বিষয়, সমকামিতার মতো ঘৃণ্য কাজকেও সেসব দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে বৈধতার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
এসবই হয়েছে ধর্মীয় প্রভাববিবর্জিত নীতিহীনতা তথা ধর্ম নিরপেক্ষতা থেকে। এর ফলে মানুষ আজ মনুষ্যত্ব তথা নৈতিক মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়েছে। মানুষ অনেক নিচে নেমে গেছে। একদিক থেকে আজকের মানুষের চেয়ে পশুরা অনেক পরিচ্ছন্ন, অনেক ভদ্র ও পবিত্র। কারণ প্রকৃতির অনুশাসন দ্বারা পশু শাসিত ও চালিত হয়। তারা প্রকৃতির বিধান কখনও লঙ্ঘন করে না। আসলে বিশ্বাসের বিধানমুক্ত হয়ে লোভ-লালসার পেছনে ছুটে গিয়ে মানুষ অনেক নিচে নেমে যেতে পারে। যে জাহিলিয়াত থেকে একদিন আল্লাহ মানুষকে মুক্ত করেছিলেন আজ মানুষ সেদিকেই ঝাঁপিয়ে পড়ছে।
আরবে ইসলামের পূর্ববর্তী সময়কে জাহিলিয়াত বলা হয়। মানুষ যখন তার চিন্তা-চেতনা, নীতি-আদর্শ, মানদণ্ড, মূল্যবোধ, বিধি-বিধান, প্রথা, রীতি-নীতি আরেক মানুষের কাছ থেকে গ্রহণ করে থাকে, তখন সেটাই হচ্ছে যাবতীয় উপাদানসহ পূর্ণ জাহিলিয়াত। পক্ষান্তরে আল্লাহপাক মানবজাতিকে হেদায়েতের জন্য যুগে যুগে প্রেরিত রাসুলদের প্রতি শরীয়তের যে বিধি-বিধান নাজিল করেছেন, তার অনুসরণ করাই হচ্ছে জাহিলিয়াত থেকে মুক্তির উপায়। ইসলামের অনুসারীদের তাই বিশ্বাসের আলোয় জীবনের পথে চলা ছাড়া উপায় নেই। আমরা অনেকেই নিজেকে মুসলমান বলে দাবি করি এবং সেইসঙ্গে নিজেকে ধর্ম নিরপেক্ষ মতবাদের অনুসারী বলেও গর্ব করি।
পক্ষান্তরে আল্লাহপাক বলেন, হে ইমানদাররা, তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবিষ্ট হও। (। আল্লাহ পাক আরও বলেন, হে ইমানদাররা, তোমরা আল্লাহকে যথাযথভাবে ভয় কর এবং তোমরা মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না। (আল-কোরআন)
উপরের উদ্ধৃত আয়াতগুলোর মর্ম হচ্ছে, ইসলাম গ্রহণ করলে সম্পূর্ণভাবেই করতে হবে। কাটছাঁট করার, অর্থাত্ সুবিধাজনক অংশটি গ্রহণ আর অপছন্দনীয় অংশটুকু বর্জন করার সুযোগ নেই। যারা আংশিকভাবে ইসলামকে মেনে চলতে চান, পার্থিব জীবনে তাদের জন্য লাঞ্ছনা আর কিয়ামত দিবসে কঠোর শাস্তি ছাড়া আর কী পরিণতি হতে পারে! প্রকৃতপক্ষে ইসলাম মানবজাতিকে পার্থিব জীবনের প্রতিটি বাঁকে চলার পদ্ধতি বলে দিয়েছে। এমন কোনো অঙ্গন নেই যেখানে ইসলামী বিধিবিধান ও আদেশ-নিষেধ প্রযোজ্য নয়। মানবজীবনে এর যে কোনো একটি অঙ্গনে ইসলামী বিধিবিধান অস্বীকার করলে তার ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে আল্লাহপাক বলেন, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, যেসব লোক তদানুযায়ী ফয়সালা করে না, তারা কাফির (আল কোরআন)।’ অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ পাক যা অবতীর্ণ করেছেন, তদানুযায়ী যারা ফয়সালা করে না, তারা ফাসিক-পাপাচারী (আল-কোরআন ২:৮৫)।’
বিশ্বাস ও আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিহীন চেতনার ধারক-বাহক ও আহ্বায়কদের পরিণাম সম্পর্কে মহানবী (সা.)-এর একটি বিখ্যাত হাদিস নিচে দেয়া হলো। প্রিয় নবী (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি জাহিলিয়াতের দিকে আহ্বান জানাবে, সে হবে জাহান্নামি। জনৈক সাহাবি (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.), নামাজ-রোজা আদায় করা সত্ত্বেও কি সে জাহান্নামি হবে? মহানবী (সা.) বললেন, হ্যাঁ নামাজ-রোজা আদায় করলেও এবং নিজেকে মুসলমান বলে দাবি করলেও তাকে জাহান্নামেই যেতে হবে (মুসনাদে আহমাদ, হাকিম)।
সাহাবায়ে কেরামরা (রা.) ছিলেন খাঁটি ইমানদার। তাদের সাধারণ ইবাদতও ছিল অত্যন্ত উচ্চমানের ও নিখুঁত। হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী জাহিলিয়াতের দিকে আহ্বান জানানোর মতো একটি অপরাধের কারণে তাদের জাহান্নামে যেতে হবে।
এ অবস্থায় ধর্ম নিরপেক্ষতার মতো মারাত্মক পথে থাকলে তার অবিলম্বে আল্লাহর কাছে তওবা করে সঠিক পথে ফিরে আসা অপরিহার্য।
অসহায় বিপন্ন মানুষের প্রতি তাকান
মা ও লা না শা হ আ ব দু স সা ত্তা র
ধনী-গরিব আল্লাহপাকের সৃষ্টি। বাহ্যিক দৃষ্টিতে আমরা প্রভূত অর্থ-সম্পদ অধিকারীকে ধনী বললেও আদতে সে ধনী নয়। আর স্বীয় অভাব মোচনের সামান্য পরিমাণ যার অর্থ, টাকা-পয়সা উপার্জনের ক্ষমতা নেই—এমন লোককে আমরা সাধারণত গরিব বলে থাকি। পবিত্র কোরআনে এ সম্পর্কে আল্লাহপাক বলেছেন। ওয়াল্লাহুল গানিয়্যুঅ আনতুমুল ফুকারাও। অর্থাত্ মহান আল্লাহপাকই একমাত্র ধনী আর তোমরা সবাই দরিদ্র বা গরিব। তাসাউফ শাস্ত্রের এ গরিবের ব্যাখ্যায় পবিত্র কোরআনের বিধিবিধানসম্মত হলেও ইসলাম গরিব-দুঃখী, অসহায়দের স্বার্থ সংরক্ষণ অধিকার বা হকগুলো ফরজ রূপে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। জাকাত, ফেতরা, সদকা ছাড়াও স্বাভাবিক নিয়মে দেশপ্রথা ও প্রচলিত রীতিনীতি অনুযায়ী গরিব, দুঃখী, অসহায়রা ধনাঢ্য, সামর্থ্যবানদের থেকে সাহায্য-সহযোগিতা পেতে পারে।
ইসলাম মানবসমাজকে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছে। একশ্রেণীর লোক ধন-সম্পদ ও অর্থের পাহাড় গড়বে। আর অন্য শ্রেণীর লোক দরিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত হবে—এ নিয়ম-নীতি ইসলাম কখনোই পছন্দ করে না। ইসলাম ধর্ম ধন-সম্পদ ও অর্থকড়ির ব্যাপারে উদারতা ও ইনসাফের মাধ্যমে গরিবের অধিকার ব্যাপকভাবে সংরক্ষিত করেছে। অন্যদিকে গরিব, দুঃখী মানুষের স্বাভাবিক জীবনধারণের জন্য ধনীদের প্রতি তাদের হককে নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। ইসলামী অর্থনীতিতে জাকাত, সদকা, ফেতরা ও দান-খয়রাত শুধু গরিব, অসহায় ও বিপন্ন মানুষের বেলায় প্রাপ্য এবং তা তাদের মৌলিক প্রাপ্য। গরিবদের মৌলিক অধিকার যেমন ইসলাম স্বীকার করেছে, পাশাপাশি তাদের মর্যাদাও দিয়েছে গুরুত্বসহকারে। এ সম্পর্কে হজরত রাসুলে পাক (সা.) হজরত বেলাল (রা.)-কে বলেছিলেন, ‘বেলাল, তুমি চেষ্টা করো যে, ইহলোক থেকে গরিব অবস্থায় যেতে পারো, ধনী-বিত্তবান ও অর্থশালী অবস্থায় যেতে চেষ্টা করো না।’ আল্লাহর নবী (সা.) আরও বলেছেন, ‘আমির অর্থাত্ ধনাঢ্য, বিত্তশালী লোকের ৪০ বছর আগে গরিব-দুঃখীরা বেহেশতে প্রবেশ করবে।’
‘রোজ কিয়ামতে আল্লাহ সুবহানাহুতায়ালা ফেরেশতাদের জিজ্ঞেস করবেন। দেখ তো আমার প্রিয় বান্দারা কোথায়। ফেরেশতারা আরজ করবেন, ইয়া আল্লাহ। কারা আপনার প্রিয় বান্দা। মহান আল্লাহপাকের পক্ষ থেকে উত্তর আসবে, তারা মুসলমান দরিদ্র লোক। যারা আমার দানে অর্থাত্ আমি যা দিতাম তাতে তারা পরিতৃপ্ত এবং সন্তুষ্ট ছিল, এসব লোককে বেহেশতে নিয়ে যাও।’
আমরা প্রতি মুহূর্তে মহান আল্লাহপাকের অগণিত নেয়ামত ভোগ করে আসছি। এর শুকরিয়া আদায় করে শেষ করা যায় না। দুনিয়ার জীবনে গরিব, অসহায়-দুস্থ মানুষের অধিকার ও সম্মান আল্লাহপাক প্রদান করেছেন, তেমন ধনাঢ্য-বিত্তবানদের তাদের প্রতি যথাযথ কর্তব্য পালনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তাই স্বাভাবিক নিয়ম ছাড়া বিশেষ করে জাকাত, সদকা, ফেতরা প্রদানের মাধ্যমে আমরা দুঃখভরা দরিদ্র, অসহায়, মিসকিন, দুস্থদের সাহায্য-সহযোগিতা করতে পারি। এ সম্পর্কে আমাদের প্রিয়নবী করীম (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা গরিব, অসহায়দের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন কর এবং তাদের প্রতি সাধ্য অনুযায়ী সাহায্যের হাত বাড়াও। পরোকালে তারাই তোমার ধন-সম্বল হবে। জেনে রাখ, দান-খয়রাতে অর্থ-সম্পদ বৃদ্ধি পায়।’ একবার সাহাবিরা হজরত রাসুলে পাক (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর নবী, যার সামর্থ্য নেই, সেই ব্যক্তি কীভাবে তার কর্তব্য পালন করবে। এর উত্তরে আল্লাহর নবী (সা.) বললেন, নিজের শক্তি দিয়ে, পরিশ্রম করে।’ সাহাবিরা আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘যদি সেরূপ কোনো সুযোগ না পায়, তাহলে কী করবে?’ আল্লাহর নবী (সা.) বললেন, ‘যেসব গরিব-দুঃখী, কষ্টে-বিপদে জর্জরিত, তাদের দান-খয়রাতের মাধ্যমে সেবা করবে।’
অতএব আসুন, যথাসাধ্য আমরা প্রতিনিয়ত গরিব, দুঃখী, অসহায়, বিপন্ন, ফকির, মিসকিন, এতিমদের সেবা ও সাহায্য-সহযোগিতায় হাত বাড়াই।ষ
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ, সিরাত মিশন।
ধনী-গরিব আল্লাহপাকের সৃষ্টি। বাহ্যিক দৃষ্টিতে আমরা প্রভূত অর্থ-সম্পদ অধিকারীকে ধনী বললেও আদতে সে ধনী নয়। আর স্বীয় অভাব মোচনের সামান্য পরিমাণ যার অর্থ, টাকা-পয়সা উপার্জনের ক্ষমতা নেই—এমন লোককে আমরা সাধারণত গরিব বলে থাকি। পবিত্র কোরআনে এ সম্পর্কে আল্লাহপাক বলেছেন। ওয়াল্লাহুল গানিয়্যুঅ আনতুমুল ফুকারাও। অর্থাত্ মহান আল্লাহপাকই একমাত্র ধনী আর তোমরা সবাই দরিদ্র বা গরিব। তাসাউফ শাস্ত্রের এ গরিবের ব্যাখ্যায় পবিত্র কোরআনের বিধিবিধানসম্মত হলেও ইসলাম গরিব-দুঃখী, অসহায়দের স্বার্থ সংরক্ষণ অধিকার বা হকগুলো ফরজ রূপে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। জাকাত, ফেতরা, সদকা ছাড়াও স্বাভাবিক নিয়মে দেশপ্রথা ও প্রচলিত রীতিনীতি অনুযায়ী গরিব, দুঃখী, অসহায়রা ধনাঢ্য, সামর্থ্যবানদের থেকে সাহায্য-সহযোগিতা পেতে পারে।
ইসলাম মানবসমাজকে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছে। একশ্রেণীর লোক ধন-সম্পদ ও অর্থের পাহাড় গড়বে। আর অন্য শ্রেণীর লোক দরিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত হবে—এ নিয়ম-নীতি ইসলাম কখনোই পছন্দ করে না। ইসলাম ধর্ম ধন-সম্পদ ও অর্থকড়ির ব্যাপারে উদারতা ও ইনসাফের মাধ্যমে গরিবের অধিকার ব্যাপকভাবে সংরক্ষিত করেছে। অন্যদিকে গরিব, দুঃখী মানুষের স্বাভাবিক জীবনধারণের জন্য ধনীদের প্রতি তাদের হককে নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। ইসলামী অর্থনীতিতে জাকাত, সদকা, ফেতরা ও দান-খয়রাত শুধু গরিব, অসহায় ও বিপন্ন মানুষের বেলায় প্রাপ্য এবং তা তাদের মৌলিক প্রাপ্য। গরিবদের মৌলিক অধিকার যেমন ইসলাম স্বীকার করেছে, পাশাপাশি তাদের মর্যাদাও দিয়েছে গুরুত্বসহকারে। এ সম্পর্কে হজরত রাসুলে পাক (সা.) হজরত বেলাল (রা.)-কে বলেছিলেন, ‘বেলাল, তুমি চেষ্টা করো যে, ইহলোক থেকে গরিব অবস্থায় যেতে পারো, ধনী-বিত্তবান ও অর্থশালী অবস্থায় যেতে চেষ্টা করো না।’ আল্লাহর নবী (সা.) আরও বলেছেন, ‘আমির অর্থাত্ ধনাঢ্য, বিত্তশালী লোকের ৪০ বছর আগে গরিব-দুঃখীরা বেহেশতে প্রবেশ করবে।’
‘রোজ কিয়ামতে আল্লাহ সুবহানাহুতায়ালা ফেরেশতাদের জিজ্ঞেস করবেন। দেখ তো আমার প্রিয় বান্দারা কোথায়। ফেরেশতারা আরজ করবেন, ইয়া আল্লাহ। কারা আপনার প্রিয় বান্দা। মহান আল্লাহপাকের পক্ষ থেকে উত্তর আসবে, তারা মুসলমান দরিদ্র লোক। যারা আমার দানে অর্থাত্ আমি যা দিতাম তাতে তারা পরিতৃপ্ত এবং সন্তুষ্ট ছিল, এসব লোককে বেহেশতে নিয়ে যাও।’
আমরা প্রতি মুহূর্তে মহান আল্লাহপাকের অগণিত নেয়ামত ভোগ করে আসছি। এর শুকরিয়া আদায় করে শেষ করা যায় না। দুনিয়ার জীবনে গরিব, অসহায়-দুস্থ মানুষের অধিকার ও সম্মান আল্লাহপাক প্রদান করেছেন, তেমন ধনাঢ্য-বিত্তবানদের তাদের প্রতি যথাযথ কর্তব্য পালনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তাই স্বাভাবিক নিয়ম ছাড়া বিশেষ করে জাকাত, সদকা, ফেতরা প্রদানের মাধ্যমে আমরা দুঃখভরা দরিদ্র, অসহায়, মিসকিন, দুস্থদের সাহায্য-সহযোগিতা করতে পারি। এ সম্পর্কে আমাদের প্রিয়নবী করীম (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা গরিব, অসহায়দের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন কর এবং তাদের প্রতি সাধ্য অনুযায়ী সাহায্যের হাত বাড়াও। পরোকালে তারাই তোমার ধন-সম্বল হবে। জেনে রাখ, দান-খয়রাতে অর্থ-সম্পদ বৃদ্ধি পায়।’ একবার সাহাবিরা হজরত রাসুলে পাক (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর নবী, যার সামর্থ্য নেই, সেই ব্যক্তি কীভাবে তার কর্তব্য পালন করবে। এর উত্তরে আল্লাহর নবী (সা.) বললেন, নিজের শক্তি দিয়ে, পরিশ্রম করে।’ সাহাবিরা আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘যদি সেরূপ কোনো সুযোগ না পায়, তাহলে কী করবে?’ আল্লাহর নবী (সা.) বললেন, ‘যেসব গরিব-দুঃখী, কষ্টে-বিপদে জর্জরিত, তাদের দান-খয়রাতের মাধ্যমে সেবা করবে।’
অতএব আসুন, যথাসাধ্য আমরা প্রতিনিয়ত গরিব, দুঃখী, অসহায়, বিপন্ন, ফকির, মিসকিন, এতিমদের সেবা ও সাহায্য-সহযোগিতায় হাত বাড়াই।ষ
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ, সিরাত মিশন।
জনপ্রতিনিধির জনসেবা
আ ব দু ল্লা হ মু কা র র ম
সেবা একটি মহত্ কাজ। ইসলাম এতে উত্সাহ যোগায় এবং সেবকের জন্য পুরস্কারের ঘোষণাও করে অনেক জায়গায়। সেবার পরিসর ছোট বা বড় যাই হোক না কেন তা পুণ্যের কাজ। সেবক নিয়ত ও ইখলাছ অনুপাতে ছওয়াবের ভাগী হয়। বাহ্যত দুনিয়াবি কাজও অনেক সময় সত্ নিয়তের কারণে ছওয়াবের কাজে পরিণত হয়। আবার অনেক ধর্মীয় কাজও নিয়তজনিত ত্রুটির কারণে ভেস্তে যায়।
জীবনের নানা সময়ে, নানা আনুকূল্য ও সেবার প্রয়োজনেই মানুষের সমাজবদ্ধ বসবাস। মানুষের লক্ষ্যে-অলক্ষ্যে পারস্পরিক সহমর্মিতা, সহযোগিতা ও সেবাই সমাজব্যবস্থা সচল থাকে। সেবার সে মানসিকতা লোপ পেলে সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে যায়। সমাজে বিশৃংখলা, নৈরাজ্য ও শোষণের মহামারী পরিলক্ষিত হয়। ইতিহাস সাক্ষী? ইসলামপূর্ব জাহেলি যুগে অঞ্চল ও গোত্রসর্বস্ব সমাজ বিদ্যমান থাকলেও তা ছিল আধিপত্য বিস্তার, হিংসা-বিদ্বেষ এবং পরশ্রীকাতরতার ভয়াল থাবায় জরাজীর্ণ। সে সমাজে ‘আমি, আমার ও আমাদের’ ছাড়া আর কারও কথা ভাবার সুযোগই ছিল না। সে পৈশাচিক সমাজকে ইসলাম যখন মানবতার দীক্ষা দিল। ‘আমি ও আমরা’-এর সঙ্গে অন্যকে নিয়েও ভাবতে শেখাল? তখন সে সমাজের হিংস্র মানুষগুলো ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হলো। সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে এল। সমাজ হলো কল্যাণমুখী।
আমাদের ঘুণেধরা এ জীর্ণশীর্ণ সমাজকে ফলপ্রসূ, সুশৃঙ্খল ও কল্যাণমুখী করতে সেবকের প্রয়োজন, যারা নিজেদের পাশাপাশি অন্যদের নিয়েও ভাববে, বরং অন্যদের বিষয়কেই প্রাধান্য দেবে। নবী করীম সা. ইরশাদ করেন, ‘জাতির নেতা তাদের সেবক’। আমাদের সমাজ ও সরকার ব্যবস্থাকে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনার জন্য প্রচলিত ধারায় গণতান্ত্রিক নিয়মে কয়েকটি স্তরে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয়। তাদের প্রধান পরিচয় ‘জনপ্রতিনিধি’। বিধিমতে জনসেবা করাই তাদের কাজ। জনগণের সমস্যা সমাধান করা, তাদের সার্বিক কল্যাণের পথকে সুগম করার লক্ষ্যে সরকারের উচ্চমহলের দৃষ্টি আকর্ষণের মাধ্যমে তাদেরই সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা। নির্বাচনপূর্ব প্রচারণায় সবারই প্রতিশ্রুতি তাই প্রমাণ করে। সম্প্রতি পৌরসভা নির্বাচন হতে চলেছে। আশা করা যাচ্ছে, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হবে শিগগিরই। তাই সেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যারা সেবক হিসেবে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন, তারা তাদের সেবাকে সুন্দর ও সার্থক করতে অতীতের সে সব মহামনীষীগণের সেবাকর্ম দেখে নিতে পারেন, অদ্যাবধি পৃথিবীবাসী যাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। যাদের নিয়ে আমরা নিজেরাও গর্ব করি।
১. হজরত আবু বকর রা. ইসলামের প্রথম খলিফা। তিনি মক্কার বিশিষ্ট ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন। ইসলাম গ্রহণের পর তার সমুদয় সম্পদ দ্বীনি কাজে ব্যয় করেছেন। খলিফা হওয়ার পরও ইসলামী খেলাফতের এ বাদশা জীবিকার সন্ধানে কাপড়ের গাট্টি মাথায় নিয়ে বাজারে ছুটছেন। পথে হজরত ওমরের সঙ্গে সাক্ষাত্। জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাচ্ছেন? আপনি এখন রাষ্ট্রপ্রধান। ব্যবসার উদ্দেশ্যে বাজারে যাওয়ার সুযোগ আর নেই। রাষ্ট্রের প্রতিটি মানুষের সব দায়িত্ব এখন আপনার। আপনি রাষ্ট্রের কাজে ব্যস্ত থাকবেন, আর রাষ্ট্র আপনার প্রয়োজন মেটাবে। এর পর তার যত্সামান্য ভাতা নির্ধারণ করা হয়। এর উপরই সন্তুষ্ট থেকে অবশিষ্ট জীবন পার করে দেন। অতঃপর মৃত্যুশয্যায় ওয়ারিশদের অসিয়ত করে গেলেন, ‘বায়তুলমাল থেকে গৃহীত সমুদয় ভাতা আমার সম্পত্তি থেকে ফিরিয়ে দেবে’। বাস্তবে হয়েছিলও তাই।
২.ক. হজরত ওমর রা.। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা, অর্ধজাহানের সফল শাসক। তাঁর সাধারণ নিয়ম ছিল, রাতের আঁধারে ছদ্মবেশে ঘুরে ঘুরে প্রজাদের প্রকৃত অবস্থা জানা। একদিন রাতে হাঁটছেন। দূরে খোলা ময়দানে কাতর কণ্ঠ শুনে এগিয়ে গেলেন। দেখেন, মুসাফির দম্পতি, স্ত্রী প্রসব ব্যথায় কাতরাচ্ছে। তাদের সহযোগিতার কেউ নেই এবং অতীব প্রয়োজনীয় আসবাবপত্রও নেই। স্বামী এ অবস্থায় স্ত্রীকে একা রেখে কোথাও যেতে পারছে না এবং কোন কিছুর ব্যবস্থাও করতে পারছে না। তাই কোনো ত্রাণকর্তার প্রতীক্ষায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পথ চেয়ে আছে। হজরত ওমর রা. দৌড়ে বাড়ি এসে স্ত্রীকে বললেন, চল চল, আজ তোমার মহাপুণ্যের সুযোগ হয়েছে। অতঃপর খলিফার স্ত্রী ধাত্রীর কাজ সমাধা করলেন আর খলিফা নিজে বাইরে অন্যান্য কাজের আন্জাম দিলেন।
খ. অন্য আরেক দিনের ঘটনা। প্রজাদের অবস্থা জানতে রাতে তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এক ঘর থেকে বাচ্চাদের করুণ আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। শিশুদের অবিরাম আর্তনাদে মহিলাকে ওমর ভর্ত্সনা করলেন, তুমি কেমন মহিলা যে, মা হয়েও শিশুদের থামাতে পারছ না! ভেতর থেকে মহিলা গর্জে ওঠল, তুমি কে? তোমার পথে তুমি যাও। উপদেশ খয়রাত করতে হবে না। আমার ঘরে কয়েকজন এতিম শিশু আছে অথচ তাদের খাবারের কোনো ব্যবস্থা নেই। আগুন জ্বালিয়ে খাবারের মিথ্যা দোহাই দিয়ে শিশুদের আর কতক্ষণ থামিয়ে রাখা যায়?
খলিফা ওমর দৌড়ে বায়তুল মালে গিয়ে প্রয়োজনীয় খাবার বস্তাভর্তি করে গোলামকে বললেন, এটা আমার কাঁধে তুলে দাও। গোলামের অবাক প্রশ্ন। হুজুর আমি থাকতে আপনি কাঁধে নেবেন কেন? তিনি বললেন, কিয়ামত দিবসে আমার বোঝা তুমি কাঁধে নেবে না। তাই দুনিয়াতেও আমার বোঝা আমাকেই বহন করতে দাও। খলিফা নিজে বস্তা কাঁধে নিয়ে মহিলার বাড়ি গিয়ে হাজির। অতঃপর বললেন, মা! তুমি রুটি সেঁকো আর আমি বানিয়ে দিচ্ছি। এভাবে শিশুদের খাইয়ে আনন্দরত অবস্থায় রেখে আসার সময় মহিলা বলছিল, খলিফা ওমর কোথায়? আজ যদি আমার ক্ষমতা থাকতো তবে খেলাফতের মসনদ থেকে তাকে নামিয়ে তোমাকেই সেখানে বসিয়ে দিতাম। মহিলা আদৌ জানতো না যে, বস্তাবাহী সে ব্যক্তিটিই খলিফা ওমর।
আমাদের সমাজের এ বেহাল দশায় সমাজ বিনির্মাণে এমন জনপ্রতিনিধির প্রয়োজন, যারা হবেন প্রকৃত নিষ্ঠাবান সমাজসেবক। সমাজের প্রতিটি স্তরের প্রতিটি সদস্যের কামনা এমনই। পূর্বসূরিদের নিয়ে যারা গর্ব করেন, যাদের উত্তরসূরি হতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করেন, তাদের কাছে অন্যদের ব্যতিক্রম কিছু প্রত্যাশা ও চাওয়া তো থাকতেই পারে।
আমাদের জনপ্রতিনিধিদের মনে রাখতে হবে—মহানবী সা. ইরশাদ করেন, তোমরা সবাই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকে আপন দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেসিত হবে?
সেবা একটি মহত্ কাজ। ইসলাম এতে উত্সাহ যোগায় এবং সেবকের জন্য পুরস্কারের ঘোষণাও করে অনেক জায়গায়। সেবার পরিসর ছোট বা বড় যাই হোক না কেন তা পুণ্যের কাজ। সেবক নিয়ত ও ইখলাছ অনুপাতে ছওয়াবের ভাগী হয়। বাহ্যত দুনিয়াবি কাজও অনেক সময় সত্ নিয়তের কারণে ছওয়াবের কাজে পরিণত হয়। আবার অনেক ধর্মীয় কাজও নিয়তজনিত ত্রুটির কারণে ভেস্তে যায়।
জীবনের নানা সময়ে, নানা আনুকূল্য ও সেবার প্রয়োজনেই মানুষের সমাজবদ্ধ বসবাস। মানুষের লক্ষ্যে-অলক্ষ্যে পারস্পরিক সহমর্মিতা, সহযোগিতা ও সেবাই সমাজব্যবস্থা সচল থাকে। সেবার সে মানসিকতা লোপ পেলে সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে যায়। সমাজে বিশৃংখলা, নৈরাজ্য ও শোষণের মহামারী পরিলক্ষিত হয়। ইতিহাস সাক্ষী? ইসলামপূর্ব জাহেলি যুগে অঞ্চল ও গোত্রসর্বস্ব সমাজ বিদ্যমান থাকলেও তা ছিল আধিপত্য বিস্তার, হিংসা-বিদ্বেষ এবং পরশ্রীকাতরতার ভয়াল থাবায় জরাজীর্ণ। সে সমাজে ‘আমি, আমার ও আমাদের’ ছাড়া আর কারও কথা ভাবার সুযোগই ছিল না। সে পৈশাচিক সমাজকে ইসলাম যখন মানবতার দীক্ষা দিল। ‘আমি ও আমরা’-এর সঙ্গে অন্যকে নিয়েও ভাবতে শেখাল? তখন সে সমাজের হিংস্র মানুষগুলো ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হলো। সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে এল। সমাজ হলো কল্যাণমুখী।
আমাদের ঘুণেধরা এ জীর্ণশীর্ণ সমাজকে ফলপ্রসূ, সুশৃঙ্খল ও কল্যাণমুখী করতে সেবকের প্রয়োজন, যারা নিজেদের পাশাপাশি অন্যদের নিয়েও ভাববে, বরং অন্যদের বিষয়কেই প্রাধান্য দেবে। নবী করীম সা. ইরশাদ করেন, ‘জাতির নেতা তাদের সেবক’। আমাদের সমাজ ও সরকার ব্যবস্থাকে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনার জন্য প্রচলিত ধারায় গণতান্ত্রিক নিয়মে কয়েকটি স্তরে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয়। তাদের প্রধান পরিচয় ‘জনপ্রতিনিধি’। বিধিমতে জনসেবা করাই তাদের কাজ। জনগণের সমস্যা সমাধান করা, তাদের সার্বিক কল্যাণের পথকে সুগম করার লক্ষ্যে সরকারের উচ্চমহলের দৃষ্টি আকর্ষণের মাধ্যমে তাদেরই সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা। নির্বাচনপূর্ব প্রচারণায় সবারই প্রতিশ্রুতি তাই প্রমাণ করে। সম্প্রতি পৌরসভা নির্বাচন হতে চলেছে। আশা করা যাচ্ছে, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হবে শিগগিরই। তাই সেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যারা সেবক হিসেবে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন, তারা তাদের সেবাকে সুন্দর ও সার্থক করতে অতীতের সে সব মহামনীষীগণের সেবাকর্ম দেখে নিতে পারেন, অদ্যাবধি পৃথিবীবাসী যাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। যাদের নিয়ে আমরা নিজেরাও গর্ব করি।
১. হজরত আবু বকর রা. ইসলামের প্রথম খলিফা। তিনি মক্কার বিশিষ্ট ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন। ইসলাম গ্রহণের পর তার সমুদয় সম্পদ দ্বীনি কাজে ব্যয় করেছেন। খলিফা হওয়ার পরও ইসলামী খেলাফতের এ বাদশা জীবিকার সন্ধানে কাপড়ের গাট্টি মাথায় নিয়ে বাজারে ছুটছেন। পথে হজরত ওমরের সঙ্গে সাক্ষাত্। জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাচ্ছেন? আপনি এখন রাষ্ট্রপ্রধান। ব্যবসার উদ্দেশ্যে বাজারে যাওয়ার সুযোগ আর নেই। রাষ্ট্রের প্রতিটি মানুষের সব দায়িত্ব এখন আপনার। আপনি রাষ্ট্রের কাজে ব্যস্ত থাকবেন, আর রাষ্ট্র আপনার প্রয়োজন মেটাবে। এর পর তার যত্সামান্য ভাতা নির্ধারণ করা হয়। এর উপরই সন্তুষ্ট থেকে অবশিষ্ট জীবন পার করে দেন। অতঃপর মৃত্যুশয্যায় ওয়ারিশদের অসিয়ত করে গেলেন, ‘বায়তুলমাল থেকে গৃহীত সমুদয় ভাতা আমার সম্পত্তি থেকে ফিরিয়ে দেবে’। বাস্তবে হয়েছিলও তাই।
২.ক. হজরত ওমর রা.। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা, অর্ধজাহানের সফল শাসক। তাঁর সাধারণ নিয়ম ছিল, রাতের আঁধারে ছদ্মবেশে ঘুরে ঘুরে প্রজাদের প্রকৃত অবস্থা জানা। একদিন রাতে হাঁটছেন। দূরে খোলা ময়দানে কাতর কণ্ঠ শুনে এগিয়ে গেলেন। দেখেন, মুসাফির দম্পতি, স্ত্রী প্রসব ব্যথায় কাতরাচ্ছে। তাদের সহযোগিতার কেউ নেই এবং অতীব প্রয়োজনীয় আসবাবপত্রও নেই। স্বামী এ অবস্থায় স্ত্রীকে একা রেখে কোথাও যেতে পারছে না এবং কোন কিছুর ব্যবস্থাও করতে পারছে না। তাই কোনো ত্রাণকর্তার প্রতীক্ষায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পথ চেয়ে আছে। হজরত ওমর রা. দৌড়ে বাড়ি এসে স্ত্রীকে বললেন, চল চল, আজ তোমার মহাপুণ্যের সুযোগ হয়েছে। অতঃপর খলিফার স্ত্রী ধাত্রীর কাজ সমাধা করলেন আর খলিফা নিজে বাইরে অন্যান্য কাজের আন্জাম দিলেন।
খ. অন্য আরেক দিনের ঘটনা। প্রজাদের অবস্থা জানতে রাতে তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এক ঘর থেকে বাচ্চাদের করুণ আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। শিশুদের অবিরাম আর্তনাদে মহিলাকে ওমর ভর্ত্সনা করলেন, তুমি কেমন মহিলা যে, মা হয়েও শিশুদের থামাতে পারছ না! ভেতর থেকে মহিলা গর্জে ওঠল, তুমি কে? তোমার পথে তুমি যাও। উপদেশ খয়রাত করতে হবে না। আমার ঘরে কয়েকজন এতিম শিশু আছে অথচ তাদের খাবারের কোনো ব্যবস্থা নেই। আগুন জ্বালিয়ে খাবারের মিথ্যা দোহাই দিয়ে শিশুদের আর কতক্ষণ থামিয়ে রাখা যায়?
খলিফা ওমর দৌড়ে বায়তুল মালে গিয়ে প্রয়োজনীয় খাবার বস্তাভর্তি করে গোলামকে বললেন, এটা আমার কাঁধে তুলে দাও। গোলামের অবাক প্রশ্ন। হুজুর আমি থাকতে আপনি কাঁধে নেবেন কেন? তিনি বললেন, কিয়ামত দিবসে আমার বোঝা তুমি কাঁধে নেবে না। তাই দুনিয়াতেও আমার বোঝা আমাকেই বহন করতে দাও। খলিফা নিজে বস্তা কাঁধে নিয়ে মহিলার বাড়ি গিয়ে হাজির। অতঃপর বললেন, মা! তুমি রুটি সেঁকো আর আমি বানিয়ে দিচ্ছি। এভাবে শিশুদের খাইয়ে আনন্দরত অবস্থায় রেখে আসার সময় মহিলা বলছিল, খলিফা ওমর কোথায়? আজ যদি আমার ক্ষমতা থাকতো তবে খেলাফতের মসনদ থেকে তাকে নামিয়ে তোমাকেই সেখানে বসিয়ে দিতাম। মহিলা আদৌ জানতো না যে, বস্তাবাহী সে ব্যক্তিটিই খলিফা ওমর।
আমাদের সমাজের এ বেহাল দশায় সমাজ বিনির্মাণে এমন জনপ্রতিনিধির প্রয়োজন, যারা হবেন প্রকৃত নিষ্ঠাবান সমাজসেবক। সমাজের প্রতিটি স্তরের প্রতিটি সদস্যের কামনা এমনই। পূর্বসূরিদের নিয়ে যারা গর্ব করেন, যাদের উত্তরসূরি হতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করেন, তাদের কাছে অন্যদের ব্যতিক্রম কিছু প্রত্যাশা ও চাওয়া তো থাকতেই পারে।
আমাদের জনপ্রতিনিধিদের মনে রাখতে হবে—মহানবী সা. ইরশাদ করেন, তোমরা সবাই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকে আপন দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেসিত হবে?
দাওয়াতের কাজ আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার মাধ্যম
— মাওলানা মুহাম্মাদ সা’দ
বিশ্ব ইজতিমা শুরু হয়েছে গত ২২ জানুয়ারি। ২৩ জানুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে শেষ হয়েছে ইজতিমার প্রথম পর্ব। আজ থেকে শুরু হচ্ছে ইজতিমার দ্বিতীয় পর্ব। ৩০ জানুয়ারি দ্বিতীয় পর্বের সমাপ্তির মাধ্যমে শেষ হবে এবারকার বিশ্ব ইজতিমা। এবারই বিশ্ব ইজতিমা বাংলাদেশে দুই পর্বে অনুষ্ঠিত হলো। প্রথম পর্বে ২২ জানুয়ারি মাগরিবের নামাজের পর বিশ্ব তাবলিগ জামাতের শীর্ষ মুরুব্বি দিল্লি নিজামুদ্দিনের হজরত মাওলানা মুহাম্মাদ সা’দ যে গুরুত্বপূর্ণ বয়ান করেন সেটির অনুবাদ করেছেন লাবীব আবদুল্লাহ। বিশ্ব ইজতিমা বিষয়ক সংবাদ বুলেটিন ‘ইজতেমা প্রতিদিন’-এর সৌজন্যে সেটির নির্বাচিত অংশ তুলে ধরা হলো
দাওয়াত হলো আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার মাধ্যম। আকিদা-মুআমালা, মু’আশারা ও আখলাক ঠিক হবে দাওয়াতের মাধ্যমে। দ্বীন শুধু কল্পনার নাম নয়। প্রিয় নবীজী যা নিয়ে দুনিয়ায় প্রেরিত হয়েছেন তার সামগ্রিক এক চিত্রের নাম দ্বীন। তিনি সাহাবায়ে কেরামকে পূর্ণ দ্বীনের ওপর উঠিয়েছেন। সাহাবায়ে কেরাম হলেন দ্বীনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি। উম্মত যখন এই কাজ ছেড়ে দেবে তখন তারা অন্য জাতি ও ধর্মের দ্বারা মাদয়ু-আহূত হবে। তারা ভিন জাতির তাহজিব-তামাদ্দুনের আগ্রাসনের শিকার হবে। অন্যদের কৃষ্টি-কালচারের প্রতি তাদের ডাকা হবে। এই হালত থেকে নিত্যনতুন আধুনিক অনেক তরিকা বের করা হবে এবং হচ্ছে। কিন্তু উম্মাহ প্রথম যুগে যেভাবে যে কাজে ইসলাহ-সংশোধন হয়েছে, বর্তমান যুগেও সেভাবেই ইসলাহ হবে। অন্য কোনো তরিকায় হবে না অবস্থার পরিবর্তন। এই ফিকির ও ভাবনা ঠিক নয় যে দাওয়াতের কাজ শুধু নবীজী ও সাহাবায়ে কেরামের যুগের জন্য সীমিত ছিল। মূলত নবীওয়ালা এই কাজ সর্বকালের সবার জন্য। কিয়ামত পর্যন্ত সময়ের জন্য। উম্মত যদি সম্মিলিতভাবে এই কাজ ছেড়ে দেয় তাহলে তাদের ধ্বংস অনিবার্য। সম্মিলিতভাবে নয়, যদি ইনফেরাদি-ব্যক্তিগতভাবেও এ দাওয়াত ছেড়ে দেয়া হয় তাহলেও উম্মতের ক্ষতি হবে অপূরণীয়। এর প্রমাণ পাওয়া যায় প্রসিদ্ধ সাহাবি হজরত কা’ব ইবনে মালেকের (রা.) জীবনে। তিনি যদিও বদরি সাহাবি ছিলেন না, কিন্তু গাযওয়াতে তাবুকে তিনি যেতে পারেননি। এ ঘটনা প্রসিদ্ধ। এই না যাওয়ার কারণে পঞ্চাশ রাত তার জীবনে নেমে আসে দুঃখের ছায়া। তার ও তার দুই সাথীসহ দুঃখের মাঝে দিন কাটান। জমিন প্রস্তুত হওয়ার পরও তাদের জন্য হয়েছিল সংকীর্ণ। পুরো মদিনাবাসী তাদের বয়কট করেছিল। সালামের উত্তর দিত না। এ সময় গাস্সানের বাদশা তার নামে রেশমের কাপড়ে পত্র পাঠিয়ে তাকে দাওয়াত দেয় যে, তোমার সাথী তোমার ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করেছে। আমাদের পথে এসো। তিনি এই পত্র আগুনে জ্বালিয়ে দেন এবং বলেন, এক মুসিবত শেষ হওয়ার আগেই আরেক মুসিবত এসে হাজির।
সাহাবি হওয়া সত্ত্বেও তাকে গাস্সানের বাদশা দাওয়াত দিল। এ ঘটনা কিয়ামত পর্যন্ত সময়ের জন্য আমাদের জন্য শিক্ষা। দাওয়াত ছেড়ে শুধু আমল করলে দ্বীনের হেফাজত হবে না। দ্বীনের ওপর ইস্তেকামাত ও দ্বীনের হেফাজত নির্ভর করে অন্যকে দাওয়াত দেয়ার ওপর, দ্বীনের হেফাজত দাওয়াতের ওপর মাওকুফ-নির্ভরশীল। দাওয়াত না দিলে, বাতিল শক্তি এই উম্মতকে অন্য দিকে দাওয়াত দেবে।
ঈমান শিখতে হয়, ঈমানের মজলিস কায়েম করতে হয়। দাওয়াতের কাজে বুনিয়াদি সিফাত হলো ঈমানের সিফাত। কোরআন-হাদিসে মুমিনকে দাওয়াত দেয়ার কথা বলা হয়েছে। সাহাবায়ে কেরাম ঈমানের মজলিস কায়েম করতেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রা.) অন্য সাহাবিকে দাওয়াত দিয়ে বলতেন, এসো আমরা ঈমান আনি। অর্থাত্ ঈমানের আলোচনা করি। ঈমানের প্রতি দাওয়াত দেয়া প্রত্যেক মুমিনের দায়িত্ব, মুমিনের কাজ। প্রত্যেকেই অন্য কিছুর আলোচনা ছেড়ে আল্লাহ তায়ালার জাত ও সিফাত, তাওহিদ ও আল্লাহর বড়াইয়ের দিকে দাওয়াত দেবে। মজার বিষয় হলো, একজন আমাকে প্রশ্ন করলেন, ঈমানেরও কি আবার মজলিস হয়? এই মজলিস দ্বারা কি ঈমান শক্তিশালী হয়?
ইমাম বুখারি (রহ.) ঈমান শক্তিশালীকরণ বিষয়ে অধ্যায় সংযোজন করেছেন। হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) অন্য সাহাবিকে দাওয়াত দিতেন। তার মা’মুল ছিল তিনি বলতেন, এসো ঈমান আনি। এসো ঈমানের তাজদিদ-নবায়ন করি। কোরআন কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ঈমান আন। অর্থাত্ ঈমান বৃদ্ধি কর। মূলত ঈমান অনুযায়ী ইতাআত-আনুগত্য হবে। দিল হলো ঈমানের জায়গা। কালেমার মেহনতের জায়গা। আমরা অনেকেই মনে করি, কালেমার দাওয়াত শুধু অমুসলিমদের জন্য। এ ধারণা ঠিক নয়। মুমিনদেরও কালেমার দাওয়াত দিতে হবে।
আজ সর্বত্র আল্লাহর বড়ত্ব ও কুদরত ছাড়া বস্তুবাদী মাদ্দিয়াতের আলোচনা। আমাদের বস্তুবাদী আলোচনা ছেড়ে আল্লাহর কুদরতের আলোচনা করতে হবে। এক সাহাবিকে রাসুল (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, সকাল কীভাবে কাটিয়েছ? তিনি বললেন, ঈমানে হকের সঙ্গে, সঠিক ঈমানের সঙ্গে। তিনি বললেন, এর আলামত কী? তিনি বললেন, আরশ কুরসি আমার সামনে, কিয়ামতের বিষয়াদি আমাদের সামনে। আমার রূহকে দুনিয়া থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আখেরাতমুখী করেছি। নবীজী বললেন, তুমি ঈমানের পরিচয় পেয়েছ। এর ওপর অটল থাক। মূলত ঈমান এভাবে ছুটে যায় যেমন ছুটে যায় লাগামহীন উট। আমরা যেমন জামা খুলে ফেলি, ঈমানও তেমনিভাবে খুলে যায়। আমাদের ঈমানের আলোচনা বাড়াতে হবে, গালেব রাখতে হবে। সাহাবায়ে কেরাম ইলমের হালকা কায়েম করতেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) ইলমের হালকা কায়েম করে অন্যকে দাওয়াত দিতেন এবং বলতেন, মসজিদে নবীজীর মিরাস বণ্টন হচ্ছে, আর তোমরা বাজারে? উম্মতকে সাহাবায়ে কেরাম জুহদ ও মেহনতের কথা বলে ঈমানের দাওয়াত দিতে হবে। আমাদের দাওয়াতের উদ্দেশ্য হলো দুনিয়ার নানা পরিবেশ থেকে ঈমানের পরিবেশে আনা। যেখানে আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো কিছুর আলোচনা থাকবে না। বস্তুবাদী নকশা ছেড়ে ঈমান বিল গায়েবের বিষয়ে দাওয়াত দেয়া।
ঈমান কী? এ বিষয়ে রাসুল (সা.) জিজ্ঞাসিত হয়ে বললেন, তোমার নেক কাজ যদি তোমাকে খুশি করে, অসত্ কাজ যদি তোমাকে পেরেশানে ফেলে, তাহলে তুমি মুমিন। আমরা মনে করি, আমরা ঈমানদার। অথচ আমাদের আমল, আমাদের আখলাক, আমাদের ইবাদত, আমাদের মুআমালা, আমাদের মুআশারা ঈমানের খেলাফ। এক সাহাবির পক্ষ থেকে নবীজীর দরবারে গিবত হয়ে গেল। নবীজী বললেন, তুমি কোরআনের খেলাপ করলে। যে ব্যক্তি কোরআনের হারামকে হালাল ভাববে সে কোরআনের খেলাপ করল। আমাদের কালিমার ইখলাস হাসিল করতে হবে। ঈমান ও ইখলাস একই। কালেমার ইখলাস হলো হারাম থেকে বিরত থাকা। ঈমান হলো উটকে লাগাম লাগানোর মতো। এর দ্বারা উটকে যেভাবে ইচ্ছা পরিচালনা করা যায়। অনুরূপ মুমিন ঈমান দ্বারা পরিচালিত হবে।
দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে ঘোরাফেরা করা সাহাবায়ে কেরামের কাজ। সব উম্মতকে তাদের অঙ্গনে দাওয়াতের কাজ করতে হবে। দুনিয়ার কোনো প্রান্তে যদি আল্লাহর হুকুম লঙ্ঘন হয়, তাহলে তার মোকাবিলায় সবাইকে কাজ করতে হবে। অনেকেই মনে করে, দাওয়াতের কাজ অন্যান্য কল্যাণকর কাজের মতো একটি। এ ধারণাও ঠিক নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, আল্লাহর পথে দাওয়াতের কাজের মতো অন্য কোনো কাজ নেই। আমাদের এহসাস ও অনুভূতি খতম হয়ে যাচ্ছে। দাওয়াতের কাজ ছেড়ে দেয়া যে গোনাহ, এই অনুভূতিও নেই আমাদের মাঝে। আমাদের ইস্তেগফার করতে হবে এবং খোলাফায়ে রাশেদার মতো দাওয়াতের কাজ নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় বের হতে হবে।
বিশ্ব ইজতিমা শুরু হয়েছে গত ২২ জানুয়ারি। ২৩ জানুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে শেষ হয়েছে ইজতিমার প্রথম পর্ব। আজ থেকে শুরু হচ্ছে ইজতিমার দ্বিতীয় পর্ব। ৩০ জানুয়ারি দ্বিতীয় পর্বের সমাপ্তির মাধ্যমে শেষ হবে এবারকার বিশ্ব ইজতিমা। এবারই বিশ্ব ইজতিমা বাংলাদেশে দুই পর্বে অনুষ্ঠিত হলো। প্রথম পর্বে ২২ জানুয়ারি মাগরিবের নামাজের পর বিশ্ব তাবলিগ জামাতের শীর্ষ মুরুব্বি দিল্লি নিজামুদ্দিনের হজরত মাওলানা মুহাম্মাদ সা’দ যে গুরুত্বপূর্ণ বয়ান করেন সেটির অনুবাদ করেছেন লাবীব আবদুল্লাহ। বিশ্ব ইজতিমা বিষয়ক সংবাদ বুলেটিন ‘ইজতেমা প্রতিদিন’-এর সৌজন্যে সেটির নির্বাচিত অংশ তুলে ধরা হলো
দাওয়াত হলো আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার মাধ্যম। আকিদা-মুআমালা, মু’আশারা ও আখলাক ঠিক হবে দাওয়াতের মাধ্যমে। দ্বীন শুধু কল্পনার নাম নয়। প্রিয় নবীজী যা নিয়ে দুনিয়ায় প্রেরিত হয়েছেন তার সামগ্রিক এক চিত্রের নাম দ্বীন। তিনি সাহাবায়ে কেরামকে পূর্ণ দ্বীনের ওপর উঠিয়েছেন। সাহাবায়ে কেরাম হলেন দ্বীনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি। উম্মত যখন এই কাজ ছেড়ে দেবে তখন তারা অন্য জাতি ও ধর্মের দ্বারা মাদয়ু-আহূত হবে। তারা ভিন জাতির তাহজিব-তামাদ্দুনের আগ্রাসনের শিকার হবে। অন্যদের কৃষ্টি-কালচারের প্রতি তাদের ডাকা হবে। এই হালত থেকে নিত্যনতুন আধুনিক অনেক তরিকা বের করা হবে এবং হচ্ছে। কিন্তু উম্মাহ প্রথম যুগে যেভাবে যে কাজে ইসলাহ-সংশোধন হয়েছে, বর্তমান যুগেও সেভাবেই ইসলাহ হবে। অন্য কোনো তরিকায় হবে না অবস্থার পরিবর্তন। এই ফিকির ও ভাবনা ঠিক নয় যে দাওয়াতের কাজ শুধু নবীজী ও সাহাবায়ে কেরামের যুগের জন্য সীমিত ছিল। মূলত নবীওয়ালা এই কাজ সর্বকালের সবার জন্য। কিয়ামত পর্যন্ত সময়ের জন্য। উম্মত যদি সম্মিলিতভাবে এই কাজ ছেড়ে দেয় তাহলে তাদের ধ্বংস অনিবার্য। সম্মিলিতভাবে নয়, যদি ইনফেরাদি-ব্যক্তিগতভাবেও এ দাওয়াত ছেড়ে দেয়া হয় তাহলেও উম্মতের ক্ষতি হবে অপূরণীয়। এর প্রমাণ পাওয়া যায় প্রসিদ্ধ সাহাবি হজরত কা’ব ইবনে মালেকের (রা.) জীবনে। তিনি যদিও বদরি সাহাবি ছিলেন না, কিন্তু গাযওয়াতে তাবুকে তিনি যেতে পারেননি। এ ঘটনা প্রসিদ্ধ। এই না যাওয়ার কারণে পঞ্চাশ রাত তার জীবনে নেমে আসে দুঃখের ছায়া। তার ও তার দুই সাথীসহ দুঃখের মাঝে দিন কাটান। জমিন প্রস্তুত হওয়ার পরও তাদের জন্য হয়েছিল সংকীর্ণ। পুরো মদিনাবাসী তাদের বয়কট করেছিল। সালামের উত্তর দিত না। এ সময় গাস্সানের বাদশা তার নামে রেশমের কাপড়ে পত্র পাঠিয়ে তাকে দাওয়াত দেয় যে, তোমার সাথী তোমার ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করেছে। আমাদের পথে এসো। তিনি এই পত্র আগুনে জ্বালিয়ে দেন এবং বলেন, এক মুসিবত শেষ হওয়ার আগেই আরেক মুসিবত এসে হাজির।
সাহাবি হওয়া সত্ত্বেও তাকে গাস্সানের বাদশা দাওয়াত দিল। এ ঘটনা কিয়ামত পর্যন্ত সময়ের জন্য আমাদের জন্য শিক্ষা। দাওয়াত ছেড়ে শুধু আমল করলে দ্বীনের হেফাজত হবে না। দ্বীনের ওপর ইস্তেকামাত ও দ্বীনের হেফাজত নির্ভর করে অন্যকে দাওয়াত দেয়ার ওপর, দ্বীনের হেফাজত দাওয়াতের ওপর মাওকুফ-নির্ভরশীল। দাওয়াত না দিলে, বাতিল শক্তি এই উম্মতকে অন্য দিকে দাওয়াত দেবে।
ঈমান শিখতে হয়, ঈমানের মজলিস কায়েম করতে হয়। দাওয়াতের কাজে বুনিয়াদি সিফাত হলো ঈমানের সিফাত। কোরআন-হাদিসে মুমিনকে দাওয়াত দেয়ার কথা বলা হয়েছে। সাহাবায়ে কেরাম ঈমানের মজলিস কায়েম করতেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রা.) অন্য সাহাবিকে দাওয়াত দিয়ে বলতেন, এসো আমরা ঈমান আনি। অর্থাত্ ঈমানের আলোচনা করি। ঈমানের প্রতি দাওয়াত দেয়া প্রত্যেক মুমিনের দায়িত্ব, মুমিনের কাজ। প্রত্যেকেই অন্য কিছুর আলোচনা ছেড়ে আল্লাহ তায়ালার জাত ও সিফাত, তাওহিদ ও আল্লাহর বড়াইয়ের দিকে দাওয়াত দেবে। মজার বিষয় হলো, একজন আমাকে প্রশ্ন করলেন, ঈমানেরও কি আবার মজলিস হয়? এই মজলিস দ্বারা কি ঈমান শক্তিশালী হয়?
ইমাম বুখারি (রহ.) ঈমান শক্তিশালীকরণ বিষয়ে অধ্যায় সংযোজন করেছেন। হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) অন্য সাহাবিকে দাওয়াত দিতেন। তার মা’মুল ছিল তিনি বলতেন, এসো ঈমান আনি। এসো ঈমানের তাজদিদ-নবায়ন করি। কোরআন কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ঈমান আন। অর্থাত্ ঈমান বৃদ্ধি কর। মূলত ঈমান অনুযায়ী ইতাআত-আনুগত্য হবে। দিল হলো ঈমানের জায়গা। কালেমার মেহনতের জায়গা। আমরা অনেকেই মনে করি, কালেমার দাওয়াত শুধু অমুসলিমদের জন্য। এ ধারণা ঠিক নয়। মুমিনদেরও কালেমার দাওয়াত দিতে হবে।
আজ সর্বত্র আল্লাহর বড়ত্ব ও কুদরত ছাড়া বস্তুবাদী মাদ্দিয়াতের আলোচনা। আমাদের বস্তুবাদী আলোচনা ছেড়ে আল্লাহর কুদরতের আলোচনা করতে হবে। এক সাহাবিকে রাসুল (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, সকাল কীভাবে কাটিয়েছ? তিনি বললেন, ঈমানে হকের সঙ্গে, সঠিক ঈমানের সঙ্গে। তিনি বললেন, এর আলামত কী? তিনি বললেন, আরশ কুরসি আমার সামনে, কিয়ামতের বিষয়াদি আমাদের সামনে। আমার রূহকে দুনিয়া থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আখেরাতমুখী করেছি। নবীজী বললেন, তুমি ঈমানের পরিচয় পেয়েছ। এর ওপর অটল থাক। মূলত ঈমান এভাবে ছুটে যায় যেমন ছুটে যায় লাগামহীন উট। আমরা যেমন জামা খুলে ফেলি, ঈমানও তেমনিভাবে খুলে যায়। আমাদের ঈমানের আলোচনা বাড়াতে হবে, গালেব রাখতে হবে। সাহাবায়ে কেরাম ইলমের হালকা কায়েম করতেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) ইলমের হালকা কায়েম করে অন্যকে দাওয়াত দিতেন এবং বলতেন, মসজিদে নবীজীর মিরাস বণ্টন হচ্ছে, আর তোমরা বাজারে? উম্মতকে সাহাবায়ে কেরাম জুহদ ও মেহনতের কথা বলে ঈমানের দাওয়াত দিতে হবে। আমাদের দাওয়াতের উদ্দেশ্য হলো দুনিয়ার নানা পরিবেশ থেকে ঈমানের পরিবেশে আনা। যেখানে আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো কিছুর আলোচনা থাকবে না। বস্তুবাদী নকশা ছেড়ে ঈমান বিল গায়েবের বিষয়ে দাওয়াত দেয়া।
ঈমান কী? এ বিষয়ে রাসুল (সা.) জিজ্ঞাসিত হয়ে বললেন, তোমার নেক কাজ যদি তোমাকে খুশি করে, অসত্ কাজ যদি তোমাকে পেরেশানে ফেলে, তাহলে তুমি মুমিন। আমরা মনে করি, আমরা ঈমানদার। অথচ আমাদের আমল, আমাদের আখলাক, আমাদের ইবাদত, আমাদের মুআমালা, আমাদের মুআশারা ঈমানের খেলাফ। এক সাহাবির পক্ষ থেকে নবীজীর দরবারে গিবত হয়ে গেল। নবীজী বললেন, তুমি কোরআনের খেলাপ করলে। যে ব্যক্তি কোরআনের হারামকে হালাল ভাববে সে কোরআনের খেলাপ করল। আমাদের কালিমার ইখলাস হাসিল করতে হবে। ঈমান ও ইখলাস একই। কালেমার ইখলাস হলো হারাম থেকে বিরত থাকা। ঈমান হলো উটকে লাগাম লাগানোর মতো। এর দ্বারা উটকে যেভাবে ইচ্ছা পরিচালনা করা যায়। অনুরূপ মুমিন ঈমান দ্বারা পরিচালিত হবে।
দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে ঘোরাফেরা করা সাহাবায়ে কেরামের কাজ। সব উম্মতকে তাদের অঙ্গনে দাওয়াতের কাজ করতে হবে। দুনিয়ার কোনো প্রান্তে যদি আল্লাহর হুকুম লঙ্ঘন হয়, তাহলে তার মোকাবিলায় সবাইকে কাজ করতে হবে। অনেকেই মনে করে, দাওয়াতের কাজ অন্যান্য কল্যাণকর কাজের মতো একটি। এ ধারণাও ঠিক নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, আল্লাহর পথে দাওয়াতের কাজের মতো অন্য কোনো কাজ নেই। আমাদের এহসাস ও অনুভূতি খতম হয়ে যাচ্ছে। দাওয়াতের কাজ ছেড়ে দেয়া যে গোনাহ, এই অনুভূতিও নেই আমাদের মাঝে। আমাদের ইস্তেগফার করতে হবে এবং খোলাফায়ে রাশেদার মতো দাওয়াতের কাজ নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় বের হতে হবে।
মুমিনের আচরণে সৌজন্য সদাচার
মোহাম্মদ সদরুল আমীন রাশেদ
ব্যবহার মানব জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য উপাদান। মানুষের সঙ্গে উত্তম ব্যবহার ও ইসলামী শরীয়াহ পরিপালন পরস্পর সহধর্মী। একটিকে ছাড়া অন্যটির কথা চিন্তাও করা যায় না। তাই সবাইকে অবশ্যই ইসলামী শরিয়ার আলোকে চরিত্র গঠন করতে হবে। আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে জগতের সব মানুষ আমাদের কাছে সর্বোত্তম ব্যবহার পাওয়ার অধিকার রাখেন। ইসলামে সুন্দর ব্যবহারকে ইবাদত হিসেবে গণ্য করা হয়। জনগণের প্রতি ভালো ব্যবহার আমাদের জীবনের অন্যতম ব্রত হওয়া উচিত। হাসিমুখে ও আন্তরিকতার সঙ্গে সবাইকে গ্রহণ করা আমাদের দায়িত্ব। মানব সেবার গুণ দ্রুত ও ইতিবাচক সেবাদানের মানসিকতা থাকতে হয়। তাই অবৈধ ও অনৈতিক কাজ থেকে দূরে থাকতে হবে। ইসলামী জীবনাচার, আদব-কায়দা ও শিষ্টাচার নিজের জীবনে পরিপালন করতে হবে।
ইসলাম কী? একজন জিজ্ঞেস করলেন। মুহাম্মদ (সা.) বললেন, পবিত্র বচন ও পরের জন্য জীবন। যে হৃদয়ে মানুষের জন্য প্রেম, ভালোবাসা ও সহানুভূতি নেই, সমব্যথা নেই, সে দিলের জন্য জান্নাত নেই। পরিপাটি হয়ে থাকা, সালাম ও পরিচয় দেয়া, সহযোগিতামূলক আচরণ করা, সৌজন্য বজায় রাখা, পরিমিত আহার করা এবং অনুমতি নিয়ে কথা বলা ইসলামের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
ইসলামে শিষ্টাচার বা আদবকে ঈমানের অংশ বলা হয়েছে। ইসলাম পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সাংস্কৃতিক পার্থক্যকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং জীবনযাপনের বিভিন্ন পর্যায়ে সর্বজনীন শিষ্টাচার বা আদব-কায়দার সাধারণ মূলনীতি অনুসরণের নির্দেশনা দিয়েছে। তাই সর্বপ্রথমে ইসলামের মিশন এবং ভিশন সম্পর্কে আমাদের সচেতন হতে হবে।
ইসলাম একটি সেবার ধর্ম, অনুষ্ঠানসর্বস্বতাই যার মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। আমরা পৃথিবীর সব মানুষের সম্পদকে আমানত হিসেবে মনে করব। সর্বোত্তম মানবসেবা চালিয়ে যাওয়া আমাদের একটি দায়িত্ব। সে জন্য সেবাদানের ব্যাপারে আজকের মুমিনদের মধ্যে স্পিরিট সৃষ্টি করতে হবে। ইসলাম হলো একটি সেবা প্রদানকারী ইন্ডাস্ট্রির নাম। এ জন্য আমাদের প্রতিযোগিতামূলকভাবে, যোগ্যতার মাধ্যমে, দ্রুততা ও দক্ষতার সঙ্গে জীব-জগতের সেবা প্রদান করা উচিত। সর্বোত্তম ব্যবহার, বিনয়ী চরিত্র, ব্যক্তিত্ব, আনুগত্য, সহযোগিতা ও পারস্পরিক সুসম্পর্কের মাধ্যমে সেবাদান নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের ব্যাপারে সদা সচেতন থাকা উচিত। সে-ই সবচেয়ে ভালো মুসলমান, যার স্বভাব আপন পরিবারের কাছে সবচেয়ে ভালো বলে বিবেচিত। সে-ই পূর্ণ মুসলমান যার আচরণ সর্বোত্তম। যে ব্যক্তি নিজের লেনদেন ও কাজ-কারবারে সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত এবং ওয়াদা পালন করে, দায়িত্ব পালন করে, মানুষকে ধোঁকা না দেয়, আমানতের খেয়ানত করে না, মানুষের হক নষ্ট করে না, ওজনে কম দেয় না, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না এবং সুদ-ঘুষসহ যাবতীয় অবৈধ রোজগার থেকে নিজেকে রক্ষা করে চলে, সে-ই হলো প্রকৃত মুসলমান।
সালামের ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। খুশি মনে সালামের জবাব দেয়া সবার কর্তব্য। পরিচিত অপরিচিত সবাইকে সালাম দিতে হবে। সুযোগ পেলে মুসাফাহা করতে হবে। অবস্থার কথা জিজ্ঞেস করে পরিবারের লোকদেরও খোঁজখবর নেয়া যেতে পারে। মানুষকে আমাদের সর্বোত্তম বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। তাদের সঙ্গে সব সময় হাসিমুখে কথা বলতে হবে। রাসুল (সা.) সব সময় মানুষের সঙ্গে হাসি মুখে কথা বলতেন। সুতরাং বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি দ্বারা আগতকে অভ্যর্থনা জানাতে হবে। একজন হাস্যোজ্জ্বল মানুষের সঙ্গে যে কেউ কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। হজরত আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেন, ‘এক ব্যক্তি নবী করিম (সা.)-এর কাছে আরজ করলেন, আপনি আমাকে অসিয়ত করুন। তিনি বললেন, তুমি রাগ করো না। লোকটি কয়েকবার তা আরজ করলে নবী করিম (সা.) প্রত্যেকবারই বললেন, রাগ করো না।’ আমাদের সমাজে একটি কথার প্রচলন করা যেতে পারে—রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন।
পৃথিবীতে যত আদর্শ প্রচারিত হয়েছে তা হয়েছে সুন্দর কথা দিয়েই, অসুন্দর কথা ও কুবচন দিয়ে কোনো আদর্শ পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সুন্দর কথা দিয়ে সহজেই মানুষের মন জয় করা যায়। শ্রেষ্ঠ মনীষীরা সুভাষী ছিলেন। সুন্দর কথার হাত, পা ও জীবন আছে। সুন্দর কথায় রোগ জীবাণু ধ্বংসের ওষুধ আছে, এন্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা আছে। সুন্দর কথায় শর্করার শক্তি আছে, ভিটামিনের সঞ্জীবনী আছে, আমিষের পুষ্টিগুণ আছে। একটি সুন্দর কথা ভালো গাছের মতো, মাটিতে যার বদ্ধমূল শিকড়, আকাশে যার বিস্তৃত শাখা, যে গাছ অফুরন্ত ফল বিলিয়ে দেয়। শুদ্ধভাবে, গুছিয়ে ও সুস্পষ্ট ভাষায় কথা বলতে হবে। বিপদে আপদে আশপাশের সবার খোঁজখবর নিতে হবে। বাড়িতে এলে সম্মানের সঙ্গে তাদের বসতে দিতে হবে এবং সুযোগমত উপযুক্ত আতিথেয়তাও করতে হবে। আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি যে দয়ার্দ্র, আল্লাহ তার প্রতি দয়ার হাত বাড়ান। মানুষের সেবা করলেই আল্লাহর সেবা করা হয়। পথের কাঁটা সরিয়ে দেয়াও ঈমানের অংশ।
কেউ যদি তার ভাইয়ের অভাব মোচনের চেষ্টা করে সফল না হয় তবুও আল্লাহ তার গুনাহ মাফ কর দেবেন। মানুষের সঙ্গে বাক্যালাপ করতে হবে তাদের বোধশক্তি অনুসারে। প্রত্যেক ব্যক্তি তার উন্নতিতে সাহায্য পাবে তার চরিত্র অনুসারে। তোমাদের মধ্যে তারাই আল্লাহর রাসুলের সবচেয়ে প্রিয় ও পরকালে ঘনিষ্ঠতম, যারা শিষ্টাচারপরায়ণ আর তারা সবচেয়ে বড় শত্রু ও সবচেয়ে পর যারা বদমেজাজি। নম্রতা ও সৌজন্য সওয়াবের কাজ। প্রকৃত বিনয় সব সত্ গুণের অংশ। সদগুণ ও সত্যনিষ্ঠায় অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা সদা জাগ্রত রাখতে হবে। কথা হবে মাধুর্যপূর্ণ, সংক্ষিপ্ত, যথাযথ ও আপেক্ষিক। সৌজন্যের খাতিরে যেসব শব্দ ব্যবহার করা যেতে পারে—অনুগ্রহপূর্বক, আপনাকে ধন্যবাদ, দুঃখিত, আমাকে ক্ষমা করবেন, যদি কিছু মনে না করেন, আপনার কাছে কৃতজ্ঞ ইত্যাদি।
জনসাধারণের সঙ্গে এমন আচরণ করা যাবে না যার ফলে ইসলামী আদর্শের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এবং বিবাদে জড়ানোর সম্ভাবনা থাকে। অবাধ্যতা পরিহার করতে হবে, গুজব ছড়ানো যাবে না ও অমার্জিত ভাষায় কথা বলা যাবে না। কথা না বলার মানসিকতা, হিংসা, ঘৃণা পোষণ, অশুভ কামনা, নিন্দা করা, কপটতা ও স্থিরতার অভাব, উেকাচ ও উপহার ইত্যাদি পরিহার করতে হবে।
হজরত মাসরুক (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন—তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক উত্তম ওই ব্যক্তি, যিনি স্বভাবে সর্বোত্তম। রাসুলুল্লাহ (সা.) স্বভাবে অশালীন ছিলেন না এবং অনিচ্ছাকৃতও অশালীন উক্তি করতেন না। কোনো মানুষ ভুলবশত কোনো কাজ করে ফেললেও তাকে সামনাসামনি তিরস্কার করা যাবে না। সময়ের কাজ যথাসময়ে করতে হবে।
ব্যবহার মানব জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য উপাদান। মানুষের সঙ্গে উত্তম ব্যবহার ও ইসলামী শরীয়াহ পরিপালন পরস্পর সহধর্মী। একটিকে ছাড়া অন্যটির কথা চিন্তাও করা যায় না। তাই সবাইকে অবশ্যই ইসলামী শরিয়ার আলোকে চরিত্র গঠন করতে হবে। আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে জগতের সব মানুষ আমাদের কাছে সর্বোত্তম ব্যবহার পাওয়ার অধিকার রাখেন। ইসলামে সুন্দর ব্যবহারকে ইবাদত হিসেবে গণ্য করা হয়। জনগণের প্রতি ভালো ব্যবহার আমাদের জীবনের অন্যতম ব্রত হওয়া উচিত। হাসিমুখে ও আন্তরিকতার সঙ্গে সবাইকে গ্রহণ করা আমাদের দায়িত্ব। মানব সেবার গুণ দ্রুত ও ইতিবাচক সেবাদানের মানসিকতা থাকতে হয়। তাই অবৈধ ও অনৈতিক কাজ থেকে দূরে থাকতে হবে। ইসলামী জীবনাচার, আদব-কায়দা ও শিষ্টাচার নিজের জীবনে পরিপালন করতে হবে।
ইসলাম কী? একজন জিজ্ঞেস করলেন। মুহাম্মদ (সা.) বললেন, পবিত্র বচন ও পরের জন্য জীবন। যে হৃদয়ে মানুষের জন্য প্রেম, ভালোবাসা ও সহানুভূতি নেই, সমব্যথা নেই, সে দিলের জন্য জান্নাত নেই। পরিপাটি হয়ে থাকা, সালাম ও পরিচয় দেয়া, সহযোগিতামূলক আচরণ করা, সৌজন্য বজায় রাখা, পরিমিত আহার করা এবং অনুমতি নিয়ে কথা বলা ইসলামের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
ইসলামে শিষ্টাচার বা আদবকে ঈমানের অংশ বলা হয়েছে। ইসলাম পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সাংস্কৃতিক পার্থক্যকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং জীবনযাপনের বিভিন্ন পর্যায়ে সর্বজনীন শিষ্টাচার বা আদব-কায়দার সাধারণ মূলনীতি অনুসরণের নির্দেশনা দিয়েছে। তাই সর্বপ্রথমে ইসলামের মিশন এবং ভিশন সম্পর্কে আমাদের সচেতন হতে হবে।
ইসলাম একটি সেবার ধর্ম, অনুষ্ঠানসর্বস্বতাই যার মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। আমরা পৃথিবীর সব মানুষের সম্পদকে আমানত হিসেবে মনে করব। সর্বোত্তম মানবসেবা চালিয়ে যাওয়া আমাদের একটি দায়িত্ব। সে জন্য সেবাদানের ব্যাপারে আজকের মুমিনদের মধ্যে স্পিরিট সৃষ্টি করতে হবে। ইসলাম হলো একটি সেবা প্রদানকারী ইন্ডাস্ট্রির নাম। এ জন্য আমাদের প্রতিযোগিতামূলকভাবে, যোগ্যতার মাধ্যমে, দ্রুততা ও দক্ষতার সঙ্গে জীব-জগতের সেবা প্রদান করা উচিত। সর্বোত্তম ব্যবহার, বিনয়ী চরিত্র, ব্যক্তিত্ব, আনুগত্য, সহযোগিতা ও পারস্পরিক সুসম্পর্কের মাধ্যমে সেবাদান নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের ব্যাপারে সদা সচেতন থাকা উচিত। সে-ই সবচেয়ে ভালো মুসলমান, যার স্বভাব আপন পরিবারের কাছে সবচেয়ে ভালো বলে বিবেচিত। সে-ই পূর্ণ মুসলমান যার আচরণ সর্বোত্তম। যে ব্যক্তি নিজের লেনদেন ও কাজ-কারবারে সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত এবং ওয়াদা পালন করে, দায়িত্ব পালন করে, মানুষকে ধোঁকা না দেয়, আমানতের খেয়ানত করে না, মানুষের হক নষ্ট করে না, ওজনে কম দেয় না, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না এবং সুদ-ঘুষসহ যাবতীয় অবৈধ রোজগার থেকে নিজেকে রক্ষা করে চলে, সে-ই হলো প্রকৃত মুসলমান।
সালামের ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। খুশি মনে সালামের জবাব দেয়া সবার কর্তব্য। পরিচিত অপরিচিত সবাইকে সালাম দিতে হবে। সুযোগ পেলে মুসাফাহা করতে হবে। অবস্থার কথা জিজ্ঞেস করে পরিবারের লোকদেরও খোঁজখবর নেয়া যেতে পারে। মানুষকে আমাদের সর্বোত্তম বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। তাদের সঙ্গে সব সময় হাসিমুখে কথা বলতে হবে। রাসুল (সা.) সব সময় মানুষের সঙ্গে হাসি মুখে কথা বলতেন। সুতরাং বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি দ্বারা আগতকে অভ্যর্থনা জানাতে হবে। একজন হাস্যোজ্জ্বল মানুষের সঙ্গে যে কেউ কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। হজরত আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেন, ‘এক ব্যক্তি নবী করিম (সা.)-এর কাছে আরজ করলেন, আপনি আমাকে অসিয়ত করুন। তিনি বললেন, তুমি রাগ করো না। লোকটি কয়েকবার তা আরজ করলে নবী করিম (সা.) প্রত্যেকবারই বললেন, রাগ করো না।’ আমাদের সমাজে একটি কথার প্রচলন করা যেতে পারে—রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন।
পৃথিবীতে যত আদর্শ প্রচারিত হয়েছে তা হয়েছে সুন্দর কথা দিয়েই, অসুন্দর কথা ও কুবচন দিয়ে কোনো আদর্শ পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সুন্দর কথা দিয়ে সহজেই মানুষের মন জয় করা যায়। শ্রেষ্ঠ মনীষীরা সুভাষী ছিলেন। সুন্দর কথার হাত, পা ও জীবন আছে। সুন্দর কথায় রোগ জীবাণু ধ্বংসের ওষুধ আছে, এন্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা আছে। সুন্দর কথায় শর্করার শক্তি আছে, ভিটামিনের সঞ্জীবনী আছে, আমিষের পুষ্টিগুণ আছে। একটি সুন্দর কথা ভালো গাছের মতো, মাটিতে যার বদ্ধমূল শিকড়, আকাশে যার বিস্তৃত শাখা, যে গাছ অফুরন্ত ফল বিলিয়ে দেয়। শুদ্ধভাবে, গুছিয়ে ও সুস্পষ্ট ভাষায় কথা বলতে হবে। বিপদে আপদে আশপাশের সবার খোঁজখবর নিতে হবে। বাড়িতে এলে সম্মানের সঙ্গে তাদের বসতে দিতে হবে এবং সুযোগমত উপযুক্ত আতিথেয়তাও করতে হবে। আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি যে দয়ার্দ্র, আল্লাহ তার প্রতি দয়ার হাত বাড়ান। মানুষের সেবা করলেই আল্লাহর সেবা করা হয়। পথের কাঁটা সরিয়ে দেয়াও ঈমানের অংশ।
কেউ যদি তার ভাইয়ের অভাব মোচনের চেষ্টা করে সফল না হয় তবুও আল্লাহ তার গুনাহ মাফ কর দেবেন। মানুষের সঙ্গে বাক্যালাপ করতে হবে তাদের বোধশক্তি অনুসারে। প্রত্যেক ব্যক্তি তার উন্নতিতে সাহায্য পাবে তার চরিত্র অনুসারে। তোমাদের মধ্যে তারাই আল্লাহর রাসুলের সবচেয়ে প্রিয় ও পরকালে ঘনিষ্ঠতম, যারা শিষ্টাচারপরায়ণ আর তারা সবচেয়ে বড় শত্রু ও সবচেয়ে পর যারা বদমেজাজি। নম্রতা ও সৌজন্য সওয়াবের কাজ। প্রকৃত বিনয় সব সত্ গুণের অংশ। সদগুণ ও সত্যনিষ্ঠায় অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা সদা জাগ্রত রাখতে হবে। কথা হবে মাধুর্যপূর্ণ, সংক্ষিপ্ত, যথাযথ ও আপেক্ষিক। সৌজন্যের খাতিরে যেসব শব্দ ব্যবহার করা যেতে পারে—অনুগ্রহপূর্বক, আপনাকে ধন্যবাদ, দুঃখিত, আমাকে ক্ষমা করবেন, যদি কিছু মনে না করেন, আপনার কাছে কৃতজ্ঞ ইত্যাদি।
জনসাধারণের সঙ্গে এমন আচরণ করা যাবে না যার ফলে ইসলামী আদর্শের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এবং বিবাদে জড়ানোর সম্ভাবনা থাকে। অবাধ্যতা পরিহার করতে হবে, গুজব ছড়ানো যাবে না ও অমার্জিত ভাষায় কথা বলা যাবে না। কথা না বলার মানসিকতা, হিংসা, ঘৃণা পোষণ, অশুভ কামনা, নিন্দা করা, কপটতা ও স্থিরতার অভাব, উেকাচ ও উপহার ইত্যাদি পরিহার করতে হবে।
হজরত মাসরুক (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন—তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক উত্তম ওই ব্যক্তি, যিনি স্বভাবে সর্বোত্তম। রাসুলুল্লাহ (সা.) স্বভাবে অশালীন ছিলেন না এবং অনিচ্ছাকৃতও অশালীন উক্তি করতেন না। কোনো মানুষ ভুলবশত কোনো কাজ করে ফেললেও তাকে সামনাসামনি তিরস্কার করা যাবে না। সময়ের কাজ যথাসময়ে করতে হবে।
আল কোরআনে মাতৃভাষার গুরুত্ব
ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
মহান আল্লাহর প্রিয় ও সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হচ্ছে মানব জাতি। এই শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি বা আশরাফুল মাখলুকাত তাদের মনের ভাব, হৃদয়ের আকুতি, অন্তরের ব্যাকুলতা ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করে থাকে। এই ভাষা আল্লাহর দান। মানুষের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত এই ভাষা এক অমূল্য ও অতি বড় নেয়ামত। আল্লাহ মানুষকে স্বাধীন বাকশক্তি বা কথা বলার ক্ষমতা দান করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘দয়াময় আল্লাহ শিক্ষা দিয়েছেন কোরআন, সৃজন করেছেন মানুষ, তাকে শিখিয়েছেন বর্ণনা’ (সূরা আর-রহমান, আয়াত ১-৪)। অর্থাত্ আল্লাহ মানুষকে তার মনের ভাব প্রকাশ করতে শিখিয়েছেন।
একজন মানব শিশু যে জনপদে জন্মগ্রহণ করে, যে পরিবেশে সে বেড়ে ওঠে, যে মায়ের কোলে সে প্রতিপালিত হয়, সে জনপদের মানুষের ভাষা, সেই পরিবেশের ভাষা, সে মায়ের ভাষা তার নিজের ভাষায় পরিণত হয়। প্রায় সাড়ে ছয়শ’ কোটি আদম সন্তান অধ্যুষিত পৃথিবী নামক এই এ ভূখণ্ডে প্রায় পাঁচ হাজার সাতশ’টি ভাষা রয়েছে। ভাষার এই ভিন্নতা, বিচিত্রতা মহান আল্লাহর সীমাহীন ক্ষমতা ও অসীম কুদরতের এক অপূর্ব ও অকল্পনীয় নিদর্শনের বহিঃপ্রকাশ। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, ‘আল্লাহর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য’ (সূরা আর-রুম, আয়াত ২২)।
মাতৃভাষার মাধ্যমে অন্য ভাষার মানুষকে, অন্য ভাষার মানুষের চিন্তা-চেতনা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও কৃষ্টি সহজে জানা যায়, আয়ত্ত করা যায়, নিজ অনুভবে নিয়ে এসে তাকে আত্মস্থ করা যায় হৃদয়ের গভীরতম প্রদেশে। মাতৃভাষা অতি সহজেই একজন মানুষের ব্যক্তি সত্তার অন্তর্গত হয়ে যায়। তাই নবী-রাসূলগণকে আল্লাহ যে অঞ্চলে প্রেরণ করেছেন, তাঁদেরকে সে অঞ্চলের মানুষের ভাষাভাষী করেছেন। এ মর্মে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি প্রত্যেক রাসূলকেই তার নিজ কওমের ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছি, তাদের নিকট সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য’ (সূরা ইব্রাহীম, আয়াত ৪)। এ আয়াতে সু্স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, মাতৃভাষার মাধ্যমে যত সহজে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে মানুষকে বোঝানো সম্ভব হয়, অন্য কোনো ভাষায় বোঝানো ও প্রকাশ করা তত সহজ হয় না। এজন্যই আল্লাহ নবী-রাসূলগণকে তাঁদের নিজ নিজ সম্প্রদায়ের ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছিলেন। হিব্রু ভাষাভাষী অঞ্চলে আল্লাহ হিব্রুভাষী নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন এবং তাঁর নিকট আল্লাহ হিব্রু ভাষায়ই কিতাব নাযিল করেছেন। যেমন তাওরাত ও ইঞ্জিল।
মহানবী মুহাম্মদ (সাঃ)-এর ভাষা ছিল আরবি। তার নিকট অবতীর্ণ মানবতার মুক্তির দিশারি কোরআনের ভাষাও ছিল আরবি। রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর প্রতি আরবি ভাষায় কোরআন নাজিল হওয়া সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘আমি আপনার ভাষায় কোরআনকে সহজ করে দিয়েছি, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে’ (সূরা আদ-দুখান, আয়াত ৫৮)।
অন্যত্র তিনি বলেন, ‘আমি আপনার প্রতি কোরআন নাযিল করেছি আরবি ভাষায় যাতে আপনি সতর্ক করতে পারেন মক্কা ও তার চতুর্দিকের জনগণকে এবং সতর্ক করতে পারেন রোজ হাশর সম্পর্কে’ (সূরা আশ-শূরা, আয়াত ৭)। তিনি আরও বলেন, ‘আমি এটা নাযিল করেছি আরবি ভাষায় কোরআন রূপে, যাতে তোমরা অনুধাবন করতে পার’ (সূরা আয-যুখরুফ, আয়াত-৩)।
কোরআনুল কারিমের বর্ণিত আয়াতগুলো থেকে জানা যায় যে, ইসলাম মাতৃভাষার উপর অশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। এ কারণে দেখা যায় যে, পরবর্তীকালে ইসলাম প্রচারকরা পৃথিবীর যে অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে গমন করেছেন, সে এলাকার মানুষের ভাষা তারা আয়ত্ত করে ওই ভাষাতেই ইসলামের বাণী, হকের দাওয়াত মানুষের সামনে পেশ করেছেন। মানবতার মুক্তির নির্ভুল দিশারি ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী, হেদায়াতের আলোকবর্তিকা মহাগ্রন্থ আল কোরআন মাতৃভাষাকে অশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। কেননা ইবাদত-উপাসনায়, দ্বীনের জ্ঞানার্জন ও মহান আল্লাহর আরাধনায় মাতৃভাষা মানুষকে যথার্থভাবে অনুপ্রাণিত করে। তাই মাতৃভাষার গুরুত্ব অনুধাবন করে আমাদেরকেও মাতৃভাষার সেবায়, মাতৃভাষার উন্নয়নে, মাতৃভাষার শ্রীবৃদ্ধিতে আত্মনিয়োগ করতে হবে।
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক
একজন মানব শিশু যে জনপদে জন্মগ্রহণ করে, যে পরিবেশে সে বেড়ে ওঠে, যে মায়ের কোলে সে প্রতিপালিত হয়, সে জনপদের মানুষের ভাষা, সেই পরিবেশের ভাষা, সে মায়ের ভাষা তার নিজের ভাষায় পরিণত হয়। প্রায় সাড়ে ছয়শ’ কোটি আদম সন্তান অধ্যুষিত পৃথিবী নামক এই এ ভূখণ্ডে প্রায় পাঁচ হাজার সাতশ’টি ভাষা রয়েছে। ভাষার এই ভিন্নতা, বিচিত্রতা মহান আল্লাহর সীমাহীন ক্ষমতা ও অসীম কুদরতের এক অপূর্ব ও অকল্পনীয় নিদর্শনের বহিঃপ্রকাশ। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, ‘আল্লাহর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য’ (সূরা আর-রুম, আয়াত ২২)।
মাতৃভাষার মাধ্যমে অন্য ভাষার মানুষকে, অন্য ভাষার মানুষের চিন্তা-চেতনা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও কৃষ্টি সহজে জানা যায়, আয়ত্ত করা যায়, নিজ অনুভবে নিয়ে এসে তাকে আত্মস্থ করা যায় হৃদয়ের গভীরতম প্রদেশে। মাতৃভাষা অতি সহজেই একজন মানুষের ব্যক্তি সত্তার অন্তর্গত হয়ে যায়। তাই নবী-রাসূলগণকে আল্লাহ যে অঞ্চলে প্রেরণ করেছেন, তাঁদেরকে সে অঞ্চলের মানুষের ভাষাভাষী করেছেন। এ মর্মে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি প্রত্যেক রাসূলকেই তার নিজ কওমের ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছি, তাদের নিকট সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য’ (সূরা ইব্রাহীম, আয়াত ৪)। এ আয়াতে সু্স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, মাতৃভাষার মাধ্যমে যত সহজে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে মানুষকে বোঝানো সম্ভব হয়, অন্য কোনো ভাষায় বোঝানো ও প্রকাশ করা তত সহজ হয় না। এজন্যই আল্লাহ নবী-রাসূলগণকে তাঁদের নিজ নিজ সম্প্রদায়ের ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছিলেন। হিব্রু ভাষাভাষী অঞ্চলে আল্লাহ হিব্রুভাষী নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন এবং তাঁর নিকট আল্লাহ হিব্রু ভাষায়ই কিতাব নাযিল করেছেন। যেমন তাওরাত ও ইঞ্জিল।
মহানবী মুহাম্মদ (সাঃ)-এর ভাষা ছিল আরবি। তার নিকট অবতীর্ণ মানবতার মুক্তির দিশারি কোরআনের ভাষাও ছিল আরবি। রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর প্রতি আরবি ভাষায় কোরআন নাজিল হওয়া সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘আমি আপনার ভাষায় কোরআনকে সহজ করে দিয়েছি, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে’ (সূরা আদ-দুখান, আয়াত ৫৮)।
অন্যত্র তিনি বলেন, ‘আমি আপনার প্রতি কোরআন নাযিল করেছি আরবি ভাষায় যাতে আপনি সতর্ক করতে পারেন মক্কা ও তার চতুর্দিকের জনগণকে এবং সতর্ক করতে পারেন রোজ হাশর সম্পর্কে’ (সূরা আশ-শূরা, আয়াত ৭)। তিনি আরও বলেন, ‘আমি এটা নাযিল করেছি আরবি ভাষায় কোরআন রূপে, যাতে তোমরা অনুধাবন করতে পার’ (সূরা আয-যুখরুফ, আয়াত-৩)।
কোরআনুল কারিমের বর্ণিত আয়াতগুলো থেকে জানা যায় যে, ইসলাম মাতৃভাষার উপর অশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। এ কারণে দেখা যায় যে, পরবর্তীকালে ইসলাম প্রচারকরা পৃথিবীর যে অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে গমন করেছেন, সে এলাকার মানুষের ভাষা তারা আয়ত্ত করে ওই ভাষাতেই ইসলামের বাণী, হকের দাওয়াত মানুষের সামনে পেশ করেছেন। মানবতার মুক্তির নির্ভুল দিশারি ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী, হেদায়াতের আলোকবর্তিকা মহাগ্রন্থ আল কোরআন মাতৃভাষাকে অশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। কেননা ইবাদত-উপাসনায়, দ্বীনের জ্ঞানার্জন ও মহান আল্লাহর আরাধনায় মাতৃভাষা মানুষকে যথার্থভাবে অনুপ্রাণিত করে। তাই মাতৃভাষার গুরুত্ব অনুধাবন করে আমাদেরকেও মাতৃভাষার সেবায়, মাতৃভাষার উন্নয়নে, মাতৃভাষার শ্রীবৃদ্ধিতে আত্মনিয়োগ করতে হবে।
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক
ন্যায়বিচারে ব্যর্থ হলে আল্লাহর লানত
রাষ্ট্রীয় শাসনকার্য ও বিচারকার্য পরিচালনা করা একটি পুণ্যমূলক ইবাদত। এর সম্পর্ক মানুষের সঙ্গে। তবে যেসব ইবাদত মানুষের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সেগুলোর বিপদাশঙ্কাও বেশি। তবে কোনোটিতে কম কোনোটিতে বেশি মাত্রায় বিপদ। সর্বাধিক বিপদের কাজ হলো শাসনকার্য ও বিচারকার্য পরিচালনা করা। শাসনকার্য ও বিচার যদি ইনসাফ, ইখলাছ এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হয় তবে উত্তম আমল। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা কর তখন ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে বিচার করবে।’ (নিসা : ৫৮)। অন্যত্র এসেছে, ‘বল আমার পালনকর্তা নির্দেশ দিয়েছেন ন্যায়বিচারের।’ (আরাফ : ২৯)। পবিত্র কোরআনে আরও এসেছে, ‘আর যদি বিচার নিষ্পত্তি কর, তবে ন্যায়বিচার কর, আল্লাহ ন্যায়বিচারকদের ভালোবাসেন।’ (মায়িদাহ : ৪২)।
মহানবীর (সা.) হাদিসে এসেছে, ‘ন্যায়পরায়ণ শাসকের একদিন, অন্যব্যক্তির একাকী ষাট বছরের ইবাদতের সমান।’ (তাবরানী)। অন্য হাদিসে এসেছে, সর্বপ্রথম তিন ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে, তাদের একজন ন্যায়বিচারক শাসক। (মুসলিম)। আরেক হাদিসে এসেছে, তিন ব্যক্তির দোয়া প্রত্যাখ্যান করা হয় না, তাদের একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক।’ মহানবী (সা.) আরও বলেন, কিয়ামতের দিনে আমার অধিক কাছে বসবে ন্যায়পরায়ণ শাসক।’
এতে প্রমাণিত হয় যে, ন্যায়বিচার একটি মহান ইবাদত এবং অনেক বড় নেকির কাজ।
পক্ষান্তরে ন্যায়বিচার পরিহার করলে বিপদাশঙ্কাও বেশি। উপরে বর্ণিত হাদিসের মাধ্যমে অনুভূত হয়েছে যে, জালিম শাসকের একদিন একজন ফাসিকের ষাট বছরের পাপের সমান। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তদনুসারে যারা বিধান দেয় না তারা কাফির।’ (মায়িদাহ : ৪৪)। ‘আল্লাহ তায়ালা যে বিধান অবতীর্ণ করেছেন, যে ব্যক্তি সে অনুযায়ী বিচার মীমাংসা করে না সে ফাসিক।’ (মায়িদাহ: ৪৭)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি দশ ব্যক্তিরও শাসক হয় সে ব্যক্তি কিয়ামতের দিনে এমতাবস্থায় হাজির হবে যে, তার হাত ঘাড়ের সঙ্গে বাঁধা থাকবে। তার ন্যায়পরায়ণতা তাকে মুক্ত করবে অথবা তার জুলুম তাকে ধ্বংস করবে’ (আহমদ)। হজরত আবুবকর সিদ্দিক (রা) বলেন, ‘যে ব্যক্তি শাসক নিযুক্ত হওয়ার পর ইনসাফ করে না, তার উপর আল্লাহর লানত আপতিত হয়।’
জ সী ম উ দ্দী ন খা ন পা ঠা ন
মহানবীর (সা.) হাদিসে এসেছে, ‘ন্যায়পরায়ণ শাসকের একদিন, অন্যব্যক্তির একাকী ষাট বছরের ইবাদতের সমান।’ (তাবরানী)। অন্য হাদিসে এসেছে, সর্বপ্রথম তিন ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে, তাদের একজন ন্যায়বিচারক শাসক। (মুসলিম)। আরেক হাদিসে এসেছে, তিন ব্যক্তির দোয়া প্রত্যাখ্যান করা হয় না, তাদের একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক।’ মহানবী (সা.) আরও বলেন, কিয়ামতের দিনে আমার অধিক কাছে বসবে ন্যায়পরায়ণ শাসক।’
এতে প্রমাণিত হয় যে, ন্যায়বিচার একটি মহান ইবাদত এবং অনেক বড় নেকির কাজ।
পক্ষান্তরে ন্যায়বিচার পরিহার করলে বিপদাশঙ্কাও বেশি। উপরে বর্ণিত হাদিসের মাধ্যমে অনুভূত হয়েছে যে, জালিম শাসকের একদিন একজন ফাসিকের ষাট বছরের পাপের সমান। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তদনুসারে যারা বিধান দেয় না তারা কাফির।’ (মায়িদাহ : ৪৪)। ‘আল্লাহ তায়ালা যে বিধান অবতীর্ণ করেছেন, যে ব্যক্তি সে অনুযায়ী বিচার মীমাংসা করে না সে ফাসিক।’ (মায়িদাহ: ৪৭)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি দশ ব্যক্তিরও শাসক হয় সে ব্যক্তি কিয়ামতের দিনে এমতাবস্থায় হাজির হবে যে, তার হাত ঘাড়ের সঙ্গে বাঁধা থাকবে। তার ন্যায়পরায়ণতা তাকে মুক্ত করবে অথবা তার জুলুম তাকে ধ্বংস করবে’ (আহমদ)। হজরত আবুবকর সিদ্দিক (রা) বলেন, ‘যে ব্যক্তি শাসক নিযুক্ত হওয়ার পর ইনসাফ করে না, তার উপর আল্লাহর লানত আপতিত হয়।’
জ সী ম উ দ্দী ন খা ন পা ঠা ন
মদিনা সনদ : শান্তির উদারনীতি
মো হা ম্ম দ কা ম রু ল ই স লা ম
রাসূল (সা.) আগমনের আগে এক সংকটময় মুহূর্ত অতিক্রম করেছিল আরবসহ সারাবিশ্ব। ইতিহাসে তাকে আইয়ামে জাহেলিয়ার যুগ বলা হয়। এ সময় সর্বত্র বিরাজ করছিল অশান্তির দাবানল। এ ক্রান্তিকালীন কাণ্ডারি হয়ে এসেছিলেন আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। প্রথমদিকে দ্বিধাবিভক্ত ও কলহপ্রিয় জাতিকে একটি আদর্শের ছায়াতলে নিয়ে আসতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। মক্কাবাসী তাকে সাদরে গ্রহণ না করায় তিনি হিজরত করে মদিনা চলে গিয়েছিলেন। মদিনার অধিবাসীদের মধ্যে এক আত্মার বন্ধন সৃষ্টি করেছিলেন। যে মূলমন্ত্রের মাধ্যমে তিনি এ বন্ধনটি তৈরি করেছিলেন সেটি মানবতার মুক্তির সনদ হিসেবে খ্যাত ‘মদিনা সনদ’। ঐতিহাসিক M.Watt এ সনদকে ঈড়হংঃরঃঁঃরড়হ ড়ভ গধফরহধ' বলে অভিহিত করেছেন। যা ছিল যে কোনো সময়ের জন্য মানবতার মুক্তির এক মহাসনদ।
রাসূল (সা.) আল্লাহর নির্দেশে ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মদিনায় হিজরত করেন। এ সময় তিনি দেখলেন, মদিনায় বিভিন্ন গোত্র, উপগোত্র ও বিভিন্ন মতাদর্শের অনুসারীরা বসবাস করছে। এরা ছিল মোটামুটি পাঁচ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। ১. মদিনায় আদি পৌত্তলিক সম্প্রদায়, ২. ইহুদি সম্প্রদায়, ৩. খ্রিস্টান সম্প্রদায়, ৪. নবী দীক্ষিত মুসলিম সম্প্রদায় (আনসার), ৫. মক্কা থেকে আগত মুসলিম সম্প্রদায় (মুহাজির)। তখন মদিনা বসবাসরত সম্প্রদায়ের মধ্যে সদ্ভাব ছিল না। তাদের মধ্যে আদর্শের মিল তো ছিলই না, তদুপরি বিরাজ করছিল জাতিগত হিংসা-বিদ্বেষ। যার ফলে মদিনার ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। আইনের শাসন ছিল না।
মহানবী (সা.) মদিনায় বিরাজমান এ পরিস্থিতিতে বিবদমান গোত্রগুলোর মধ্যে আন্তঃবিরোধ মিটিয়ে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে একটি জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করতে প্রচেষ্টা চালান। আর এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন ছিল কলহে লিপ্ত সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে ঐক্য ও সদ্ভাব সৃষ্টি করা। এ ছাড়াও প্রয়োজন ছিল জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সব নাগরিকের সমান অধিকার ও কর্তব্য নির্ধারণ এবং মুহাজিরদের মদিনায় বাসস্থান ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। কারণ যে দেশে বিভিন্ন ধর্মমত ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোক বাস করে সে দেশে পরমত সহিষ্ণুতার প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি ও ঐক্য না থাকলে দেশের কল্যাণ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। ফলে মহানবী (সা.) মদিনার সব সম্প্রদায়ের সঙ্গে বৈঠক করে আন্তঃসাম্প্রদায়িক ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ করার লক্ষ্যে ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে মদিনায় বসবাসকারী সব সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি সন্ধি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এ চুক্তিটি ঐতিহাসিক ‘মদিনা সনদ’ নামি পরিচিত। বিশ্বের ইতিহাসে ‘মদিনা সদন’ অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি সনদ। এর মাধ্যমে রাসূল (সা.) এর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞার প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ড. গঁরত্ এর মতে, ‘মদিনা সদন’ শুধু সে যুগে কেন, বরং সর্বযুগে ও সর্বকালে হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর অসামান্য মাহাত্ম্য ও অপূর্ব মননশীলতা ঘোষণা করবে।’
মদিনা সনদ পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম লিখিত সংবিধান এবং একে মহাসনদও বলা যেতে পারে। আরবি ভাষায় লিখিত এ সনদের মোট ৪৭টি ধারা ছিল। কয়েকটি প্রধান ধারা নিম্নে উল্লেখ করা হলো।
* মদিনা সনদে স্বাক্ষরকারী ইহুদি, খ্রিস্টান, পৌত্তলিক ও মুসলমান সম্প্রদায়গুলো সমান নাগরিক অধিকার ভোগ করবে এবং তারা একটি সমন্বিত জাতি (কমনওয়েলথ) গঠন করবে।
* পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা বজায় থাকবে, মুসলমান ও অমুসলমান সম্প্রদায়ের লোকেরা বিনা দ্বিধায় নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারবে। কেউ কারো ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
* রক্তপাত, হত্যা, বলাত্কার এবং অপরাপর গর্হিত কার্যকলাপ একেবারেই নিষিদ্ধ করা হলো।
* দুর্বল ও অসহায়কে সর্বতোভাবে সাহায্য ও রক্ষা করতে হবে।
* ইহুদিদের মিত্ররাও সমান নিরাপত্তা ভোগ করবে।
মদিনা সনদের উপহারে বলা হয়, আল্লাহ এ সনদের সত্যিকার বাস্তবায়নকারী। অন্যায়কারীকে বা বিশ্বাসঘাতককে এ সনদ প্রশ্রয় দেয় না।
মদিনা সদন বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র। রাসূল (সা.) আবির্ভাবের আগ পর্যন্ত বিশ্বের কোনো শাসকই জনগণকে কোনো লিখিত শাসনতন্ত্র উপহার দিতে পারেনি। এ শাসনতন্ত্রের মাধ্যমে মহানবী (সা.) বিভিন্ন সম্প্রদায়কে একটি শক্তিশালী জাতি হিসেবে গড়ে তোলেন এবং তারা একত্রে মিলেমিশে বসবাস করার সুযোগ পান। ফলে তাদের মধ্যে গোত্রীয় ধারণার পরিবর্তে একটি রাজনৈতিক ঐক্যের সৃষ্টি হয় এবং মদিনা সনদের মাধ্যমেই প্রথম দেশভিত্তিক জাতীয়তাবোধের সৃষ্টি হয়। মদিনার সামাজিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে উচ্ছৃঙ্খলা রহিত হয় এবং সুশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়। যা নব্য প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্র মদিনার প্রশাসনিক ভিত্তিকে অনেক শক্ত করে তোলে এবং ইসলাম আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিস্তার লাভ করার সুযোগ পায়।
মদিনা সনদ থেকে যে শিক্ষা পাওয়া যায় তা হলো—মদিনা রাষ্ট্র ও জনগণের ওপর মহানবীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ, সব নাগরিকের নিজ নিজ ধর্ম, নিজস্ব সংস্কৃতি ইত্যাদি পালনের অধিকার। শত্রুর আক্রমণ থেকে নিজেদের নিরাপদ রাখার জন্য একের প্রতি অপরের সহযোগিতা এবং অন্যের মত ও বিশ্বাসের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার মানসিকতা ও যোগ্য নেতৃত্বের আনুগত্য মেনে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলা। কারণ তখনকার দিনে সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের অধিকারী ছিলেন স্বয়ং রাসূল (সা.) এবং তিনি হয়েছিলেন নবগঠিত মদিনা প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রনায়ক।
মদিনা সনদ ছিল বিশ্বের ইতিহাসের প্রথম আন্তর্জাতিক চুক্তির ধারণা। এ চুক্তির নীতিমালাগুলো বিশ্লেষণ করলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শান্তি প্রতিষ্ঠার অনেক মূল্যবান উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়। এ সনদে ব্যক্তিগত বা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, ন্যায্য স্বার্থ সংরক্ষণ, ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে স্বাধীনতা এবং পরস্পরের প্রতি সুসম্পর্কের ভিত্তি নিশ্চিত করা হয়েছিল। যার ফলে অশান্ত মদিনায় শান্তির সুবাতাস বইতে শুরু করেছিল। শান্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মহানবী (সা.) মদিনা নামক যে ইসলামী রাষ্ট্রটির গোড়াপত্তন করেছিলেন তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব তদানীন্তন বিশ্বের সর্বত্র প্রতিফলিত হয়েছিল।
মদিনা সদনের এ সাফল্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বৃহত্তর সনদ স্বাক্ষরের পথকে সুগম করে। এমনিভাবে এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিকতাবাদের সূচনা হয়। বর্তমান বিশ্বের শান্তি-সংহতি ও নিরাপত্তা বিধানের জন্য জাতিসংঘ গঠন করা হয়েছে। সে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার ধারণা মদিনা সনদের মধ্যেই পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে আরনল্ড টয়েনবীর তার ডরংফড়স ড়ভ গঁযধসসধফ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ‘ইসলামই প্রকৃত জাতিপুঞ্জ গঠনের ধারণা দিয়েছিল। এ ধারণাই সঠিক ও প্রয়োগযোগ্য।’
রাসূল (সা.) আল্লাহর নির্দেশে ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মদিনায় হিজরত করেন। এ সময় তিনি দেখলেন, মদিনায় বিভিন্ন গোত্র, উপগোত্র ও বিভিন্ন মতাদর্শের অনুসারীরা বসবাস করছে। এরা ছিল মোটামুটি পাঁচ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। ১. মদিনায় আদি পৌত্তলিক সম্প্রদায়, ২. ইহুদি সম্প্রদায়, ৩. খ্রিস্টান সম্প্রদায়, ৪. নবী দীক্ষিত মুসলিম সম্প্রদায় (আনসার), ৫. মক্কা থেকে আগত মুসলিম সম্প্রদায় (মুহাজির)। তখন মদিনা বসবাসরত সম্প্রদায়ের মধ্যে সদ্ভাব ছিল না। তাদের মধ্যে আদর্শের মিল তো ছিলই না, তদুপরি বিরাজ করছিল জাতিগত হিংসা-বিদ্বেষ। যার ফলে মদিনার ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। আইনের শাসন ছিল না।
মহানবী (সা.) মদিনায় বিরাজমান এ পরিস্থিতিতে বিবদমান গোত্রগুলোর মধ্যে আন্তঃবিরোধ মিটিয়ে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে একটি জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করতে প্রচেষ্টা চালান। আর এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন ছিল কলহে লিপ্ত সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে ঐক্য ও সদ্ভাব সৃষ্টি করা। এ ছাড়াও প্রয়োজন ছিল জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সব নাগরিকের সমান অধিকার ও কর্তব্য নির্ধারণ এবং মুহাজিরদের মদিনায় বাসস্থান ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। কারণ যে দেশে বিভিন্ন ধর্মমত ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোক বাস করে সে দেশে পরমত সহিষ্ণুতার প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি ও ঐক্য না থাকলে দেশের কল্যাণ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। ফলে মহানবী (সা.) মদিনার সব সম্প্রদায়ের সঙ্গে বৈঠক করে আন্তঃসাম্প্রদায়িক ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ করার লক্ষ্যে ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে মদিনায় বসবাসকারী সব সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি সন্ধি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এ চুক্তিটি ঐতিহাসিক ‘মদিনা সনদ’ নামি পরিচিত। বিশ্বের ইতিহাসে ‘মদিনা সদন’ অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি সনদ। এর মাধ্যমে রাসূল (সা.) এর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞার প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ড. গঁরত্ এর মতে, ‘মদিনা সদন’ শুধু সে যুগে কেন, বরং সর্বযুগে ও সর্বকালে হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর অসামান্য মাহাত্ম্য ও অপূর্ব মননশীলতা ঘোষণা করবে।’
মদিনা সনদ পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম লিখিত সংবিধান এবং একে মহাসনদও বলা যেতে পারে। আরবি ভাষায় লিখিত এ সনদের মোট ৪৭টি ধারা ছিল। কয়েকটি প্রধান ধারা নিম্নে উল্লেখ করা হলো।
* মদিনা সনদে স্বাক্ষরকারী ইহুদি, খ্রিস্টান, পৌত্তলিক ও মুসলমান সম্প্রদায়গুলো সমান নাগরিক অধিকার ভোগ করবে এবং তারা একটি সমন্বিত জাতি (কমনওয়েলথ) গঠন করবে।
* পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা বজায় থাকবে, মুসলমান ও অমুসলমান সম্প্রদায়ের লোকেরা বিনা দ্বিধায় নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারবে। কেউ কারো ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
* রক্তপাত, হত্যা, বলাত্কার এবং অপরাপর গর্হিত কার্যকলাপ একেবারেই নিষিদ্ধ করা হলো।
* দুর্বল ও অসহায়কে সর্বতোভাবে সাহায্য ও রক্ষা করতে হবে।
* ইহুদিদের মিত্ররাও সমান নিরাপত্তা ভোগ করবে।
মদিনা সনদের উপহারে বলা হয়, আল্লাহ এ সনদের সত্যিকার বাস্তবায়নকারী। অন্যায়কারীকে বা বিশ্বাসঘাতককে এ সনদ প্রশ্রয় দেয় না।
মদিনা সদন বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র। রাসূল (সা.) আবির্ভাবের আগ পর্যন্ত বিশ্বের কোনো শাসকই জনগণকে কোনো লিখিত শাসনতন্ত্র উপহার দিতে পারেনি। এ শাসনতন্ত্রের মাধ্যমে মহানবী (সা.) বিভিন্ন সম্প্রদায়কে একটি শক্তিশালী জাতি হিসেবে গড়ে তোলেন এবং তারা একত্রে মিলেমিশে বসবাস করার সুযোগ পান। ফলে তাদের মধ্যে গোত্রীয় ধারণার পরিবর্তে একটি রাজনৈতিক ঐক্যের সৃষ্টি হয় এবং মদিনা সনদের মাধ্যমেই প্রথম দেশভিত্তিক জাতীয়তাবোধের সৃষ্টি হয়। মদিনার সামাজিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে উচ্ছৃঙ্খলা রহিত হয় এবং সুশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়। যা নব্য প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্র মদিনার প্রশাসনিক ভিত্তিকে অনেক শক্ত করে তোলে এবং ইসলাম আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিস্তার লাভ করার সুযোগ পায়।
মদিনা সনদ থেকে যে শিক্ষা পাওয়া যায় তা হলো—মদিনা রাষ্ট্র ও জনগণের ওপর মহানবীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ, সব নাগরিকের নিজ নিজ ধর্ম, নিজস্ব সংস্কৃতি ইত্যাদি পালনের অধিকার। শত্রুর আক্রমণ থেকে নিজেদের নিরাপদ রাখার জন্য একের প্রতি অপরের সহযোগিতা এবং অন্যের মত ও বিশ্বাসের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার মানসিকতা ও যোগ্য নেতৃত্বের আনুগত্য মেনে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলা। কারণ তখনকার দিনে সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের অধিকারী ছিলেন স্বয়ং রাসূল (সা.) এবং তিনি হয়েছিলেন নবগঠিত মদিনা প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রনায়ক।
মদিনা সনদ ছিল বিশ্বের ইতিহাসের প্রথম আন্তর্জাতিক চুক্তির ধারণা। এ চুক্তির নীতিমালাগুলো বিশ্লেষণ করলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শান্তি প্রতিষ্ঠার অনেক মূল্যবান উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়। এ সনদে ব্যক্তিগত বা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, ন্যায্য স্বার্থ সংরক্ষণ, ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে স্বাধীনতা এবং পরস্পরের প্রতি সুসম্পর্কের ভিত্তি নিশ্চিত করা হয়েছিল। যার ফলে অশান্ত মদিনায় শান্তির সুবাতাস বইতে শুরু করেছিল। শান্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মহানবী (সা.) মদিনা নামক যে ইসলামী রাষ্ট্রটির গোড়াপত্তন করেছিলেন তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব তদানীন্তন বিশ্বের সর্বত্র প্রতিফলিত হয়েছিল।
মদিনা সদনের এ সাফল্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বৃহত্তর সনদ স্বাক্ষরের পথকে সুগম করে। এমনিভাবে এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিকতাবাদের সূচনা হয়। বর্তমান বিশ্বের শান্তি-সংহতি ও নিরাপত্তা বিধানের জন্য জাতিসংঘ গঠন করা হয়েছে। সে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার ধারণা মদিনা সনদের মধ্যেই পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে আরনল্ড টয়েনবীর তার ডরংফড়স ড়ভ গঁযধসসধফ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ‘ইসলামই প্রকৃত জাতিপুঞ্জ গঠনের ধারণা দিয়েছিল। এ ধারণাই সঠিক ও প্রয়োগযোগ্য।’
রাসুলুল্লাহর (সা.) সাহিত্যানুরাগ
রাসুলুল্লাহ (সা.) ছিলেন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল। তার জীবনের মিশন ছিল সত্যের পয়গাম ও শাশ্বত দ্বীনের প্রচার-প্রসার। কিন্তু তিনি যেমন একজন রাসুল ছিলেন, তেমনি ছিলেন একজন মানুষও। সাধারণ মানুষের মতো তারও অনুভব, অনুভূতি ও লেনদেনের প্রয়োজন হতো। মানুষ হিসেবে সেই মুহূর্তগুলো তাকে পীড়িত করেছে। আপনজনের প্রতি ভালোবাসা, বিপদে ব্যথিত হওয়া এবং সুখের সময় আনন্দ প্রকাশ করার ক্ষেত্রে তিনি অন্যান্য মানুষের ব্যতিক্রম ছিলেন না। সেসব মুহূর্তে তিনি অলঙ্কার ও সাহিত্যপূর্ণ সাবলীল ভাষায় মনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন। একাডেমিক শিক্ষা তাঁর ছিল না। তার জ্ঞানের উত্স ছিল আসমানি ওহী। তাই তার সাহিত্যও ছিল ঐশী শক্তিতে বলীয়ান। শুদ্ধ বাচনভঙ্গি, অতিপ্রভাবক বিষয়বস্তু নিরূপণ, সাবলীল উপস্থাপনা ও হৃদয়স্পর্শী ব্যাখ্যায় তিনি ছিলেন অতুলনীয়।
যেহেতু তিনি উম্মী ছিলেন, তাই লেখ্য-সাহিত্যে তার কোনো ছাপ পাওয়া যায় না। কিন্তু কথ্য-সাহিত্যের পুরোপুরি বৈশিষ্ট্য তার মধ্যে ছিল। তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন স্প্পষ্টভাষী বংশ কুরাইশে। বেড়ে উঠেছেন বিশুদ্ধভাষী গোত্র বনু সাদে। অলঙ্কারপূর্ণ কালাম কোরআনুল কারিম দ্বারা তার পরবর্তী পাথেয় সঞ্চিত হয়েছে। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তার বিচরণ লক্ষণীয়। যেমন—কথাবার্তা, সংম্বোধন, ঘটনা বর্ণনা, উপদেশ দান, দোয়া ও অনুভূতি প্রকাশে তিনি তার সাহিত্যচেতা মনের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। এজন্য তার ভাষায় ছিল সম্মোহনী শক্তি। এর টানে অনেকেই ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছেন।
কোরআন ও হাদিসের সাহিত্যভাণ্ডার আরবি গদ্য সাহিত্যে সমৃদ্ধি আনে। তবে কবিতাপ্রীতিও নবীজীর মধ্যে কোনো অংশে কম ছিল না। কবিতার ছন্দে, ভাব ও অনুভূতিতে যে অভিব্যক্তি প্রকাশ পায় রাসুল (সা.) তা যথাযথ অনুভব করতেন। সাহাবায়ে কেরামের কবিতা আবৃত্তিকে পছন্দের দৃষ্টিতে দেখতেন। বরং যেসব কবি মুসলমান হয়েছিলেন, তিনি তাদের কবিতাকে দ্বীনের সাহায্যার্থে প্রয়োগ করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন। কবি হাসসান ইবনে সাবিত (রা.) ছিলেন রাসুলের কবি। রাসুলের ওপর আরোপিত বিভিন্ন অপবাদের জবাবদানে তিনি তার কাব্যপ্রতিভাকে কাজে লাগিয়েছেন। রাসুল (সা.) তাকে উত্সাহিত করে বলেন ‘ইসলামের খেদমত ঢাল-তলোয়ারে যেমন করা যায়, তেমনি কবিতা ও সাহিত্যের মাধ্যমেও করা যায়।’
কবিতা আবৃত্তির দ্বারা আবেগে আপ্লুত হওয়ার ঘটনাও হাদিসে পাওয়া যায়। মক্কা বিজয়ের সময় কিছু লোককে ইসলামের প্রতি চরম বিদ্বেষ পোষণের কারণে সাধারণ ক্ষমার আওতাভুক্ত করা হয়নি। তাদের সবাইকে হত্যার নির্দেশ দেয়া হয়। এদের মধ্যে কুরাইশদের এক ব্যক্তি ছিল। তাকে হত্যা করার পর তার বোন রাসুলের (সা.) দরবারে এসে আবেগঝরা ও হৃদয়গ্রাহী ভাষায় কবিতা আবৃত্তি করতে থাকে। এ কবিতা রাসুলের মধ্যে বিরাট প্রভাব ফেলে। কবিতা শুনে তিনি আফসোস করে বললেন, ‘এই কবিতা যদি আগে শুনতাম তবে তাকে মাফ করে দিতাম।’ স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে কখনও তার নিজের মুখ থেকে কবিতার ছন্দ বেরিয়ে যেত। কিন্তু কাফেররা যেহেতু তার ওপর অবতীর্ণ আল্লাহর বাণীকে স্বরচিত কবিতা বলে অপপ্রচার চালাতো, সে জন্য তিনি অনেকটা ইচ্ছাকৃতভাবেই তা থেকে বিরত থাকতেন। কোরআনে এরশাদ হচ্ছে, ‘আমি তাঁকে (রাসুলকে) কবিতা রচনা শিক্ষা দিইনি এবং এরকম কাজ তার পক্ষে শোভনও নয়।’
রাসুলের (সা.) অসংখ্য হাদিসের মধ্যে গদ্য সাহিত্যের কথ্যরূপ স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে আছে। প্রিয় ছেলে ইবরাহিমের ইন্তেকালের পর দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ের অভিব্যক্তি প্রকাশ পায়। একদিকে দাসত্বের প্রতি পূর্ণ দৃষ্টি, যেন সীমা লঙ্ঘন না হয়ে যায়; অন্যদিকে মানব-প্রকৃতির চিরায়ত রীতির বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন জড়তাহীন ও মর্মস্পর্শী ভাষায়। তিনি তখন বলেছিলেন ‘অন্তর ব্যথিত, চক্ষুদ্বয় অশ্রুসিক্ত, কিন্তু আমি বলব সে কথাই, যাতে আমার প্রভু সন্তুষ্ট; হে ইবরাহিম! তোমার বিরহে আমি ভারাক্রান্ত।’ নারীদের কোমল স্বভাবের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘তারা স্বচ্ছ কোমল স্ফটিকের পাত্রের মতো।’ পরস্পর মতবিরোধ ও বিভেদের কোনো অবকাশ নেই—একথা বোঝাতে বলেন ‘এ ব্যাপারে দুটি ছাগল পরস্পরে শিং নাড়াতে পারবে না।।’
রাসুল (সা.) তার বিবিদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ পরিবেশে কথা বলার সময়ও সাহিত্যপূর্ণতার দিকে দৃষ্টি রাখতেন। একদিন তিনি বিবিদের কাছে অভিজ্ঞতার কথা ব্যক্ত করেন অত্যন্ত সাহিত্যপূর্ণ ও চিত্তাকর্ষক ভাষায়। সেখানে তিনি একটি ঘটনা আকারে কয়েকজন মহিলার নিজ নিজ স্বামী সম্পর্কে মন্তব্য পেশ করেছেন। ‘হাদিসে উম্মে জারা’ নামে সেই বিবরণ বর্ণিত হয়েছে হাদিসের কিতাবগুলোয়। বিশেষভাবে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করার সময় সাহিত্যের ঝলক প্রস্ফুটিত হতো। তার মোনাজাত ও দোয়া এই পরিমাণ প্রভাবক ছিল যে, তা শুধু আরবি সাহিত্যে নতুন ধারার সূচনা করেনি বরং সাহিত্যের উচ্চ শ্রেণীভুক্ত হয়ে যায়। উপস্থাপনের দিক থেকে এগুলো যেমন গাম্ভীর্যপূর্ণ, তেমনি তাত্পর্যের দিক থেকেও অনেক উচ্চাঙ্গের। এর সর্বোত্কৃষ্ট দৃষ্টান্ত রাসুলের (সা.) দোয়া, যা তিনি তায়েফের ময়দানে করেছিলেন। এছাড়াও আরাফাতের ময়দানে ও বদর যুদ্ধের রাতের দোয়া, বিদায় হজের ভাষণ ইত্যাদিতে রাসুলের (সা.) সাহিত্যানুরাগের বিশেষ প্রমাণ পাওয়া যায়।
রাসুল (সা.) মানব সভ্যতার উত্কর্ষে যে বিশাল অবদান রেখে গেছেন, তা থেকে সাহিত্যাঙ্গন খালি নয়। এক্ষেত্রেও তার সুস্পষ্ট প্রভাব ও অবদান উদ্ভাসিত।
জ হি র উ দ্দি ন বা ব র
zahirbabor@yahoo.com
যেহেতু তিনি উম্মী ছিলেন, তাই লেখ্য-সাহিত্যে তার কোনো ছাপ পাওয়া যায় না। কিন্তু কথ্য-সাহিত্যের পুরোপুরি বৈশিষ্ট্য তার মধ্যে ছিল। তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন স্প্পষ্টভাষী বংশ কুরাইশে। বেড়ে উঠেছেন বিশুদ্ধভাষী গোত্র বনু সাদে। অলঙ্কারপূর্ণ কালাম কোরআনুল কারিম দ্বারা তার পরবর্তী পাথেয় সঞ্চিত হয়েছে। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তার বিচরণ লক্ষণীয়। যেমন—কথাবার্তা, সংম্বোধন, ঘটনা বর্ণনা, উপদেশ দান, দোয়া ও অনুভূতি প্রকাশে তিনি তার সাহিত্যচেতা মনের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। এজন্য তার ভাষায় ছিল সম্মোহনী শক্তি। এর টানে অনেকেই ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছেন।
কোরআন ও হাদিসের সাহিত্যভাণ্ডার আরবি গদ্য সাহিত্যে সমৃদ্ধি আনে। তবে কবিতাপ্রীতিও নবীজীর মধ্যে কোনো অংশে কম ছিল না। কবিতার ছন্দে, ভাব ও অনুভূতিতে যে অভিব্যক্তি প্রকাশ পায় রাসুল (সা.) তা যথাযথ অনুভব করতেন। সাহাবায়ে কেরামের কবিতা আবৃত্তিকে পছন্দের দৃষ্টিতে দেখতেন। বরং যেসব কবি মুসলমান হয়েছিলেন, তিনি তাদের কবিতাকে দ্বীনের সাহায্যার্থে প্রয়োগ করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন। কবি হাসসান ইবনে সাবিত (রা.) ছিলেন রাসুলের কবি। রাসুলের ওপর আরোপিত বিভিন্ন অপবাদের জবাবদানে তিনি তার কাব্যপ্রতিভাকে কাজে লাগিয়েছেন। রাসুল (সা.) তাকে উত্সাহিত করে বলেন ‘ইসলামের খেদমত ঢাল-তলোয়ারে যেমন করা যায়, তেমনি কবিতা ও সাহিত্যের মাধ্যমেও করা যায়।’
কবিতা আবৃত্তির দ্বারা আবেগে আপ্লুত হওয়ার ঘটনাও হাদিসে পাওয়া যায়। মক্কা বিজয়ের সময় কিছু লোককে ইসলামের প্রতি চরম বিদ্বেষ পোষণের কারণে সাধারণ ক্ষমার আওতাভুক্ত করা হয়নি। তাদের সবাইকে হত্যার নির্দেশ দেয়া হয়। এদের মধ্যে কুরাইশদের এক ব্যক্তি ছিল। তাকে হত্যা করার পর তার বোন রাসুলের (সা.) দরবারে এসে আবেগঝরা ও হৃদয়গ্রাহী ভাষায় কবিতা আবৃত্তি করতে থাকে। এ কবিতা রাসুলের মধ্যে বিরাট প্রভাব ফেলে। কবিতা শুনে তিনি আফসোস করে বললেন, ‘এই কবিতা যদি আগে শুনতাম তবে তাকে মাফ করে দিতাম।’ স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে কখনও তার নিজের মুখ থেকে কবিতার ছন্দ বেরিয়ে যেত। কিন্তু কাফেররা যেহেতু তার ওপর অবতীর্ণ আল্লাহর বাণীকে স্বরচিত কবিতা বলে অপপ্রচার চালাতো, সে জন্য তিনি অনেকটা ইচ্ছাকৃতভাবেই তা থেকে বিরত থাকতেন। কোরআনে এরশাদ হচ্ছে, ‘আমি তাঁকে (রাসুলকে) কবিতা রচনা শিক্ষা দিইনি এবং এরকম কাজ তার পক্ষে শোভনও নয়।’
রাসুলের (সা.) অসংখ্য হাদিসের মধ্যে গদ্য সাহিত্যের কথ্যরূপ স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে আছে। প্রিয় ছেলে ইবরাহিমের ইন্তেকালের পর দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ের অভিব্যক্তি প্রকাশ পায়। একদিকে দাসত্বের প্রতি পূর্ণ দৃষ্টি, যেন সীমা লঙ্ঘন না হয়ে যায়; অন্যদিকে মানব-প্রকৃতির চিরায়ত রীতির বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন জড়তাহীন ও মর্মস্পর্শী ভাষায়। তিনি তখন বলেছিলেন ‘অন্তর ব্যথিত, চক্ষুদ্বয় অশ্রুসিক্ত, কিন্তু আমি বলব সে কথাই, যাতে আমার প্রভু সন্তুষ্ট; হে ইবরাহিম! তোমার বিরহে আমি ভারাক্রান্ত।’ নারীদের কোমল স্বভাবের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘তারা স্বচ্ছ কোমল স্ফটিকের পাত্রের মতো।’ পরস্পর মতবিরোধ ও বিভেদের কোনো অবকাশ নেই—একথা বোঝাতে বলেন ‘এ ব্যাপারে দুটি ছাগল পরস্পরে শিং নাড়াতে পারবে না।।’
রাসুল (সা.) তার বিবিদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ পরিবেশে কথা বলার সময়ও সাহিত্যপূর্ণতার দিকে দৃষ্টি রাখতেন। একদিন তিনি বিবিদের কাছে অভিজ্ঞতার কথা ব্যক্ত করেন অত্যন্ত সাহিত্যপূর্ণ ও চিত্তাকর্ষক ভাষায়। সেখানে তিনি একটি ঘটনা আকারে কয়েকজন মহিলার নিজ নিজ স্বামী সম্পর্কে মন্তব্য পেশ করেছেন। ‘হাদিসে উম্মে জারা’ নামে সেই বিবরণ বর্ণিত হয়েছে হাদিসের কিতাবগুলোয়। বিশেষভাবে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করার সময় সাহিত্যের ঝলক প্রস্ফুটিত হতো। তার মোনাজাত ও দোয়া এই পরিমাণ প্রভাবক ছিল যে, তা শুধু আরবি সাহিত্যে নতুন ধারার সূচনা করেনি বরং সাহিত্যের উচ্চ শ্রেণীভুক্ত হয়ে যায়। উপস্থাপনের দিক থেকে এগুলো যেমন গাম্ভীর্যপূর্ণ, তেমনি তাত্পর্যের দিক থেকেও অনেক উচ্চাঙ্গের। এর সর্বোত্কৃষ্ট দৃষ্টান্ত রাসুলের (সা.) দোয়া, যা তিনি তায়েফের ময়দানে করেছিলেন। এছাড়াও আরাফাতের ময়দানে ও বদর যুদ্ধের রাতের দোয়া, বিদায় হজের ভাষণ ইত্যাদিতে রাসুলের (সা.) সাহিত্যানুরাগের বিশেষ প্রমাণ পাওয়া যায়।
রাসুল (সা.) মানব সভ্যতার উত্কর্ষে যে বিশাল অবদান রেখে গেছেন, তা থেকে সাহিত্যাঙ্গন খালি নয়। এক্ষেত্রেও তার সুস্পষ্ট প্রভাব ও অবদান উদ্ভাসিত।
জ হি র উ দ্দি ন বা ব র
zahirbabor@yahoo.com
নবী জীবনের ঘটনা : পবিত্র যন্ত্রণা
অবশেষে কামরায় ঢুকে পড়লেন উমর (রা.)। আর অপেক্ষা করতে পারলেন না। অপেক্ষার প্রয়োজনও ছিল না। একবার, দু’বার এবং তিনবার অনুমতি চাওয়ার পর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে কামরার ভেতরে এসে হাজির হওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ্র মুখোমুখি দাঁড়ানোর জন্য বিপুল বেচাইনির ঝড়ে তিনি আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। অন্য রকম একটি ভার ভার যন্ত্রণা ও কষ্ট তাঁকে কুঁকরে তুলছিল। উমর (রা.) তাঁর বিনীত দুটি চোখ, সমব্যথি ও কাতর দুটি চোখ মেলে দেখলেন রাসূলুল্লাহ (সা.) দড়ির খাটিয়ার উপর শুয়ে আছেন। নির্জনে, নিঃশব্দে একটি ঘরে তাঁর এই শুয়ে থাকা দেখে উমরের হৃদয়ে অসম্ভব কষ্টের তুষারপাত শুরু হলো। দুঃখের এক পশলা হাহাকার তার অন্তর আর্দ্র করে তুলল। কী বলবেন, কী করবেন, কোনো কিছুই ঠিক করতে পারছেন না। প্রশ্ন কৌতূহল আর কষ্টের ধারালো অনুভবগুলোই তাঁর এখানে এসে আরও তীক্ষষ্ট হয়ে উঠেছে।
গত রাতে রাসূলুল্লাহ্র একটি ব্যক্তিগত কষ্টের কথা, দুঃখের কথা, মনোযাতনা ও যন্ত্রণার কথা শুনে উমরের ব্যাকুলতা রাতের ঘুমে নিরন্তর আঘাত করেছে। ফজরের জামাতে এসে তিনি দৌড়ে শামিল হয়েছেন মদীনায়। জামাতের পর রাসূলুল্লাহ্ (সা.) সময়ক্ষেপণ না করে আবারও নির্জন অন্দরে চলে আসায় উমর (রা.) বিহ্বল হয়ে মসজিদে বসেছিলেন কিছুক্ষণ। মাঝে দু’বার এসে অনুমতি চেয়েছিলেন; অনুমতি মিলেনি। অবশেষে এক বুকফাটা-আব্দার তিনি রাসূলুল্লাহ্র (সা.) দরবারে পাঠালেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাঁকে অনুমতি দিলেন এবং এরপর তিনি কামরায় ঢুকলেন।
উমর (রা.) রাসূলুল্লাহ্র (সা.) মুখোমুখি হয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাঁকে দেখছিলেন। তাঁর পারিবারিক একটি সঙ্কটে, দাম্পত্যের একটি সমস্যায় তিনি কতটা কষ্টের মধ্যে আছেন, সবার অগোচরে, কতটা নিঃশব্দ দুঃখের মধ্যে প্রহর কাটছে তাঁর, উমর (রা.) সম্ভবত তা-ই লক্ষ্য করছেন। উমর (রা.) তাঁর দু’চোখ মেলে রাসূলুল্লাহেক (সা.) দেখলেন। দেখলেন সাধারণ একটি দড়ির খাটে শুয়ে আছেন তিনি। তাঁর গায়ে দড়ির দাগ পড়ে গেছে। কোমল ত্বকে দারিদ্র্যের নিষ্ঠুর আঁচড়ের মতোই সেই দাগ জ্বল জ্বল করছে। উমর (রা.) দেখলেন আসবাবপত্রহীন, আয়োজনহীন, বিত্তহীন এই কামরার এক পাশে রাখা আছে সামান্য যব, আরবের মোটা খাবার। আরেক পাশে একটি খুঁটিতে ঝুলছে সামান্য একটি শুর চামড়া। উল্লেখ করার মতো তেমন আর কোনো আসবাবপত্র ঘরে নেই।
দেখতে দেখতেই উমরের বোধগুলো ঝাপসা হয়ে এলো। মুষলধারে নেমে আসা বৃষ্টিতে হঠাত্ আক্রান্ত পথিকের মতো উমরের হৃদয় কাকভেজা হয়ে গেল। নিয়ন্ত্রণের শক্ত পিঞ্জর ভেঙে গেল তাঁর। উমর (রা.) ডুকরে কেঁদে উঠলেন। কাঁদতেই লাগলেন। দু’চোখ বেয়ে বিন্দু বিন্দু কষ্টের ভাঁপ কপাল বেয়ে নেমে আসতে লাগল। উমর (রা.) এক সীমানাহীন ভালোবাসার ভুবন, হাহাকারের ভুবন, পবিত্র যন্ত্রণার ভুবনে বন্দি হয়ে গেলেন।
অঝোরে বৃষ্টি ঝরার মতো উমরের দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে দেখে অসম্ভব কোমল কণ্ঠে বিপুল সান্ত্বনার আবেশ ছড়াতে রাসূলে আকরাম (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন ‘উমর! তুমি কাঁদছ কেন?’
দিশেহারা কান্নার মাঝেও অশ্রুপাতের অবিরল ধারার মধ্যেও উমর আরজ করলেন ‘এছাড়া আমার কান্নার আর কী কারণ থাকতে পারে যে, রোম সম্রাট আর পারস্য সম্রাট পৃথিবীর প্রাচুর্য ভোগ করছে। অথচ নবী হয়ে আপনার এই দারিদ্র্য!’
সম্পূর্ণ পাত্র উপুড় করে দেয়ার মতোই উমর তাঁর ভালোবাসা ও কষ্টের, দুঃখ ও যন্ত্রণার আদ্যোপান্ত উপুড় করে দিলেন। তাঁর নিঃশব্দ হাহাকার প্রচণ্ডভাবে বিস্ফোরিত হলো। মানবতার, সহানুভূতির সর্বোচ্চ শৃঙ্গে যার আয়েশী অবস্থান, সেই রাসূলে আকরাম (সা.) সব শুনলেন, দেখলেন। তাঁর এক প্রেমিক সহচরের হৃদয় উজাড় করা কান্নায় তিনি অভির্ভূত হলেন। তিনি এক অনন্য অভিব্যক্তি শূন্যে ছেড়ে দিলেন। দৃশ্যমান বাস্তবতার ঊর্ধ্বে, সংকীর্ণ ইহকালীনতার বাইরে এক দিগন্তহীন দিগন্ত থেকে তিনি উচ্চারণ করলেন ‘উমর! তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, রোম সম্রাট ও পারস্য সম্রাট পৃথিবীর প্রাচুর্য ভোগ করুক আর আমি পরকালের ক্ষয়-লয়হীন অনাবিল শান্তি লাভ করি?’
অশ্রুসিক্ত উমরের দু’চোখ স্থির হয়ে আছে রাসূলুল্লাহ্র (সা.) অদ্ভুত প্রশান্ত মুখের উপর। এ প্রশ্নের জবাবে তাঁর নিজের মুখে কোনো শব্দ নেই। তিনি শুধু শান্তির অনাবিল প্রতীক এই মুবারক মুখের আদলে শান্তির মানচিত্র খুঁজে নিচ্ছেন। তাঁর বুকের মধ্যে জমে যাওয়া কষ্টের পালকগুলো উড়ে উড়ে চলে যাচ্ছে দূরে, অন্যখানে।
শ রী ফ মু হা ম্ম দ
গত রাতে রাসূলুল্লাহ্র একটি ব্যক্তিগত কষ্টের কথা, দুঃখের কথা, মনোযাতনা ও যন্ত্রণার কথা শুনে উমরের ব্যাকুলতা রাতের ঘুমে নিরন্তর আঘাত করেছে। ফজরের জামাতে এসে তিনি দৌড়ে শামিল হয়েছেন মদীনায়। জামাতের পর রাসূলুল্লাহ্ (সা.) সময়ক্ষেপণ না করে আবারও নির্জন অন্দরে চলে আসায় উমর (রা.) বিহ্বল হয়ে মসজিদে বসেছিলেন কিছুক্ষণ। মাঝে দু’বার এসে অনুমতি চেয়েছিলেন; অনুমতি মিলেনি। অবশেষে এক বুকফাটা-আব্দার তিনি রাসূলুল্লাহ্র (সা.) দরবারে পাঠালেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাঁকে অনুমতি দিলেন এবং এরপর তিনি কামরায় ঢুকলেন।
উমর (রা.) রাসূলুল্লাহ্র (সা.) মুখোমুখি হয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাঁকে দেখছিলেন। তাঁর পারিবারিক একটি সঙ্কটে, দাম্পত্যের একটি সমস্যায় তিনি কতটা কষ্টের মধ্যে আছেন, সবার অগোচরে, কতটা নিঃশব্দ দুঃখের মধ্যে প্রহর কাটছে তাঁর, উমর (রা.) সম্ভবত তা-ই লক্ষ্য করছেন। উমর (রা.) তাঁর দু’চোখ মেলে রাসূলুল্লাহেক (সা.) দেখলেন। দেখলেন সাধারণ একটি দড়ির খাটে শুয়ে আছেন তিনি। তাঁর গায়ে দড়ির দাগ পড়ে গেছে। কোমল ত্বকে দারিদ্র্যের নিষ্ঠুর আঁচড়ের মতোই সেই দাগ জ্বল জ্বল করছে। উমর (রা.) দেখলেন আসবাবপত্রহীন, আয়োজনহীন, বিত্তহীন এই কামরার এক পাশে রাখা আছে সামান্য যব, আরবের মোটা খাবার। আরেক পাশে একটি খুঁটিতে ঝুলছে সামান্য একটি শুর চামড়া। উল্লেখ করার মতো তেমন আর কোনো আসবাবপত্র ঘরে নেই।
দেখতে দেখতেই উমরের বোধগুলো ঝাপসা হয়ে এলো। মুষলধারে নেমে আসা বৃষ্টিতে হঠাত্ আক্রান্ত পথিকের মতো উমরের হৃদয় কাকভেজা হয়ে গেল। নিয়ন্ত্রণের শক্ত পিঞ্জর ভেঙে গেল তাঁর। উমর (রা.) ডুকরে কেঁদে উঠলেন। কাঁদতেই লাগলেন। দু’চোখ বেয়ে বিন্দু বিন্দু কষ্টের ভাঁপ কপাল বেয়ে নেমে আসতে লাগল। উমর (রা.) এক সীমানাহীন ভালোবাসার ভুবন, হাহাকারের ভুবন, পবিত্র যন্ত্রণার ভুবনে বন্দি হয়ে গেলেন।
অঝোরে বৃষ্টি ঝরার মতো উমরের দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে দেখে অসম্ভব কোমল কণ্ঠে বিপুল সান্ত্বনার আবেশ ছড়াতে রাসূলে আকরাম (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন ‘উমর! তুমি কাঁদছ কেন?’
দিশেহারা কান্নার মাঝেও অশ্রুপাতের অবিরল ধারার মধ্যেও উমর আরজ করলেন ‘এছাড়া আমার কান্নার আর কী কারণ থাকতে পারে যে, রোম সম্রাট আর পারস্য সম্রাট পৃথিবীর প্রাচুর্য ভোগ করছে। অথচ নবী হয়ে আপনার এই দারিদ্র্য!’
সম্পূর্ণ পাত্র উপুড় করে দেয়ার মতোই উমর তাঁর ভালোবাসা ও কষ্টের, দুঃখ ও যন্ত্রণার আদ্যোপান্ত উপুড় করে দিলেন। তাঁর নিঃশব্দ হাহাকার প্রচণ্ডভাবে বিস্ফোরিত হলো। মানবতার, সহানুভূতির সর্বোচ্চ শৃঙ্গে যার আয়েশী অবস্থান, সেই রাসূলে আকরাম (সা.) সব শুনলেন, দেখলেন। তাঁর এক প্রেমিক সহচরের হৃদয় উজাড় করা কান্নায় তিনি অভির্ভূত হলেন। তিনি এক অনন্য অভিব্যক্তি শূন্যে ছেড়ে দিলেন। দৃশ্যমান বাস্তবতার ঊর্ধ্বে, সংকীর্ণ ইহকালীনতার বাইরে এক দিগন্তহীন দিগন্ত থেকে তিনি উচ্চারণ করলেন ‘উমর! তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, রোম সম্রাট ও পারস্য সম্রাট পৃথিবীর প্রাচুর্য ভোগ করুক আর আমি পরকালের ক্ষয়-লয়হীন অনাবিল শান্তি লাভ করি?’
অশ্রুসিক্ত উমরের দু’চোখ স্থির হয়ে আছে রাসূলুল্লাহ্র (সা.) অদ্ভুত প্রশান্ত মুখের উপর। এ প্রশ্নের জবাবে তাঁর নিজের মুখে কোনো শব্দ নেই। তিনি শুধু শান্তির অনাবিল প্রতীক এই মুবারক মুখের আদলে শান্তির মানচিত্র খুঁজে নিচ্ছেন। তাঁর বুকের মধ্যে জমে যাওয়া কষ্টের পালকগুলো উড়ে উড়ে চলে যাচ্ছে দূরে, অন্যখানে।
শ রী ফ মু হা ম্ম দ
প্রসঙ্গ: ফতোয়া ও গ্রাম্য সালিশ প্রয়োজন উলামা-মাশায়েখদের সমন্বিত পদক্ষেপ
আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে অসামাজিক ও নৈতিকতাবিরোধী কর্মকাণ্ডকে কেন্দ্র করে গ্রাম্য মাতব্বর এবং সালিশকারীদের সিদ্ধান্তকে ‘ফতোয়া’ ও শাস্তিকে ‘দোররা’ হিসেবে অভিহিত করে। প্রতিনিয়ত এসব কর্মকাণ্ডকে ‘ফতোয়াবাজি’ বলে প্রপাগান্ডা চালাচ্ছেন। গ্রামের যেসব লোক সালিশ করে বেত্রাঘাতের মাধ্যমে শাস্তি কার্যকর করছে, তারা কেউ ইসলামী আইনে পারদর্শী ‘মুফতি’ নন। তাদের প্রদত্ত রায় কোনোক্রমে ‘ফতোয়া’ নয়। ফিকহে ইসলামীর মৌলিক নীতিমালা সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই নেই। তারা যা করছে তা প্রচলিত সামাজিক রীতি-প্রথার (Convention of the society) আওতায় পড়তে পারে, ধর্মের আওতায় নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গ্রাম্য সালিশে মানসিক ও দৈহিক শাস্তি মেয়েদের প্রদান করা হয়, তাকে একঘরে করা হয় আর ছেলেকে করা হয় আর্থিক জরিমানা। এটাও ইসলামী ইনসাফের পরিপন্থী। ধর্মের অপব্যাখ্যা করে প্রদত্ত সালিশি বিচারের নামে এসব রায়, সিদ্ধান্ত ও দনণ্ড প্রয়োগ শরিয়াহ আইনের পরিপন্থী এবং বিচারবহির্ভূত এসব কার্যক্রম কোনোভাবেই বরদাশত করা উচিত নয়। কোনো সভ্য সমাজে এটা চলতে পারে না।
ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত থাকলে ‘মুফতি’ কুরআন, হাদিস, ইজমা, কিয়াস, ইশতেহসানের ভিত্তিতে যে কোনো সমস্যার শরয়ী ব্যাখ্যা দেবেন। প্রদত্ত ব্যাখ্যাকে ভিত্তি ধরে রাষ্ট্র কর্তৃক নির্ধারিত উপযুক্ত আদালতের (Competent Court) বিচারক (কাজী) বাদী-বিবাদী-সাক্ষীর বক্তব্য, আসামির স্বীকারোক্তি, জেরা-জবানবন্দি, তদন্ত প্রতিবেদন ও Circumstantial evidence গ্রহণ করে নিরপেক্ষ রায় প্রদান করবেন এবং প্রশাসন আদালতের রায় কার্যকর করবে। সাজা ও ভীতি প্রদর্শনমূলক শাস্তি (হুদুদ ও তাজিরাত) কার্যকর দায়িত্ব সরকারের নির্দিষ্ট বিভাগের। ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে অর্থাত্ বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কোনো ব্যক্তির পক্ষে শরয়ী শাস্তির বিধান কার্যকর করার সুযোগও নেই, আইনও নেই। এটা তার এখতিয়ার বহির্ভূত।
ফতোয়া প্রদান করা মুফতিদের ধর্মীয় অধিকার। জোর করে এ অধিকার হরণ করা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। বাংলাদেশের প্রায় কওমী ও আলিয়া মাদরাসায় স্বতন্ত্র ফতোয়া বিভাগ আছে। পারদর্শী মুফতিরা হাতে-কলমে শিক্ষার্থীদের ‘শরিয়াহ আইন’ সম্পর্কে বিস্তারিত পাঠদান করে থাকেন। যুগ চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে মুসলমানদের ব্যক্তি, পারিবারিক ও সামষ্টিক জীবনে নানা সমস্যা দেখা দেয়—এগুলোর শরয়ী ব্যাখ্যা ও সমাধান মানুষ জানতে আগ্রহী। যুগ যুগ ধরে বিজ্ঞ মুফতিরা এ দায়িত্ব পালন করে আসছেন। পরিচ্ছন্নতা, নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, চাঁদ দেখা, বিয়ে, তালাক, খোরপোশ, ইদ্দত, সম্পত্তির উত্তরাধিকার, দেনমোহর প্রভৃতি বিষয়ে উদ্ভূত সমস্যা বা মাসয়ালার শরয়ী ব্যাখ্যা ও সমাধান দেয়ার উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ (Competent Authority) হচ্ছেন মুফতিরা। এসব আদালতের কাজ নয়। আদালতের পক্ষে ইসলামী শরিয়তের জটিল মাসায়েলগুলোর ব্যাখ্যা দেয়া সঙ্গত কারণে সম্ভব নয়। আদালতের মূল কাজ হচ্ছে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। এসব মাসয়ালা-মাসায়েলের জবাব দিতে গেলে বিচার কার্যক্রম ব্যাহত হবে। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে অনেক সময় হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্ট আইনের ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন, মুসলিম পারিবারিক বিষয়াবলীতে শরিয়াহের বিধিবদ্ধ বিধান (Islamic Legal Codes) অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক। বিধিবদ্ধ বিধানে স্পষ্ট নয় অথবা দ্বৈততা আছে অথবা ভিন্ন ভিন্ন মত আছে এমন সব ব্যাপারে বিজ্ঞ বিচারক বিজ্ঞ মুফতিদের আদালতে তলব করে শরয়ী ব্যাখ্যা জানতে চান। প্রদত্ত ব্যাখার আলোকে বিজ্ঞ বিচারক রায় ঘোষণা করেন। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে এরকম বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। তখন বিচারকের কাছাকাছি ইসলামী আইনে পারদর্শী জুরি বোর্ডের সদস্যরাও আদালতে বসতেন। বাংলাদেশেও এরকম ঘটনার নজির আছে। তালাকপ্রাপ্ত নারী সাবেক স্বামীর কাছ থেকে কত দিন খোরপোশ পাওয়ার দাবিদার এ সম্পর্কিত একটি মামলায় জেলা জজ আদালত ও হাইকোর্টের বিজ্ঞ বিচারকরা পরস্পরবিরোধী রায় দিলে সুপ্রিমকোর্ট বায়তুল মোকাররমের সাবেক খতিব মাওলানা উবায়দুল হক (রহ.) ও মাসিক মদীনার সম্পাদক মাওলানা মুহীউদ্দীন খানকে আদালতে তলব করে এ ব্যাপারে শরিয়তের ব্যাখ্যা জানতে চান। তাদের প্রদত্ত ব্যাখ্যার আলোকে বিজ্ঞ বিচারক রায় ঘোষণা করেন যে, তালাকপ্রাপ্ত মহিলা ইদ্দত চলাকালীন সাবেক স্বামীর পক্ষ থেকে কাবিননামায় বর্ণিত হারে যথাযথ খোরপোশ পাবেন।
ভারতের প্রায় প্রতিটি অঙ্গরাজ্যে সরকারের অনুমোদনক্রমে শরিয়াহ আইনে বিশেষজ্ঞ মুফতিদের সমন্বয়ে ‘মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ড’ রয়েছে। বোর্ডের রায় আদালতের কাছে স্বীকৃত ও গ্রহণযোগ্য। কেন্দ্রীয় ‘মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ড’-এর এক সময় চেয়ারম্যান ছিলেন বিশ্বখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ আল্লামা সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.)।
এরই মধ্যে বাংলাদেশ হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ফতোয়ার নামে সংঘটিত সব ধরনের বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ডকে অবৈধ ও ফৌজদারি অপরাধ বলে ঘোষণা করেছেন। আদালত একই সঙ্গে রায়ে বলেন, যদি কোনো ব্যক্তি ফতোয়া জারি করে এবং তার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তিকে শাস্তি দেয় তাহলে তা অবশ্যই শাস্তিযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ বলে গণ্য হবে। এছাড়া যারা ফতোয়া জারি করে ও শাস্তি দেয়ার মতো বিচারবহির্ভূত কাজে সহযোগিতা করবেন তারাও একই দোষে দোষী হিসেবে সমপরিমাণ শাস্তি পাবেন। হাইকোর্টের রায়ে স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে, ফতোয়া একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। উচ্চ আদালতের প্রতি সন্মান রেখে নিবেদন করতে চাই, বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ডকে অবৈধ ও ফৌজদারি অপরাধ বলে আদালতের রুলিংয়ের ক্ষেত্রে কারও দ্বিমত নেই। সালিশি বিচারের নামে যারা শারীরিক শাস্তি দেয় তাদের আইনের আওতায় আনার সিদ্ধান্ত প্রশংসনীয়। কিন্তু ফতোয়া যদি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হয়ে থাকে তা হলে শরিয়াহ আইন (ফিকহে ইসলামী) শিক্ষা, অনুশীলন ও চর্চার কাঠামো ভেঙে পড়বে। বাংলাদেশে যেসব মাদরাসা ও গবেষণা কেন্দ্রে হাতে-কলমে ইফতা পড়ানো হয় তা বেআইনি হয়ে যাবে এবং যুগে যুগে প্রাজ্ঞ ইমামদের লিখিত ফতোয়ার বিপুল আয়তনের গ্রন্থাবলি নিষিদ্ধ হয়ে যাবে।
অনেক সময় মাসয়ালা ও জটিল সমস্যার বর্ণনা, পারিপার্শিক অবস্থা, সাক্ষীর বক্তব্যের অসঙ্গতির কারণে মুফতিরা একই মাসয়ালার ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন। অনেক সময় প্রাজ্ঞ ইমামদের ইখতিলাফের কারণেও ব্যাখ্যা ভিন্ন হতে পারে। এ অসঙ্গতি দূর করার জন্য আমাদের প্রস্তাব হচ্ছে রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনায় ইসলামী আইনে বিশেষজ্ঞ আলিমদের নিয়ে একটি শক্তিশালী ‘কেন্দ্রীয় ফতোয়া বোর্ড’ গঠন করা হোক। এ বোর্ডের প্রধান দেশের ‘গ্র্যান্ড মুফতি’ অভিধায় ভূষিত হবেন। বোর্ডের আওতায় জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে স্থানীয় বিজ্ঞ আলিমদের নিয়ে ‘ফতোয়া বোর্ড’ থাকবে। বোর্ড প্রদত্ত ফতোয়া রাষ্ট্রীয়ভাবে গ্রহণযোগ্য হবে। বড় বড় মাদরাসায় বা ইসলামী গবেষণাকেন্দ্রিক ইফতা বিভাগ আছে এবং শিক্ষার্থীরা নিয়মিত শরিয়াহ আইনের ওপর গবেষণা করেন তাদের প্রদত্ত ফতোয়াও সহিহ বলে বিবেচিত হবে। ফতোয়ার ক্ষেত্রে ভিন্নতা দেখা দিলে ‘কেন্দ্রীয় ফতোয়া বোর্ড’-এর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে। এর বাইরে ইসলামী আইনের ব্যাখ্যা দেয়ার মতো কোনো অথরিটি না থাকা বাঞ্ছনীয়। তা হলে গ্রামগঞ্জে যেসব মোড়ল-মাতব্বর সালিশি রায় দিয়ে তা কার্যকর করছে, সে প্র্যাকটিস বন্ধ হয়ে যাবে। সৌদি আরব সরকার সম্প্রতি এমন একটি নির্দেশনা জারি করে।
যেসব ফতোয়ার সঙ্গে সাজা, দণ্ড, প্রশাসনিক ও বিচারিক কর্মকাণ্ড বিজড়িত সে ক্ষেত্রে বিজ্ঞ মুফতিরা অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন করবেন। আমাদের মনে রাখতে হবে, মুফতিরা বিচার করার ও দণ্ড কার্যকর করার বৈধ কর্তৃপক্ষ নন। এ দায়িত্ব আদালতের ও প্রশাসনের।
একশ্রেণীর সংবাদপত্র ও এনজিও চক্র যে হারে গ্রাম্য সালিশ এবং শাস্তিকে ‘ফতোয়া’ ‘ফতোয়াবাজি’ ও ‘দোররা’ বলে অভিহিত করে সাধারণ মানুষের অন্তরে ইসলামী অনুুশাসন এবং বিধিবিধানের প্রতি ভীতি ও অশ্রদ্ধার জন্ম দিচ্ছে, তাতে আমরা শঙ্কিত না হয়ে পারি না। এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। অনৈতিক যৌন সম্পর্কে যারা জড়িয়ে পড়ছে বা পরকীয়া প্রেমে যারা আসক্ত তাদের ব্যাপারে বিদ্যমান আইনের ধারাকে আরও কঠোর করা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। অন্যথায় সামাজিক স্থিতি ও শৃঙ্খলা ভেঙে পড়তে পারে। স্মর্তব্য যে, পারিবারিক ও সামাজিক শৃঙ্খলার স্বার্থে শরিয়াহ আইন অপরাধীর প্রতি কঠোর। অপরাধের মাত্রানুযায়ী দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা শরিয়াহ আইনের বৈশিষ্ট্য, যাতে অপরাধের উত্সমূল বন্ধ হয়ে যায়। কারণ অপরাধ অপরাধের জন্ম দেয়।
আমরা আবারও বলছি, শরিয়াহ আইন কার্যকর করার দায়িত্ব সরকারের। শরিয়াহ আইন বিশেল্গষণ করবেন বিজ্ঞ মুফতিরা। শরিয়াহ আইনের অনুপস্থিতিতে প্রচলিত দেশীয় আইন মেনে চলতে জনগণ বাধ্য। সুতরাং আলিম, উলামা, মাশায়েখ ও মুফতিদের সমন্বিত কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, সংলাপ, আলোচনা সভার মাধ্যমে ‘ফতোয়া’ ও ‘দোররা’র সঠিক তথ্য এবং অবস্থান জনগণের কাছে তুলে ধরা দরকার। প্রয়োজনে উচ্চ আদালতের বিচারক, সিনিয়র আইনজীবী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বিজ্ঞ আলিম ও মুফতিদের মতবিনিময় হতে পারে।
লেখক : ড. আ ফ ম খা লি দ হো সে ন
অধ্যাপক, গবেষক ও ইসলামি চিন্তাবিদ
ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত থাকলে ‘মুফতি’ কুরআন, হাদিস, ইজমা, কিয়াস, ইশতেহসানের ভিত্তিতে যে কোনো সমস্যার শরয়ী ব্যাখ্যা দেবেন। প্রদত্ত ব্যাখ্যাকে ভিত্তি ধরে রাষ্ট্র কর্তৃক নির্ধারিত উপযুক্ত আদালতের (Competent Court) বিচারক (কাজী) বাদী-বিবাদী-সাক্ষীর বক্তব্য, আসামির স্বীকারোক্তি, জেরা-জবানবন্দি, তদন্ত প্রতিবেদন ও Circumstantial evidence গ্রহণ করে নিরপেক্ষ রায় প্রদান করবেন এবং প্রশাসন আদালতের রায় কার্যকর করবে। সাজা ও ভীতি প্রদর্শনমূলক শাস্তি (হুদুদ ও তাজিরাত) কার্যকর দায়িত্ব সরকারের নির্দিষ্ট বিভাগের। ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে অর্থাত্ বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কোনো ব্যক্তির পক্ষে শরয়ী শাস্তির বিধান কার্যকর করার সুযোগও নেই, আইনও নেই। এটা তার এখতিয়ার বহির্ভূত।
ফতোয়া প্রদান করা মুফতিদের ধর্মীয় অধিকার। জোর করে এ অধিকার হরণ করা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। বাংলাদেশের প্রায় কওমী ও আলিয়া মাদরাসায় স্বতন্ত্র ফতোয়া বিভাগ আছে। পারদর্শী মুফতিরা হাতে-কলমে শিক্ষার্থীদের ‘শরিয়াহ আইন’ সম্পর্কে বিস্তারিত পাঠদান করে থাকেন। যুগ চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে মুসলমানদের ব্যক্তি, পারিবারিক ও সামষ্টিক জীবনে নানা সমস্যা দেখা দেয়—এগুলোর শরয়ী ব্যাখ্যা ও সমাধান মানুষ জানতে আগ্রহী। যুগ যুগ ধরে বিজ্ঞ মুফতিরা এ দায়িত্ব পালন করে আসছেন। পরিচ্ছন্নতা, নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, চাঁদ দেখা, বিয়ে, তালাক, খোরপোশ, ইদ্দত, সম্পত্তির উত্তরাধিকার, দেনমোহর প্রভৃতি বিষয়ে উদ্ভূত সমস্যা বা মাসয়ালার শরয়ী ব্যাখ্যা ও সমাধান দেয়ার উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ (Competent Authority) হচ্ছেন মুফতিরা। এসব আদালতের কাজ নয়। আদালতের পক্ষে ইসলামী শরিয়তের জটিল মাসায়েলগুলোর ব্যাখ্যা দেয়া সঙ্গত কারণে সম্ভব নয়। আদালতের মূল কাজ হচ্ছে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। এসব মাসয়ালা-মাসায়েলের জবাব দিতে গেলে বিচার কার্যক্রম ব্যাহত হবে। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে অনেক সময় হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্ট আইনের ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন, মুসলিম পারিবারিক বিষয়াবলীতে শরিয়াহের বিধিবদ্ধ বিধান (Islamic Legal Codes) অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক। বিধিবদ্ধ বিধানে স্পষ্ট নয় অথবা দ্বৈততা আছে অথবা ভিন্ন ভিন্ন মত আছে এমন সব ব্যাপারে বিজ্ঞ বিচারক বিজ্ঞ মুফতিদের আদালতে তলব করে শরয়ী ব্যাখ্যা জানতে চান। প্রদত্ত ব্যাখার আলোকে বিজ্ঞ বিচারক রায় ঘোষণা করেন। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে এরকম বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। তখন বিচারকের কাছাকাছি ইসলামী আইনে পারদর্শী জুরি বোর্ডের সদস্যরাও আদালতে বসতেন। বাংলাদেশেও এরকম ঘটনার নজির আছে। তালাকপ্রাপ্ত নারী সাবেক স্বামীর কাছ থেকে কত দিন খোরপোশ পাওয়ার দাবিদার এ সম্পর্কিত একটি মামলায় জেলা জজ আদালত ও হাইকোর্টের বিজ্ঞ বিচারকরা পরস্পরবিরোধী রায় দিলে সুপ্রিমকোর্ট বায়তুল মোকাররমের সাবেক খতিব মাওলানা উবায়দুল হক (রহ.) ও মাসিক মদীনার সম্পাদক মাওলানা মুহীউদ্দীন খানকে আদালতে তলব করে এ ব্যাপারে শরিয়তের ব্যাখ্যা জানতে চান। তাদের প্রদত্ত ব্যাখ্যার আলোকে বিজ্ঞ বিচারক রায় ঘোষণা করেন যে, তালাকপ্রাপ্ত মহিলা ইদ্দত চলাকালীন সাবেক স্বামীর পক্ষ থেকে কাবিননামায় বর্ণিত হারে যথাযথ খোরপোশ পাবেন।
ভারতের প্রায় প্রতিটি অঙ্গরাজ্যে সরকারের অনুমোদনক্রমে শরিয়াহ আইনে বিশেষজ্ঞ মুফতিদের সমন্বয়ে ‘মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ড’ রয়েছে। বোর্ডের রায় আদালতের কাছে স্বীকৃত ও গ্রহণযোগ্য। কেন্দ্রীয় ‘মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ড’-এর এক সময় চেয়ারম্যান ছিলেন বিশ্বখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ আল্লামা সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.)।
এরই মধ্যে বাংলাদেশ হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ফতোয়ার নামে সংঘটিত সব ধরনের বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ডকে অবৈধ ও ফৌজদারি অপরাধ বলে ঘোষণা করেছেন। আদালত একই সঙ্গে রায়ে বলেন, যদি কোনো ব্যক্তি ফতোয়া জারি করে এবং তার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তিকে শাস্তি দেয় তাহলে তা অবশ্যই শাস্তিযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ বলে গণ্য হবে। এছাড়া যারা ফতোয়া জারি করে ও শাস্তি দেয়ার মতো বিচারবহির্ভূত কাজে সহযোগিতা করবেন তারাও একই দোষে দোষী হিসেবে সমপরিমাণ শাস্তি পাবেন। হাইকোর্টের রায়ে স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে, ফতোয়া একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। উচ্চ আদালতের প্রতি সন্মান রেখে নিবেদন করতে চাই, বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ডকে অবৈধ ও ফৌজদারি অপরাধ বলে আদালতের রুলিংয়ের ক্ষেত্রে কারও দ্বিমত নেই। সালিশি বিচারের নামে যারা শারীরিক শাস্তি দেয় তাদের আইনের আওতায় আনার সিদ্ধান্ত প্রশংসনীয়। কিন্তু ফতোয়া যদি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হয়ে থাকে তা হলে শরিয়াহ আইন (ফিকহে ইসলামী) শিক্ষা, অনুশীলন ও চর্চার কাঠামো ভেঙে পড়বে। বাংলাদেশে যেসব মাদরাসা ও গবেষণা কেন্দ্রে হাতে-কলমে ইফতা পড়ানো হয় তা বেআইনি হয়ে যাবে এবং যুগে যুগে প্রাজ্ঞ ইমামদের লিখিত ফতোয়ার বিপুল আয়তনের গ্রন্থাবলি নিষিদ্ধ হয়ে যাবে।
অনেক সময় মাসয়ালা ও জটিল সমস্যার বর্ণনা, পারিপার্শিক অবস্থা, সাক্ষীর বক্তব্যের অসঙ্গতির কারণে মুফতিরা একই মাসয়ালার ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন। অনেক সময় প্রাজ্ঞ ইমামদের ইখতিলাফের কারণেও ব্যাখ্যা ভিন্ন হতে পারে। এ অসঙ্গতি দূর করার জন্য আমাদের প্রস্তাব হচ্ছে রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনায় ইসলামী আইনে বিশেষজ্ঞ আলিমদের নিয়ে একটি শক্তিশালী ‘কেন্দ্রীয় ফতোয়া বোর্ড’ গঠন করা হোক। এ বোর্ডের প্রধান দেশের ‘গ্র্যান্ড মুফতি’ অভিধায় ভূষিত হবেন। বোর্ডের আওতায় জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে স্থানীয় বিজ্ঞ আলিমদের নিয়ে ‘ফতোয়া বোর্ড’ থাকবে। বোর্ড প্রদত্ত ফতোয়া রাষ্ট্রীয়ভাবে গ্রহণযোগ্য হবে। বড় বড় মাদরাসায় বা ইসলামী গবেষণাকেন্দ্রিক ইফতা বিভাগ আছে এবং শিক্ষার্থীরা নিয়মিত শরিয়াহ আইনের ওপর গবেষণা করেন তাদের প্রদত্ত ফতোয়াও সহিহ বলে বিবেচিত হবে। ফতোয়ার ক্ষেত্রে ভিন্নতা দেখা দিলে ‘কেন্দ্রীয় ফতোয়া বোর্ড’-এর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে। এর বাইরে ইসলামী আইনের ব্যাখ্যা দেয়ার মতো কোনো অথরিটি না থাকা বাঞ্ছনীয়। তা হলে গ্রামগঞ্জে যেসব মোড়ল-মাতব্বর সালিশি রায় দিয়ে তা কার্যকর করছে, সে প্র্যাকটিস বন্ধ হয়ে যাবে। সৌদি আরব সরকার সম্প্রতি এমন একটি নির্দেশনা জারি করে।
যেসব ফতোয়ার সঙ্গে সাজা, দণ্ড, প্রশাসনিক ও বিচারিক কর্মকাণ্ড বিজড়িত সে ক্ষেত্রে বিজ্ঞ মুফতিরা অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন করবেন। আমাদের মনে রাখতে হবে, মুফতিরা বিচার করার ও দণ্ড কার্যকর করার বৈধ কর্তৃপক্ষ নন। এ দায়িত্ব আদালতের ও প্রশাসনের।
একশ্রেণীর সংবাদপত্র ও এনজিও চক্র যে হারে গ্রাম্য সালিশ এবং শাস্তিকে ‘ফতোয়া’ ‘ফতোয়াবাজি’ ও ‘দোররা’ বলে অভিহিত করে সাধারণ মানুষের অন্তরে ইসলামী অনুুশাসন এবং বিধিবিধানের প্রতি ভীতি ও অশ্রদ্ধার জন্ম দিচ্ছে, তাতে আমরা শঙ্কিত না হয়ে পারি না। এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। অনৈতিক যৌন সম্পর্কে যারা জড়িয়ে পড়ছে বা পরকীয়া প্রেমে যারা আসক্ত তাদের ব্যাপারে বিদ্যমান আইনের ধারাকে আরও কঠোর করা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। অন্যথায় সামাজিক স্থিতি ও শৃঙ্খলা ভেঙে পড়তে পারে। স্মর্তব্য যে, পারিবারিক ও সামাজিক শৃঙ্খলার স্বার্থে শরিয়াহ আইন অপরাধীর প্রতি কঠোর। অপরাধের মাত্রানুযায়ী দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা শরিয়াহ আইনের বৈশিষ্ট্য, যাতে অপরাধের উত্সমূল বন্ধ হয়ে যায়। কারণ অপরাধ অপরাধের জন্ম দেয়।
আমরা আবারও বলছি, শরিয়াহ আইন কার্যকর করার দায়িত্ব সরকারের। শরিয়াহ আইন বিশেল্গষণ করবেন বিজ্ঞ মুফতিরা। শরিয়াহ আইনের অনুপস্থিতিতে প্রচলিত দেশীয় আইন মেনে চলতে জনগণ বাধ্য। সুতরাং আলিম, উলামা, মাশায়েখ ও মুফতিদের সমন্বিত কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, সংলাপ, আলোচনা সভার মাধ্যমে ‘ফতোয়া’ ও ‘দোররা’র সঠিক তথ্য এবং অবস্থান জনগণের কাছে তুলে ধরা দরকার। প্রয়োজনে উচ্চ আদালতের বিচারক, সিনিয়র আইনজীবী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বিজ্ঞ আলিম ও মুফতিদের মতবিনিময় হতে পারে।
লেখক : ড. আ ফ ম খা লি দ হো সে ন
অধ্যাপক, গবেষক ও ইসলামি চিন্তাবিদ
সবার আগে মানবাধিকারের ঘোষণা দিয়েছেন মহানবী (সা.)
‘হজরত মোহাম্মদের (সা.) ভাষণসমূহ : একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক সমীক্ষা’ শিরোনামে থিসিস করেছেন ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন। তার থিসিসের বিষয়-বৈশিষ্ট্য নিয়ে সাক্ষাত্কারে তিনি জানান, বিভিন্ন ভাষণে মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) শাশ্বত ও সর্বোচ্চ মানবাধিকারের ঘোষণা পৃথিবীতে সবার আগে দিয়ে গেছেন। মহানবীর (সা.) ভাষণগুলো মানুষ ও মানবতার প্রতি তাঁর স্বর্ণালী অবদানের উজ্জ্বল স্বাক্ষর। সাক্ষাত্কার নিয়েছেন শরীফ মুহাম্মদ
মানবতার নবী হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনের পুরোটাই ছিল মানুষ ও মানবতার স্বর্ণালী আদর্শ ও শিক্ষায় ভরপুর। বাস্তব আচরণ ও ঘটনার বাইরে তাঁর ভাষণ-বক্তব্য থেকেও এর অগণিত নমুনা পাওয়া যায়। ব্যাপকভাবে এ প্রসঙ্গে আমরা শুধু বিদায় হজের ভাষণের কথাই জানি ও আলোচনায় আনি। কিন্তু তাঁর জীবনের প্রায় সব ভাষণ-বক্তব্যেই মানুষ ও মানবতার প্রতি তাঁর অবদানের তথ্যটি ফুটে ওঠে। ‘হজরত মোহাম্মদের (সা.) ভাষণসমূহ : একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক সমীক্ষা’ শিরোনামে থিসিস সম্পন্ন করে পিএইচডি অর্জন করা অধ্যাপক ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন এ কথা জানান।
চট্টগ্রাম ওমর গণি এমইএস কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির অধ্যাপক ড. খালিদকে ২০০৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এ বিষয়ে ডিগ্রিটি দেয়া হয়। ৩৭০ পৃষ্ঠায় রচিত তার থিসিসটিতে রয়েছে আটটি অধ্যায়। থিসিসটির তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহ মুহাম্মদ শফিকুল্লাহ। পরীক্ষক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবির অধ্যাপক ড. আবু বকর সিদ্দিক ও ভারতের লক্ষেষ্টৗ বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ও ইসলামী সভ্যতা বিভাগের চেয়ারম্যান ড. শিব্বির আহমদ। ড. খালিদ জানান, তিনি তার থিসিসে মহানবীর (সা.) ৮১টি ভাষণ সংগ্রহ, ভাষান্তর ও বিশ্লেষণ করেন। ভাষণগুলোর মাঝে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বিদায় হজের ভাষণ, মক্কা বিজয়, তাবুক প্রান্তর, গাদির খুম, বদর, ওহুদ প্রান্তর, মদিনার প্রথম ভাষণ, দাজ্জালের ব্যাপারে সতর্কতা, মুহাজির-আনসারের সমাবেশ, মক্কায় নেতৃস্থানীয়দের জন্য আয়োজিত ভোজসভা, আকাবা উপত্যকা, মসজিদে নববী ও মুতার যোদ্ধাদের বিদায় দানকালে দেয়া ভাষণগুলো।
এক প্রশ্নের জবাবে ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন জানান, মহানবীর (সা.) ভাষণে সামাজিক নিরাপত্তা, অসাম্প্রদায়িক সহাবস্থানের প্রেরণা ও রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা রক্ষার চেতনা প্রস্ফুটিত। এছাড়াও মহানবীর (সা.) ভাষণে রয়েছে ধর্মের সঙ্গে সমাজ-সংস্কৃতির সম্পর্ক, মানবাধিকার, নারীর মর্যাদা ও শিশুর অধিকার, অধীনস্থদের সঙ্গে মানবিক আচরণ, সহিষ্ণুতা, সহমর্মিতা, ভ্রাতৃত্ববোধ, আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতা, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, যুদ্ধক্ষেত্রে নৈতিকতা, মানবসেবা, ক্ষমা ও ঔদার্য, বাড়াবাড়ি বিষয়ে সতর্কতা, খতমে নবুওয়ত, জিহাদ, সুদমুক্ত অর্থনীতি, আত্মীয়তার সম্পর্ক সুদৃঢ়করণ, ব্যক্তি ও ব্যাষ্টিক দায়িত্ববোধ, সামাজিক ন্যায়বিচার, দাসমুক্তি, বর্ণ ও গোত্রীয় বৈষম্যের অবসান এবং শ্রমের মর্যাদা সম্পর্কিত বহুবিধ নির্দেশনা ও আলোকপাত।
মানবাধিকার রক্ষায় মহানবীর (সা.) ভাষণ ও নির্দেশনার ভূমিকা সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বিভিন্ন ভাষণের ধারাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মহানবী (সা.) শাশ্বত ও সর্বোচ্চ মানবাধিকারের ঘোষণা সবার আগে দিয়ে গেছেন। ১২১৫ সালের ম্যাগনাকার্টা, ১৬২৮ সালের পিটিশন অব রাইটস, ১৬৭৯ সালের হেবিয়াস কর্পাস অ্যাক্ট, ১৬৮৯ সালের বিল অব রাইটস এবং ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা মানুষের সামনে আসার বহু শত বছর আগেই মানবতার ঝাণ্ডাবাহী মহানবীর (সা.) ভাষণে মানুষের আর্থ-সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অধিকার ঘোষিত হয়েছে।
থিসিস সম্পন্ন করতে ড. খালিদ তিনটি দেশের বিভিন্ন ইসলামী প্রতিষ্ঠান ও লাইব্রেরি মন্থন এবং পৃথিবী বিখ্যাত ইসলামী স্কলারদের সাক্ষাত্কার গ্রহণ করেন। একই সঙ্গে নির্দিষ্টভাবে ৮৬টি আরবি, ৮৫টি ইংরেজি, ৩০টি উর্দু, ৬টি ফার্সি, ৫টি বাংলা গ্রন্থ ও ১৫টি সাময়িকী অধ্যয়ন করেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সিরাত বিশ্বকোষের চতুর্দশ খণ্ডে তার থিসিস থেকে নেয়া মহানবীর (সা.) ভাষণগুলো মূল আরবিসহ বাংলা তরজমা ‘রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর খুতবাসমূহ’ নামে ছাপা হয়েছে।
—অধ্যাপক ড. আফম খালিদ হোসেন
মানবতার নবী হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনের পুরোটাই ছিল মানুষ ও মানবতার স্বর্ণালী আদর্শ ও শিক্ষায় ভরপুর। বাস্তব আচরণ ও ঘটনার বাইরে তাঁর ভাষণ-বক্তব্য থেকেও এর অগণিত নমুনা পাওয়া যায়। ব্যাপকভাবে এ প্রসঙ্গে আমরা শুধু বিদায় হজের ভাষণের কথাই জানি ও আলোচনায় আনি। কিন্তু তাঁর জীবনের প্রায় সব ভাষণ-বক্তব্যেই মানুষ ও মানবতার প্রতি তাঁর অবদানের তথ্যটি ফুটে ওঠে। ‘হজরত মোহাম্মদের (সা.) ভাষণসমূহ : একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক সমীক্ষা’ শিরোনামে থিসিস সম্পন্ন করে পিএইচডি অর্জন করা অধ্যাপক ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন এ কথা জানান।
চট্টগ্রাম ওমর গণি এমইএস কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির অধ্যাপক ড. খালিদকে ২০০৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এ বিষয়ে ডিগ্রিটি দেয়া হয়। ৩৭০ পৃষ্ঠায় রচিত তার থিসিসটিতে রয়েছে আটটি অধ্যায়। থিসিসটির তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহ মুহাম্মদ শফিকুল্লাহ। পরীক্ষক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবির অধ্যাপক ড. আবু বকর সিদ্দিক ও ভারতের লক্ষেষ্টৗ বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ও ইসলামী সভ্যতা বিভাগের চেয়ারম্যান ড. শিব্বির আহমদ। ড. খালিদ জানান, তিনি তার থিসিসে মহানবীর (সা.) ৮১টি ভাষণ সংগ্রহ, ভাষান্তর ও বিশ্লেষণ করেন। ভাষণগুলোর মাঝে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বিদায় হজের ভাষণ, মক্কা বিজয়, তাবুক প্রান্তর, গাদির খুম, বদর, ওহুদ প্রান্তর, মদিনার প্রথম ভাষণ, দাজ্জালের ব্যাপারে সতর্কতা, মুহাজির-আনসারের সমাবেশ, মক্কায় নেতৃস্থানীয়দের জন্য আয়োজিত ভোজসভা, আকাবা উপত্যকা, মসজিদে নববী ও মুতার যোদ্ধাদের বিদায় দানকালে দেয়া ভাষণগুলো।
এক প্রশ্নের জবাবে ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন জানান, মহানবীর (সা.) ভাষণে সামাজিক নিরাপত্তা, অসাম্প্রদায়িক সহাবস্থানের প্রেরণা ও রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা রক্ষার চেতনা প্রস্ফুটিত। এছাড়াও মহানবীর (সা.) ভাষণে রয়েছে ধর্মের সঙ্গে সমাজ-সংস্কৃতির সম্পর্ক, মানবাধিকার, নারীর মর্যাদা ও শিশুর অধিকার, অধীনস্থদের সঙ্গে মানবিক আচরণ, সহিষ্ণুতা, সহমর্মিতা, ভ্রাতৃত্ববোধ, আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতা, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, যুদ্ধক্ষেত্রে নৈতিকতা, মানবসেবা, ক্ষমা ও ঔদার্য, বাড়াবাড়ি বিষয়ে সতর্কতা, খতমে নবুওয়ত, জিহাদ, সুদমুক্ত অর্থনীতি, আত্মীয়তার সম্পর্ক সুদৃঢ়করণ, ব্যক্তি ও ব্যাষ্টিক দায়িত্ববোধ, সামাজিক ন্যায়বিচার, দাসমুক্তি, বর্ণ ও গোত্রীয় বৈষম্যের অবসান এবং শ্রমের মর্যাদা সম্পর্কিত বহুবিধ নির্দেশনা ও আলোকপাত।
মানবাধিকার রক্ষায় মহানবীর (সা.) ভাষণ ও নির্দেশনার ভূমিকা সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বিভিন্ন ভাষণের ধারাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মহানবী (সা.) শাশ্বত ও সর্বোচ্চ মানবাধিকারের ঘোষণা সবার আগে দিয়ে গেছেন। ১২১৫ সালের ম্যাগনাকার্টা, ১৬২৮ সালের পিটিশন অব রাইটস, ১৬৭৯ সালের হেবিয়াস কর্পাস অ্যাক্ট, ১৬৮৯ সালের বিল অব রাইটস এবং ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা মানুষের সামনে আসার বহু শত বছর আগেই মানবতার ঝাণ্ডাবাহী মহানবীর (সা.) ভাষণে মানুষের আর্থ-সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অধিকার ঘোষিত হয়েছে।
থিসিস সম্পন্ন করতে ড. খালিদ তিনটি দেশের বিভিন্ন ইসলামী প্রতিষ্ঠান ও লাইব্রেরি মন্থন এবং পৃথিবী বিখ্যাত ইসলামী স্কলারদের সাক্ষাত্কার গ্রহণ করেন। একই সঙ্গে নির্দিষ্টভাবে ৮৬টি আরবি, ৮৫টি ইংরেজি, ৩০টি উর্দু, ৬টি ফার্সি, ৫টি বাংলা গ্রন্থ ও ১৫টি সাময়িকী অধ্যয়ন করেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সিরাত বিশ্বকোষের চতুর্দশ খণ্ডে তার থিসিস থেকে নেয়া মহানবীর (সা.) ভাষণগুলো মূল আরবিসহ বাংলা তরজমা ‘রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর খুতবাসমূহ’ নামে ছাপা হয়েছে।
—অধ্যাপক ড. আফম খালিদ হোসেন
Subscribe to:
Comments (Atom)