Friday, April 29, 2011
Wednesday, April 27, 2011
Friday, April 1, 2011
উত্তরাধিকারে নারীকে অর্ধেক দেয়া হবে কেন?
ইবনে হুসাইন
বস্তুত ইসলাম নারী উন্নয়ন ও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে নয়। বরং নারী নির্যাতনের এক চরম সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে সারা বিশ্বের নির্যাতিত ও নিগৃহীত নারীর পক্ষে ইসলামই সর্বাগ্রে আওয়াজ বুলন্দ করেছে। জীবন্ত প্রোথিত হওয়ার আবহ থেকে, পণ্য হিসেবে বাজারে বিক্রি হওয়ার পরিবেশ থেকে উঠিয়ে এনে নারীকে সম্মানের রাজাসনে ইসলামই সর্বপ্রথম অধিষ্ঠিত করেছে। সামাজিক সমূহ নিগ্রহের অক্টোপাস থেকে মুক্ত করে নারীকে স্বাধীন জীবন উপভোগ করার সুযোগ করে দিয়েছে। মাতৃত্বের গৌরবে বিভূষিত নারীর দেহবল্লরী যাতে যারতার লালসা ও লোলুপ দৃষ্টির শিকার না হয় সেজন্য পর্দার বিধান দিয়ে মানবরূপী পশুদের দৃষ্টিসীমার অন্তরালে নিয়ে নারীকে করেছে দুর্লভ, মহামূল্যবান ও মহাসম্মানী। বিয়েতে মোহরের প্রথার প্রবর্তন করে নারীর মূল্য যে পুরুষের তুলনায় বেশি সে বিষয়টি পরিষ্কার করে দিয়েছে। পারিবারিক অর্থ জোগানের দায়-দায়িত্ব ও কায়িক কষ্টকর শ্রমের বোঝা নারীর ওপর অর্পণ না করে পুরুষের কাঁধে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। আর নারীকে আগামী পৃথিবীর জন্য যোগ্য ও আদর্শবান, সত্পরায়ণ, ন্যায়নিষ্ঠ, মমত্ববোধসম্পন্ন নতুন প্রজন্ম গড়ে তোলার সর্বশ্রেষ্ঠ দায়িত্ব অর্পণ করে তাকে মর্যাদার শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছে দিয়েছে। কোনোরূপ আর্থিক ব্যয়ের দায়িত্ব নারীর ওপর অর্পণ না করেও পৈতৃক উত্তরাধিকারে তাকে পুরুষের অর্ধেক প্রদান করে তার জীবনের অর্থনৈতিক ভিতকে করা হয়েছে সুদৃঢ়; যাতে দুর্যোগের মোকাবিলা সে সহজেই করতে পারে। যৌথ জীবনে পুরুষকে তার অভিভাবক সাব্যস্ত করে সব জটিলতা ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত রেখে নারীকে দান করেছে টেনশনমুক্ত হাস্যোজ্জ্বল এক আনন্দময় জীবন। বলতে গেলে ইসলাম নারীকে যে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত করেছে তার চেয়ে বেশি সম্মান দেয়া আদৌ সম্ভব নয়। পৃথিবীতে কেউ দেয়নি, দিতে পারবে না কোনো কালেও।
বস্তুত নারী-পুরুষের স্বভাব ও মেজাজ বিবেচনা করে ইসলাম কোনো ক্ষেত্রে নারীকে দায়িত্ব দিয়েছে কম, পুরুষকে দিয়েছে বেশি, আবার কোনো ক্ষেত্রে পুরুষকে দায়িত্ব দিয়েছে কম নারীকে দিয়েছে বেশি। আবার অধিকারের প্রশ্নেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষকে দেয়া হয়েছে বেশি, আর নারীকে দেয়া হয়েছে কম। তবে এ ধরনের ক্ষেত্র খুব একটা বেশি নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইসলাম উভয়ের দায়িত্ব ও অধিকারে সাম্য বিধান করেছে যথার্থভাবেই। যেসব ক্ষেত্রে কাউকে বেশি ও কাউকে কম দেয়া হয়েছে, তার যুক্তিসঙ্গত কারণ ব্যাখ্যাা করে দিয়েছে ইসলাম। সামাজিক ভারসাম্য ও পারিবারিক বন্ধন অটুট রাখার জন্যই যে এরূপ করা হয়েছে তা বলাই বাহুল্য। ইসলামের এই ভারসাম্যপূর্ণ নীতি অনুসরণ করে ১৪শ’ বছর যাবত ইসলামী সমাজ নির্বিঘ্নে পরম শান্তি ও শৃঙ্খলার সঙ্গে অতিবাহিত করে আসছে তাদের জীবন। কিন্তু পাশ্চাত্য জগতের নারীরা ইসলাম প্রদত্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকার কারণে ছিল চরম নিগ্রহের শিকার। সেই নিগ্রহের জাঁতাকলে পিষ্ট হতে হতে একদিন তথাকার নারীরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে; তারা তাদের অধিকারের দাবি নিয়ে রাজপথে অবতীর্ণ হয়। সেই আন্দোলন জোরদার হয়ে একদিন তা সমঅধিকার দাবিতে পরিণত হয়। বস্তুত সেই প্রেক্ষাপটেই অনুষ্ঠিত হয় ‘কনভেনশন অন দ্য এলিমিনেশন অব-অলফম অব ডিসক্রিমিনেশন এগেইনস্ট উইমেন’ সংক্ষেপে (সিডও)। সেই সম্মেলনের সিদ্ধান্তবলিকে বলা হয় ‘সিডও সনদ’। জাতিসংঘ এ সনদ জারি করতে চাইলে বিশ্বের বহু দেশই তা মেনে নেয়নি। কেননা সেই সনদে নারীকে যেভাবে চিত্রায়ন করা হয়েছে, তা স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করে বাস্তবায়ন করা সম্ভব ছিল না। অধিকাংশ মুসলিম দেশও তা মেনে নেয়নি। কেননা তার বহু ধারা ইসলামের সঙ্গে ছিল সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক।
বিশেষ করে উত্তরাধিকারে নারী-পুরুষের সমতার নীতি এবং তালাকের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতার নীতি ছিল সম্পূর্ণরূপে কোরআনের বিধানের পরিপন্থী। একই পিতামাতার সন্তান হয়ে বোন পাবে ভাইয়ের অর্ধেক। এই নীতি অনেকের কাছেই যুক্তিগ্রাহ্য নয়। এ নীতির মাঝে অনেকেই অবিচারের গন্ধ পান, নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের তত্ত্ব আবিষ্কার করার চেষ্টা করেন। আসলে মহান আল্লাহ তায়ালা নারীদের প্রতি কতটা সহানুভূতি প্রদর্শন করেছেন, সে বিষয়টি তারা তলিয়ে দেখেন না।
নারীকে উত্তরাধিকারে সমান না দেয়ার প্রশ্ন উঠিয়ে একশ্রেণীর তথাকথিত বুদ্ধিজীবী নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যে মায়াকান্না করছেন তারা আসলে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে আদৌ ধারণাই রাখেন না। কেননা, পৈতৃক উত্তরাধিকারই নারীর একমাত্র উত্তরাধিকারের সূত্র নয়; বরং নারীরা পিতামাতার সম্পদে উত্তরাধিকার লাভের সঙ্গে সঙ্গে স্বামীর সম্পদেও উত্তরাধিকার লাভ করে থাকেন। স্বামী নিঃসন্তান হলে তার সম্পদের এক-চতুর্থাংশ লাভ করেন। আর স্বামীর সন্তান থাকলে তখন এক অষ্টমাংশ লাভ করেন। আর নারীর জীবদ্দশায় তার সন্তান মারা গেলে তার সম্পদের এক ষষ্ঠাংশ লাভ করে থাকেন। এভাবে বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তার সম্পদের পরিমাণ তার দায়-দায়িত্ব ও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি।
ইসলামী সমাজে নারীকে কোনো অর্থনৈতিক দায়িত্ব বহন করতে হয় না। এমনকি তার নিজের দায়িত্বও তাকে বহন করতে হয় না। জন্মের পর থেকে বিয়ের আগ পর্যন্ত তার লালন-পালন ও ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পিতার। বিয়ের পর তার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব স্বামীর। স্বামীর মৃত্যুর পর তার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব ছেলের (যদি সে বালেগ হয়)। সুতরাং কোনো এক সন্ধিক্ষণেও তার নিজের দায়িত্ব তাকে বহন করতে হয় না। সন্তানের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পিতার, মাতার নয়। বাবা-মা বৃদ্ধ হয়ে গেলে তাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব ছেলের। পারিবারিক আত্মীয়-স্বজনের আপ্যায়নের দায়িত্ব পুরুষের, নারীর নয়। সারকথা এই দাঁড়ায়, জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই নারীকে তার নিজের বা অন্যের দায়িত্ব বহন করতে হয় না। অথচ ছেলে সন্তান হলে বালেগ হওয়ার আগ পর্যন্ত তার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পিতার। বালেগ হওয়ার পর থেকে তার নিজের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব আইনগতভাবে তার নিজের। বিয়ে করলে স্ত্রীর ভরণ-পোষণের
দায়িত্ব তার ওপর বর্তায়। সন্তান জন্মালে তাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব বাবা হিসেবে তার ওপর এসে যায়। পিতা-মাতা বৃদ্ধ হয়ে গেল তাদের সম্পদ না থাকলে এবং তারা উপার্জনে অক্ষম হলে তাদের দায়-দায়িত্ব ছেলের। আত্মীয়-স্বজনের আপ্যায়নের দায়িত্ব ছেলের ওপর। বেচারা পুরুষ নিজের, স্ত্রী-সন্তান ও পিতা-মাতাসহ সবার দায়িত্ব বহন করে যা পায়, তা নারীর প্রাপ্তির তুলনায় যথেষ্ট কম। পক্ষান্তরে রমণী নিজের দায়িত্বও বহন করে না, আর অন্য কারও কোনো দায়িত্ব বহন না করার পরও তাকে যদি পৈতৃক উত্তরাধিকারে পুরুষের অর্ধেকসহ অন্য সূত্রেও উত্তরাধিকারে অংশ দেয়া হয়ে থাকে, তাহলে কি বিষয়টা অবিচার করা হয়েছে বলে মনে হয়? তদুপরি মোহর হিসেবে প্রাপ্ত টাকা, বৈধ পন্থায় উপার্জিত সম্পদে তার পূর্ণ অধিকার থাকে। স্বামী অভাবে পড়লেও স্ত্রীর ব্যক্তিগত সম্পদে হস্তক্ষেপ করার কোনো অধিকার তার নেই। সুতরাং বলা যায়, দায়-দায়িত্ব ও প্রয়োজনের বিচারে নারীকে উত্তরাধিকার হিসেবে যতটুকু দেয়া হয়েছে তা অনেক বেশি। নারী দুর্বল বলেই দায়িত্ব না দিয়েও তাকে পিতা-মাতার উত্তরাধিকারে অর্ধেক দেয়া হয়েছে। যাতে দুর্যোগের সময় বা কারও অসহযোগিতার মুহূর্তে তার জীবন সঙ্কটে নিপতিত না হয়। ইসলামী সমাজের এই স্ট্রাকচারাল দিক সম্পর্কে যারা অবগত নয়, তারাই আল্লাহর বিচারে সন্তুষ্ট হতে না পেরে নিজেরাই নারীর পক্ষে মায়াকান্না শুরু করে দেন। তাদের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয়, (নাউজুবিল্লাহ) মহান আল্লাহ তায়ালা ভুল করলেও তারা সে ভুল সংশোধন করে ফেলতে চান। তাই তারা সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু করেন। জাতিসংঘ প্রণীত সিডও সনদ পড়ে সেরূপই মনে হয়। তবে মুসলিম জাতিকে মনে রাখতে হবে, আল্লাহর চেয়ে ইনসাফগার কেউ হতে পারে না। যদি কেউ সেরূপ দাবি নিয়ে উপস্থিত হয়, তাহলে মনে করতে হবে এর পেছনে কোনো অসত্ উদ্দেশ্য লুকায়িত আছে। ষ
লেখক : গবেষক, গ্রন্থকার, ইসলামী চিন্তাবিদ
বস্তুত ইসলাম নারী উন্নয়ন ও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে নয়। বরং নারী নির্যাতনের এক চরম সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে সারা বিশ্বের নির্যাতিত ও নিগৃহীত নারীর পক্ষে ইসলামই সর্বাগ্রে আওয়াজ বুলন্দ করেছে। জীবন্ত প্রোথিত হওয়ার আবহ থেকে, পণ্য হিসেবে বাজারে বিক্রি হওয়ার পরিবেশ থেকে উঠিয়ে এনে নারীকে সম্মানের রাজাসনে ইসলামই সর্বপ্রথম অধিষ্ঠিত করেছে। সামাজিক সমূহ নিগ্রহের অক্টোপাস থেকে মুক্ত করে নারীকে স্বাধীন জীবন উপভোগ করার সুযোগ করে দিয়েছে। মাতৃত্বের গৌরবে বিভূষিত নারীর দেহবল্লরী যাতে যারতার লালসা ও লোলুপ দৃষ্টির শিকার না হয় সেজন্য পর্দার বিধান দিয়ে মানবরূপী পশুদের দৃষ্টিসীমার অন্তরালে নিয়ে নারীকে করেছে দুর্লভ, মহামূল্যবান ও মহাসম্মানী। বিয়েতে মোহরের প্রথার প্রবর্তন করে নারীর মূল্য যে পুরুষের তুলনায় বেশি সে বিষয়টি পরিষ্কার করে দিয়েছে। পারিবারিক অর্থ জোগানের দায়-দায়িত্ব ও কায়িক কষ্টকর শ্রমের বোঝা নারীর ওপর অর্পণ না করে পুরুষের কাঁধে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। আর নারীকে আগামী পৃথিবীর জন্য যোগ্য ও আদর্শবান, সত্পরায়ণ, ন্যায়নিষ্ঠ, মমত্ববোধসম্পন্ন নতুন প্রজন্ম গড়ে তোলার সর্বশ্রেষ্ঠ দায়িত্ব অর্পণ করে তাকে মর্যাদার শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছে দিয়েছে। কোনোরূপ আর্থিক ব্যয়ের দায়িত্ব নারীর ওপর অর্পণ না করেও পৈতৃক উত্তরাধিকারে তাকে পুরুষের অর্ধেক প্রদান করে তার জীবনের অর্থনৈতিক ভিতকে করা হয়েছে সুদৃঢ়; যাতে দুর্যোগের মোকাবিলা সে সহজেই করতে পারে। যৌথ জীবনে পুরুষকে তার অভিভাবক সাব্যস্ত করে সব জটিলতা ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত রেখে নারীকে দান করেছে টেনশনমুক্ত হাস্যোজ্জ্বল এক আনন্দময় জীবন। বলতে গেলে ইসলাম নারীকে যে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত করেছে তার চেয়ে বেশি সম্মান দেয়া আদৌ সম্ভব নয়। পৃথিবীতে কেউ দেয়নি, দিতে পারবে না কোনো কালেও।
বস্তুত নারী-পুরুষের স্বভাব ও মেজাজ বিবেচনা করে ইসলাম কোনো ক্ষেত্রে নারীকে দায়িত্ব দিয়েছে কম, পুরুষকে দিয়েছে বেশি, আবার কোনো ক্ষেত্রে পুরুষকে দায়িত্ব দিয়েছে কম নারীকে দিয়েছে বেশি। আবার অধিকারের প্রশ্নেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষকে দেয়া হয়েছে বেশি, আর নারীকে দেয়া হয়েছে কম। তবে এ ধরনের ক্ষেত্র খুব একটা বেশি নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইসলাম উভয়ের দায়িত্ব ও অধিকারে সাম্য বিধান করেছে যথার্থভাবেই। যেসব ক্ষেত্রে কাউকে বেশি ও কাউকে কম দেয়া হয়েছে, তার যুক্তিসঙ্গত কারণ ব্যাখ্যাা করে দিয়েছে ইসলাম। সামাজিক ভারসাম্য ও পারিবারিক বন্ধন অটুট রাখার জন্যই যে এরূপ করা হয়েছে তা বলাই বাহুল্য। ইসলামের এই ভারসাম্যপূর্ণ নীতি অনুসরণ করে ১৪শ’ বছর যাবত ইসলামী সমাজ নির্বিঘ্নে পরম শান্তি ও শৃঙ্খলার সঙ্গে অতিবাহিত করে আসছে তাদের জীবন। কিন্তু পাশ্চাত্য জগতের নারীরা ইসলাম প্রদত্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকার কারণে ছিল চরম নিগ্রহের শিকার। সেই নিগ্রহের জাঁতাকলে পিষ্ট হতে হতে একদিন তথাকার নারীরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে; তারা তাদের অধিকারের দাবি নিয়ে রাজপথে অবতীর্ণ হয়। সেই আন্দোলন জোরদার হয়ে একদিন তা সমঅধিকার দাবিতে পরিণত হয়। বস্তুত সেই প্রেক্ষাপটেই অনুষ্ঠিত হয় ‘কনভেনশন অন দ্য এলিমিনেশন অব-অলফম অব ডিসক্রিমিনেশন এগেইনস্ট উইমেন’ সংক্ষেপে (সিডও)। সেই সম্মেলনের সিদ্ধান্তবলিকে বলা হয় ‘সিডও সনদ’। জাতিসংঘ এ সনদ জারি করতে চাইলে বিশ্বের বহু দেশই তা মেনে নেয়নি। কেননা সেই সনদে নারীকে যেভাবে চিত্রায়ন করা হয়েছে, তা স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করে বাস্তবায়ন করা সম্ভব ছিল না। অধিকাংশ মুসলিম দেশও তা মেনে নেয়নি। কেননা তার বহু ধারা ইসলামের সঙ্গে ছিল সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক।
বিশেষ করে উত্তরাধিকারে নারী-পুরুষের সমতার নীতি এবং তালাকের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতার নীতি ছিল সম্পূর্ণরূপে কোরআনের বিধানের পরিপন্থী। একই পিতামাতার সন্তান হয়ে বোন পাবে ভাইয়ের অর্ধেক। এই নীতি অনেকের কাছেই যুক্তিগ্রাহ্য নয়। এ নীতির মাঝে অনেকেই অবিচারের গন্ধ পান, নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের তত্ত্ব আবিষ্কার করার চেষ্টা করেন। আসলে মহান আল্লাহ তায়ালা নারীদের প্রতি কতটা সহানুভূতি প্রদর্শন করেছেন, সে বিষয়টি তারা তলিয়ে দেখেন না।
নারীকে উত্তরাধিকারে সমান না দেয়ার প্রশ্ন উঠিয়ে একশ্রেণীর তথাকথিত বুদ্ধিজীবী নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যে মায়াকান্না করছেন তারা আসলে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে আদৌ ধারণাই রাখেন না। কেননা, পৈতৃক উত্তরাধিকারই নারীর একমাত্র উত্তরাধিকারের সূত্র নয়; বরং নারীরা পিতামাতার সম্পদে উত্তরাধিকার লাভের সঙ্গে সঙ্গে স্বামীর সম্পদেও উত্তরাধিকার লাভ করে থাকেন। স্বামী নিঃসন্তান হলে তার সম্পদের এক-চতুর্থাংশ লাভ করেন। আর স্বামীর সন্তান থাকলে তখন এক অষ্টমাংশ লাভ করেন। আর নারীর জীবদ্দশায় তার সন্তান মারা গেলে তার সম্পদের এক ষষ্ঠাংশ লাভ করে থাকেন। এভাবে বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তার সম্পদের পরিমাণ তার দায়-দায়িত্ব ও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি।
ইসলামী সমাজে নারীকে কোনো অর্থনৈতিক দায়িত্ব বহন করতে হয় না। এমনকি তার নিজের দায়িত্বও তাকে বহন করতে হয় না। জন্মের পর থেকে বিয়ের আগ পর্যন্ত তার লালন-পালন ও ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পিতার। বিয়ের পর তার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব স্বামীর। স্বামীর মৃত্যুর পর তার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব ছেলের (যদি সে বালেগ হয়)। সুতরাং কোনো এক সন্ধিক্ষণেও তার নিজের দায়িত্ব তাকে বহন করতে হয় না। সন্তানের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পিতার, মাতার নয়। বাবা-মা বৃদ্ধ হয়ে গেলে তাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব ছেলের। পারিবারিক আত্মীয়-স্বজনের আপ্যায়নের দায়িত্ব পুরুষের, নারীর নয়। সারকথা এই দাঁড়ায়, জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই নারীকে তার নিজের বা অন্যের দায়িত্ব বহন করতে হয় না। অথচ ছেলে সন্তান হলে বালেগ হওয়ার আগ পর্যন্ত তার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পিতার। বালেগ হওয়ার পর থেকে তার নিজের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব আইনগতভাবে তার নিজের। বিয়ে করলে স্ত্রীর ভরণ-পোষণের
দায়িত্ব তার ওপর বর্তায়। সন্তান জন্মালে তাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব বাবা হিসেবে তার ওপর এসে যায়। পিতা-মাতা বৃদ্ধ হয়ে গেল তাদের সম্পদ না থাকলে এবং তারা উপার্জনে অক্ষম হলে তাদের দায়-দায়িত্ব ছেলের। আত্মীয়-স্বজনের আপ্যায়নের দায়িত্ব ছেলের ওপর। বেচারা পুরুষ নিজের, স্ত্রী-সন্তান ও পিতা-মাতাসহ সবার দায়িত্ব বহন করে যা পায়, তা নারীর প্রাপ্তির তুলনায় যথেষ্ট কম। পক্ষান্তরে রমণী নিজের দায়িত্বও বহন করে না, আর অন্য কারও কোনো দায়িত্ব বহন না করার পরও তাকে যদি পৈতৃক উত্তরাধিকারে পুরুষের অর্ধেকসহ অন্য সূত্রেও উত্তরাধিকারে অংশ দেয়া হয়ে থাকে, তাহলে কি বিষয়টা অবিচার করা হয়েছে বলে মনে হয়? তদুপরি মোহর হিসেবে প্রাপ্ত টাকা, বৈধ পন্থায় উপার্জিত সম্পদে তার পূর্ণ অধিকার থাকে। স্বামী অভাবে পড়লেও স্ত্রীর ব্যক্তিগত সম্পদে হস্তক্ষেপ করার কোনো অধিকার তার নেই। সুতরাং বলা যায়, দায়-দায়িত্ব ও প্রয়োজনের বিচারে নারীকে উত্তরাধিকার হিসেবে যতটুকু দেয়া হয়েছে তা অনেক বেশি। নারী দুর্বল বলেই দায়িত্ব না দিয়েও তাকে পিতা-মাতার উত্তরাধিকারে অর্ধেক দেয়া হয়েছে। যাতে দুর্যোগের সময় বা কারও অসহযোগিতার মুহূর্তে তার জীবন সঙ্কটে নিপতিত না হয়। ইসলামী সমাজের এই স্ট্রাকচারাল দিক সম্পর্কে যারা অবগত নয়, তারাই আল্লাহর বিচারে সন্তুষ্ট হতে না পেরে নিজেরাই নারীর পক্ষে মায়াকান্না শুরু করে দেন। তাদের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয়, (নাউজুবিল্লাহ) মহান আল্লাহ তায়ালা ভুল করলেও তারা সে ভুল সংশোধন করে ফেলতে চান। তাই তারা সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু করেন। জাতিসংঘ প্রণীত সিডও সনদ পড়ে সেরূপই মনে হয়। তবে মুসলিম জাতিকে মনে রাখতে হবে, আল্লাহর চেয়ে ইনসাফগার কেউ হতে পারে না। যদি কেউ সেরূপ দাবি নিয়ে উপস্থিত হয়, তাহলে মনে করতে হবে এর পেছনে কোনো অসত্ উদ্দেশ্য লুকায়িত আছে। ষ
লেখক : গবেষক, গ্রন্থকার, ইসলামী চিন্তাবিদ
মুমিনের জীবনে দোয়ার শক্তি ও প্রভাব
খা লি দ বে গ
একদিন রাসুল মোহাম্মদ (সা.) কিছু দুর্যোগপীড়িত মানুষকে অতিক্রম করে যাওয়ার পর বললেন, ‘তারা আল্লাহপাকের কাছে রহমত ও নিরাপত্তার জন্য দোয়া করে না কেন?’ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মুসলমান আজ যে দুর্ভোগ ও বিপর্যয়ের শিকার, সেই পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্নটি আজ আমাদের উদ্দেশ্যেও করা যেতে পারে।
এমন নয় যে, আমরা দোয়া করার কথা পুরোপুরি বিস্মৃত হয়েছি; আমরা বরং প্রতিনিয়তই নিয়মিতভাবে দোয়া করি। কিন্তু দোয়া সম্পর্কে আমাদের ধারণা ও ক্রিয়াকর্মাদি আসলে রীতিমত বিকৃতির শিকার এবং আমাদের দোয়ার অধিকাংশ সময়ই নিতান্ত আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। সাধারণভাবে এটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, যখন আমাদের সব চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, তখন একেবারে শেষ অবলম্বন হিসেবে দোয়ার কাছে আশ্রয় গ্রহণ করি এবং এটাও লক্ষণীয় যে, কাজে-কর্মে তো বটেই, অমানবিক কথার দ্বারাও দোয়াকে অবজ্ঞা ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয় এবং এটা আদৌ আশ্চর্যজনক নয় যে, দোয়ার এখন অর্থ দাঁড়িয়েছে পরিস্থিতি থেকে উদ্ভুত নৈরাশ্য, হতাশা ও ব্যর্থতার মোকাবিলায় দোয়া যেন এক ব্যর্থ ও অনাবশ্যক আকুতি।
কী দুর্ভাগ্য! অথচ দোয়া হলো বিশ্বাসীদের জন্য সর্বাধিক শক্তিশালী ও সর্বাধিক ফলপ্রসূ একটি হাতিয়ার। দোয়া ভাগ্যলিপিকে পরিবত
ন করতে পারে, যা আমাদের কোনো চেষ্টা-প্রচেষ্টার দ্বারা সম্ভব নয়। দোয়া হলো সব ইবাদতের সৌরভ ও সারবস্তু। দোয়া আমাদের কোনো কাজে কখনও ব্যর্থ হতে দেয় না, আর দোয়া ছাড়া আমরা কখনও সাফল্যও লাভ করতে পারি না। কোনো বিষয়ে সুষ্ঠু পরিকল্পনা-গ্রহণের আগে ও শেষে আল্লাহর সমীপে দোয়া পেশ করা বিশ্বাসীদের জন্য প্রথম ও শেষ ভরসাস্থল; কারণ বিশ্বাসীদের (ঈমানদার) সব পরিকল্পনা ও কার্যক্রম পূর্বাপর দোয়ার মধ্যস্থলে অবস্থিত।
দোয়া হলো আল্লাহপাকের সঙ্গে আমাদের একান্ত বাক্যালাপ, সেই আল্লাহ যিনি আমাদের স্রষ্টা ও অভিভাবক, যিনি আমাদের প্রভু ও প্রতিপালক, যিনি সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান। বস্তুতই, দোয়া এক অসামান্য তাত্পর্য বহন করে। দোয়া ঊর্ধারোহণের শ্রেষ্ঠ সোপান, মুক্তির বার্তা, ক্ষমতাপ্রাপ্তির পাথেয়, রুপান্তর-প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত এক অতীব ফলপ্রসূ জীবনচেতনা, যা কোনো মানুষের পক্ষে অর্জন করা অসম্ভব। দোয়ার মধ্য দিয়ে আমরা আল্লাহর দিকে ফিরে আসি, কারণ আমরা জানি, একমাত্র তিনিই আমাদের সব দুর্ভোগ থেকে মুক্তি দিতে পারেন; এবং একমাত্র তিনিই পারেন আমাদের সব সমস্যার সমাধান করে দিতে। এবং স্রষ্টার কাছে আমাদের সব বিপদ-মুসিবত ও দুর্যোগ-দুর্ভোগের কথা নিবেদন করে আমরা স্বস্তি অনুভব করি; সর্বশক্তিমান আল্লাহর সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে আমরা নিজের মধ্যে শক্তি খুঁজে পাই। অনন্ত-অসীম ক্ষমা ও করুণার যিনি আঁধার, তাঁর কাছে আকুতি জানিয়ে আমরা আমাদের চতুর্দিকে তাঁরই করুণার উপস্থিতি উপলব্ধি করি এবং তাঁর প্রদর্শিত পথে চলার জন্য আমরা নতুনভাবে অঙ্গীকারে সমৃদ্ধ হয়ে উঠি, বুঝতে পারি তাঁর পথই কামিয়াবির একমাত্র পথ। আর এভাবেই আমাদের বিশ্বাস ও অঙ্গীকার নিয়ে আমরা এক অবর্ণনীয় রহমতের আস্বাদ অনুভব করি।
প্রতিটি বিপদের মুহূর্তে আমাদের প্রথম কাজই হলো দোয়া এবং শেষেও দোয়া। আমরা আল্লাহপাকের কাছে প্রার্থনা জানাই বিপদ মোকাবিলার জন্য সঠিক পথ তিনি দেখিয়ে দেবেন। আমরা তাঁরই কাছে সাহায্য কামনা করি যাতে তার প্রদর্শিত পথে আমরা চলতে সক্ষম হই এবং আমাদের সব কাজে লাভ করতে পারি সাফল্য। আমরা যখন রোগগ্রস্ত হয়ে পড়ি, আমরা জানি, আল্লাহর অভিপ্রায় ছাড়া আমরা সঠিক চিকিত্সকের সন্ধান পাব না; জানি তার আদেশ ব্যতীত সর্বোত্তম চিকিত্সকও রোগ-নির্ণয়ে ব্যর্থ হবেন এবং এ কথাও জানি সর্বোত্তম চিকিত্সাও তার অনুমতি ছাড়া নিষম্ফল হতে বাধ্য। আমরা আল্লাহপাকের কাছে এ সবকিছুর জন্যই অনুগ্রহ প্রার্থনা করি। আমরা চিকিত্সা-সাহায্যের জন্য দোয়া করি, চিকিত্সা-লাভের পর নিরাময় হয়েও করি। জীবনের সব বিপদে-মুসিবতে দুঃখে-দুর্যোগে আল্লাহর কাছে আমাদের এই অনুগ্রহ প্রার্থনা একইভাবে একই রকম সত্য।
দোয়া হলো আমাদের সব ইবাদতের সুরভি ও সারবস্তু। আল্লাহপাকের কাছে প্রার্থনারত একজন ব্যক্তি তার তাওহিদী-বিশ্বাসকে (একত্ববাদ, গড়হড়ঃযবরংস) দৃঢ়তার সঙ্গে সত্যায়িত করে এবং সব মিথ্যা-ঈশ্বরকে পরিত্যাগ করে। প্রত্যেক দোয়ার মধ্য দিয়ে আল্লাহপাকের প্রতি তার আস্থা ও বিশ্বাসের পুন: পুন: নবজন্ম ঘটে; এবং তার সানুরাগ প্রার্থনা তার নিজের মধ্যে নিজের অক্ষমতা ও শক্তিহীনতার অনুভূতিও জাগ্রত করে। গুরুত্ব ও আন্তরিকতার সঙ্গে প্রার্থনারত একজন ব্যক্তি যথার্থভাবেই অনুধাবন করতে পারে, স্রষ্টার সঙ্গে তার কী-অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক; এবং এই বিষয়টি তার বাস্তব জীবনের ক্রিয়াকর্মেও ফুটে ওঠে, প্রতিফলিত হয়। আর এটাই তো সব ইবাদত বন্দেগির প্রাণবস্তু। উপরন্তু এ ধরনের মানুষ কখনও দাম্ভিক ও উদ্ধত হতে পারে না, যা আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদিত আমাদের সব আন্তরিক দোয়া ও ইবাদতের যৌক্তিক ফলাফল।
দোয়া আমাদের জীবন সংগ্রামে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী হাতিয়ার, এমনকি যুদ্ধের ময়দানে প্রত্যক্ষ জিহাদেও এই দোয়ার কার্যকারিতা অসামান্য। বদরযুদ্ধ ছিল বিপুল অস্ত্রশস্ত্র-সজ্জিত এক বিশাল মুশরিক বাহিনীর মোকাবিলায় মুসলমানদের একটি অসম যুদ্ধ। যুদ্ধের পূর্বরাতে রাসুল (সা.) আল্লাহপাকের সাহায্য কামনায় নামাজে দাঁড়িয়ে সারারাত অতিবাহিত করলেন। ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত যুদ্ধে সুলতান সালাউদ্দীন আইয়ুবী দিবারাত্রি সমানভাবে ব্যস্ত। তার দিনগুলো কাটত জিহাদে আর রাত্রিগুলো অতিবাহিত হতো আল্লাহর সাহায্য-প্রার্থনায় ক্রন্দনরত অবস্থায় দোয়া ও ইবাদতে।
আমাদের মনে রাখা আবশ্যক, ক্ষুদ্র-বৃহত্ সব বিষয়েই আমরা আল্লাহপাকের কাছে আরজু পেশ করতে পারি। এটাই আসলে প্রজ্ঞার প্রথম কথা যে, ক্ষুদ্র বা বৃহত্ বলে কিছু নেই, এটা মূলত মানুষের প্রয়োজন ও ব্যক্তিগত বিবেচনার ওপর নির্ভরশীল। অতএব এ ধরনের পার্থক্য রচনা একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। বিশেষ করে আমরা যার কাছে প্রার্থনা-করছি, তার কাছে বড় বলে কিছু নেই; আর আমরা যারা কিছু পাওয়ার আশায় প্রার্থনা করি, তাদের কাছে কোনো কিছুই ছোট নয়। এইজন্যই আল্লাহর রাসূল (সা.) শিক্ষা দিয়েছেন, আমরা আল্লাহপাকের কাছে আমাদের প্রয়োজনমত সবকিছুই চাইতে পারি, এমনকি তা যদি জুতার ফিতার মতো কোনো তুচ্ছ জিনিসও হয়। তবে আমাদের চাওয়া উচিত একেবারে ভিখারির মতো, একেবারে রিক্ত নিঃসম্বল অসহায় মানুষের মতো; আর বাস্তব ক্ষেত্রে আল্লাহপাকের সঙ্গে এটাই তো আমাদের প্রকৃত সম্পর্ক এবং এটাও উল্লেখযোগ্য যে, আমাদের প্রার্থনা হতে হবে সর্বোচ্চ আশা ও সুদৃঢ় আস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত; অর্থাত্ আল্লাহপাক অবশ্যই আমাদের প্রার্থনা পূর্ণ করবেন, এই আশা আমাদের অন্তরে সর্বদা জাগরুক থাকবে। প্রসঙ্গত, আমরা একটি হাদিস স্মরণ করতে পারি: ‘আল্লাহর কাছে তার বান্দাহর দোয়া বা প্রার্থনার চেয়ে অধিক প্রিয় আর কিছু নেই’। অন্যদিকে দোয়ার মধ্যে যদি বিশ্বাস, নিষ্ঠা ও একাগ্রতার অভাব থাকে, তাহলে সেই দোয়া আদৌ কোনো দোয়া-ই নয়।
শুধু দুঃসময় কি দুঃখ-দুর্যোগের মধ্যে নয়, আমাদের উচিত সর্বদা ও সর্বাবস্থায়ই দোয়া করা। মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি চায় যে বিপদে ও প্রতিকূল অবস্থায় আল্লাহপাক তাকে সাহায্য করুন, তার প্রার্থনা গ্রহণ করুন, সে যেন সুখে ও সুসময়েও আল্লাহর কাছে সর্বদা দোয়া করে’। রাসূল (সা.) আরও বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহপাকের নিকট কিছু চায় না, আল্লাহ সুবহানুতায়ালা তার প্রতি ক্রোধান্বিত।’
আমাদের উচিত, দুনিয়া এবং আখেরাতের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত আমাদের যে কোনো বিষয়েই আল্লাহপাকের কাছে প্রার্থনা জ্ঞাপন করা। অবশ্য যারা শুধু দুনিয়াকেই একমাত্র বিবেচনা করে এবং দুনিয়াই যাদের প্রার্থনার একমাত্র লক্ষ্যবস্তু, আল কোরআন বলছে, যেখানে তাদের স্থায়ী আবাস সেই আখেরাতে তারা কিছুই পাবে না। তখন নিজেকে ছাড়া তারা তাদের পরকালীন ধ্বংসের জন্য অন্য আর কাউকে দায়ী ও দোষারোপ করতে পারবে না। আল কোরআন আমাদেরকে নিশ্চিতভাবে জানিয়ে দিচ্ছে, সেই ধ্বংস ও বিনাশের জন্য তাদের অপেক্ষা করতে দাও। আবার যারা আখেরাতের প্রতি অত্যধিক মনোযোগী, তারা ভারসাম্য রক্ষা করছেন না; কারণ আল্লাহর সাহায্য আমাদের পার্থিব ও পারলৌকিক উভয় জিন্দেগির জন্যই অত্যাবশ্যক।
উল্লেখ করা আবশ্যক, আমাদের দোয়া শুধু আমাদের নিজের জন্যই নয়। আমাদের পিতামাতা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু-শিক্ষক-শুভানুধ্যায়ী, পীড়িত-অভাবগ্রস্ত এবং বিশ্বব্যাপী সংগ্রামরত মুসলিম ভাই-বোন সবার জন্যই দোয়া করা উচিত। তাদের ঐহিক ও পারত্রিক উভয় জিন্দেগির কল্যাণ ও কামিয়াবির জন্য আন্তরিকভাবে দোয়া করা আমাদের কর্তব্য। রাসুল (সা.) বলেন: ‘একজন মুসিলম যখন তার কোনো মুসলিম ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে দোয়া করে, সেই দোয়া সঙ্গে সঙ্গে গৃহীত হয়। একজন ফেরেশতাকে তার পাশে নিযুক্ত রাখা হয়; যখন সে তার ভাইয়ের কল্যাণের জন্য দোয়া করে, তখন সেই নিযুক্ত ফেরেশতা বলেন, ‘আমীন, এবং তোমার উপরও একই রহমত বর্ষিত হোক’।’ (মুসলিম শরিফ, হাদিস-৪৯১৪)।
অনুবাদ : অধ্যাপক আবু জাফর
একদিন রাসুল মোহাম্মদ (সা.) কিছু দুর্যোগপীড়িত মানুষকে অতিক্রম করে যাওয়ার পর বললেন, ‘তারা আল্লাহপাকের কাছে রহমত ও নিরাপত্তার জন্য দোয়া করে না কেন?’ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মুসলমান আজ যে দুর্ভোগ ও বিপর্যয়ের শিকার, সেই পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্নটি আজ আমাদের উদ্দেশ্যেও করা যেতে পারে।
এমন নয় যে, আমরা দোয়া করার কথা পুরোপুরি বিস্মৃত হয়েছি; আমরা বরং প্রতিনিয়তই নিয়মিতভাবে দোয়া করি। কিন্তু দোয়া সম্পর্কে আমাদের ধারণা ও ক্রিয়াকর্মাদি আসলে রীতিমত বিকৃতির শিকার এবং আমাদের দোয়ার অধিকাংশ সময়ই নিতান্ত আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। সাধারণভাবে এটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, যখন আমাদের সব চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, তখন একেবারে শেষ অবলম্বন হিসেবে দোয়ার কাছে আশ্রয় গ্রহণ করি এবং এটাও লক্ষণীয় যে, কাজে-কর্মে তো বটেই, অমানবিক কথার দ্বারাও দোয়াকে অবজ্ঞা ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয় এবং এটা আদৌ আশ্চর্যজনক নয় যে, দোয়ার এখন অর্থ দাঁড়িয়েছে পরিস্থিতি থেকে উদ্ভুত নৈরাশ্য, হতাশা ও ব্যর্থতার মোকাবিলায় দোয়া যেন এক ব্যর্থ ও অনাবশ্যক আকুতি।
কী দুর্ভাগ্য! অথচ দোয়া হলো বিশ্বাসীদের জন্য সর্বাধিক শক্তিশালী ও সর্বাধিক ফলপ্রসূ একটি হাতিয়ার। দোয়া ভাগ্যলিপিকে পরিবত
ন করতে পারে, যা আমাদের কোনো চেষ্টা-প্রচেষ্টার দ্বারা সম্ভব নয়। দোয়া হলো সব ইবাদতের সৌরভ ও সারবস্তু। দোয়া আমাদের কোনো কাজে কখনও ব্যর্থ হতে দেয় না, আর দোয়া ছাড়া আমরা কখনও সাফল্যও লাভ করতে পারি না। কোনো বিষয়ে সুষ্ঠু পরিকল্পনা-গ্রহণের আগে ও শেষে আল্লাহর সমীপে দোয়া পেশ করা বিশ্বাসীদের জন্য প্রথম ও শেষ ভরসাস্থল; কারণ বিশ্বাসীদের (ঈমানদার) সব পরিকল্পনা ও কার্যক্রম পূর্বাপর দোয়ার মধ্যস্থলে অবস্থিত।
দোয়া হলো আল্লাহপাকের সঙ্গে আমাদের একান্ত বাক্যালাপ, সেই আল্লাহ যিনি আমাদের স্রষ্টা ও অভিভাবক, যিনি আমাদের প্রভু ও প্রতিপালক, যিনি সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান। বস্তুতই, দোয়া এক অসামান্য তাত্পর্য বহন করে। দোয়া ঊর্ধারোহণের শ্রেষ্ঠ সোপান, মুক্তির বার্তা, ক্ষমতাপ্রাপ্তির পাথেয়, রুপান্তর-প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত এক অতীব ফলপ্রসূ জীবনচেতনা, যা কোনো মানুষের পক্ষে অর্জন করা অসম্ভব। দোয়ার মধ্য দিয়ে আমরা আল্লাহর দিকে ফিরে আসি, কারণ আমরা জানি, একমাত্র তিনিই আমাদের সব দুর্ভোগ থেকে মুক্তি দিতে পারেন; এবং একমাত্র তিনিই পারেন আমাদের সব সমস্যার সমাধান করে দিতে। এবং স্রষ্টার কাছে আমাদের সব বিপদ-মুসিবত ও দুর্যোগ-দুর্ভোগের কথা নিবেদন করে আমরা স্বস্তি অনুভব করি; সর্বশক্তিমান আল্লাহর সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে আমরা নিজের মধ্যে শক্তি খুঁজে পাই। অনন্ত-অসীম ক্ষমা ও করুণার যিনি আঁধার, তাঁর কাছে আকুতি জানিয়ে আমরা আমাদের চতুর্দিকে তাঁরই করুণার উপস্থিতি উপলব্ধি করি এবং তাঁর প্রদর্শিত পথে চলার জন্য আমরা নতুনভাবে অঙ্গীকারে সমৃদ্ধ হয়ে উঠি, বুঝতে পারি তাঁর পথই কামিয়াবির একমাত্র পথ। আর এভাবেই আমাদের বিশ্বাস ও অঙ্গীকার নিয়ে আমরা এক অবর্ণনীয় রহমতের আস্বাদ অনুভব করি।
প্রতিটি বিপদের মুহূর্তে আমাদের প্রথম কাজই হলো দোয়া এবং শেষেও দোয়া। আমরা আল্লাহপাকের কাছে প্রার্থনা জানাই বিপদ মোকাবিলার জন্য সঠিক পথ তিনি দেখিয়ে দেবেন। আমরা তাঁরই কাছে সাহায্য কামনা করি যাতে তার প্রদর্শিত পথে আমরা চলতে সক্ষম হই এবং আমাদের সব কাজে লাভ করতে পারি সাফল্য। আমরা যখন রোগগ্রস্ত হয়ে পড়ি, আমরা জানি, আল্লাহর অভিপ্রায় ছাড়া আমরা সঠিক চিকিত্সকের সন্ধান পাব না; জানি তার আদেশ ব্যতীত সর্বোত্তম চিকিত্সকও রোগ-নির্ণয়ে ব্যর্থ হবেন এবং এ কথাও জানি সর্বোত্তম চিকিত্সাও তার অনুমতি ছাড়া নিষম্ফল হতে বাধ্য। আমরা আল্লাহপাকের কাছে এ সবকিছুর জন্যই অনুগ্রহ প্রার্থনা করি। আমরা চিকিত্সা-সাহায্যের জন্য দোয়া করি, চিকিত্সা-লাভের পর নিরাময় হয়েও করি। জীবনের সব বিপদে-মুসিবতে দুঃখে-দুর্যোগে আল্লাহর কাছে আমাদের এই অনুগ্রহ প্রার্থনা একইভাবে একই রকম সত্য।
দোয়া হলো আমাদের সব ইবাদতের সুরভি ও সারবস্তু। আল্লাহপাকের কাছে প্রার্থনারত একজন ব্যক্তি তার তাওহিদী-বিশ্বাসকে (একত্ববাদ, গড়হড়ঃযবরংস) দৃঢ়তার সঙ্গে সত্যায়িত করে এবং সব মিথ্যা-ঈশ্বরকে পরিত্যাগ করে। প্রত্যেক দোয়ার মধ্য দিয়ে আল্লাহপাকের প্রতি তার আস্থা ও বিশ্বাসের পুন: পুন: নবজন্ম ঘটে; এবং তার সানুরাগ প্রার্থনা তার নিজের মধ্যে নিজের অক্ষমতা ও শক্তিহীনতার অনুভূতিও জাগ্রত করে। গুরুত্ব ও আন্তরিকতার সঙ্গে প্রার্থনারত একজন ব্যক্তি যথার্থভাবেই অনুধাবন করতে পারে, স্রষ্টার সঙ্গে তার কী-অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক; এবং এই বিষয়টি তার বাস্তব জীবনের ক্রিয়াকর্মেও ফুটে ওঠে, প্রতিফলিত হয়। আর এটাই তো সব ইবাদত বন্দেগির প্রাণবস্তু। উপরন্তু এ ধরনের মানুষ কখনও দাম্ভিক ও উদ্ধত হতে পারে না, যা আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদিত আমাদের সব আন্তরিক দোয়া ও ইবাদতের যৌক্তিক ফলাফল।
দোয়া আমাদের জীবন সংগ্রামে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী হাতিয়ার, এমনকি যুদ্ধের ময়দানে প্রত্যক্ষ জিহাদেও এই দোয়ার কার্যকারিতা অসামান্য। বদরযুদ্ধ ছিল বিপুল অস্ত্রশস্ত্র-সজ্জিত এক বিশাল মুশরিক বাহিনীর মোকাবিলায় মুসলমানদের একটি অসম যুদ্ধ। যুদ্ধের পূর্বরাতে রাসুল (সা.) আল্লাহপাকের সাহায্য কামনায় নামাজে দাঁড়িয়ে সারারাত অতিবাহিত করলেন। ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত যুদ্ধে সুলতান সালাউদ্দীন আইয়ুবী দিবারাত্রি সমানভাবে ব্যস্ত। তার দিনগুলো কাটত জিহাদে আর রাত্রিগুলো অতিবাহিত হতো আল্লাহর সাহায্য-প্রার্থনায় ক্রন্দনরত অবস্থায় দোয়া ও ইবাদতে।
আমাদের মনে রাখা আবশ্যক, ক্ষুদ্র-বৃহত্ সব বিষয়েই আমরা আল্লাহপাকের কাছে আরজু পেশ করতে পারি। এটাই আসলে প্রজ্ঞার প্রথম কথা যে, ক্ষুদ্র বা বৃহত্ বলে কিছু নেই, এটা মূলত মানুষের প্রয়োজন ও ব্যক্তিগত বিবেচনার ওপর নির্ভরশীল। অতএব এ ধরনের পার্থক্য রচনা একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। বিশেষ করে আমরা যার কাছে প্রার্থনা-করছি, তার কাছে বড় বলে কিছু নেই; আর আমরা যারা কিছু পাওয়ার আশায় প্রার্থনা করি, তাদের কাছে কোনো কিছুই ছোট নয়। এইজন্যই আল্লাহর রাসূল (সা.) শিক্ষা দিয়েছেন, আমরা আল্লাহপাকের কাছে আমাদের প্রয়োজনমত সবকিছুই চাইতে পারি, এমনকি তা যদি জুতার ফিতার মতো কোনো তুচ্ছ জিনিসও হয়। তবে আমাদের চাওয়া উচিত একেবারে ভিখারির মতো, একেবারে রিক্ত নিঃসম্বল অসহায় মানুষের মতো; আর বাস্তব ক্ষেত্রে আল্লাহপাকের সঙ্গে এটাই তো আমাদের প্রকৃত সম্পর্ক এবং এটাও উল্লেখযোগ্য যে, আমাদের প্রার্থনা হতে হবে সর্বোচ্চ আশা ও সুদৃঢ় আস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত; অর্থাত্ আল্লাহপাক অবশ্যই আমাদের প্রার্থনা পূর্ণ করবেন, এই আশা আমাদের অন্তরে সর্বদা জাগরুক থাকবে। প্রসঙ্গত, আমরা একটি হাদিস স্মরণ করতে পারি: ‘আল্লাহর কাছে তার বান্দাহর দোয়া বা প্রার্থনার চেয়ে অধিক প্রিয় আর কিছু নেই’। অন্যদিকে দোয়ার মধ্যে যদি বিশ্বাস, নিষ্ঠা ও একাগ্রতার অভাব থাকে, তাহলে সেই দোয়া আদৌ কোনো দোয়া-ই নয়।
শুধু দুঃসময় কি দুঃখ-দুর্যোগের মধ্যে নয়, আমাদের উচিত সর্বদা ও সর্বাবস্থায়ই দোয়া করা। মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি চায় যে বিপদে ও প্রতিকূল অবস্থায় আল্লাহপাক তাকে সাহায্য করুন, তার প্রার্থনা গ্রহণ করুন, সে যেন সুখে ও সুসময়েও আল্লাহর কাছে সর্বদা দোয়া করে’। রাসূল (সা.) আরও বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহপাকের নিকট কিছু চায় না, আল্লাহ সুবহানুতায়ালা তার প্রতি ক্রোধান্বিত।’
আমাদের উচিত, দুনিয়া এবং আখেরাতের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত আমাদের যে কোনো বিষয়েই আল্লাহপাকের কাছে প্রার্থনা জ্ঞাপন করা। অবশ্য যারা শুধু দুনিয়াকেই একমাত্র বিবেচনা করে এবং দুনিয়াই যাদের প্রার্থনার একমাত্র লক্ষ্যবস্তু, আল কোরআন বলছে, যেখানে তাদের স্থায়ী আবাস সেই আখেরাতে তারা কিছুই পাবে না। তখন নিজেকে ছাড়া তারা তাদের পরকালীন ধ্বংসের জন্য অন্য আর কাউকে দায়ী ও দোষারোপ করতে পারবে না। আল কোরআন আমাদেরকে নিশ্চিতভাবে জানিয়ে দিচ্ছে, সেই ধ্বংস ও বিনাশের জন্য তাদের অপেক্ষা করতে দাও। আবার যারা আখেরাতের প্রতি অত্যধিক মনোযোগী, তারা ভারসাম্য রক্ষা করছেন না; কারণ আল্লাহর সাহায্য আমাদের পার্থিব ও পারলৌকিক উভয় জিন্দেগির জন্যই অত্যাবশ্যক।
উল্লেখ করা আবশ্যক, আমাদের দোয়া শুধু আমাদের নিজের জন্যই নয়। আমাদের পিতামাতা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু-শিক্ষক-শুভানুধ্যায়ী, পীড়িত-অভাবগ্রস্ত এবং বিশ্বব্যাপী সংগ্রামরত মুসলিম ভাই-বোন সবার জন্যই দোয়া করা উচিত। তাদের ঐহিক ও পারত্রিক উভয় জিন্দেগির কল্যাণ ও কামিয়াবির জন্য আন্তরিকভাবে দোয়া করা আমাদের কর্তব্য। রাসুল (সা.) বলেন: ‘একজন মুসিলম যখন তার কোনো মুসলিম ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে দোয়া করে, সেই দোয়া সঙ্গে সঙ্গে গৃহীত হয়। একজন ফেরেশতাকে তার পাশে নিযুক্ত রাখা হয়; যখন সে তার ভাইয়ের কল্যাণের জন্য দোয়া করে, তখন সেই নিযুক্ত ফেরেশতা বলেন, ‘আমীন, এবং তোমার উপরও একই রহমত বর্ষিত হোক’।’ (মুসলিম শরিফ, হাদিস-৪৯১৪)।
অনুবাদ : অধ্যাপক আবু জাফর
নারী উন্নয়ন নীতিমালা-২০১১ কয়েকটি ধারা ও কোরআনের ভাষ্য
বর্তমান সরকার নারী উন্নয়ন নীতিমালার নামে যে খসড়া নীতি অনুমোদন করেছে, তা সিডও বাস্তবায়নের অঙ্গীকারের একটি কৌশলপত্র মাত্র। সিডও সনদের ধারাগুলোর হুবহু প্রতিধ্বনি করা হয়েছে নারী উন্নয়ন নীতিমালা-২০১১ এর খসড়ায়।
সিডও সনদে মুসলিম দেশগুলোর পক্ষ থেকে যেসব ধারার উপর আপত্তি জানানো হয়েছে সেগুলো হলো— ২, ৩, ৯, ১৩ এবং ১৬ নং ধারা। এই ধারাগুলোর বক্তব্য আমরা হুবহু উদ্ধৃত করছি।
২. অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে—নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্যের প্রতি নিন্দা জানিয়েছে সনদে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো। নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য দূর করতে তারা নিজ নিজ দেশে প্রয়োজনীয় আইন তৈরির ঘোষণা দিচ্ছে। সংবিধানে সমঅধিকারের ঘোষণা না থাকলে সমঅধিকারের নিশ্চয়তা দিয়ে সংবিধান নতুন করে প্রণয়ন করবে। নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক সব আইনকানুন ও বিধিবিধান বিলোপ করবে।
৩. রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সবক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি নারীর সমান অধিকার নিশ্চিত করবে রাষ্ট্র।
১৩. অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনের সবক্ষেত্রে নারীর প্রতি সব বৈষম্য দূর করে সমতার ভিত্তিতে নারী ও পুরুষেরা সমান অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্র পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এ অধিকারের মাঝে পারিবারিক সুযোগ-সুবিধা ও ব্যাংক লোনও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
১৫. চলাফেরার স্বাধীনতা, বাসস্থান পছন্দ এবং স্থায়ী নিবাস স্থাপনের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা।
১৬. বিয়ে এবং পারিবারিক সম্পর্কসহ সব বিষয়ে নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য দূর করতে রাষ্ট্র পদক্ষেপ নেবে এবং এসব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করবে।
১৬-১. বিবাহিত জীবনে প্রবেশের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার থাকবে।
১৬.২ বিবাহ, স্বামী নির্বাচনের ক্ষেত্রে স্বাধিকার।
১৬-৩. বিয়ে এবং তালাকের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও সমান দায়দায়িত্ব থাকবে।
১৬-৫. শিশু লালন-পালনের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও সমান দায়দায়িত্ব থাকবে।
১৬.৭ : সম্পত্তির মালিকানা, ব্যবস্থাপনা এবং বিক্রয়ের ক্ষেত্রে সমান দায়িত্ব ও অধিকার।
বাংলাদেশ এই ধারাগুলোর ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছিল। এতে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, কোরআন সুন্নাহ ও ইসলামী আইন এবং মুসলিম সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। যে কারণে অতীতের সব কটি সরকার সিডও সনদের ইসলাম ও কোরআনবিরোধী ধারাগুলো প্রত্যাখ্যান করে আসছে। তারপরও কোন স্বার্থে বর্তমান সরকার সেই আপত্তি প্রত্যাহার করেছে? ইসলামপ্রিয় ৯০ শতাংশ নাগরিকের আজ সেটিই জিজ্ঞাসা।
বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, নারী উন্নয়ন নীতিমালায় ইসলামবিরোধী কোন কিছু নেই। অথচ দেশের বিজ্ঞ আলেম-ওলামা ও ইসলামী বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নারী উন্নয়ন নীতিমালা কোরআন সুন্নাহ ও ইসলামী শরীয়ার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
বিগত ৭ মার্চ মন্ত্রিসভায় নারী উন্নয়ন নীতিমালা অনুমোদনের পর বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) পরিবেশিত খবরে বলা হয়, ‘ভূমিসহ সম্পদ-সম্পত্তিতেও উত্তরাধিকারে নারীর সমান অধিকার স্বীকৃতি দিয়ে নারী উন্নয়ন নীতি-২০১১ এর খসড়া অনুমোদন করছে মন্ত্রিসভা’। (প্রথম আলো, যুগান্তর, কালের কণ্ঠ)
আমাদের দৃষ্টিতে নারী উন্নয়ন নীতিমালার সমস্যাগুলো এবং ইসলামের সঙ্গে তথা কোরআন সুন্নাহর সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিষয়গুলো নিম্নরূপ :
১. এই নীতিমালা সিডও সনদ বাস্তবায়নের অঙ্গীকারের কৌশল হিসাবে প্রণয়ন করা হয়েছে। সিডও সনদের ২, ৩, ৯, ১৩, ১৬ ধারায় ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। নারীর নীতিতে সিডও বাস্তবায়নের অঙ্গীকার স্পষ্ট ভাষায় বারবার ব্যক্ত করা হয়েছে। (দ্রষ্টব্য নারী উন্নয়ন নীতিমালা ৪ নং ধারার শেষ প্যারা। ৪.১, ১৭.২)
২. এই নীতিমালায় সিডও-এরই প্রতিধ্বনি করা হয়েছে মাত্র। সিডও সনদে নারীকে উপস্থাপন করা হয়েছে ইউরোপিয়ান জীবন ধারা ও সংস্কৃতির আলোকে। ফলে এই নীতিমালায় মুসলিম নারীর জীবন ধারা ও ইসলামী সংস্কৃতির মোটেই প্রতিফলন ঘটেনি, যে কারণে এই নীতিমালা ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশের জীবনাচারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। আমাদের বিশ্বাস, এই নীতিমালার মাধ্যমে মুসলমানদের মুসলিম সংস্কৃতি বর্জন করে ইউরোপিয়ান সংস্কৃতি অবলম্বনের দক্ষ কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে।
৩. ইসলাম নারী উন্নয়ন ও নারী অধিকারে সর্বোচ্চ প্রবক্তা হলেও এবং নারী নির্যাতনরোধে সর্বাধিক বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করলেও পুরুষ প্রধান সমাজব্যবস্থার প্রবক্তা। পরামর্শের সব পর্যায়ে নারীকে সমঅধিকার প্রদান করলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের অধিকার পুরুষকেই প্রদান করেছে। আল-কোরআনে এ মর্মে স্পষ্টতই উল্লেখ আছে।
দ্রষ্টব্য : সূরা বাকারা আয়াত-২২৮, সূরা নিসা : আয়াত-৩৮, বুখারি শরীফ : খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-১০৫৭, মুসলিম শরীফ : খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-১২২
৪. নারী উন্নয়ন নীতিমালা যেহেতু ইউরোপিয়ান নারীর কল্পচিত্রকে সামনে রেখে প্রণীত হয়েছে। অতএব, নীতিমালাটি প্রণয়নের ক্ষেত্রে ইসলামের অলংঘনীয় বিধান পর্দার বিষয়টির প্রতি মোটেও লক্ষ রাখা হয়নি, ফলে এর অধিকাংশ ধারা পর্দার বিধান লংঘন না করে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। ফলে উন্নয়ন পরিকল্পনা হিসেবে উপস্থাপিত বিষয়গুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোরআনের বিরুদ্ধে প্রকাশ পেয়েছে এবং পর্দার বিধান লংঘন হওয়ার কারণে তা কোরআনবিরোধী বলে প্রতিপন্ন হয়েছে।
৫. ইসলাম মূলত নারী-পুরুষের পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে যে সৌহার্দ্যপূর্ণ পারিবারিক জীবন গড়ে তুলতে চেয়েছে, নারী নীতি বাস্তবায়ন হলে তা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যাবে। অধিকারের টানাটানিতে পারিবারিক জীবন এক সংঘাতময় যুদ্ধ ক্ষেত্রে পরিণত হবে। পারিবারিক সৌহার্দ্য শেষ হয়ে যাবে, যা এখন ইউরোপের সমাজ ব্যবস্থায় নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং এদিক থেকে এই নীতিমালা ইসলামের পারিবারিক নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
৬. ইসলাম পৈতৃক উত্তরাধিকারে নারীকে পুরুষের তুলনায় অর্ধেক প্রদান করেছে। এই বিধান সূরা নিসার ১১নং আয়াতের সুস্পষ্টভাবে বিবৃত হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে :
‘আল্লাহ তোমাদের সন্তানদের (উত্তরাধিকার প্রাপ্তির) ব্যাপারে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, পুত্র সন্তান পাবে দুই কন্যা সন্তানের সমান। এ হলো আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞাতা ও প্রজ্ঞাময়।’ [সূরা নিসা : আয়াত-১১]
সুতরাং উত্তরাধিকারে যদি নারীকে পুরুষের সমান প্রদান করা হয়, তাহলে এটি হবে সুস্পষ্ট কোরআনবিরোধী।
অথচ সরকার মুখে বলছে, কোরআনবিরোধী কোনো বিষয় নারী নীতিতে নেই। সরকারের এই বক্তব্যকে অন্যক্ষেত্রে না হলেও শুধু উত্তরাধিকারের প্রশ্নে সরল অর্থে গ্রহণ করা যেত যদি সিডও বাস্তবায়নের অঙ্গীকার দৃঢ়তার সঙ্গে নারী নীতিতে ব্যক্ত না করা হতো। সিডও সনদের আগে ধারাগুলো যে কুরআন সুন্নাহ ও ইসলামী জীবন দর্শনের পরিপন্থী তা আন্তর্জাতিকভাবেই স্বীকৃত। যে কারণে মুসলিম দেশগুলো তা মেনে নেয়নি। স্বয়ং বাংলাদেশও সেগুলোকে কোরআন সুন্নাহর পরিপন্থী মনে করে সেগুলো সংরক্ষণ করে সিডও সনদে স্বাক্ষর করেছিল। সবক্ষেত্রে নারীর সম-অধিকারের ঘোষণার মাধ্যমে মুসলিম উত্তরাধিকার আইনকে অকার্যকর করাই যে সিডও সনদের মূল লক্ষ্য তা অন্ধজনও বুঝতে সক্ষম।
নারী নীতির ভূমিকা ২য় লাইন ৪, ৪.১, ১৬.১, ১৬.৮, ১৬.১২, ১৭.১, ১৭.৪, ২৩.৫ ধারাগুলো যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, তাতে যে কোনো ব্যক্তি তাদ্বারা উত্তরাধিকারে নারী-পুরুষের সমান পাবে এই সিদ্ধান্ত উপনীত হতে পারবে। সিডও বাস্তয়নের অঙ্গীকারে আবদ্ধ সরকার পরে সেই ধারাগুলোকে উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে সমতার ব্যাখ্যা করবে না এ নিশ্চয়তা কে দেবে?
লেখক : গবেষক, গ্রন্থকার, ইসলামী চিন্তাদিব
সিডও সনদে মুসলিম দেশগুলোর পক্ষ থেকে যেসব ধারার উপর আপত্তি জানানো হয়েছে সেগুলো হলো— ২, ৩, ৯, ১৩ এবং ১৬ নং ধারা। এই ধারাগুলোর বক্তব্য আমরা হুবহু উদ্ধৃত করছি।
২. অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে—নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্যের প্রতি নিন্দা জানিয়েছে সনদে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো। নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য দূর করতে তারা নিজ নিজ দেশে প্রয়োজনীয় আইন তৈরির ঘোষণা দিচ্ছে। সংবিধানে সমঅধিকারের ঘোষণা না থাকলে সমঅধিকারের নিশ্চয়তা দিয়ে সংবিধান নতুন করে প্রণয়ন করবে। নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক সব আইনকানুন ও বিধিবিধান বিলোপ করবে।
৩. রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সবক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি নারীর সমান অধিকার নিশ্চিত করবে রাষ্ট্র।
১৩. অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনের সবক্ষেত্রে নারীর প্রতি সব বৈষম্য দূর করে সমতার ভিত্তিতে নারী ও পুরুষেরা সমান অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্র পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এ অধিকারের মাঝে পারিবারিক সুযোগ-সুবিধা ও ব্যাংক লোনও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
১৫. চলাফেরার স্বাধীনতা, বাসস্থান পছন্দ এবং স্থায়ী নিবাস স্থাপনের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা।
১৬. বিয়ে এবং পারিবারিক সম্পর্কসহ সব বিষয়ে নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য দূর করতে রাষ্ট্র পদক্ষেপ নেবে এবং এসব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করবে।
১৬-১. বিবাহিত জীবনে প্রবেশের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার থাকবে।
১৬.২ বিবাহ, স্বামী নির্বাচনের ক্ষেত্রে স্বাধিকার।
১৬-৩. বিয়ে এবং তালাকের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও সমান দায়দায়িত্ব থাকবে।
১৬-৫. শিশু লালন-পালনের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও সমান দায়দায়িত্ব থাকবে।
১৬.৭ : সম্পত্তির মালিকানা, ব্যবস্থাপনা এবং বিক্রয়ের ক্ষেত্রে সমান দায়িত্ব ও অধিকার।
বাংলাদেশ এই ধারাগুলোর ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছিল। এতে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, কোরআন সুন্নাহ ও ইসলামী আইন এবং মুসলিম সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। যে কারণে অতীতের সব কটি সরকার সিডও সনদের ইসলাম ও কোরআনবিরোধী ধারাগুলো প্রত্যাখ্যান করে আসছে। তারপরও কোন স্বার্থে বর্তমান সরকার সেই আপত্তি প্রত্যাহার করেছে? ইসলামপ্রিয় ৯০ শতাংশ নাগরিকের আজ সেটিই জিজ্ঞাসা।
বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, নারী উন্নয়ন নীতিমালায় ইসলামবিরোধী কোন কিছু নেই। অথচ দেশের বিজ্ঞ আলেম-ওলামা ও ইসলামী বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নারী উন্নয়ন নীতিমালা কোরআন সুন্নাহ ও ইসলামী শরীয়ার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
বিগত ৭ মার্চ মন্ত্রিসভায় নারী উন্নয়ন নীতিমালা অনুমোদনের পর বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) পরিবেশিত খবরে বলা হয়, ‘ভূমিসহ সম্পদ-সম্পত্তিতেও উত্তরাধিকারে নারীর সমান অধিকার স্বীকৃতি দিয়ে নারী উন্নয়ন নীতি-২০১১ এর খসড়া অনুমোদন করছে মন্ত্রিসভা’। (প্রথম আলো, যুগান্তর, কালের কণ্ঠ)
আমাদের দৃষ্টিতে নারী উন্নয়ন নীতিমালার সমস্যাগুলো এবং ইসলামের সঙ্গে তথা কোরআন সুন্নাহর সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিষয়গুলো নিম্নরূপ :
১. এই নীতিমালা সিডও সনদ বাস্তবায়নের অঙ্গীকারের কৌশল হিসাবে প্রণয়ন করা হয়েছে। সিডও সনদের ২, ৩, ৯, ১৩, ১৬ ধারায় ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। নারীর নীতিতে সিডও বাস্তবায়নের অঙ্গীকার স্পষ্ট ভাষায় বারবার ব্যক্ত করা হয়েছে। (দ্রষ্টব্য নারী উন্নয়ন নীতিমালা ৪ নং ধারার শেষ প্যারা। ৪.১, ১৭.২)
২. এই নীতিমালায় সিডও-এরই প্রতিধ্বনি করা হয়েছে মাত্র। সিডও সনদে নারীকে উপস্থাপন করা হয়েছে ইউরোপিয়ান জীবন ধারা ও সংস্কৃতির আলোকে। ফলে এই নীতিমালায় মুসলিম নারীর জীবন ধারা ও ইসলামী সংস্কৃতির মোটেই প্রতিফলন ঘটেনি, যে কারণে এই নীতিমালা ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশের জীবনাচারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। আমাদের বিশ্বাস, এই নীতিমালার মাধ্যমে মুসলমানদের মুসলিম সংস্কৃতি বর্জন করে ইউরোপিয়ান সংস্কৃতি অবলম্বনের দক্ষ কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে।
৩. ইসলাম নারী উন্নয়ন ও নারী অধিকারে সর্বোচ্চ প্রবক্তা হলেও এবং নারী নির্যাতনরোধে সর্বাধিক বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করলেও পুরুষ প্রধান সমাজব্যবস্থার প্রবক্তা। পরামর্শের সব পর্যায়ে নারীকে সমঅধিকার প্রদান করলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের অধিকার পুরুষকেই প্রদান করেছে। আল-কোরআনে এ মর্মে স্পষ্টতই উল্লেখ আছে।
দ্রষ্টব্য : সূরা বাকারা আয়াত-২২৮, সূরা নিসা : আয়াত-৩৮, বুখারি শরীফ : খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-১০৫৭, মুসলিম শরীফ : খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-১২২
৪. নারী উন্নয়ন নীতিমালা যেহেতু ইউরোপিয়ান নারীর কল্পচিত্রকে সামনে রেখে প্রণীত হয়েছে। অতএব, নীতিমালাটি প্রণয়নের ক্ষেত্রে ইসলামের অলংঘনীয় বিধান পর্দার বিষয়টির প্রতি মোটেও লক্ষ রাখা হয়নি, ফলে এর অধিকাংশ ধারা পর্দার বিধান লংঘন না করে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। ফলে উন্নয়ন পরিকল্পনা হিসেবে উপস্থাপিত বিষয়গুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোরআনের বিরুদ্ধে প্রকাশ পেয়েছে এবং পর্দার বিধান লংঘন হওয়ার কারণে তা কোরআনবিরোধী বলে প্রতিপন্ন হয়েছে।
৫. ইসলাম মূলত নারী-পুরুষের পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে যে সৌহার্দ্যপূর্ণ পারিবারিক জীবন গড়ে তুলতে চেয়েছে, নারী নীতি বাস্তবায়ন হলে তা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যাবে। অধিকারের টানাটানিতে পারিবারিক জীবন এক সংঘাতময় যুদ্ধ ক্ষেত্রে পরিণত হবে। পারিবারিক সৌহার্দ্য শেষ হয়ে যাবে, যা এখন ইউরোপের সমাজ ব্যবস্থায় নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং এদিক থেকে এই নীতিমালা ইসলামের পারিবারিক নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
৬. ইসলাম পৈতৃক উত্তরাধিকারে নারীকে পুরুষের তুলনায় অর্ধেক প্রদান করেছে। এই বিধান সূরা নিসার ১১নং আয়াতের সুস্পষ্টভাবে বিবৃত হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে :
‘আল্লাহ তোমাদের সন্তানদের (উত্তরাধিকার প্রাপ্তির) ব্যাপারে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, পুত্র সন্তান পাবে দুই কন্যা সন্তানের সমান। এ হলো আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞাতা ও প্রজ্ঞাময়।’ [সূরা নিসা : আয়াত-১১]
সুতরাং উত্তরাধিকারে যদি নারীকে পুরুষের সমান প্রদান করা হয়, তাহলে এটি হবে সুস্পষ্ট কোরআনবিরোধী।
অথচ সরকার মুখে বলছে, কোরআনবিরোধী কোনো বিষয় নারী নীতিতে নেই। সরকারের এই বক্তব্যকে অন্যক্ষেত্রে না হলেও শুধু উত্তরাধিকারের প্রশ্নে সরল অর্থে গ্রহণ করা যেত যদি সিডও বাস্তবায়নের অঙ্গীকার দৃঢ়তার সঙ্গে নারী নীতিতে ব্যক্ত না করা হতো। সিডও সনদের আগে ধারাগুলো যে কুরআন সুন্নাহ ও ইসলামী জীবন দর্শনের পরিপন্থী তা আন্তর্জাতিকভাবেই স্বীকৃত। যে কারণে মুসলিম দেশগুলো তা মেনে নেয়নি। স্বয়ং বাংলাদেশও সেগুলোকে কোরআন সুন্নাহর পরিপন্থী মনে করে সেগুলো সংরক্ষণ করে সিডও সনদে স্বাক্ষর করেছিল। সবক্ষেত্রে নারীর সম-অধিকারের ঘোষণার মাধ্যমে মুসলিম উত্তরাধিকার আইনকে অকার্যকর করাই যে সিডও সনদের মূল লক্ষ্য তা অন্ধজনও বুঝতে সক্ষম।
নারী নীতির ভূমিকা ২য় লাইন ৪, ৪.১, ১৬.১, ১৬.৮, ১৬.১২, ১৭.১, ১৭.৪, ২৩.৫ ধারাগুলো যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, তাতে যে কোনো ব্যক্তি তাদ্বারা উত্তরাধিকারে নারী-পুরুষের সমান পাবে এই সিদ্ধান্ত উপনীত হতে পারবে। সিডও বাস্তয়নের অঙ্গীকারে আবদ্ধ সরকার পরে সেই ধারাগুলোকে উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে সমতার ব্যাখ্যা করবে না এ নিশ্চয়তা কে দেবে?
লেখক : গবেষক, গ্রন্থকার, ইসলামী চিন্তাদিব
Subscribe to:
Comments (Atom)