খা লি দ বে গ
একদিন রাসুল মোহাম্মদ (সা.) কিছু দুর্যোগপীড়িত মানুষকে অতিক্রম করে যাওয়ার পর বললেন, ‘তারা আল্লাহপাকের কাছে রহমত ও নিরাপত্তার জন্য দোয়া করে না কেন?’ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মুসলমান আজ যে দুর্ভোগ ও বিপর্যয়ের শিকার, সেই পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্নটি আজ আমাদের উদ্দেশ্যেও করা যেতে পারে।
এমন নয় যে, আমরা দোয়া করার কথা পুরোপুরি বিস্মৃত হয়েছি; আমরা বরং প্রতিনিয়তই নিয়মিতভাবে দোয়া করি। কিন্তু দোয়া সম্পর্কে আমাদের ধারণা ও ক্রিয়াকর্মাদি আসলে রীতিমত বিকৃতির শিকার এবং আমাদের দোয়ার অধিকাংশ সময়ই নিতান্ত আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। সাধারণভাবে এটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, যখন আমাদের সব চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, তখন একেবারে শেষ অবলম্বন হিসেবে দোয়ার কাছে আশ্রয় গ্রহণ করি এবং এটাও লক্ষণীয় যে, কাজে-কর্মে তো বটেই, অমানবিক কথার দ্বারাও দোয়াকে অবজ্ঞা ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয় এবং এটা আদৌ আশ্চর্যজনক নয় যে, দোয়ার এখন অর্থ দাঁড়িয়েছে পরিস্থিতি থেকে উদ্ভুত নৈরাশ্য, হতাশা ও ব্যর্থতার মোকাবিলায় দোয়া যেন এক ব্যর্থ ও অনাবশ্যক আকুতি।
কী দুর্ভাগ্য! অথচ দোয়া হলো বিশ্বাসীদের জন্য সর্বাধিক শক্তিশালী ও সর্বাধিক ফলপ্রসূ একটি হাতিয়ার। দোয়া ভাগ্যলিপিকে পরিবত
ন করতে পারে, যা আমাদের কোনো চেষ্টা-প্রচেষ্টার দ্বারা সম্ভব নয়। দোয়া হলো সব ইবাদতের সৌরভ ও সারবস্তু। দোয়া আমাদের কোনো কাজে কখনও ব্যর্থ হতে দেয় না, আর দোয়া ছাড়া আমরা কখনও সাফল্যও লাভ করতে পারি না। কোনো বিষয়ে সুষ্ঠু পরিকল্পনা-গ্রহণের আগে ও শেষে আল্লাহর সমীপে দোয়া পেশ করা বিশ্বাসীদের জন্য প্রথম ও শেষ ভরসাস্থল; কারণ বিশ্বাসীদের (ঈমানদার) সব পরিকল্পনা ও কার্যক্রম পূর্বাপর দোয়ার মধ্যস্থলে অবস্থিত।
দোয়া হলো আল্লাহপাকের সঙ্গে আমাদের একান্ত বাক্যালাপ, সেই আল্লাহ যিনি আমাদের স্রষ্টা ও অভিভাবক, যিনি আমাদের প্রভু ও প্রতিপালক, যিনি সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান। বস্তুতই, দোয়া এক অসামান্য তাত্পর্য বহন করে। দোয়া ঊর্ধারোহণের শ্রেষ্ঠ সোপান, মুক্তির বার্তা, ক্ষমতাপ্রাপ্তির পাথেয়, রুপান্তর-প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত এক অতীব ফলপ্রসূ জীবনচেতনা, যা কোনো মানুষের পক্ষে অর্জন করা অসম্ভব। দোয়ার মধ্য দিয়ে আমরা আল্লাহর দিকে ফিরে আসি, কারণ আমরা জানি, একমাত্র তিনিই আমাদের সব দুর্ভোগ থেকে মুক্তি দিতে পারেন; এবং একমাত্র তিনিই পারেন আমাদের সব সমস্যার সমাধান করে দিতে। এবং স্রষ্টার কাছে আমাদের সব বিপদ-মুসিবত ও দুর্যোগ-দুর্ভোগের কথা নিবেদন করে আমরা স্বস্তি অনুভব করি; সর্বশক্তিমান আল্লাহর সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে আমরা নিজের মধ্যে শক্তি খুঁজে পাই। অনন্ত-অসীম ক্ষমা ও করুণার যিনি আঁধার, তাঁর কাছে আকুতি জানিয়ে আমরা আমাদের চতুর্দিকে তাঁরই করুণার উপস্থিতি উপলব্ধি করি এবং তাঁর প্রদর্শিত পথে চলার জন্য আমরা নতুনভাবে অঙ্গীকারে সমৃদ্ধ হয়ে উঠি, বুঝতে পারি তাঁর পথই কামিয়াবির একমাত্র পথ। আর এভাবেই আমাদের বিশ্বাস ও অঙ্গীকার নিয়ে আমরা এক অবর্ণনীয় রহমতের আস্বাদ অনুভব করি।
প্রতিটি বিপদের মুহূর্তে আমাদের প্রথম কাজই হলো দোয়া এবং শেষেও দোয়া। আমরা আল্লাহপাকের কাছে প্রার্থনা জানাই বিপদ মোকাবিলার জন্য সঠিক পথ তিনি দেখিয়ে দেবেন। আমরা তাঁরই কাছে সাহায্য কামনা করি যাতে তার প্রদর্শিত পথে আমরা চলতে সক্ষম হই এবং আমাদের সব কাজে লাভ করতে পারি সাফল্য। আমরা যখন রোগগ্রস্ত হয়ে পড়ি, আমরা জানি, আল্লাহর অভিপ্রায় ছাড়া আমরা সঠিক চিকিত্সকের সন্ধান পাব না; জানি তার আদেশ ব্যতীত সর্বোত্তম চিকিত্সকও রোগ-নির্ণয়ে ব্যর্থ হবেন এবং এ কথাও জানি সর্বোত্তম চিকিত্সাও তার অনুমতি ছাড়া নিষম্ফল হতে বাধ্য। আমরা আল্লাহপাকের কাছে এ সবকিছুর জন্যই অনুগ্রহ প্রার্থনা করি। আমরা চিকিত্সা-সাহায্যের জন্য দোয়া করি, চিকিত্সা-লাভের পর নিরাময় হয়েও করি। জীবনের সব বিপদে-মুসিবতে দুঃখে-দুর্যোগে আল্লাহর কাছে আমাদের এই অনুগ্রহ প্রার্থনা একইভাবে একই রকম সত্য।
দোয়া হলো আমাদের সব ইবাদতের সুরভি ও সারবস্তু। আল্লাহপাকের কাছে প্রার্থনারত একজন ব্যক্তি তার তাওহিদী-বিশ্বাসকে (একত্ববাদ, গড়হড়ঃযবরংস) দৃঢ়তার সঙ্গে সত্যায়িত করে এবং সব মিথ্যা-ঈশ্বরকে পরিত্যাগ করে। প্রত্যেক দোয়ার মধ্য দিয়ে আল্লাহপাকের প্রতি তার আস্থা ও বিশ্বাসের পুন: পুন: নবজন্ম ঘটে; এবং তার সানুরাগ প্রার্থনা তার নিজের মধ্যে নিজের অক্ষমতা ও শক্তিহীনতার অনুভূতিও জাগ্রত করে। গুরুত্ব ও আন্তরিকতার সঙ্গে প্রার্থনারত একজন ব্যক্তি যথার্থভাবেই অনুধাবন করতে পারে, স্রষ্টার সঙ্গে তার কী-অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক; এবং এই বিষয়টি তার বাস্তব জীবনের ক্রিয়াকর্মেও ফুটে ওঠে, প্রতিফলিত হয়। আর এটাই তো সব ইবাদত বন্দেগির প্রাণবস্তু। উপরন্তু এ ধরনের মানুষ কখনও দাম্ভিক ও উদ্ধত হতে পারে না, যা আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদিত আমাদের সব আন্তরিক দোয়া ও ইবাদতের যৌক্তিক ফলাফল।
দোয়া আমাদের জীবন সংগ্রামে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী হাতিয়ার, এমনকি যুদ্ধের ময়দানে প্রত্যক্ষ জিহাদেও এই দোয়ার কার্যকারিতা অসামান্য। বদরযুদ্ধ ছিল বিপুল অস্ত্রশস্ত্র-সজ্জিত এক বিশাল মুশরিক বাহিনীর মোকাবিলায় মুসলমানদের একটি অসম যুদ্ধ। যুদ্ধের পূর্বরাতে রাসুল (সা.) আল্লাহপাকের সাহায্য কামনায় নামাজে দাঁড়িয়ে সারারাত অতিবাহিত করলেন। ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত যুদ্ধে সুলতান সালাউদ্দীন আইয়ুবী দিবারাত্রি সমানভাবে ব্যস্ত। তার দিনগুলো কাটত জিহাদে আর রাত্রিগুলো অতিবাহিত হতো আল্লাহর সাহায্য-প্রার্থনায় ক্রন্দনরত অবস্থায় দোয়া ও ইবাদতে।
আমাদের মনে রাখা আবশ্যক, ক্ষুদ্র-বৃহত্ সব বিষয়েই আমরা আল্লাহপাকের কাছে আরজু পেশ করতে পারি। এটাই আসলে প্রজ্ঞার প্রথম কথা যে, ক্ষুদ্র বা বৃহত্ বলে কিছু নেই, এটা মূলত মানুষের প্রয়োজন ও ব্যক্তিগত বিবেচনার ওপর নির্ভরশীল। অতএব এ ধরনের পার্থক্য রচনা একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। বিশেষ করে আমরা যার কাছে প্রার্থনা-করছি, তার কাছে বড় বলে কিছু নেই; আর আমরা যারা কিছু পাওয়ার আশায় প্রার্থনা করি, তাদের কাছে কোনো কিছুই ছোট নয়। এইজন্যই আল্লাহর রাসূল (সা.) শিক্ষা দিয়েছেন, আমরা আল্লাহপাকের কাছে আমাদের প্রয়োজনমত সবকিছুই চাইতে পারি, এমনকি তা যদি জুতার ফিতার মতো কোনো তুচ্ছ জিনিসও হয়। তবে আমাদের চাওয়া উচিত একেবারে ভিখারির মতো, একেবারে রিক্ত নিঃসম্বল অসহায় মানুষের মতো; আর বাস্তব ক্ষেত্রে আল্লাহপাকের সঙ্গে এটাই তো আমাদের প্রকৃত সম্পর্ক এবং এটাও উল্লেখযোগ্য যে, আমাদের প্রার্থনা হতে হবে সর্বোচ্চ আশা ও সুদৃঢ় আস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত; অর্থাত্ আল্লাহপাক অবশ্যই আমাদের প্রার্থনা পূর্ণ করবেন, এই আশা আমাদের অন্তরে সর্বদা জাগরুক থাকবে। প্রসঙ্গত, আমরা একটি হাদিস স্মরণ করতে পারি: ‘আল্লাহর কাছে তার বান্দাহর দোয়া বা প্রার্থনার চেয়ে অধিক প্রিয় আর কিছু নেই’। অন্যদিকে দোয়ার মধ্যে যদি বিশ্বাস, নিষ্ঠা ও একাগ্রতার অভাব থাকে, তাহলে সেই দোয়া আদৌ কোনো দোয়া-ই নয়।
শুধু দুঃসময় কি দুঃখ-দুর্যোগের মধ্যে নয়, আমাদের উচিত সর্বদা ও সর্বাবস্থায়ই দোয়া করা। মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি চায় যে বিপদে ও প্রতিকূল অবস্থায় আল্লাহপাক তাকে সাহায্য করুন, তার প্রার্থনা গ্রহণ করুন, সে যেন সুখে ও সুসময়েও আল্লাহর কাছে সর্বদা দোয়া করে’। রাসূল (সা.) আরও বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহপাকের নিকট কিছু চায় না, আল্লাহ সুবহানুতায়ালা তার প্রতি ক্রোধান্বিত।’
আমাদের উচিত, দুনিয়া এবং আখেরাতের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত আমাদের যে কোনো বিষয়েই আল্লাহপাকের কাছে প্রার্থনা জ্ঞাপন করা। অবশ্য যারা শুধু দুনিয়াকেই একমাত্র বিবেচনা করে এবং দুনিয়াই যাদের প্রার্থনার একমাত্র লক্ষ্যবস্তু, আল কোরআন বলছে, যেখানে তাদের স্থায়ী আবাস সেই আখেরাতে তারা কিছুই পাবে না। তখন নিজেকে ছাড়া তারা তাদের পরকালীন ধ্বংসের জন্য অন্য আর কাউকে দায়ী ও দোষারোপ করতে পারবে না। আল কোরআন আমাদেরকে নিশ্চিতভাবে জানিয়ে দিচ্ছে, সেই ধ্বংস ও বিনাশের জন্য তাদের অপেক্ষা করতে দাও। আবার যারা আখেরাতের প্রতি অত্যধিক মনোযোগী, তারা ভারসাম্য রক্ষা করছেন না; কারণ আল্লাহর সাহায্য আমাদের পার্থিব ও পারলৌকিক উভয় জিন্দেগির জন্যই অত্যাবশ্যক।
উল্লেখ করা আবশ্যক, আমাদের দোয়া শুধু আমাদের নিজের জন্যই নয়। আমাদের পিতামাতা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু-শিক্ষক-শুভানুধ্যায়ী, পীড়িত-অভাবগ্রস্ত এবং বিশ্বব্যাপী সংগ্রামরত মুসলিম ভাই-বোন সবার জন্যই দোয়া করা উচিত। তাদের ঐহিক ও পারত্রিক উভয় জিন্দেগির কল্যাণ ও কামিয়াবির জন্য আন্তরিকভাবে দোয়া করা আমাদের কর্তব্য। রাসুল (সা.) বলেন: ‘একজন মুসিলম যখন তার কোনো মুসলিম ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে দোয়া করে, সেই দোয়া সঙ্গে সঙ্গে গৃহীত হয়। একজন ফেরেশতাকে তার পাশে নিযুক্ত রাখা হয়; যখন সে তার ভাইয়ের কল্যাণের জন্য দোয়া করে, তখন সেই নিযুক্ত ফেরেশতা বলেন, ‘আমীন, এবং তোমার উপরও একই রহমত বর্ষিত হোক’।’ (মুসলিম শরিফ, হাদিস-৪৯১৪)।
অনুবাদ : অধ্যাপক আবু জাফর
একদিন রাসুল মোহাম্মদ (সা.) কিছু দুর্যোগপীড়িত মানুষকে অতিক্রম করে যাওয়ার পর বললেন, ‘তারা আল্লাহপাকের কাছে রহমত ও নিরাপত্তার জন্য দোয়া করে না কেন?’ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মুসলমান আজ যে দুর্ভোগ ও বিপর্যয়ের শিকার, সেই পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্নটি আজ আমাদের উদ্দেশ্যেও করা যেতে পারে।
এমন নয় যে, আমরা দোয়া করার কথা পুরোপুরি বিস্মৃত হয়েছি; আমরা বরং প্রতিনিয়তই নিয়মিতভাবে দোয়া করি। কিন্তু দোয়া সম্পর্কে আমাদের ধারণা ও ক্রিয়াকর্মাদি আসলে রীতিমত বিকৃতির শিকার এবং আমাদের দোয়ার অধিকাংশ সময়ই নিতান্ত আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। সাধারণভাবে এটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, যখন আমাদের সব চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, তখন একেবারে শেষ অবলম্বন হিসেবে দোয়ার কাছে আশ্রয় গ্রহণ করি এবং এটাও লক্ষণীয় যে, কাজে-কর্মে তো বটেই, অমানবিক কথার দ্বারাও দোয়াকে অবজ্ঞা ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয় এবং এটা আদৌ আশ্চর্যজনক নয় যে, দোয়ার এখন অর্থ দাঁড়িয়েছে পরিস্থিতি থেকে উদ্ভুত নৈরাশ্য, হতাশা ও ব্যর্থতার মোকাবিলায় দোয়া যেন এক ব্যর্থ ও অনাবশ্যক আকুতি।
কী দুর্ভাগ্য! অথচ দোয়া হলো বিশ্বাসীদের জন্য সর্বাধিক শক্তিশালী ও সর্বাধিক ফলপ্রসূ একটি হাতিয়ার। দোয়া ভাগ্যলিপিকে পরিবত
ন করতে পারে, যা আমাদের কোনো চেষ্টা-প্রচেষ্টার দ্বারা সম্ভব নয়। দোয়া হলো সব ইবাদতের সৌরভ ও সারবস্তু। দোয়া আমাদের কোনো কাজে কখনও ব্যর্থ হতে দেয় না, আর দোয়া ছাড়া আমরা কখনও সাফল্যও লাভ করতে পারি না। কোনো বিষয়ে সুষ্ঠু পরিকল্পনা-গ্রহণের আগে ও শেষে আল্লাহর সমীপে দোয়া পেশ করা বিশ্বাসীদের জন্য প্রথম ও শেষ ভরসাস্থল; কারণ বিশ্বাসীদের (ঈমানদার) সব পরিকল্পনা ও কার্যক্রম পূর্বাপর দোয়ার মধ্যস্থলে অবস্থিত।
দোয়া হলো আল্লাহপাকের সঙ্গে আমাদের একান্ত বাক্যালাপ, সেই আল্লাহ যিনি আমাদের স্রষ্টা ও অভিভাবক, যিনি আমাদের প্রভু ও প্রতিপালক, যিনি সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান। বস্তুতই, দোয়া এক অসামান্য তাত্পর্য বহন করে। দোয়া ঊর্ধারোহণের শ্রেষ্ঠ সোপান, মুক্তির বার্তা, ক্ষমতাপ্রাপ্তির পাথেয়, রুপান্তর-প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত এক অতীব ফলপ্রসূ জীবনচেতনা, যা কোনো মানুষের পক্ষে অর্জন করা অসম্ভব। দোয়ার মধ্য দিয়ে আমরা আল্লাহর দিকে ফিরে আসি, কারণ আমরা জানি, একমাত্র তিনিই আমাদের সব দুর্ভোগ থেকে মুক্তি দিতে পারেন; এবং একমাত্র তিনিই পারেন আমাদের সব সমস্যার সমাধান করে দিতে। এবং স্রষ্টার কাছে আমাদের সব বিপদ-মুসিবত ও দুর্যোগ-দুর্ভোগের কথা নিবেদন করে আমরা স্বস্তি অনুভব করি; সর্বশক্তিমান আল্লাহর সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে আমরা নিজের মধ্যে শক্তি খুঁজে পাই। অনন্ত-অসীম ক্ষমা ও করুণার যিনি আঁধার, তাঁর কাছে আকুতি জানিয়ে আমরা আমাদের চতুর্দিকে তাঁরই করুণার উপস্থিতি উপলব্ধি করি এবং তাঁর প্রদর্শিত পথে চলার জন্য আমরা নতুনভাবে অঙ্গীকারে সমৃদ্ধ হয়ে উঠি, বুঝতে পারি তাঁর পথই কামিয়াবির একমাত্র পথ। আর এভাবেই আমাদের বিশ্বাস ও অঙ্গীকার নিয়ে আমরা এক অবর্ণনীয় রহমতের আস্বাদ অনুভব করি।
প্রতিটি বিপদের মুহূর্তে আমাদের প্রথম কাজই হলো দোয়া এবং শেষেও দোয়া। আমরা আল্লাহপাকের কাছে প্রার্থনা জানাই বিপদ মোকাবিলার জন্য সঠিক পথ তিনি দেখিয়ে দেবেন। আমরা তাঁরই কাছে সাহায্য কামনা করি যাতে তার প্রদর্শিত পথে আমরা চলতে সক্ষম হই এবং আমাদের সব কাজে লাভ করতে পারি সাফল্য। আমরা যখন রোগগ্রস্ত হয়ে পড়ি, আমরা জানি, আল্লাহর অভিপ্রায় ছাড়া আমরা সঠিক চিকিত্সকের সন্ধান পাব না; জানি তার আদেশ ব্যতীত সর্বোত্তম চিকিত্সকও রোগ-নির্ণয়ে ব্যর্থ হবেন এবং এ কথাও জানি সর্বোত্তম চিকিত্সাও তার অনুমতি ছাড়া নিষম্ফল হতে বাধ্য। আমরা আল্লাহপাকের কাছে এ সবকিছুর জন্যই অনুগ্রহ প্রার্থনা করি। আমরা চিকিত্সা-সাহায্যের জন্য দোয়া করি, চিকিত্সা-লাভের পর নিরাময় হয়েও করি। জীবনের সব বিপদে-মুসিবতে দুঃখে-দুর্যোগে আল্লাহর কাছে আমাদের এই অনুগ্রহ প্রার্থনা একইভাবে একই রকম সত্য।
দোয়া হলো আমাদের সব ইবাদতের সুরভি ও সারবস্তু। আল্লাহপাকের কাছে প্রার্থনারত একজন ব্যক্তি তার তাওহিদী-বিশ্বাসকে (একত্ববাদ, গড়হড়ঃযবরংস) দৃঢ়তার সঙ্গে সত্যায়িত করে এবং সব মিথ্যা-ঈশ্বরকে পরিত্যাগ করে। প্রত্যেক দোয়ার মধ্য দিয়ে আল্লাহপাকের প্রতি তার আস্থা ও বিশ্বাসের পুন: পুন: নবজন্ম ঘটে; এবং তার সানুরাগ প্রার্থনা তার নিজের মধ্যে নিজের অক্ষমতা ও শক্তিহীনতার অনুভূতিও জাগ্রত করে। গুরুত্ব ও আন্তরিকতার সঙ্গে প্রার্থনারত একজন ব্যক্তি যথার্থভাবেই অনুধাবন করতে পারে, স্রষ্টার সঙ্গে তার কী-অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক; এবং এই বিষয়টি তার বাস্তব জীবনের ক্রিয়াকর্মেও ফুটে ওঠে, প্রতিফলিত হয়। আর এটাই তো সব ইবাদত বন্দেগির প্রাণবস্তু। উপরন্তু এ ধরনের মানুষ কখনও দাম্ভিক ও উদ্ধত হতে পারে না, যা আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদিত আমাদের সব আন্তরিক দোয়া ও ইবাদতের যৌক্তিক ফলাফল।
দোয়া আমাদের জীবন সংগ্রামে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী হাতিয়ার, এমনকি যুদ্ধের ময়দানে প্রত্যক্ষ জিহাদেও এই দোয়ার কার্যকারিতা অসামান্য। বদরযুদ্ধ ছিল বিপুল অস্ত্রশস্ত্র-সজ্জিত এক বিশাল মুশরিক বাহিনীর মোকাবিলায় মুসলমানদের একটি অসম যুদ্ধ। যুদ্ধের পূর্বরাতে রাসুল (সা.) আল্লাহপাকের সাহায্য কামনায় নামাজে দাঁড়িয়ে সারারাত অতিবাহিত করলেন। ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত যুদ্ধে সুলতান সালাউদ্দীন আইয়ুবী দিবারাত্রি সমানভাবে ব্যস্ত। তার দিনগুলো কাটত জিহাদে আর রাত্রিগুলো অতিবাহিত হতো আল্লাহর সাহায্য-প্রার্থনায় ক্রন্দনরত অবস্থায় দোয়া ও ইবাদতে।
আমাদের মনে রাখা আবশ্যক, ক্ষুদ্র-বৃহত্ সব বিষয়েই আমরা আল্লাহপাকের কাছে আরজু পেশ করতে পারি। এটাই আসলে প্রজ্ঞার প্রথম কথা যে, ক্ষুদ্র বা বৃহত্ বলে কিছু নেই, এটা মূলত মানুষের প্রয়োজন ও ব্যক্তিগত বিবেচনার ওপর নির্ভরশীল। অতএব এ ধরনের পার্থক্য রচনা একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। বিশেষ করে আমরা যার কাছে প্রার্থনা-করছি, তার কাছে বড় বলে কিছু নেই; আর আমরা যারা কিছু পাওয়ার আশায় প্রার্থনা করি, তাদের কাছে কোনো কিছুই ছোট নয়। এইজন্যই আল্লাহর রাসূল (সা.) শিক্ষা দিয়েছেন, আমরা আল্লাহপাকের কাছে আমাদের প্রয়োজনমত সবকিছুই চাইতে পারি, এমনকি তা যদি জুতার ফিতার মতো কোনো তুচ্ছ জিনিসও হয়। তবে আমাদের চাওয়া উচিত একেবারে ভিখারির মতো, একেবারে রিক্ত নিঃসম্বল অসহায় মানুষের মতো; আর বাস্তব ক্ষেত্রে আল্লাহপাকের সঙ্গে এটাই তো আমাদের প্রকৃত সম্পর্ক এবং এটাও উল্লেখযোগ্য যে, আমাদের প্রার্থনা হতে হবে সর্বোচ্চ আশা ও সুদৃঢ় আস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত; অর্থাত্ আল্লাহপাক অবশ্যই আমাদের প্রার্থনা পূর্ণ করবেন, এই আশা আমাদের অন্তরে সর্বদা জাগরুক থাকবে। প্রসঙ্গত, আমরা একটি হাদিস স্মরণ করতে পারি: ‘আল্লাহর কাছে তার বান্দাহর দোয়া বা প্রার্থনার চেয়ে অধিক প্রিয় আর কিছু নেই’। অন্যদিকে দোয়ার মধ্যে যদি বিশ্বাস, নিষ্ঠা ও একাগ্রতার অভাব থাকে, তাহলে সেই দোয়া আদৌ কোনো দোয়া-ই নয়।
শুধু দুঃসময় কি দুঃখ-দুর্যোগের মধ্যে নয়, আমাদের উচিত সর্বদা ও সর্বাবস্থায়ই দোয়া করা। মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি চায় যে বিপদে ও প্রতিকূল অবস্থায় আল্লাহপাক তাকে সাহায্য করুন, তার প্রার্থনা গ্রহণ করুন, সে যেন সুখে ও সুসময়েও আল্লাহর কাছে সর্বদা দোয়া করে’। রাসূল (সা.) আরও বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহপাকের নিকট কিছু চায় না, আল্লাহ সুবহানুতায়ালা তার প্রতি ক্রোধান্বিত।’
আমাদের উচিত, দুনিয়া এবং আখেরাতের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত আমাদের যে কোনো বিষয়েই আল্লাহপাকের কাছে প্রার্থনা জ্ঞাপন করা। অবশ্য যারা শুধু দুনিয়াকেই একমাত্র বিবেচনা করে এবং দুনিয়াই যাদের প্রার্থনার একমাত্র লক্ষ্যবস্তু, আল কোরআন বলছে, যেখানে তাদের স্থায়ী আবাস সেই আখেরাতে তারা কিছুই পাবে না। তখন নিজেকে ছাড়া তারা তাদের পরকালীন ধ্বংসের জন্য অন্য আর কাউকে দায়ী ও দোষারোপ করতে পারবে না। আল কোরআন আমাদেরকে নিশ্চিতভাবে জানিয়ে দিচ্ছে, সেই ধ্বংস ও বিনাশের জন্য তাদের অপেক্ষা করতে দাও। আবার যারা আখেরাতের প্রতি অত্যধিক মনোযোগী, তারা ভারসাম্য রক্ষা করছেন না; কারণ আল্লাহর সাহায্য আমাদের পার্থিব ও পারলৌকিক উভয় জিন্দেগির জন্যই অত্যাবশ্যক।
উল্লেখ করা আবশ্যক, আমাদের দোয়া শুধু আমাদের নিজের জন্যই নয়। আমাদের পিতামাতা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু-শিক্ষক-শুভানুধ্যায়ী, পীড়িত-অভাবগ্রস্ত এবং বিশ্বব্যাপী সংগ্রামরত মুসলিম ভাই-বোন সবার জন্যই দোয়া করা উচিত। তাদের ঐহিক ও পারত্রিক উভয় জিন্দেগির কল্যাণ ও কামিয়াবির জন্য আন্তরিকভাবে দোয়া করা আমাদের কর্তব্য। রাসুল (সা.) বলেন: ‘একজন মুসিলম যখন তার কোনো মুসলিম ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে দোয়া করে, সেই দোয়া সঙ্গে সঙ্গে গৃহীত হয়। একজন ফেরেশতাকে তার পাশে নিযুক্ত রাখা হয়; যখন সে তার ভাইয়ের কল্যাণের জন্য দোয়া করে, তখন সেই নিযুক্ত ফেরেশতা বলেন, ‘আমীন, এবং তোমার উপরও একই রহমত বর্ষিত হোক’।’ (মুসলিম শরিফ, হাদিস-৪৯১৪)।
অনুবাদ : অধ্যাপক আবু জাফর
No comments:
Post a Comment